মঙ্গলবার, ০২ মার্চ ২০২১, ০৭:৪৫ পূর্বাহ্ন
গাইবান্ধা জেলা প্রতিনিধি: ভোর ঘুম থেকে ওঠার আগেই হইচই। ঘরের দরজা খুলতেই বন্দুক হাতে হুরমুর করে ঢুকলো কয়েকজন। কি যেন কি বলছিল তারা। কিছু বুঝতে না পেরে ছোট দুই মেয়েকে বুকে চেপে মাচার নিচে ঢুকে যায়। লুকিয়ে থাকায় আমি আর আমার দুই সন্তান বাঁচলেও স্বামী, ভাতিজা আর চাচা শ্বশুরসহ আটজন প্রাণ হারান। মাচার নিচে থেকে বেরিয়ে ছলছলা চোখে তাকাতেই দেখি ঘরে রক্তের বান বয়ে যাচ্ছে। মাটিতে পড়ে ছিল আটজনের লাশ। কথাগুলো বলতে বলতে বারবার মূর্ছা যাচ্ছিলেন একাত্তরে স্বজনহারা রেজিয়া বেগম। শুধু মানুষ মেরে ক্ষান্ত হয়নি পাকহানাদাররা। যাওয়ার সময় সঙ্গে করে নিয়ে যায় গোয়ালে থাকা গরুগুলো। তাদের মাটি দেওয়ার জন্য গ্রামের কেউ এগিয়ে আসেনি। গ্রামের মানুষ বলে মাটি দিলে মিলিটারিরা গুলি করবে। ছোট ছেলে আর ছোট ভাইকে সঙ্গে নিয়ে কবর খুরি। রক্তে মাখা লাশের কেউ মাথা কেউবা পা ধরে এক কবরে দুইজন করে রেখে মাটি চাপা দেয়। অল্প বয়সে বিধবা হলাম, কি দোষে স্বামীকে হারালাম তা জানা নেই। তখন থেকে অন্যের বাড়িতে কাজ করে খাই। জীবনে আর সুখ হলো না আমার। মুক্তিযুদ্ধে স্বামী হারানোর বেদনা বুকে চেপে পিতৃহারা সন্তান নিয়ে বেঁচে আছেন গাইবান্ধা জেলার ফুলছড়ি উপজেলার উদাখালী গ্রামের রেজিয়া বেগম। দেশ স্বাধীনের ৪৮ বছর কেটে গেলেও মুক্তিযুদ্ধে স্বজনহারাদের কপালে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি মেলেনি। মুক্তিযুদ্ধের পরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেড় বান টিন আর ২ হাজার টাকা দেয়। পরে স্বামী-স্বজনহারা বিধবা রেজিয়ায় আর তাদের স্বজনদের খোঁজ পর্যন্ত নেয়নি কেউ। রেজিয়া বেগম আক্ষেপ করে বলেন, বৃদ্ধ বয়সে মানুষের বাড়িতে কাজ না করলে ভাত জোটে না। থাকার আশ্রয়টুকুও নেই। চেয়ারম্যান-মেম্বারকে বলেও একটা ঘর পাইনি। তার অভিযোগ, যারা টাকা দেয় তারা ঘর পায়। আমার কাছে টাকা নেই তাই ঘরও নেই। রেজিয়া আরও বলেন, একটু বৃষ্টি হলেই অন্যের ঘরে থাকতে হয়। শুধুমাত্র বাঙালি হওয়ার কারণে সেদিন স্বামী, দেবর-ভাসুর, ভাতিজাসহ পরিবারের আটজনকে পাখির মতো গুলি করে মারে পাকিস্তানি সৈন্যরা। সেই স্মৃতি মনে হলে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারিনা। কতজন আসলো নাম লিখে নিয়ে গেলো কিছুই পাইনি। এখন অসুস্থ শরীর নিয়ে মানুষের বাড়িতে কাজ করা দুঃসাধ্য হয়ে পড়েছে। নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে বিনা চিকিৎসায় এখন মৃত্যুর প্রহর গুনছি। গাইবান্ধা জেলায় শুধু রেজিয়া নন মুক্তিযুদ্ধে স্বজনহারা অনেকেই একই অবস্থা। উদাখালী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় একই পরিবারের আটজনকে হত্যা করেছিল পাকিস্তানি বাহিনী এ ঘটনা আমি শুনেছি। তবে রেজিয়া বেগমের থাকার ঘর নেই এ খবর আমি জানিনা। এর আগে তিনি আমার কাছে আসেননি। গাইবান্ধা জেলা প্রশাসক আবদুল মতিন বলেন, বিষয়টি আমি জানি না, যদি এমন কোন ঘটনা ঘটে থাকে। তবে খোঁজ নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। যাদের আতœত্যাগের বিনিময়ে আজকের এই বিজয়। তাদের উত্তরসূরিদের রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি দেয়ার দাবি জানিয়েছেন মুক্তিযোদ্ধা ও বধ্যভূমি সংরক্ষণ কমিটির নেতারা।