বুধবার, ১৪ এপ্রিল ২০২১, ০৭:১৭ পূর্বাহ্ন
কাজী সামছুজ্জোহা মিলন, মহাদেবপুর (নওগাঁ) প্রতিনিধিঃ ৭ মার্চ ২০২১ স্বাধীনতার প্রায় ৫০ বছরেও নওগাঁর মহাদেবপুর উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের গণকবর গুলো সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়া হয়নি। পায়নি সরকারি স্বীকৃতিও। বধ্যভূমি গুলো অযত্ন-অবহেলায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে। নতুন প্রজন্মের কেউ জানতেই পারছেন না সে বধ্যভূমি গুলোতে চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন মুক্তিকামী বীর বাঙালির দামাল সন্তানরা। সরকারি ভাবে এসব বধ্যভূমি সম্পর্কে তেমন কোন তথ্যাদি সংরক্ষণ করা হয়নি। ফলে এসব বধ্যভূমির উন্নয়ন, সংস্কার বা অন্য কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা যায়নি। তথ্যানুসন্ধ্যানে জানা যায়, উপজেলার উপর দিয়ে প্রবাহিত ঐতিহ্যবাহী আত্রাই নদী সংলগ্ন রাবেয়া পল্লীতে, আখেড়া গ্রামে, সিদ্দিকপুর গ্রামে, চেরাগপুর ইউনিয়নের বাজিতপুর গ্রামে, চকদৌলত গ্রামে, খাজুর ইউনিয়নের দেবীপুর মোড়ে, হাতুড় ইউনিয়নের মহিষবাথান গ্রামের বামনদহ বিল এলাকায় পৃথক গণকবর রয়েছে। এগুলোর মধ্যে শুধু বাজিতপুর গ্রামে অবস্থিত গণকবরে প্রায় পাঁচ বছর আগে নওগাঁ জেলা পরিষদের উদ্যোগে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়। তবে সেখানে সীমানা প্রাচীর না থাকায় এখনো অরক্ষিত রয়েছে। সরেজমিনে মহিষবাথান গ্রামের বামনদহ বিল এলাকায় গিয়ে গণ কবরের খোঁজ করলে গ্রামবাসীরা জানান, গণ কবর স্থানটি এখন বিলীন হয়ে গেছে। এটি কোথায় ছিল তা গ্রামের কেউ আর বলতে পারে না। স্থানীয় বীর মুক্তিযোদ্ধাদের খোঁজ করে মহিষবাথান বাজারে পাওয়া গেল বয়সের ভারে অনেক প্রবীণ বীর মুক্তিযোদ্ধা সেরাতুন নবীকে। তিনি এই প্রতিবেদককে নিয়ে গেলেন সেখানে। যেখানে শহীদদের গণকবর রয়েছে। পায়ে হেঁটে কলাবাগান ও ফসলের মাঠের ভিতর দিয়ে এক কিলোমিটারের বেশি পথ পাড়ি দিয়ে বামনদহ বিলে। তিনি বিলের একটি পুকুরের পশ্চিম-দক্ষিণ পার্শ্বে শিম ক্ষেতের মাচা দেখিয়ে বললেন সেইখানেই পুঁতে রাখা হয় ৩০ জন মুক্তিকামী বাঙালির নিথর দেহ। আবেগঘন কণ্ঠে তিনি জানান, সেখানে একটি ক্যানেলের পাড়ে ছিল বিশাল পাকুড় গাছ। বর্বর পাক হানাদার বাহিনী একাত্তরের ২৬ এপ্রিল সোমবার বেলা ১০ টায় তিন দিক থেকে মহিষবাথান গ্রামে আক্রমণ চালায়। তিন দিক থেকে একসঙ্গে পাক হানাদাররা মহিষবাথান হাটে ঢুকে অগ্নিসংযোগ, ভাংচুর, লুটতরাজ চালায়। যাবার সময় স্থানীয় ৩৫ জনকে আটক করে। পরে তাদের বামনদহ বিলের পশ্চিমের দীঘিরপাড়ে নিয়ে হাত বেঁধে সারি করে দাঁড় করিয়ে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে জখম করে। পরে ব্রাশফায়ারে তাদের হত্যা করা হয়। ভাগ্যক্রমে মারাত্মক জখম নিয়ে বেঁচে যান ৫ থেকে ৭ জন। বাকিদের বিলসংলগ্ন পাকুড় গাছের তলায় একসঙ্গে মাটিচাপা দেওয়া হয়। স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত এটির আর খোঁজ নেয়নি কেউ। যারা বেঁচে গিয়েছিলেন তাদের মধ্যে ২ জন ছিলেন বামনদহ গ্রামের। কয়েক বছর আগে তারাও মারা গেছেন। সরেজমিন থেকে ফেরার পথে মহাদেবপুর-পোরশা সড়কের খাজুর ইউনিয়নের দেবীপুর মোড় এলাকায় খোঁজ পাওয়া গেল আরও একটি গণকবরের। একই দিন এই রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় বর্বর পাকবাহিনী এলাকার ১৩ জন মুক্তিকামী বাঙালিকে ধরে এনে গুলি করে নির্মম ভাবে হত্যা করে। সেখানেই দেখা হয় অমূল্য চন্দ্র বর্মণ নামে ৭০ বছরের এক বৃদ্ধার সাথে। তার পিতা গোপাল চন্দ্র বর্মণকে হত্যা করা হয়েছিল এখানে। তিনি জানন, এই গণ কবরের জায়গায় এখন ধানের আবাদ করা হয়েছে। কবরের চিহ্নটিও নেই। কেউ এই জায়গাটি সংরক্ষণের উদ্যোগও নেয়নি। উপজেলার চেরাগপুর ইউনিয়নের বাজিতপুর গ্রামে গিয়ে দেখা গেল একটি স্মৃতিস্তম্ভ। প্রায় পাঁচ বছর আগে নওগাঁ জেলা পরিষদ এটি নির্মাণ করে। যুদ্ধ চলাকালে পাক হানাদার বাহিনী এখানে ঢুকে অগ্নিসংযোগ করে বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিয়ে নিরীহ গ্রামবাসীর ওপর নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালায়। ওই স্মৃতিস্তম্ভে পাকবাহিনীর গুলিতে নিহত ৬ জন মুক্তিকামী শহীদের নাম খোদাই করে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। তারা হলেন- জাহান আলী সরদার, জফি উদ্দিন সরদার, শফিউদ্দিন, আব্দুল জলিল মন্ডল, তায়েজ উদ্দিন মন্ডল ও হোসেন উদ্দিন। এই গ্রামের পাশে চকদৌলত গ্রামে রয়েছে আরও একটি গণ কবর। এখানে তিন জনকে নির্মম ভাবে হত্যা করে পাকবাহিনী। মহাদেবপুর উপজেলা প্রকৌশলী সুমন মাহমুদ জানান, উপজেলার ৮ টি গণ কবরের তালিকা করা হয়েছে। এসব স্থানে প্রয়োজনীয় স্থাপনা নির্মাণ করা হবে বলেও তিনি জানান। উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার বদিউজ্জামান বদি গণ কবর গুলো চিহ্নিত করে সেগুলো সংরক্ষণ ও সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণ না করায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন। উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ভারপ্রাপ্ত কমান্ডার উপজেলা নির্বাহী অফিসার মিজানুর রহমান মিলন জানান, উপজেলার ১০টি ইউনিয়নের ১১৩ জন বীর মুক্তিযোদ্ধার কবর বাঁধাই করার জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছে। প্রথম পর্যায়ে অর্থনৈতিক ভাবে পিছিয়ে পড়া ১৩ জন বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বাড়িঘর নির্মাণ করে দেয়া হবে বলেও জানান তিনি। মহাদেবপুর উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আরিফ প্রামাণিক জানান, মুজিব জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে উপজেলার ১০টি ইউনিয়নে একটি করে রাস্তা সেখানকার বীর মুক্তিযোদ্ধার নামে নাম করণ করার প্রক্রিয়া চলছে। তিনি আরোও জানান, এ উপজেলায় মোট ২১৬ জন তালিকাভুক্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা রয়েছেন। তারা সবাই সরকারি ভাতা পান।###