ষড় ঋতুর বাংলাদেশে এখন
হেমন্তকাল। পৃথিবীর কোন
দেশেই হেমন্তের অস্তিত্ব খুঁজে না
পেলেও আমাদের হেমন্তের
অগ্রহায়ণে প্রথম প্রহরেই হয়
নবান্ন উৎসবক্ষন। চিত্র শিল্পী
মনের আঙিনায় শরৎ ও হেমন্তের ছবি ধারণ করে রং তুলির আল্পনায় প্রকৃতির নান্দনিক বৈচিত্র্য প্রকাশ করেন। রূপসী বাংলার সৌন্দর্য্যে মুগ্ধ হয়ে আবেগ আপ্লুত কবি সাহিত্যিক নিজ নিজ কলমের খোঁচায় সাজিয়ে পাঠক হৃদয়ে দৃষ্টি নন্দন হন। পল্লীর পাগল করা বাউলের ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালী, জারি,সারি, ও মুর্শিদী গান সুরে সুরে জাগিয়ে তোলেন হৃদয় এর স্পন্দন। যার মাঝে আমরা বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখি। সভ্যতার আদিকাল হতে গ্রাম বাংলার আত্মভোলা সহজ সরল মানুষ গুলো মঙ্গল প্রদীপ জ¦ালিয়ে সংসারের শুভ কামনায় বার মাসে তের পার্বণ পালন করেন। নতুন ফসল ঘরে তোলার প্রারম্ভে কৃষক পরিবার হেমন্তে নবান্ন উৎসব ধুমধামের সহিত করে। বাংলার মুসলমানরা পীরের দরগায় মানত করে মসজিদে শির্ণী বিতরণ করেন। হিন্দুরা পূজা করে প্রস্বাদ বিলায়। এই হচ্ছে পল্লী বাংলার বাঙ্গালীদের নবান্ন রীতি। নবান্ন ও উথলী বাজারের অছেদ্য সম্পর্ক। জনশ্রুতি অনুযায়ী “১২৭২ বঙ্গাব্দ আশি^ন মাসের ২য় সপ্তাহে কলকাতার লক্ষ্মীবারের সেরেস্তায় নায়েব মহাশয় জমিদার বুধসিংহ বোথরাজ কে অবগত করেন পোলাদশী পরগণার তহশিলের পত্র সম্পর্কে। জমিদার পত্র বিষয়ে অবগত হয়ে পুত্র খর্গসিংহ কে পোলাদশী পরগণায় পাঠান। তখন খর¯্রােতা করতোয়ার ভরা যৌবন। নৌকায় একমাত্র চলার বাহন। জমিদার পুত্র নৌ-পথ ও ঘোড়ার গাড়ীতে সমস্ত পরগণা ঘুরে ঘুরে দেখেন। এখানের মানুষের আতিথিয়াতায় তিনি মুগ্ধ হন। করতোয়া বালুচরে এই জনপদ। তাই আগাম রবিশষ্যে অপার সম্ভাবনা। কৃষি পন্যের ন্যায্যমূল্য পাওয়ার জন্য করতোয়ার পূর্বতীরে ৫২ বিঘার তৌজিতে তাই এই বাজার ও হাটুরেগণের পানীয় জলের প্রয়োজন মিটানোর জন্য সু-গভীর ইন্দারা স্থাপন করেন” অধুনা বগুড়া জেলার শিবগঞ্জ উপজেলার উথলী হাটের এমন কাহিনী শোনা যায় প্রবীণদের মুখে। জ.ঈ.ঝ রেকর্ডে পোলাদশী পরগণায় উথলী হাটের মালিকানায় বুধ সিংহ বোথরাজ ও খর্গ সিংহের নাম এই সত্যকে তুলে ধরে। জাতীয় পর্যায়ে বিভিন্ন দিবস উৎযাপনের জন্য বিভিন্ন নামকরণ করে ব্যাপক আড়ম্বরের মাধ্যমে মেলা করা হয়। যেমন কৃষি মেলা, বিজ্ঞান মেলা, কর মেলা, বই মেলা, মীনা মেলা ইত্যাদি। আবার অনেক তিথি অনুসরণ করে দেশের বিভিন্ন এলাকা বা জায়গায় মেলা বসে। কখনও কখনও মেলার নামে জুয়া হাউজি, যাত্রা- বিচিত্রার নামে অশ্লীল নৃত্য পরিবেশন করে আয়োজক শ্রেণি পকেট ভারি করে। পত্র পত্রিকায় লেখা লেখি হয়। কর্তা ব্যক্তি বা প্রশাসনিক হস্তক্ষেপে অশ্লীলতা বন্ধ হয়ে যায়। এই হচ্ছে মেলার সংস্কৃতি। কিন্তুু উথলী নবান্ন মেলা শত বছরের ঐতিহ্য এখনও লালন করে আসছে। স্থানীয় সুশিল সমাজ বাপ-দাদার আদী সংস্কৃতি লালনে বদ্ধ পরিকর সেহেতু, এখানে অপসংস্কৃতির কোন ছোঁয়া মেলায় স্পর্শ করতে পারে না। এক দিনের এই মেলায় দুইদিন আগেই আগাম সবজি,বিভিন্ন প্রজাতির মাছ, রকমারি পণ্য, আঞ্চলিক প্রসিদ্ধ খাবার নিয়ে ভোজন বিলাসী হাটুরেগণের চাহিদা মেটাতে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল হতে ব্যবসায়ীদের আগমণ ঘটে। দূরের আত্মীয়স্বজন, বন্ধু বান্ধবদের আগমণে পাড়ায় পাড়ায় সাড়া পরে যায়।
বিশ^ জলবায়ু পরিবর্তনের পরিক্রমায় আজ আমরাও অন্তর্ভূক্ত। এবারে শরৎ আকাশে শুভ্র মেঘের ভেলার পরিবর্তে অবিরাম ঝড়-বৃষ্টিতে প্রকৃতিকুল সিক্ত। মাঠের সব ধরণের ফসল দুমরে মুচরে নষ্ট হয়ে গেছে। কৃষক বিপন্ন! কৃষি পণ্যের ব্যাপক ক্ষতি। এ জনপদ (আলু, কপি, মুলা, লাউ, করলা, ঝিঙ্গা, পটল, বেগুন, কলা) রবিশস্য উৎপাদনে খ্যাত। সবগুলো ফসলের ক্ষতি সাধনে কৃষক দিশেহারা। তাই এবারের নবান্ন উৎসব কৃষিজীবী সম্প্রদায়ের বিষফোঁড়া। আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধব, লোক-লৌকিকতার মায়ার শৃঙ্খলে বন্দী প্রতিটি মানুষ। সেহেতু, জনজীবনে এবারের নবান্ন উৎসব দুর্ভোগের সামিল। তারপরও বলব আগামী ১৮ নভেম্বর ২০১৯ রোজ সোমবার সূর্য়াদয়ের পর নবান্নœ বাজারের চিত্র হবে ভিন্ন। এখানে সব শ্রেণি পেশার মানুষ সাধ্যানুযায়ী মানসম্মত বাজারে থলে ভরাবেন। হিন্দু অধ্যুসিত এলাকা হলেও স্থানীয় মুসলমান সম্প্রদায় এই নবান্ন উৎসব জীবন বীণায় ধারণ করে প্রীতি ও প্রেমে সেতু বন্ধনে লালন করেন সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি।

“নবান্ন ও উথলী বাজার” মোঃ তাজমিলুর রহমান ছাইদুর
Please follow and like us: