শনিবার, ০৬ মার্চ ২০২১, ০৮:১৩ পূর্বাহ্ন
মৌসুমী প্রামাণিক মৌসান, কোলকাতা ডেস্কঃ পরকীয়া নিয়ে মহামান্য আদালতের রায়ের ভুল ইন্টারপ্রিটেশান করে চলেছি আমরা। আমরা অনেকেই সেকশন ৪৯৭এর ধারাটা ভালো করে জানি না। স্বাধীনতার আগে তৈরি হয়েছিল আইনটা। একশ’ বছর আগে। এখন সামাজিক পরিস্থিতি ভিন্ন, তাই ওই একই আইন লাগু হতে পারে না। আইনটাতে দুটি বড় ফাঁক ছিল।
১. স্বামীর অনুমতি ছাড়া কোন পুরুষ যদি সেই স্বামীর স্ত্রীর সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক গড়ে তোলে তাহলে ফৌজদারি আইনে তার পাঁচ বছর জেল হবে।
প্রথমতঃ কোন নারীর যৌন ইচ্ছার উপর কোন পুরুষের অধিকার থাকতে পারে না। নারী কখনও পুরুষের সম্পত্তি নয়।
দ্বিতীয়তঃ একই আইনের আওতায় পুরুষটি শাস্তি পাবেন, অথচ নারীর কোন শাস্তির বিধান ছিল না। এটা তো হতে পারে না। পরকীয়া যদি অপরাধ হয়, তাহলে দুজনেই দোষী। তা না হলে সংবিধানের ১৪ নম্বর ধারাকে কন্ট্রাডিক্ট করা হয়।
২. এই আইন সংবিধানের ২১ ধারাকে লঙ্ঘিত করছে। রাষ্ট্র বা আদালত কোন মানুষের ব্যক্তি স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করতে পারে না। শারীরিক সম্পর্ক কিন্তু ব্যক্তি স্বাধীনতার মধ্যে পড়ে। তথাপি, স্বাধীনতা ও স্বেচ্ছাচারীতার মধ্যে একটা থিন লাইন আছে। আমরা যদি সেই লক্ষণ রেখাকে মেনটেইন করতে না পারি, তবে আইন আদালত কি করবে?
সেই কারণে সুপ্রিম কোর্ট সেকশন ৪৯৭কে অবৈধ ঘোষণা করেছে। আদালত এও জানিয়েছে যে শারীরিক সম্পর্ক কোন ক্রিমিনাল অফেন্স হতে পারে না। আমার মতে এটা জাস্টিফায়েড। কারণ তাহলে দেহব্যবসাও ক্রিমিনাল অফেন্স। যারা প্রস কোয়ার্টারে নিয়মিত যাতায়াত করেন ঘরে বৌ রেখে, তাহলে তাদেরকেও দোষী সাব্যস্ত করে শাস্তির বিধান করতে হয়। মহামান্য আদালত উভয়ের সম্মতিক্রমে শারীরিক সম্পর্ককে অপরাধ বলে মান্যতা দেন নি। এটা ভীষণ ভালো একটা পজিটিভ স্টেপ। কেন?
আমাদের মত উপমহাদেশে পরকীয়া উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে, তার বড় একটা কারণ সেক্স এডুকেশানের অভাব। প্রপার সেক্স এডুকেশান নেই বলেই পরকীয়ার বাড়বাড়ন্ত । সেক্সটা শরীর ও মনের জন্যে খুব প্রয়োজন। স্ত্রী ও স্বামী দুজনেরই দুজনকে পরিতৃপ্তি দেওয়ার ক্ষমতা কম বেশি থাকা উচিত। সমস্যা থাকলে একে অন্যের সঙ্গে আলোচনা করে, প্রয়োজনে কাউন্সিলিং করিয়ে সমস্যার সমাধান করা উচিত। প্রসঙ্গত, সকল মানুষের সেক্সুয়াল আর্জ সমান নয়। পারভাসান অপরাধ হলেও হতে পারে, আর্জ কখনো অন্যায় হতে পারে না। আর আমি যেহেতু ক্রিয়েটিভ মানুষ, তাই ভালো করেই জানি যে শারীরিক ও মানসিক উভয় প্রেমই ক্রিয়েটিভ কাজে কতখানি ইন্সপিরেশান দেয়।
তাই আদালত শুধুমাত্র এনজয়মেন্ট করার জন্যে পরকীয়া আর দাম্পত্য অসুখের কারণে পরকীয়াকে আলাদা করে দেখতে চেয়েছেন।
পরকীয়া প্রেমের দ্বারা সাফার করছেন এমন স্ত্রী ও পুরুষকে ডিভোর্স ফাইল করার অধিকার দিয়েছেন। এর চাইতে ভালো আর কিছু হতেই পারে না। ভাঙা সম্পর্ককে টেনে নিয়ে যাওয়ার কোন মানে নেই। অন্য কারোর সঙ্গে থাকতে চাও তো ডিভোর্স কর। তবে এক্ষেত্রে ডিভোর্স ও বিবাহ আইন অনেক বেশি ফ্লেক্সিবল হওয়ার প্রয়োজন আছে। আদালত, রাষ্ট্র সবসময় মেয়েদের প্রোটেকশান দিতে চাইছেন। ভালো কথা। কিন্তু আইনের ফাঁক গলে শিক্ষিত ও চাকরি করা মেয়েদের দ্বারা নির্যাতিত পুরুষের সংখ্যা নেহাত কম নয়। আমি পুরুষদের নিয়ে লিখি, তাই খুব ভালো করে জানি যে, এমন অনেক মেয়ে আছে, যারা তাদের স্বামীর সঙ্গে থাকতেও চায় না আবার ডিভোর্সও দিতে চায় না। স্বামী যদি ডিভোর্স চান তখন উদ্ভট একটা অ্যামাউন্ট ক্লেইম করে বসেন, যাতে পুরুষটি পিছিয়ে আসতে বাধ্য হয়।
এছাড়াও সামাজিক প্রেশারটাও বড় বাধা ডিভোর্সের ক্ষেত্রে। বেশির ভাগ মানুষ এখনও মনে করেন যে, বিবাহ বিচ্ছেদ অপরাধ। মেনে নিতেই পারেন না। বিশেষ করে পুরুষরা, তাদের মেল ইগোতে ঘা লাগে যে! তাই জীবন্ত লাশ হয়ে বেঁচে থাকা একজন পুরুষ একটুখানি খোলা হাওয়া পাওয়ার জন্যে পরকীয়ায় লিপ্ত হবে এটাই স্বাভাবিক।
অন্য ভাবে বলা যায় যে, আইনটা সহজ হয়ে যাবার জন্যে গাছের খাবো, তলার কুড়াবো পুরুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে নিঃসন্দেহে। আমি পুরুষের কথা তুললাম কারণ আমাদের দেশে ৯০ শতাংশ মেয়েই বিয়ে করে সেটেলড্ হতে চায়, তা সে মুখে স্বীকার না করুক। তা সে মহিলাটি সিঙ্গল, ডিভোর্সি বা উইডো যাই হোক না কেন? কিন্তু প্রেম করে বিয়ে করবে এমন পুরুষের সংখ্যা বেশ কম। বিশেষ করে রবিবারের পাত্রী চাইয়ের পাতার অ্যাডগুলো দেখলে মানুষ হিসাবে নিজের লজ্জা লাগে। একজন ডিভোর্সি পুরুষ যার সন্তান আছে, তিনি নিঃসন্তান ডিভোর্সি, উইডোর সঙ্গে বিয়েতে আগ্রহী। মানেটা হল এই যে, বাছুরের সঙ্গে গাই তারা কিনবে না? কেউ কেউ তো আবার সিঙ্গল পাত্র খোঁজে। ম্যারেজ ব্যুরোগুলোতেও দেখেছি ব্যাচেলারস্ লাইফ লিড করতে বেশি উৎসাহী পুরুষরা।
সুতরাং যারা বিয়ে প্রতিষ্ঠানকে বাঁচিয়ে রাখার কথা ভাবছেন, তারা বুঝতেও পারছেন না যে বিবাহ নামক বিষয়টি পুরুষের কাছেই আর প্রাধান্য নয়। এই বিষয়ে আদালতের হস্তক্ষেপের প্রয়োজন আছে বলেই আমি মনে করি। আলটিমেটলি পরকীয়া প্রেমে মেয়েরাই বেশি কষ্ট পায় অনেক ক্ষেত্রে। তবে সেইসব মেয়েরা যারা ইমোশানাল লাভকে শরীরের আগে রাখে। কিন্তু এমন মেয়ের সংখ্যাও কিছু কম নয় যারা স্বামীকে ছাড়বে না আবার অন্য পুরুষের সঙ্গ এনজয় করতে ভালোবাসে। এরকম তো চলতে পারে না। তবে এখন কিন্তু পুরুষরাও প্রমাণ দাখিল করে এই গ্রাউণ্ডে ডিভোর্সের জন্যে অ্যাপ্লাই করতে পারবেন।
সুতরাং গেল গেল রব তোলার দরকার এখনই নেই। তবে আইনটা আরও ফ্লেক্সিবল হওয়া উচিত ছিল। বিবাহ আইন ও ডিভোর্স আইনকে এর সঙ্গে সংযুক্ত করা উচিত ছিল।
আদালত ৩০৬ ধারাকে সংযুক্ত করেছেন পরকীয়ার সঙ্গে। পরকীয়া প্রেমের কারণে যদি আত্মহত্যা করে কেউ, তবে এই ধারায় অপরাধীর শাস্তি হবে। এটা কিন্তু বেশ কঠিন সিদ্ধান্ত। আমি এর সমালোচনা না করে পারছি না।
সাইকলোজিস্টরা বলেন যে, যারা সুইসাইড করে, তাদের মানসিক স্থিতি আলাদা হয়। সত্যিই কি তাদের কোন কারণ দরকার হয় সুইসাইডের জন্যে? এটা মানসিক দূর্বলতা। যেমন চাইলেই কেউ খুন করতে পারে না, তেমনিই চাইলেই যে কেউ আত্মহনন করতে পারে না। আমাদের দেশে নারী, পুরুষ নির্বিশেষে সকলেরই সন্দেহ প্রবণতা কাজ করে। সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে তো আরও বেশি বেশি করে বাড়ছে। সন্দেহবাতিক একটা অসুখ। তেমনি যারা আত্মহত্যা করে তারা মানসিকভাবে অসুস্থ। তার সঙ্গে পরকীয়া প্রেমকে জড়িয়ে দেওয়া একেবারে উচিত কাজ হয় নি। উল্টোদিকে বধু নির্যাতনের মতই খুনকে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেওয়া খুব একটা অসম্ভব হবে না।
এবার আসি, আইনত পরকীয়া বৈধ নাকি অবৈধ সেই প্রসঙ্গে। আইনত ঘুষ দেওয়া নেওয়াও তো অপরাধ! কজন মানছে আর কজন শাস্তি পাচ্ছে। আবার ধর্ষনের জন্যে বেশ শক্তপোক্ত আইন হয়েছে। তবুও তো ধর্ষন থামছে না! তাই পরকীয়া বৈধ নাকি অবৈধ তা তো আমাদেরই স্থির করতে হবে।
পরিশেষে বলব, আমাদের বিবেক কি মৃত? আইন যাই থাক না কেন? আমরা তো মানুষ থেকে বনমানুষ হয়ে যাই নি। আমি একজন বিবাহিত পুরুষের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতেই পারি, কিন্তু মানসিক বা শারীরিক ভালোবাসা কিভাবে করতে পারি? যখন জানি যে আমার কারণে সেই পুরুষটির স্ত্রী ও সন্তান কষ্ট পাচ্ছে? অন্যের চোখের জলের বিনিময়ে আমরা কি নিজের সুখভাগ্য লিখতে পারি?
আর অন্যদিকে একজন পুরুষ যদি মনে করেন যে তিনি তার স্ত্রীর সঙ্গে সুখী নন, তাহলে সাহস থাকে তো বেরিয়ে আসুন। বিবাহবিচ্ছেদ খুব স্বাভাবিক একটা ঘটনা। মেনে নিন সত্যকে। একদিকে স্ত্রী, অন্যদিকে প্রেমিকা দুজনকেই তো বলি চড়াচ্ছেন নিজের সুখের জন্যে। কিছু পেতে গেলে তো কিছু ত্যাগ স্বীকার করতেই হয়। আপনার যদি সৎ সাহস থাকে তবে আইন, রাষ্ট্র নিশ্চয় আপনার পাশে থাকবে। বিচ্ছেদের কথা মাথায় রেখেই বলছি, বিয়ে খুব সুন্দর একটি প্রতিষ্ঠান। একাকীত্ব কখনওই কাম্য নয়। কারণ একা একা কোন মানুষ ভালো থাকতে পারে না। তাই ভালোবাসলে কিংবা প্রেম করলে কমিটেড হতে শিখুন। অন্যথা সকল মেয়েদের বোন আর মা ভাবুন। মানসিক নপুংসকদের কাছ থেকে সেটাই একমাত্র প্রত্যাশা।
কোলকাতা থেকে।