বৃহস্পতিবার, ০৪ মার্চ ২০২১, ০২:৫১ পূর্বাহ্ন
স্বপ্নীল সাগর
ইংরেজি বিভাগ, দ্বিতীয় বর্ষ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
বিজয়ের ৪৯ বছর পূর্ণ আজ! বাঙালি জাতির হাজার বছরের শৌর্য-বীরত্বের এক অবিস্মরণীয় দিন। বীরের জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার দিন। পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ নামে একটি স্বাধীন ভূখণ্ডের অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠার চিরস্মরণীয় অধ্যায়।প্রতি বছর যথাযথ ভাবগাম্ভীর্যে দিবসটি সাড়ম্বরে উদযাপন করা হয়।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর প্রভাতী সূর্যের আলোয় ঝলমলিয়ে উঠেছিল বাংলার রক্তস্নাত শিশির ভেজা মাটি, অবসান হয়েছিল পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর সাড়ে তেইশ বছরের নির্বিচার শোষণ,বঞ্চনা, অত্যাচার আর দাসত্বের কালো অধ্যায়। নয় মাসের তীব্র যন্ত্রণা শেষে এদিন জন্ম নেয় একটি নতুন দেশ স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ।আমরা অর্জন করি লাল সবুজের পতাকা ।প্রায় ৯২ হাজার পাকিস্তানি বাহিনী ঐতিহাসিক রোসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) আত্মসমর্পণের মাধ্যমে সূচিত হয়েছিল এই মাহেন্দ্রক্ষণ।
জিন্নাহের দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান নামক একটি অসম রাষ্ট্রকে বাঙালির ওপর জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হয়। দিনের পর দিন বিভিন্নভাবে বাঙালিদের উপর উৎপীড়ন, নির্যাতন করতে থাকে পাকিস্তানিরা যার মাত্রা ছিল তীব্র থেকে তীব্রতর।
এই শাসন-শোষণ ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে বাঙালি একে একে গড়ে তোলে আন্দোলন-সংগ্রাম। বায়ান্নের ভাষা আন্দোলন, ৫৪ এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ৬২ এর শিক্ষা আন্দোলন,৬৬ এর ৬ দফা, ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান, ৭০ এর নির্বাচনে বিজয় লাভের মধ্য দিয়ে বাঙালি চূড়ান্ত বিজয়ের লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত হতে থাকে।
এসব আন্দোলনের বলিষ্ঠ নেতৃত্ব দিয়ে বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা হয়ে ওঠেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এছাড়াও অসামান্য নেতৃত্ব দেন মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, এ কে ফজলুল হক, জাতীয় চার নেতা সহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ।
বায়ান্নের ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে বাঙালির যে আন্দোলন শুরু হয় ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে সেই আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ নেয়। যার চূড়ান্ত পরিণতি ঘটে একাত্তরের স্বাধীনতা অর্জনের মধ্যে দিয়ে।
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে) লাখ লাখ মানুষের সমাবেশে দেওয়া ঐতিহাসিক ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতিকে মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাকার নির্দেশ দেন।
”তিনি বলেছিলেন, তোমাদের যা কিছু আছে তাই দিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে,
রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরও দিব, তবুও এ দেশকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ ”
এবারে সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম,
এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম”
জাতির পিতার এ জ্বালাময়ী ভাষণের পর বাঙালি জাতির মধ্যে শুরু হয় কম্পন,শুরু হয় স্বাধীনতা অর্জনের তীব্র আকাঙ্ক্ষা। এই ইচ্ছা শক্তিকে দমাতে শুরু হয় ষড়যন্ত্র। ২৫ মার্চ আপারেশন সার্চলাইটের ভয়াল থাবায় প্রাণ যায় নিষ্পাপ বাঙালিদের ।
বাংলাদেশ পরিণত হয় ধ্বংস স্তূপে । আধুনিক অস্ত্র-সস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে অদম্য সাহস ও জীবনবাজি রেখে যুদ্ধ করে এদেশের কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, যুব, নারীসহ সব শ্রেণী-পেশার সর্বস্তরের মানুষ।
এই সময় বাংলাদেশের মানুষের পাশে দাঁড়ায় প্রতিবেশী দেশ ভারত। অস্ত্র, সৈন্য, খাদ্য, আশ্রয়সহ সার্বিক সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়। আন্তর্জাতিক পরিসরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অভূতপূর্ব ভূমিকা রাখে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন।
এছাড়া মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে এগিয়ে আসে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মুক্তিকামী মানুষ।
সর্বস্তরের মানুষ স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করলেও পাক বাহিনীর পক্ষ নেয় ঘরের শত্রু বিভীষনের মতো কিছু কুলাঙ্গার, নরপিশাচ জানোয়ার রূপি দালাল। আল বদর, আল শামস বাহিনী গঠন করে পাক বাহিনীর সাথে ধ্বংস যজ্ঞে মেতে ওঠে তারা।
বাঙালি জাতির মরণপণ যুদ্ধ এবং দুর্বার প্রতিরোধের মুখে পাক হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা পরাজয়ের চূড়ান্ত পর্যায় বুঝতে পেরে বিজয়ের দুই দিন আগে জাতির সূর্য সন্তান প্রায় ১১১১ জন বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে। এই দিনে তাদের শ্রদ্ধা ভরে স্মরণ করছি। এরা বেঁচে থাকলে হয়তো বাংলাদেশ আর ও সমৃদ্ধশালী হতো।
দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে প্রায় ৩০ লাখ মানুষ শহীদ হন। সম্ভ্রম হারার দুই লাখের বেশি মা-বোন।
এতো আত্মত্যাগের বিনিময়ে কি তারা আমাদের জন্য আজকের এই দুর্নীতিবাজ, চাঁদাবাজ, সন্ত্রাসী, টেন্ডারবাজিদের, রাজাকারের আধিপত্যের এই বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন নাকি সোনার বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন?
পত্রিকা খুলেই গুজব, ধর্ষণ, ঘুষ, দূর্নীতি, দ্বন্দ্ব কলহ, ষড়যন্ত্র লেগেই আছে। কতটা রক্ত,কত টুকু অশ্রু দিয়ে এই বাংলাদেশ পেয়েছি সেটা এত সহজে আমরা ভুলে যাই কি করে??
স্বাধীনতার চেতনাকে বুকে ধারন করে আমাদের উচিৎ এদেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত মূল্যবোধ রক্ষায় আমাদের হতে হবে অধিক যত্নবান ।
তবেই বিজয় হয়ে উঠবে অর্থবহ।
যে কোনো জাতির শক্তির প্রধান উৎস ঐক্য।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ থেকে শিক্ষা নিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে সব সমস্যা মোকাবেলায় সচেষ্ট হলে আমাদের অগ্রগতি ঘটবে দ্রুত। বিভেদ ভুলে আমরা সে পথেই হবো অগ্রসর–
এই হোক বিজয় দিবসের অঙ্গীকার।
পরিশেষে মুক্তিযুদ্ধে আত্মত্যাগী সকল শহীদ ও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি।