“বেশ্যানাং পুরুষাধিগমে রতির্বৃত্তিশ্চ সর্গাৎ”(বেশ্যাগণের পুরুষগ্রহণ প্রবৃত্তি বা পুরুষকে প্রলুব্ধ করা এবং অর্থার্জন সেই সৃষ্টিকাল থেকে চলে আসছে।) – এহেন কথাই বাৎস্যায়ন তাঁর বিরচিত “কামসূত্র” গ্রন্থের চতুর্থ অধিকরণে অবহিত করেছেন।“কামসূত্র”, বাৎস্যায়ন তাঁর গ্রন্থে চতুর্থ অধিকরণটি বরাদ্দ করেছেন বৈশিকদের জন্য। বৈশিক কারা ? আসলে বেশ্যাদেরই “বৈশিক” বলা হয়। বেশ্যার অসংখ্য প্রতিপরিচয়, যেমন — পতিতা, বারাঙ্গনা, দেহপসারিণী, দেহপোজীবিনী, রক্ষিতা, খানকি, বারবনিতা, উপপত্নী, জারিণী, সাধারণী, মহানগ্নী, পুংশ্চলী, পুংশ্চলূ, অতীত্বরী, বিজর্জরা, অসোগু, অতিষ্কদ্বরী, গণিকা এবং হাল আমলের যৌনকর্মীও বোঝায়। ইংরেজিতে যার প্রতিশব্দ Domi-monde বা Public Women। Hatairai, Aspasia, Phrynes ইত্যাদি আদিম এবং প্রাগৈতিহাসিক নামও আছে। আরও তিনটি আধুনিক বিশেষণ : Pornstar, Call Girl, Escort Girl.
প্রসঙ্গত বলি, বিশেষ এই পেশার মেয়েদের যে নাম বা যে বিশেষণে বিশেষিত করা হয়েছে, সেগুলি সবই পেশার রকমফেরের উপর ভিত্তি করেই। সবকটি বিশেষণের ব্যাখ্যা দেওয়া মানে কলেবর বৃদ্ধি করা। তথাপি যেহেতু প্রবন্ধটির শিরোনামে “বেশ্যা” শব্দটি ব্যবহার করেছি (গোটা প্রবন্ধে আমি “বেশ্যা” শব্দটিই উল্লেখ করব), সেইহেতু এই শব্দটিই দেখব কীভাবে পাওয়া যায়।
ভিন্টারনিৎসের মতে ঋগবেদের প্রথম মণ্ডলের ১২৬তম সূক্তের অন্তর্গত পঞ্চম ঋকে যে “বিশ্যা” শব্দটি আছে তার থেকেই নাকি “বেশ্যা” কথাটির উৎপত্তি। ঋকটি হল : “সুবন্ধবো যে বিশ্যা ইব ব্রা অনস্বন্তঃ শ্রব ঐযন্ত পূজাঃ”। ভিন্টারনিৎস ঠিক না বেঠিক, সে ব্যাপারে এই ভারতের কোনো বেদবেত্তা পণ্ডিত কোনো আপত্তি করেছেন বলে জানা নেই।
বেশ্যাবৃত্তির শুরুটা ঠিক কবে থেকে ? বেশ্যাবৃত্তির প্রসঙ্গ উঠলেই সবাই বলে “আদিম পেশা”। “আদিম” মানে কী ? আদিম জাতি বলতে আমরা সেই সময়ের মানুষের কথা বুঝি, যখন তারা পোশাকের ব্যবহার জানত না। বেশ্যাবৃত্তি ঠিক তখন থেকেই সৃষ্টি হয়েছে বলে আমার মনে হয় না। আমার মনে হয় সমাজে বেশ্যাবৃত্তি শুরু হয়েছে পোশাকের ব্যবহার জানার অনেক পর। নাগরিক-সভ্যতা শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বেশ্যাবৃত্তির সূত্রপাত।নাগরিক জীবন শুরু হল বহির্দেশীয় মানুষদের অনুপ্রবেশ বা আগমনের পর, ভারতে যাঁরা “আর্য” পরিচিত।এই বহির্দেশীয়রাই ভূমিকন্যাদের যথেচ্ছভাবে ব্যবহার করত। ধনশালী, বলশালী ও উচ্চস্তরের সাদাবর্ণের মানুষগুলো ভূমিকন্যা বা অনার্য কন্যাদের সঙ্গে শারিরীক লিপ্ত হলেও স্বীকৃতি দেয়নি। অনার্য-কন্যাদের সঙ্গে শোওয়া যায়, কিন্তু গ্রহণ করা যায় না।আর তাই পুরাণ, রামায়ণ, মহাভারতে যত যুদ্ধের কাহিনি পাওয়া যায়, তার সবই আর্য-অনার্যের দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষের কাহিনি। আর্যের জয়, অনার্যের পরাজয়। দুষ্টের দমন, শিষ্টের পালনের নামে আর্যদের দাদাগিরির কাহিনিই বর্ণিত হয়েছে মনুসংহিতা, পুরাণ ইত্যাদি তথাকথিত শাস্ত্রগুলিতে। মনুসংহিতায় এইভাবেই পেয়ে যাই হাজারো জারজ সন্তান।আর্যরা ধর্ষণ করলে অনার্যদের শাস্তির বিধান ছিল।আর্যদের চাইতে তুলনামূলকভাবে ভারতীয় আদি অনার্যদের সমরাস্ত্রের দিক থেকে কমজোরী ছিল। তারা আর্যদের মতো তির-ধনুক, বর্শা, ছোরা, কুঠার ব্যবহার করলেও আর্যদের ব্যবহৃত শিরস্ত্রাণ ও কবচের ব্যবহার জানত না। তাই বারবার পরাজয় ঘটেছিল। অসুর, দৈত্য, রাক্ষস-খোক্ষস তকমা পেয়ে বহু সহস্র অনার্য পুরুষের মৃত্যু হয়েছে। আর অনার্যদের অসহায় রমণীরা আর্যদের দাসী ও যৌনসঙ্গী বা রক্ষিতা হিসাবে গৃহীত হয়েছিল। এদেরই একটা বড়ো অংশ যৌনজীবিকার পথ বেছে নিল। সেইসব রমণীরা বুঝল নারী-শরীরের প্রতি পুরুষদের লালসা তীব্র।অতএব এই শরীর মাগনা কেন, মূল্য দিতে হবে।
এরপর যখন সমাজে রাজতান্ত্রিকতার উন্মেষ ঘটেছিল, তখন এইসব রমণীদের শত্রু নিধন এবং গুপ্তচরবৃত্তির কাজে লাগানো হত।বিশিষ্ট্য অতিথি, অমাত্য এবং অপরাপর উচ্চধনীবর্গদের নারী-শরীর উপঢৌকন দিতে হত। বলা যায়, ঠিক এই সময় থেকেই বেশ্যাবৃত্তি রাষ্ট্রানুমোদিত হয়ে যায়। এই বৃত্তি তখন থেকেই রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতা ও আনুকূল্যে পুষ্ট হতে থাকে।
অবশ্য প্রচলিত অর্থে বেশ্যা বা গণিকা বা পতিতা বলতে আমরা যা বুঝি, প্রাচীন ভারতে এইসব রমণীরা তেমনটা ছিলেন না। স্বয়ং দেশের রাজা গণিকাদের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। বার্ষিক ১০০০ পণ বেতন দিয়ে রাজা তাঁর প্রাসাদে গণিকাদের নিয়োগ করতেন। গণিকা বা বেশ্যাদের আয়ের একটা অংশ “কর” হিসাবে রাজার কোশাগারে সংগৃহীত হত।প্রাচীন ভারতে গণিকারা রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি হিসাবে গণ্য হত।তদুপরি বেশ্যাদের ঘরে যেমন জ্ঞানী-গুণীদের আলোচনা-সভা বসত, আবার প্রাচীন ভারতেও এমন জ্ঞানী-গুণীদের এবং শিক্ষাব্রতীদের বেশ্যালয় ছিল প্রধান আখড়া।আরও জানা যায়, প্রাচীনকালে বেশ্যালয়ে বা গণিকালয়ে গমন খুব একটা গোপনীয় বা লজ্জাকর ছিল না। সেযুগের নাগরিকরা বসন-ভূষণে সজ্জিত হয়ে ঘোড়ার পিঠে চড়ে দিনে-দুপুরে বেশ্যালয়ে যাতায়াত করতেন।
প্রাচীনকালে বহুভোগ্যা নারীদের নানাবিধ নামে উল্লেখ করা হত বেশ্যাবৃত্তির চরিত্রানুসারে। তাই প্রত্যেকটি নামের মাহাত্ম্যও স্বতন্ত্র।যদিও মোটিভেশন একই, সকলেরই পেশা শরীর বিক্রি করা।প্রাচীনকালে “গণিকা” বলতে বোঝাত বহুভোগ্যা নারীকেই।গণ বা দলবদ্ধ হয়ে যে নারী যাপন করে তিনিই গণিকা। অনুরূপ “বেশ্যা” বলতে বোঝাত, যে নারী বেশ বা সাজসজ্জা দ্বারা পুরুষদের প্ররোচিত করে প্রলোভিত করে তাঁরাই বেশ্যা।আবার ‘বেশ’ শব্দের আদি অর্থ হল বাসস্থান, এই বিশেষ বাসস্থানে যে নারী বাস করেন তিনিই বেশ্যা। “পণ্যাঙ্গনা” বলা হত সেই নারীদের, যে নারীদের পণের বাজি রেখে সম্ভোগ করা হত।“বারস্ত্রী” তাঁরাই, যে নারীরা যুগপৎ মন্দিরের সেবাদাসী ও রাজা বা অমাত্য মর্যাদার রাজকর্মচারীদের ভোগ্যা হতেন। পরিচারিকা বা ক্রীতদাসী রক্ষিতারা হলেন “ভুজিয়া”। যে নারীর চরিত্রের পতন হয়েছে তিনি “পতিতা” ইত্যাদি।অনুমান করা হয়, প্রধানত ব্রাহ্মসমাজের প্রচারের দৌলতেই ‘পতিতা’ শব্দটি বেশ্যার সুভাষণরূপে গ্রহণীয় হয়ে ওঠে। ১৮৯৪ সালে লেখা ‘বিচারক’ গল্পে রবীন্দ্রনাথও দেখছি ব্যবহার করেছেন। সমর সেন ‘গণিকা’ শব্দটিই বেশি ব্যবহার করতেন।“প্রবাসী” পত্রিকার সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের তাঁর পত্রিকায় বারবার ‘বেশ্যা’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। সাম্প্রতিককালে গণিকা বা বারবনিতাদের মতো “যৌনকর্মী” শব্দটিও একটি জীবিকাকে বর্ণনা করে।“যৌনকর্মী” শব্দটি যেন তাঁদের জীবিকাকে আরও বেশি করে চিহ্নিত করে।
বর্তমানে ধাত্রীবিদ্যা, উদ্যানবিদ্যা, চিকিৎসাবিদ্যা, রসায়নবিদ্যা ইত্যাদি যেমন নানা শিক্ষা আছে, ঠিক তেমনই সেকালে গণিকাবিদ্যাও ছিল এমনই এক শিক্ষণীয় বিষয় এবং সেই শিক্ষা এক্কেবারেই নিন্দনীয় ছিল না। এ বিষয়ে পৃথক বিদ্যালয়ও ছিল। রীতিমতো পরিচর্যা, প্রশিক্ষণ এবং অনুশীলন দ্বারা আগামীদিনের গণিকাদের এইসব শিক্ষালয় থেকে উত্তীর্ণ হতে হত। নৃত্য-গীতবাদ্য ছাড়াও চিত্রকলা, জ্যোতিষশাস্ত্র, অভিনয়, রন্ধনবিদ্যা, ভাষাশিক্ষা, লিখন, মার্জিত ভাষায় কথা বলা, মালাগাঁথা ইত্যাদি এরকম ৬৪ কলায় পারদর্শী করে তোলা হত। ৬৪ কলায় সুশিক্ষিতা, রূপবতী, গুণবতী বেশ্যা বা গণিকারাই জনসমাজে মর্যাদাপ্রাপ্ত হতেন।
এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকার সংজ্ঞা অনুযায়ী, বেশ্যাবৃত্তি হল স্বামী বা বন্ধুকে ছাড়া অন্য কারও সঙ্গে নগদ অর্থ বা অন্য কোনো কিছুর বিনিময়ে বাছবিচারহীনভাবে যৌনকর্মে লিপ্ত হওয়া। তসলিমা নাসরিন এই পেশা সম্বন্ধে বলেন, “এটাকে পৃথিবীর প্রাচীনতম পেশা বলে লোককে ধোঁকা দেওয়ার চেষ্টা হয় বটে, আসলে এটা কিন্তু প্রাচীনতম পেশা নয়, এটা বরং মেয়েদের বিরুদ্ধে ‘পৃথিবীর প্রাচীনতম নির্যাতন’”। এই পণ্য-দুনিয়ায় নারী-মানুষকে পণ্য করার নেটওয়ার্কগুলির জোয়ার প্রবল বেগে ধেয়ে আসছে আমাদের দিকে। আর এই সুনামির মূল প্রতিপাদ্য যৌন-বাণিজ্য ও বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের মুনাফা। বাৎসায়নের “কামসূত্র”-এ বৈশিকাখ্যং অধ্যায়ে বলা হয়েছে, “রুচি হইতে যে পুরুষগ্রহণপ্রবৃত্তি তা স্বাভাবিক আর অর্থার্জনার্থ যে প্রবৃত্তি তা কৃত্রিম”। বাৎসায়ন উল্লিখিত “অর্থার্জনার্থ” এই কৃত্রিম প্রবৃত্তিই নিন্দার্হ। এই বেশ্যাপ্রবৃত্তিই বর্তমান বিশ্বে এক নম্বরের বাণিজ্য-উপজীব্য, অনেক দেশের রাজকোশের অর্থের বেশ্যাপ্রবৃত্তিই প্রধান উৎস। কৌটিল্য বিভিন্ন কারণে যৌনব্যাবসাকে স্বাভাবিক বলেই ধরে নিয়েছিলেন। অবৈধ নারীসংসর্গ বোঝাতে তিনি ‘বাহ্যবিহার’ শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন। কিন্তু এই ‘বাহ্যবিহার’-এর পক্ষে বা বিপক্ষে স্পষ্ট করে কিছুই বলেননি কৌটিল্য। বাৎসায়ন বলেছেন, গণিকা অথবা বিধবাদের সঙ্গে দেহসম্ভোগ সমর্থন করা হয় না, আবার নিষিদ্ধও নয়।
সমাজবিদ লেকির মতে, গণিকাবৃত্তি হল সমাজের মাত্রাতিরিক্ত যৌনকামনা বেরিয়ে যাওয়ার একটি সেফটি-ভালভ। লেকি মনে করেন, নিজে মূর্তিমতী পাপীষ্ঠা হলেও পরিণামে পুণ্যের অধিকারিণী এই গণিকা। এরা না-থাকলে সংখ্যাহীন সুখী পরিবারের প্রশ্নাতীত পবিত্রতা নষ্ট হয়ে যেত। তাহলে কি চিরটাকাল সমাজের বিষ-ক্লেদ কণ্ঠে ধারণ করে নীলকণ্ঠী হয়ে থেকে যাবে গণিকাশ্রেণি ! নারীবাদী লেখিকা তসলিমা নাসরিন একটি ব্লগে লিখতে গিয়ে বলেছেন – “ক্রীতদাসপ্রথার সঙ্গে পতিতা প্রথার মূলত কোনো পার্থক্য নেই। ক্রীতদাসরা যখন তুলো ক্ষেতে চাষের কাজ করত, দাসমালিকরা প্রায়ই সশরীরে উপস্থিত হয়ে কিছু ক্রীতদাসীকে যৌনকর্মের জন্য তুলে নিয়ে যেত। ত্বক যাদের একটু কম কালো, সাধারণত তাদেরকেই পছন্দ করত। বাজারে নিয়ে যৌন-ব্যাবসার জন্য ভাড়া খাটাত, নয়তো সরাসরি পতিতালয়েই তাদের নগদ টাকায় বিক্রি করে দিত। আঠারো-উনিশ শতকে যে প্রথাটিকে বলা হত ক্রীতদাস প্রথা, বিংশ-একবিংশ শতকে সেই প্রথাকে বলা হচ্ছে পতিতা প্রথা”।
অর্থের বিনিময়ে যৌনতা বিক্রির ইতিহাস সুপ্রাচীন। ওয়েবস্টার অভিধান মতে, সুমেরিয়ানদের মধ্যেই প্রথম পবিত্র পতিতার দেখা মেলে। প্রাচীন গ্রন্থাদিসূত্রে, যেমন ইতিহাসের জনক হিসাবে খ্যাত হিরোডেটাস (খ্রিস্টপূর্ব ৪৮৪ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ৪৩০/২০)-এর লেখায় এই পবিত্র বেশ্যাবৃত্তির প্রচুর উদাহরণ পাওয়া যাবে, যেটি প্রথম শুরু হয়েছিল ব্যাবিলনে। সেখানে প্রত্যেক নারীকে বছরে অন্তত একবার করে যৌনতা, উর্বরতা ও সৌন্দর্যের দেবী আফ্রোদিতির মন্দিরে যেতে হত এবং সেবাশুশ্রূষার নমুনা হিসাবে নামমাত্র মূল্যে যৌনসঙ্গম করতে হত একজন বিদেশির সঙ্গে। এরকমই বেশ্যাবৃত্তির চর্চা হত সাইপ্রাস এবং করিন্থেও। এটি বিস্তৃত হয়েছিল সার্দিনিয়া এবং কিছু ফিনিশীয় সংস্কৃতিতে, বিশেষ করে ইস্টার দেবতার সম্মানে। ফিনিশীয়দের মাধ্যমে ক্রমশ এটি ভূমধ্যসাগরের অন্যান্য বন্দর শহরগুলিতেও সংক্রমিত হয়, যেমন সিসিলি, ক্রটন, রোসানো ভাগলিও, সিক্কা ভেনেরিয়া এবং অন্যান্য শহরে। এক্ষেত্রে অনুমান করা হয় এশিয়া মাইনর, লাইদিয়া, সিরিয়া ও এট্রাকসনের প্রাচীন গ্রিক ও রোমান সমাজে বেশ্যা বা পতিতারা ছিলেন স্বাধীন এবং তাঁরা বিশেষ ধরনের পোশাক পরিধান করা ও কর দেওয়ার ব্যাপারে আদিষ্ট ছিল।
কৌটিল্যের “অর্থশাস্ত্র” থেকে পতিতা ও পতিতাবৃত্তি সংক্রান্ত ভারতবর্ষীয় চিত্র পাওয়া যায়। কী বলছে অর্থশাস্ত্র ? অর্থশাস্ত্র বলছে দেহব্যাবসা একটি প্রতিষ্ঠিত প্রথা। পুরোপুরি ঘৃণিত বা গোপনীয় নয়। কৌটিল্যের সময় দেহব্যাবসা শিল্পের পর্যায়ে উন্নীত হয় বলে জানা যায়, যে শিল্পের নাম ছিল বৈশিক কলা। বিশেষজ্ঞরা এ শিল্পের চর্চা করতেন এবং শিক্ষা দিতেন। অর্থশাস্ত্রের ২৭ অধ্যায়ে গণিকাধ্যক্ষেরও উল্লেখ আছে। এখানে মৌর্য সামাজ্যের সময়কার বহু পুরুষগামী বারাঙ্গনা নারীদের হাল-হকিকৎ প্রাসঙ্গিক একটা বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। বলা হয়েছে, গণিকাধ্যক্ষের কাজ ছিল রাষ্ট্রীয় তত্ত্বাবধানে গণিকাদের সংগঠিত ও দেখভাল করা। গণিকাধ্যক্ষকে নিযুক্ত করতেন দেশের রাজা।গণিকাধ্যক্ষের আর-একটা প্রধান কাজ ছিল গণিকাদের আয় ও ব্যয়ের হিসাবপত্র রাখা। কোন্ গণিকার দিনে কত খরিদ্দার আসছে, খরিদ্দার-পিছু পারিশ্রমিক কত, উপরি পাওনা কী এবং কত, তার ব্যয়ই-বা কত – সে সবকিছুই জাবেদা খাতায় নথিভুক্ত করত। অর্থশাস্ত্রে বলা হয়েছে, কোনো গণিকা যদি তাঁর বৃত্তি ছেড়ে চলে যায় অথবা কোনো কারণে মারা যায়, তাহলে তাঁর মেয়ে বা বোন তাঁর বৃত্তি গ্রহণ করবে। এই কারণেই তাঁর ত্যাজ্য সম্পত্তিরও সে মালিক হবে। অথবা সেই মৃতা কিংবা বৃত্তিত্যাজ্যা গণিকার মা তাঁর শূন্যস্থান অন্য কোনো যোগ্য মেয়ে দ্বারা পূরণ করতে পারবে।যদি সেই মৃতা কিংবা বৃত্তিত্যাজ্যা গণিকার মেয়ে বা বোন বা মাতৃনিযুক্ত প্রতিগণিকা না-থাকে সেক্ষেত্রে তাঁর ত্যাজ্য ধন রাজকোশে জমা পড়বে।
কৌটিল্যের সময়ে গণিকাদের তিনভাগে ভাগ করা হত। যেমন – কনিষ্ঠ, মধ্যম ও উত্তম। কোন্ গুণাবলি বিবেচনা করে এই বিভাজন? বিভাজন হত কোন্ গণিকার কীরকম রূপ, কীরকম শারীরিক গঠন, কীরকম বয়স – সব মিলিয়ে তাঁর পুরুষ আকর্ষণ ও মনোরঞ্জনের ক্ষমতা কতোখানি এসব দেখে তাকে উত্তম, মধ্যম বা কনিষ্ঠ শ্রেণির গণিকার স্বীকৃত দেওয়া হত।এই স্বীকৃত বা সার্টিফিকেট দেওয়ার ক্ষমতা ছিল একমাত্র গণিকাধ্যক্ষের। কনিষ্ঠ শ্রেণির গণিকার বেতন ছিল ১০০০ পণ, মধ্যম শ্রেণির গণিকার ২০০০ পণ এবং উত্তম শ্রেণির গণিকার বেতন ছিল ৩০০০ পণ। সেসময় কোনো রাজকুলে নিযুক্ত গণিকা যদি রাজসেবা থেকে কোনো কারণে মুক্তি চাইত তাহলে তাঁকে রাজাকে ২৪,০০০ পণ মুক্তিমূল্য দিতে হত।এমনকি গণিকাদের সন্তানদের দাসত্ব (গণিকার সন্তানরা রাজার “দাস” হিসাবে গণ্য হত) থেকে মুক্তি পেতে ১২,০০০ পণ নিষ্ক্রয় দিতে হত। গণিকাদের কাছ থেকে শুধুই নিঙড়ে নিত ভাবছেন যাঁরা তাঁদের বলি, শুধু নিঙড়ে নেওয়া নয় নিরাপত্তার ব্যাপারটাও কঠোরভাবে দেখা যেত। যেমন – কোনো কামনারহিত কোনো বেশ্যা বা গণিকাকে কোনো পুরুষ (খরিদ্দার) তাঁর ঘরে অবরুদ্ধ করে রাখে, অথবা কোনো গোপন স্থানে লুকিয়ে রাখে এবং তাঁর শরীরে ক্ষতের সৃষ্টি করে, দাঁত দিয়ে তাঁর বিশেষ বিশেষ স্থানে আঘাত করে তাঁর রূপ নষ্ট করে – তাহলে সেই পুরুষপুঙ্গবটিকে ২৪,০০০ পণ এবং প্রয়োজনে ৪৮,০০০ পণ পর্যন্ত জরিমানা দিতে হত। এখানেই শেষ নয়, যে গণিকা রাজার ছত্র, ভৃঙ্গার (জল ছিটানোর ছিদ্রযুক্ত পাত্রবিশেষ) বহনের কাজে নিযুক্ত হয়েছে তাকে কোনো মারধোর করলে সংশ্লিষ্ট অভিযুক্ত পুরুষটিকে ৭২,০০০ পণ অর্থদণ্ড করা হত।
তবে গণিকাদেরও শাস্তি বা অর্থদণ্ডের ব্যবস্থা ছিল। যেমন – (১) রাজার আজ্ঞা বা আদেশ সত্ত্বেও যদি কোনো বেশ্যা গণিকা কোনো বিশেষ পুরুষের সঙ্গে যৌনক্রিয়ায় আপত্তি জানায়, তাহলে সেই সংশ্লিষ্ট বেশ্যাকে ১০০০ চাবুক মারার রীতি ছিল। কখনো-কখনো ৫০০০ পণ পর্যন্ত গুণগারি দেওয়ার ব্যবস্থা ছিল। (২) যদি কোনো পুরুষের কাছ থেকে যৌনমিলন করার শর্তে অগ্রিম অর্থ নিয়ে দুর্ব্যবহার করে, তাহলে সংশ্লিষ্ট গণিকাকে অগ্রিম অর্থের দ্বিগুণ পুরুষটিকে ফেরত দিতে হবে। (৩) যদি কোনো বেশ্যা কোনো পুরুষের কাছ থেকে যৌনমিলন করবে এই শর্তে রাত্রিযাপনের কোনোরূপ আগাম অর্থ নিয়েও যৌনমিলন না-করে, তাহলে উক্ত পুরুষ বা খরিদ্দার বেশ্যাটিকে যে পরিমাণ অর্থ প্রদান করেছিল তার ৮ গুণ অর্থ ফেরত দিতে হবে। (৪) কোনো গণিকা যদি ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়ে কোনো পুরুষকে হত্যা করত, তাহলে সেই মৃত পুরুষের জ্বলন্ত চিতায় খুনী গণিকাকেও পুড়িয়ে মারার বিধান রেখেছিলেন অর্থশাস্ত্রের স্রষ্টা।
ভারতের প্রাচীন গ্রন্থাবলিতে, বিশেষ করে ৩৬টি পুরাণ, রামায়ণ, মহাভারতে প্রচুর বেশ্যার উল্লেখ পাওয়া যায়, যাঁরা “স্বর্গবেশ্যা” হিসাবে বিশেষ পরিচিত। যেমন – বিশ্বাচী, পঞ্জিকাস্থলা, সরলা, বিদ্যুৎপর্ণা, উর্বশী, মেনকা, রম্ভা, তিলোত্তমা, ঘৃতাচী, সুকেশী, মঞ্জুঘেষা, অলম্বুষা, বিদ্যুৎপর্ণা, সুবাহু, সুপ্রিয়া উল্লেখযোগ্য। – এরকম কয়েক ডজন স্বর্গবেশ্যার নাম আমরা পাই। সংস্কৃত শব্দ অপ্ ( বাংলা অর্থ জল) হতে এদের উৎপত্তি তাই এদের অপ্সরা বলা হয়। আসলে এরাই স্বর্গবেশ্যা বলে পরিচিত।এরা নৃত্যে-সংগীতে পারদর্শী ছিলেন। এই কারণেই প্রাচীন সাহিত্যে এদের ইন্দ্রের সভা গায়িকা ও নর্তকী হিসাবে দেখা যায়। অপ্সরাদের অধিপতি ছিলেন কামদেব। অপ্সরা বা স্বর্গবেশ্যাদের সংখ্যা মোটামুটি ৬০ কোটি।দেবাসুরের সমুদ্র স্নানের সময়ে এরা সমুদ্রের ভিতর থেকে অসংখ্য নারীর সঙ্গে উঠে আসেন। কিন্তু কোনো দেবতা ও দানবই তাদের গ্রহণ করতে রাজি হননি, কিন্তু পণ্য হতে কারোর বাধা ছিল না। প্রভাবশালী মানুষদের যৌনসুখ বিতরণ করে তাঁদের বিভ্রান্ত করাই ছিল এদের একমাত্র কাজ। তথাকথিত দেবতারা যখনই আসন্ন বিপদের গন্ধ পেতেন তখনই এইসব পরমা সুন্দরী বেশ্যানারীদের কাজে লাগাতেন।এরা মুনি-ঋষিদের ধ্যান নষ্ট করতেন। কিন্তু কেন দেবতারা এই বেশ্যাদের মুনি-ঋষিদের বিবশ করার কাজে লাগাতেন ? কারণ হল বৈদিক যুগে কঠোর তপস্যার বলে কোনো কোনো ক্ষেত্রে মুনি-ঋষিরা দেবতাদের চাইতেও বেশি ক্ষমতাশালী হয়ে পড়ার সম্ভাবনা ছিল। যাতে তারা দেবতাদের চেয়ে বেশি ক্ষমতাশালী হয়ে উঠতে না পারে তাই তারা বেশ্যাদের লেলিয়ে দিতেন। শকুন্তলার জন্ম হয় বিশ্বামিত্র নামক ঋষির ধ্যানভঙ্গের কারণে। হিন্দু ধর্ম মতে ব্রাহ্মণগণ কঠোর তপস্যার ফলে দেবতা পর্যায়ে চলে যেতে পারতেন। বিশ্বমিত্র ঠিক তেমনই একজন ব্রাহ্মণ, কিন্তু তার উপর দেবতা ইন্দ্র সন্তুষ্ট ছিলেন না। তাই দেবতা ইন্দ্র তাকে ঈর্ষা করতেন, ইন্দ্র অনেক সময় তাকে ভয়ও করতেন। কারণ তিনি যদি দেবতাতুল্য হয়ে যান তবে ইন্দ্রের স্বর্গরাজ্যে এসে বিশ্বমিত্র হানা দিতে পারেন। দেবতা ইন্দ্র তার এই তপস্যা ভঙ্গের জন্য ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন। আর এই ষড়যন্ত্রে ইন্দ্র স্বর্গবেশ্যা মেনকাকে হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করেন। বিশ্বমিত্রের তপস্যাতে দেবতারা উদবিগ্ন হয়ে পড়লে তার ধ্যান ভঙ্গ করার জন্য দেবতারা মেনকাকে পাঠায় । পবনদেবের প্ররোচনায় মেনকার শরীর থেকে সমস্ত বস্ত্র খুলে পড়ে। নৃত্যরত নগ্ন মেনকার রূপ-যৌবনে মুগ্ধ হয়ে বিশ্বমিত্রের ধ্যান ভঙ্গ হয়ে যায় এবং সংযম হারিয়ে বিশ্বামিত্র মেনকার সঙ্গে যৌনমিলনে লিপ্ত হয়, ফলে শকুন্তলার জন্ম হয়।
রম্ভা স্বর্গবেশ্যাদের মধ্যে অন্যতম। রম্ভাকে নিয়ে বেশ কয়েকটি মিথ পাওয়া যায় পৌরাণিক গ্রন্থগুলিতে।এগুলির মধ্যে অন্যতম হল — (১) রম্ভা কুবেরের পুত্র নবকুলের নিকট অভিসার গমন কালে রাবণ তাকে দেখে কামমুগ্ধ হয়ে পড়েন। তাই রাবণ তাকে ধর্ষণ করেন। রম্ভা নবকুলকে এই ঘটনা বললে নবকুল রাবণকে অভিশাপ দেন, যদি রাবণ কোন নারীর অনিচ্ছায় তার প্রতি বল প্রয়োগ করে ধর্ষণ করতে গেলে রাবণের মাথা সাত খন্ডে বিভক্ত হয়ে যাবে। এই জন্যই সীতা রাবণ কর্তৃক অপহৃত হয়েও নিজের সতীত্ব রক্ষা করতে পেরেছিলেন।(২) একবার ইন্দ্র বিশ্বমিত্রের তপস্যা ভঙ্গ করার জন্য অপ্সরা রম্ভাকে প্রেরণ করেন। কিন্তু বিশ্বমিত্রের অভিশাপে রম্ভা শিলাতে পরিণত হয়ে ১০০০ বছর অস্থান করেন।রম্ভা যখন বিশ্বমিত্রের আশ্রমে শিলারূপে বাস করছিলেন তখন অঙ্গকার নামে একজন রাক্ষসী সেখানে নানা উপদ্রব করতে আরম্ভ করেন। তখন ওই আশ্রমে তপস্যারত শ্বেমুনি বায়ব্য অস্ত্রে ওই শিলাখণ্ড দুই ভাগে ভাগ করে রাক্ষসকে উদ্দেশ্য করে নিক্ষেপ করেন। অস্ত্রের ভয়ে ভীত হয়ে রাক্ষসী পলায়ন করে কপিতীর্থে এলে তার মাথায় সেই শিলা খণ্ড পড়ে রাক্ষসের মুত্যু হয়। এই শিলাখণ্ড কপিতীর্থে নিমগ্ন হলে রম্ভা আবার নিজের রূপ ফিরে পান।(৩) ইন্দ্র সভায় নৃত্যকালে রম্ভার তালভঙ্গ হয়। তখন ইন্দ্র ক্রদ্ধ হয়ে রম্ভাকে অভিশাপ দেন, রম্ভা স্পন্দনহীন বিকলাঙ্গ হয়ে ভূতলে পতিত হন। পরে নারদের পরামর্শে শিবের পুজো করে পুনরায় স্বর্গে ফিরে যান।(৪) ইন্দ্রের আদেশে রম্ভা জাবালি মুনির তপোভঙ্গ করেন। মুনির ঔরসে রম্ভার এক কন্যা জন্মগ্রহণ করে। জাবালি এই কন্যার প্রতিপালন করেন; এই কন্যার নাম ফলবতী।
তিলোত্তমা দৈত্যরাজ নিকুম্ভের দুই পুত্র সুন্দ ও উপসুন্দ ব্রহ্মার কঠোর তপস্যা করে ত্রিলোক বিজয়ের জন্য অমরত্ব প্রার্থনা করেন। কিন্তু ব্রহ্মা এদের অমরত্বের বরদান করতে সম্মত হননি। তবে তিনি বলেন যে, স্থাবর-জঙ্গমের কোনো প্রাণী তাদের ক্ষতি করতে পারবে না। যদি এদের মৃত্যু হয় তবে পরস্পরের হাতেই হবে। এই বর পাওয়ার পর তারা দেবতাদের উপর নিপীড়নে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। তখন দেবতারা প্রাণ রক্ষা করার জন্য ব্রহ্মার নিকট প্রার্থনা করেন এদের নিকেশ করার জন্য। ব্রহ্মা এদের নিকেশ করার জন্য পরমা সুন্দর এক রমণীর সৃষ্টি করলেন। ত্রিভুবনের সমস্ত উত্তম জিনিস তিল তিল করে সংগ্রহ করে ব্রহ্মা এক অতুলনীয়া নারী সৃষ্টি করেন। তিল তিল সুন্দর বস্তু মিলিত হয়ে এই সুন্দরী সৃষ্টি হয়েছিল বলে এর নাম হয় তিলোত্তমা। তিলোত্তমাকে সৃষ্টির পর ব্রহ্মা সুন্দ ও উপসুন্দরের নিকট পাঠিয়ে দেন। স্বর্গবেশ্যা তিলোত্তমা এদের দুজনের সামনে নগ্ন হয়ে নৃত্য করতে থাকে। সুন্দ ও উপসুন্দ তিলোত্তমার রূপে মুগ্ধ হয়ে তাকে পাওয়ার জন্য পরস্পর যুদ্ধে লিপ্ত হন। ফলে একে অন্যের হাতে নিহত হন।
উর্বশীও একজন পরমা সুন্দরী স্বর্গবেশ্যা। অভিশাপের ফলে উর্বশী মানুষরূপে জন্ম নেন। স্বর্গবেশ্যা উর্বশীকে দেখে বুধপুত্র পুরূরবা প্রেমাসাক্ত হয়। দুজন দুজনের প্রেমে মগ্ন। উর্বশীকে ছাড়া পুরূরবার চলে না। উর্বশী কয়েকটি শর্তে পুরূরবাকে বিয়ে করতে রাজি হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য শর্তটি হল — উর্বশী যেন কোনো দিন স্বামী পুরূরবাকে নগ্ন অবস্থায় না দেখেন।যদি দেখেন তবে সেদিনই উর্বশী পুরূরবাকে ত্যাগ করবেন। পুরূরবা উর্বশীর সকল শর্ত মেনে নিয়ে বিয়ে করে। সুখেই তাদের দিন কাটছিল। এদিকে স্বর্গের দেবতারা উর্বশীকে ফিরিয়ে আনতে উঠেপড়ে লাগলেন। এক রাতে বিশ্বাবসু উর্বশীর প্রিয় দুটি মেষ চুরি করেন। পুরূরবা মেষদুটি উদ্ধার করতে সম্পূর্ণ নগ্ন অবস্থাতেই বিছানা থেকে দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। ঠিক তখনই বিদ্যুতের প্ররোচনায় রাতের অন্ধকার ক্ষণিকের জন্য দূর হয়, সেই ক্ষণকালেই উর্বশী চোখের সামনে নগ্ন পুরূরবা প্রকট হয়ে পড়ে। শর্তমতে তখনই উর্বশী পুরূরবাকে ত্যাগ করে অদৃশ্য হয়ে যান। শোকাহত পুরূরবা পাগলের মতো উর্বশীর সন্ধানে দেশবিদেশে ঘুরে-বেড়ায়। অনেকদিন পর অবশ্য সে অপ্সরারূপে উর্বশীর দেখা পায়। চরিত্রবান পুরূরবা বর হিসাবে উর্বশীর সঙ্গে পুরো জীবন কাটাতে ইচ্ছা প্রকাশ করলে দেবতারা তাঁর ইচ্ছা পূরণ করেন এবং স্বর্গলোকে স্থান দেন।
স্বর্গের আরও একজন প্র্রসিদ্ধ স্বর্গবেশ্যা ঘৃতাচী। ইনি ইন্দ্রের আদেশে নিজের নগ্ন রূপ দেখিয়ে বহু মুনিদের তপস্যা ভঙ্গ করেছেন। ঘৃতাচীকে দেখে ভরদ্বাজ ঋষির শুক্র স্খলিত হওয়ায় দ্রোণের জন্ম হয়। তাই দ্রোণের মাতা না হলেও তাঁর জন্মের মূলে ছিলেন ঘৃতাচী। চ্যবন ও সুকন্যার পুত্র প্রমতির সঙ্গে ঘৃতাচীর মিলনে রুরুর জন্ম হয়। একবার ব্যাসদেব সুমেরু পর্বত থেকে নিজ আশ্রমে ফিরে একবার যখন হোমের আয়োজন করছিলেন, সে সময় ঘৃতাচী উপস্থিত হন। ঘৃতাচীকে দেখে ইনি অত্যন্ত কামাবিষ্ট হন। ব্যাসদেবের এরূপ অবস্থা দেখে ঘৃতাচী শুকপাখির রূপ ধরে পলায়ন করেন। কিন্তু ব্যাসদেবের প্রবল কামনার কারণে তাঁর বীর্যস্খলন হয় এবং তা অরণির উপর পতিত হয়। ব্যাসদেব উক্ত অরণি মন্থন করতে থাকলে একটি পুত্রের জন্ম হয়। ঘৃতাচী শুক পাখির রূপ ধরে পলায়ন করেছিলেন বলে ব্যাসদেব এর নাম রাখেন শুক।
এইসব বেশ্যারা ছিলেন অনন্তযৌবনা, তাই “দেবরাজ” ইন্দ্র গুপ্তচরবৃত্তি এবং গুপ্তহত্যার কাজে নিয়োগ করতেন। রামায়ণে তো প্রচুর বেশ্যা এবং গুপ্তচর বৃত্তির কাজে রূপাজীবা নিয়োগের কথা উল্লেখ আছে। রামচন্দ্রের অভিষেকের সময় প্রচুর বেশ্যা অংশগ্রহণ করেছিল। রামায়ণের যুগে বিশিষ্ট অভ্যাগতদের অভ্যর্থনায় এ রাজপরিবারের মানুষদের মৃগয়ায় বেশ্যা বা গণিকাদের নিয়োগপ্রথা চালু ছিল। গণিকা কর্তৃক ঋষ্যশৃংগের প্রলোভন আখ্যান রামায়ণে সুখ্যাত হয়ে আছে। মহাভারতের যুগে “বিষকন্যা” নামক এক শ্রেণির সুন্দরী গণিকাদের কথা জানা যায়। এরা খুনে গুপ্তচর বাহিনীর সক্রিয় সদস্য ছিলেন। কাজ ছিল – যৌনসম্ভোগকালে ওষ্ঠ-চুম্বনে অথবা দন্ত দংশনে এরা হত্যার জন্য প্রেরিত ব্যক্তির শরীরে বিষ ঢেলে দিত। সেই ব্যক্তি জ্ঞান হারালে তাকে নির্মমভাবে হত্যা করত এবং পুরুষাঙ্গটিও কেটে ফেলা হত। বিষকন্যা গণিকাদের সবচেয়ে বেশি আধিক্য দেখা যায় ভারতবর্ষে মৌর্য সাম্রাজ্যের সময়। বিশাখদত্তের “মুদ্রারাক্ষস” নাটকের প্রথম ও দ্বিতীয়াংশে এক বিষকন্যার উল্লেখ আছে, যে নন্দরাজের মন্ত্রী রাক্ষস নিয়োগ করেছিলেন চন্দ্রগুপ্ত (মৌর্য)-কে হত্যা করার নিমিত্তে। এহেন বিষকন্যারা একাধারে বহুপুরুষগামী, অপরদিকে হত্যাকারীও।
মহাভারতের যুগে এমন জনা পাঁচেক বিখ্যাত মুনিঋষির নাম উল্লেখ করা যায়, যাঁরা “স্বর্গবেশ্যা”-দের দেখে কামার্ত হয়ে তাঁদের সঙ্গে যৌন-সংসর্গে মিলিত হয়েছিলেন। বিশ্বামিত্র, শরদ্বান, ভরদ্বাজ, ব্যাস, বশিষ্ঠ, পরাশর, দীর্ঘতমা – এরাই সেইসব গুণধর ! মহাভারতের যুগে অপরাপর সম্মানজনক বৃত্তিগুলির মধ্যে গণিকাবৃত্তিই ছিল অন্যতম। রাজদরবারে ও বিবিধ রাজকীয় অনুষ্ঠানে গণিকাদের উপস্থিতি ছিল অপরিহার্য। এরা মনোহর রত্ন সোনা ও মণিমু্ক্তাখচিত অলংকারাদি ও মহামূল্য পোশাকে আচ্ছাদিত হয়ে তাঁরা রাজপথে অবাধে বিচরণ করতেন। যে-কোনো অনুষ্ঠান ও শোভাযাত্রার আয়োজন হলে পুরোভাগে বস্ত্রালংকারে শোভিত সুন্দরী বেশ্যারা থাকতেন।
শুধু সুরলোকেই নয়, দেবলোকেও বেশ্যাদের প্রয়োজনীয়তা ছিল যথেষ্ট, উপস্থিতিও ছিল লক্ষ্যণীয়। মহাভারতে ত্বষ্টা নামক এক ঋষির কথা জানা যায়। ত্বষ্টার পুত্র ছিলেন ত্রিশিরা। ত্রিশিরা ছিলেন একাধারে মদ্যপ এবং নিষ্ঠাবান ধার্মিক। তাঁর উদ্দেশ্য স্বর্গজয়। স্বভাবতই স্বর্গরাজ ইন্দ্রের ভয়ের কারণ হল ত্রিশিরা। উপায় খুঁজতে বেশ্যাদের শরণাপন্ন হলেন ইন্দ্র। ত্রিশিরার তপস্যা ভঙ্গ করতে সুন্দরী বেশ্যাদের কাজে লাগালেন দেবরাজ ইন্দ্র। মহাভারতের যুগে সমরসম্ভারের সঙ্গে সৈন্যশিবিরে সুন্দরী বেশ্যাদেরকেও স্থান দেওয়া হত। সেনাদের একঘেয়েমি নিবারণ ও আনন্দদানের জন্য সেনাশিবিরে এদের মজুত রাখা হত। যুযুধান দুই পক্ষ পাণ্ডব ও কৌরব সেনাশিবিরে অসংখ্য সৈন্যদের বিনোদন ও মনোরঞ্জনের জন্য শত সহস্র বেশ্যা নিয়োগ করা হয়েছিল। পাণ্ডব সেনাশিবিরে যে সব সুন্দরী “বেশস্ত্রী” অর্থাৎ বেশ্যাদের নিয়োগ করা হয়েছিল তাঁদের সুযোগসুবিধা যা কিছু দেখভালের দায়িত্ব সবই ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের উপরই ন্যস্ত ছিল। রামায়ণের রামচন্দ্রের জন্য যে স্বতন্ত্র সৈন্যবাহিনী গঠন করেছিলেন সেই বাহিনীতে বিবিধ সমরসম্ভারেও অজস্র যৌবনবতী বেশ্যাদের নিয়োগ করা হয়েছিল।
প্রাচীন যুগে বেশ্যাদের বিবরণ বর্ণনা করতে চাইব অথচ বাৎস্যায়নে “কামসূত্রম্” উল্লেখ করব না, তা হয় নাকি ! সবার আগে সংক্ষেপে জেনে নিই কী আছে বাৎস্যায়নের “কামসূত্রম্”-এ। আছে নরনারীর কামকলার যাবতীয় তথ্য, এবং প্রয়োজনীয় সমস্ত কিছুর বিশদ বর্ণনা। আছে লিঙ্গের দৈর্ঘ্য ও যোনির বিস্তার অনুসারে নরনারীর প্রকারভেদ, স্বভাব অনুসারে নারীর বৈশিষ্ট্য-চুম্বন-আলিঙ্গনাদি, স্তনমর্দন, দংশনক্ষত, নখক্ষত, যৌনমিলনের বিভিন্ন ভঙ্গি তথা আসন এবং প্রয়োগবিধি, পত্নী নির্বাচন, পত্নী এবং উপপত্নীর লক্ষণ, পরস্ত্রীকে বশীভূত করার উপায়, কৃত্রিম লিঙ্গের ব্যবহার, যোনির বিস্তৃতি এবং সংকোচনের উপায়, বিভিন্ন প্রকার বিবাহ, পরস্ত্রীর সঙ্গে যৌনমিলন, রতিক্রিয়ার উপযুক্ত স্থান প্রভৃতি। এই “কাম-সূত্রম্”-এর ‘বৈশিক’ নামে একটি বিস্তৃত অধিকরণে প্রাচীনকালে ভারতীয় বেশ্যাদের জীবনযাত্রার একটি সুস্পষ্ট এবং সম্পূর্ণ বিবরণ পাওয়া যায়। এই বিবরণ থেকেই সাধারণের মনে বেশ্যাদের সম্পর্কে যে অবজ্ঞা, ঘৃণা এবং অশ্রদ্ধার বিরূপ ধারণা আছে বাৎস্যায়নের উল্লিখিত বেশ্যাদের জীবনযাত্রার বর্ণনা হৃদয়ঙ্গম করলেই সেই বধ্যমূল ধারণার বদল হতে পারে।
বাৎস্যায়ন বেশ্যাদের পরিচয় দিতে গিয়ে কাম-সূত্রমের চতুর্থ অধিকরণের প্রথম অধ্যায়ের প্রথম শ্লোকে বলেছেন – “বেশ্যানাং পুরুষাধিগমে রতিবৃত্তিশ্চ সর্গাৎ”। অর্থাৎ, “বেশ্যাদের পুরুষ-ধরা বিদ্যা এবং অর্থ উপার্জন সেই সৃষ্টির আদিকাল থেকে চলে আসছে”। দ্বিতীয় শ্লোকে বলেছেন, “রতিতঃ প্রবর্তনং স্বাভাবিকং কৃত্রিমমর্থার্থম্”। অর্থাৎ, রুচি হল রতির প্রতিশব্দ। রুচি থেকে যে পুরুষ গ্রহণে প্রবৃত্তি সেটা স্বাভাবিক, আর তা থেকে বেশ্যাদের যে অর্থোপার্জন প্রবৃত্তি সেটা কৃত্রিম”। এবার বেশ্যাদের উদ্দেশে তৃতীয় শ্লোকটি পড়ুন, “তদপি স্বাভাবিকবদ্রূপরেৎ। কামপরাসু হি পুংসাং বিশ্বাসযোগাৎ”। অর্থাৎ, “তুমি যে পুরুষের কাছে ছল করছ, সেটা যেন বুঝতে না পারে। এমন ভাব দেখাবে যে তুমি তাকে ভালোবাসো, তাঁর অনুরাগিণী — এরকম হলে পুরুষ তোমার হাতের মুঠোয় এসে যাবে”। ষষ্ঠ শ্লোকে উল্লেখ হয়েছে – “ন চানুপায়েনার্থান সাধয়েদায়তিসংরক্ষণার্থম্”। অর্থাৎ, “পুরুষের কাছে অর্থ উপার্জন করবে, কিন্তু খুব কৌশলে”। বাৎস্যায়ন পইপই করে বলেছেন কোন্ কোন্ পুরুষ একজন বেশ্যার কাছে চরম কাম্য হওয়া আবশ্যক। অর্থাৎ সাদা বাংলায় বেশ্যারা কোন্ কোন্ পুরুষদের সঙ্গ দিলে মোটা অঙ্কের অর্থ আমদানি হবে। যেমন – (১) ধনী অথচ স্বাধীন যুবক, (২) যে ব্যক্তি প্রজাদের কাছ থেকে শুল্কাদি আদায় করে, (৩) ধনীক শ্রেণির যৌন বিকৃত বৃদ্ধ, (৪) সংঘর্ষবান, অর্থাৎ এক বেশ্যাকে নিয়ে দুজন ধনীর প্রতিদ্বন্দ্বীর কে কত টাকা দিয়ে তাকে নিতে পারে, (৫) সবসময় যাদের হাতে টাকা আসে। যেমন – সুদখোর, কুসীদজীবী ইত্যাদি, (৬) যে পুরুষ দেখতে কালো কুৎসিত, অথচ নিজেকে সে রূপবান এবং রমণীরঞ্জন মনে করে, (৭) আত্মশ্লাঘার বড়াই করে, এমন ব্যক্তির কাছ থেকে টাকা আদায় করা খুব সহজ, (৮) ধনী, অথচ ধ্বজভঙ্গ বা নপুংসক পুরুষ, (৯) বাপ-মায়ের অনাদরের ছেলে, (১০) সঙ্গদোষে দুষ্ট যুবক ইত্যাদি।
এমনকি কোন্ পুরুষদের সঙ্গে বেশ্যারা যৌনমিলন করবেন না, তারও কিছু নির্দেশিকা বাৎস্যায়ন দিয়েছেন। যেমন – (১) যক্ষ্মারোগ হয়েছে এমন পুরুষ, (২) কুষ্ঠরোগাক্রান্ত পুরুষ, (৩) যে ব্যক্তির শুক্রের সঙ্গে ক্রিমি জাতীয় একপ্রকার ক্ষুদ্র কীট থাকে, যা নারীর যোনির ভিতর দিয়ে জরায়ুতে পৌঁছে নারীকে জরাগ্রস্ত করবে, (৪) কঠোর ও কর্কশ ভাষী, (৫) কঞ্জুষ বা কৃপণ, (৬) নির্ঘৃণ, (৭) গুরুজনের পরিত্যক্ত পুরুষ, (৮) চোর, (৯) বিশ্বাসঘাতক, (১০) যে পুরুষের মুখে দুর্গন্ধ, (১১) যে পুরুষ বশীকরণ জানে, (১২) বঞ্চক ইত্যাদি।
সব ঠিক থাকলে একজন বেশ্যা (“বর্তমানং নিষ্পীড়িতার্থমুৎসৃজন্তী বিশীর্ণেন সহ সন্দধ্যাৎ”) একজন পুরুষের অর্থ নিঃশেষ করে ছিবড়ে করে তারপর আর-একজন অর্থবান পুরুষকে পাকড়াও করবে(কাম-সূত্রম ৪/৩/১)। বাৎস্যায়ন মনে করেন, একজন বেশ্যাকে বিভিন্ন রুচির যুবক এবং প্রৌঢ় ব্যক্তির সঙ্গ দিতে হবে। যদি ধনবান হয়, প্রয়োজনে বৃদ্ধের সঙ্গেও শুতে হবে বৃত্তির তাগিদে। এমনকি বেশ্যাদের কামশাস্ত্রে পারদর্শিতা লাভ করতে হলে সবার আগে ৬৪ কলায় নিপুণতা লাভ করতে হবে। প্রসঙ্গক্রমে ৬৪ কলাগুলি জেনে নিতে পারি – (১) সংগীত, (২) বাদ্য, (৩) নৃত্য, (৪) অঙ্কন, (৫) তিলক-কাটা (সেই সময়ে ললাটে-কপোলে-স্তনে, এমনকি নাভি ও হাতে-পায়ে তিলক কাটার রীতি ছিল), (৬) তণ্ডুল-কুসুম-বলি-বিকারের ব্যবহার, (৭) পুষ্পাস্তরণ ( যে বিছানায় যৌনক্রিয়া চলবে সেটি ফুল দিয়ে সাজিয়ে রাখতে হবে), (৮) দশনবসনাঙ্গরাগ (নিজের দেহবল্লরী চিত্রিত করতে হবে), (৯) মণিভূমিকাকর্ম, (১০) শয়ন রচনা (ঋতু অনুসারে শোওয়ার বিছানা প্রস্তুত এবং সাজাতে হবে), (১১) উদকবাদ্য, (১২) উদকঘাত, (১৩) চিত্রযোগ, (১৪) মালা-গ্রন্থন-বিকল্প (মালা গাঁথা এবং তা দিয়ে সাজাতে হবে শরীর), (১৫) শেখরকাপীড়যোজন, (১৬) নেপথ্য প্রয়োগ, (১৭) কর্ণপত্রভঙ্গ, (১৮) গন্ধযুক্তি, (১৯) ভূষণযোজন, (২০) ঐন্দ্রজাল, (২১) কৌচমার যোগ, (২২) হস্তলাঘব (হাত-সাফাই বিদ্যা), (২৩) বিচিত্রশাক-যূষ-ভক্ষ-বিকার-ক্রিয়া, (২৪) সূচিবানকর্ম, (২৫) সূত্রক্রীড়া, (২৬) বীণা-ডমরুক-বাদ্য, (২৭) প্রহেলিকা, (২৮) প্রতিমালা, (২৯) দুর্বাচক যোগ, (৩০) পুস্তকবাচন, (৩১) নাটকাখ্যায়িকা, (৩২) কাব্য-সমস্যা-পূরণ, (৩৩) পট্টিকা-বেত্র-বাণ-বিকল্প, (৩৪) তক্ষকর্ম, (৩৫) তক্ষণ, (৩৬) বাস্তুবিদ্যা, (৩৭) রৌপ্যরত্ন পরীক্ষা, (৩৮) ধাতুবাদ, (৩৯) মণিরাগাকর জ্ঞান, (৪০) বৃক্ষায়ুর্বেদযোগ, (৪১) মেষকুক্কুট-লাবক-যুদ্ধবিধি, (৪২) শুকসারিকা প্রলাপন, (৪৩) শরীর মর্দন, কেশ মর্দনাদির কৌশল, (৪৪) অক্ষরমুষ্টিকাকথন, (৪৫) ম্লেচ্ছিত-বিকল্প, (৪৬) নানা প্রাদেশিক ভাষায় জ্ঞান, (৪৭) পুষ্পশকটিকা, (৪৮) নিমিত্তজ্ঞান, (৪৯) যন্ত্রমাতৃকা, (৫০) ধারণমাতৃকা, (৫১) সংপাঠ, (৫২) মানসী, (৫৩) কাব্যক্রিয়া, (৫৪) অভিধানকোষ, (৫৫) ছন্দপাঠ, (৫৬) ক্রিয়াকল্প, (৫৭) ছলিতকযোগ, (৫৮) বস্ত্রগোপন, (৫৯) দ্যূতবিশেষ, (৬০) আকর্ষক্রীড়া, (৬১) বালক্রীড়নক, (৬২) বৈনয়িকী বিদ্যা, (৬৩) বৈজয়িকী বিদ্যা, (৬৪) বৈয়ামিকী বিদ্যা।বাৎস্যায়ন চৌষট্টি বা চতুঃষষ্টি কলায় সুশিক্ষিত বেশ্যার উদ্দেশে বলেছেন – “আভিরভূচ্ছ্রিতা বেশ্যা শীলরূপগুণান্বিতা।/লভতে গণিকাশব্দং স্থানঞ্চ জনসংসদি”।।
বাৎস্যায়নের সময় বেশ্যাদের বিয়ের মধ্যে এক অভিনব ব্যাপার ছিল। আর পাঁচটা সাধারণ মেয়েদের মতো তাঁদেরও বিয়ে-থা, সন্তান জন্মদান, ঘর-সংসার করতে পারত। তবে কোনো বেশ্যাকেই বিয়ের পর পুরোনো বেশ্যাবৃত্তিকে ত্যাগ করতে হত না। এমনকি স্বামীর দিক থেকেও বেশ্যা-স্ত্রীর বেশ্যাবৃত্তির বিরুদ্ধে অভিযোগ করত না।অবশ্য বিয়ের পর প্রথম একটা বছর স্বামী ছাড়া অন্য কোনো পুরুষের সঙ্গে যৌনমিলন করা নিষিদ্ধ ছিল।বিয়ের এক বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর বেশ্যাবৃত্তিতে আর কোনো বাধা ছিল না।তবে সেক্ষেত্রে শর্ত একটাই – এক বছর পর স্বামী যে রাতে তাঁকে যৌনমিলনের নিমিত্ত বিছানায় আহ্বান করবে সেই মুহূর্তে শত খরিদ্দার ত্যাগ করে সেই রাতে তাঁকে স্বামীর সঙ্গে যৌনকর্মে লিপ্ত হবে(কাম-সূত্রম্ ৭/১/২২)।
বাৎস্যায়ন শেষ করব বেশ্যাদের একটি বিপজ্জনক অপকর্ম দিয়ে – এইসব বেশ্যা বা গণিকারা চতুরতার সাহায্যে মাঝে মধ্যেই শাঁসালো ধনীর ছেলে বা যুবক খুঁজে তাঁর কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায় করত। কীসের ক্ষতিপূরণ ? গণিকা বা বেশ্যারা তাঁর কোনো সখি বা দাসীর সাহায্যে তাঁর অক্ষতযোনি কন্যার যোনিদেশে সীসা-লৌহাদি নির্মিত কৃত্রিম লিঙ্গ প্রবেশ করিয়ে সতীচ্ছদ ছিন্ন করে ক্ষতের সৃষ্টি করত। এরপর ওই যোনি-বিধ্বস্ত মেয়েকে পাখি-পড়া পড়িয়ে মুখিয়ার দরবারে কিংবা বিচারালয়ে পূর্বে নির্দিষ্ট যুবকের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করা হত এবং বেশ মোটা অঙ্কের ক্ষতিপূরণ আদায় করে নিত (কাম-সূত্রম্ ৭/১/২০)।
মহাকবি কালিদাসের মহাকাব্যগুলিতেও বেশ্যানারীর উল্লেখ আছে। বিশেষ করে “মেঘদূতম্”-এ। তবে “বিক্রমোর্ব্বশীয়ম্” নাটকে মহাকবি যে উর্বশীকে নায়িকা করেছেন তিনি একজন বহুভোগ্যা বেশ্যারমণী। অবশ্যই উর্বশী ছিলেন তথাকথিত “স্বর্গবেশ্যা”।“নীচৈরাখ্যং গিরিমধিবসেস্তত্র বিশ্রামহেতোস্ত্বৎসম্পকাৎ পুলকিতমিব প্রৌঢ় পুষ্পৈঃ কদম্বৈ।।/যঃ পণ্য স্ত্রী রতিপরিমলোদগারিভির্ন্নাগরানামুদ্দামানি প্রথয়তি শিলাবেশ্মভির্যোবনানি”।।– এই শ্লোকটি মহাকবির বিরচিত “মেঘদূতম্”-এর পূর্বমেঘের ২৫ অংশ থেকে উল্লেখ করা হল।
শুধু কালিদাস কেন, বিশাখদত্তের “মুদ্রারাক্ষসম্” গ্রন্থ থেকে জানা যায় – সেকালের গণিকাদের সঙ্গে রাজা সাধারণ মানুষের সম্পর্ক কাহিনি বর্ণিত আছে। সেকালের গণিকারা যে নানা বসনেভূষণে অলংকৃত হয়ে রাজপথ শোভাবর্ধন করতেন তারও উল্লেখ আছে। শ্রীধরদাস তাঁর “সদুক্তির্ণামৃত” গ্রন্থে তৎকালীন বঙ্গদেশের বেশ্যাদের বিবরণ দিয়েছেন। এখানে “তৎকালীন” বলতে দ্বাদশ শতক বুঝতে হবে। শ্রীধরদাস বলেছেন “বেশঃ কেষাং ন হরতি মনো বঙ্গ বারাঙ্গনানাম্”।নবম শতকে রচিত “কুট্টনীমত” গ্রন্থে দামোদরগুপ্ত বলেছেন, সেকালের বারানসী নগরীতে মালতী নামে গণিকা বাস করত। সে গণিকা সংক্রান্ত নানা প্রয়োজনীয় উপদেশ নিতে বিকরবালা নাম্নী এক বৃদ্ধা গণিকার কাছে যেতেন। “কুট্টনীমত”-ই বৃদ্ধা গণিকার উপদেশ সংবলিত গ্রন্থ।ভবভূতির “মালতীমাধব”-এ ব্রাহ্মণ মাধব সিংহলে বাণিজ্য করে প্রভূত সম্পদশালী হন। এরপর কুবলয়াবলি নাম্নী এক সুন্দরী গণিকার প্রেমে পড়েন এবং যৌনমিলন কার্য সম্পাদন করেন। ব্রাহ্মণের মোহাবিষ্টতার সুযোগ নিয়ে সেই বেশ্যারমণী তাঁর সমস্ত সম্পত্তি হাতিয়ে নেয়। পরে অবশ্য কুবলয়াবলিকে পাকড়াও করে নাক-কান কেটে প্রেমিকা মালতীর কাছে ফিরে যান মাধব। এই হল “মালতীমাধব”-এর উপজীব্য।সপ্তম শতকের লেখক বানভট্ট তাঁর “কাদম্বরী” গ্রন্থে জানিয়েছেন, সেকালে গণিকারা দেশের রাজাকে স্নান করাত। রাজার মাথায় আমলকী ঘষে দিত। স্নানের পর রাজার সারা শরীরে চন্দন, আতর, কুমকুম ইত্যাদি মাখিয়ে দিত।এমনকি রাজার পরনের যাবতীয় পোশাক বেশ্যারাই পরিয়ে দিতেন।“চারুদত্ত” গ্রন্থে লেখক ভাসের কাহিনি উপজীব্য হল চারুদত্ত ও বসন্তসেনার প্রেম। এখানে চারুদত্ত নামে জনৈক ব্রাহ্মণের সঙ্গে বেশ্যা বসন্তসেনার বিয়ে হয়। এছাড়া শর্বিলক নামে এক ব্রাহ্মণের সঙ্গে মদনিকা নামক বিয়ের কাহিনিও এই গ্রন্থে আছে।
মধ্যযুগের সাহিত্যেও বেশ্যা-বারাঙ্গনা ছিল। গোপীচন্দ্রের গান, ঘনরাম চক্রবর্তীর ধর্মমঙ্গল, দোনা গাজির সয়ফুলমুলক বদিউজ্জামাল, আবদুল হাকিমের লালমতি সয়ফুল মুল্লুক, শুকুর মাহমুদের গুপীচন্দ্রের সন্ন্যাস — এইসব নানা কাব্যপুথিতে বেশ্যা-সংস্কৃতির সরস বিবরণ রয়েছে। পাশ্চাত্য সভ্যতার জতুগৃহ প্রাচীন গ্রিকের এথেনাইয়ের কবি সোলোন , যিনি তৎকালীন গ্রিকের সাতজন জ্ঞানী লোকের একজন হিসেবে গণ্য হতেন, খ্রিস্টপূর্ব ছয় শতকে এথেন্সে প্রথম বেশ্যালয় স্থাপন করেন। এই বেশ্যালয়ের উপার্জন দিয়ে আফ্রোদিতিকে নিবেদন করে একটি মন্দির নির্মাণ করা হয়েছিল। মধ্যযুগে ইউরোপে ব্যাপকভাবে পতিতাবৃত্তি ছড়িয়ে পড়ে এবং পৌরসভার মাধ্যমে সমস্ত বেশ্যালয় পরিচালিত হতে থাকে।প্রাচীন গ্রিক ইতিহাসবিদ ও কূটনীতিক মেগান্থিনিস এক ধরনের পরিদর্শকের কথা বলেছেন, যারা রাজ্যের সকল কার্যক্রমের উপর বেশ্যাদের সহায়তায় নজর রাখতেন এবং রাজার কাছে গোপন রিপোর্ট দিতেন।
ধর্মীয় সংস্কার-আচার-প্রথা ও ‘পবিত্র পতিতা’-র জন্ম দিয়েছে। লোকজীবনে দেহসাধনার নামে যে অবাধ যৌনাচার চলে আসছে তাতে ভণ্ড পির, কামুক সাধু কিংবা বৈরাগী-বৈষ্ণবের আখড়াও বাদ যায় না। “তন্ত্রসার” গ্রন্থে ভুরি ভুরি বেশ্যার উল্লেখ আছে। এই গ্রন্থে বেশ্যারমণীদের চারভাগে ভাগ করা হয়েছে – যেমন (১) গুপ্তবেশ্যা : এই বেশ্যারা সাধারণত তন্ত্রসাধক বা তান্ত্রিকদের বংশজাতা হয়। এরা স্বভাবে নির্লজ্জ এবং অত্যধিক কামাসক্ত হন। এরা পশুভাবাপন্ন স্বামী বা পুরুষ পছন্দ করেন।(২) মহাবেশ্যা : এই মহাবেশ্যারমণীরা স্বেচ্ছায় শরীরের পোশাক ত্যাগ করে গুপ্ত-অঙ্গ প্রদর্শন করেন। (৩) রাজবেশ্যা : রাজবেশ্যারা স্বাধীনভাবে নগরে বিচরণ করণে এবং রাজার মতোই আচরণ করেন (৪) দেববেশ্যা : যে রমণী মন্ত্র উচ্চারণের সঙ্গে তান্ত্রিক-চক্রে অধিষ্ঠিতকালে যৌনমিলন সম্পাদনের মাধ্যমে গর্ভবতী হন, সেই নারীর গর্ভজাতা কন্যাই দেববেশ্যা নামে অভিহিত করা হয়।
নিরুত্তরতন্ত্রে আবার মোট ছয় প্রকারের বেশ্যার উল্লেখ আছে। যেমন – (১) গুপ্তবেশ্যা, (২) মহাবেশ্যা, (৩) কুলবেশ্যা, (৪) রাজবেশ্যা, (৫) ব্রহ্মবেশ্যা এবং (৬) মহোদয়া। এক্ষেত্রে বলা হয়েছে এইসব বেশ্যারা এক-একটি প্রসিদ্ধ তীর্থতুল্য।যেমন – গুপ্তবেশ্যারা অযোধ্যা তীর্থতুল্য, মহাবেশ্যারা মথুরা তীর্থতুল্য, কুলবেশ্যাগণ মায়া তীর্থতুল্য, রাজবেশ্যাগণ দ্বারকা ও অবন্তী তীর্থ তুল্য, ব্রহ্মবেশ্যাগণ দ্বারাবতী তীর্থতুল্য এবং মহোদয়া বেশ্যারা কালিকা তীর্থতুল্য।নিরুত্তরতন্ত্রে বলা হয়েছে, “স্ত্রী পুংসো সঙ্গমে সৌখ্যং জায়তে তং পরমং পদম্”।অর্থাৎ, স্ত্রী ও পুরুষের সঙ্গমে যে সৌখ্য বা আনন্দ তাই-ই পরমপদ বা ব্রহ্ম। সেই কারণেই তন্ত্র সাধনার ক্ষেত্রে ‘পঞ্চ ম-কার’ অপরিহার্য অঙ্গ। পঞ্চ ম-কার হল মদ্য, মাংস, মৎস্য, মুদ্রা এবং মৈথুন।“বিনা পীত্বা সুরাং ভুক্ত্বা মৎস্যমাংসং রজস্বলাং।/যো জপেদ্ দক্ষিণাং কালীং তস্য দুঃখ পদে পদে”।।– অর্থাৎ “যে বিনা মদ্যপানে, বিন মাছমাসং খেয়ে, বিনা যুবতী সম্ভোগে দক্ষিণা কালীর আরাধনা করবে তাঁর পদে পদে দুঃখ হবে”।
সম্প্রতি কর্ণাটক রাজ্যের দেবনগর জেলার উত্তরঙ্গমালা দুর্গা মন্দিরে রাতের বেলায় নারীদের দেবতার নামে ‘উৎসর্গ’ করার অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হচ্ছে – এই মর্মে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের আবেদনের ভিত্তিতে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন এক বেঞ্চ রাজ্যের মুখ্যসচিবকে ওই অনুষ্ঠান বন্ধ করার নির্দেশ দেন৷ এই কুপ্রথা কার্যত নারীদের যৌনশোষণ, যা নিষিদ্ধ করা হয় ১৯৮৮ সালে৷ আশা ছিল, এর ফলে দেবদাসীদের সামাজিক যৌনশোষণ বন্ধ হয়ে যাবে৷ কিন্তু তা হয়নি৷ এখনও ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে, বিশেষ করে দক্ষিণ ভারতে, মহারাষ্ট্রে, ওড়িশায় এবং গুজরাটে দেবতাকে উৎসর্গ করার নামে দেবদাসীদের প্রধানত দেহভোগের কাজে ব্যবহার করা হয়৷ দেবতা বা মন্দিরে উৎসর্গ করার পর তাঁদের পরিচয় হয় দেবদাসী৷ কোনো কোনো অঞ্চলে তাঁদের বলা হয় যোগিনী৷
প্রায় হাজার বছরের প্রাচীন এই প্রথা ধর্মীয় ও সামাজিক রীতিনীতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত৷ এর পেছনে আছে চরম দারিদ্র্য, জাতিভেদ এবং পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা৷ গরিব ঘরের মা-বাবা তাঁদের কুমারী মেয়েকে রজস্বলা হবার আগেই নিয়ে আসে মন্দিরে৷ প্রথমে কুমারী মেয়েদের নিলাম করা হয়৷ তারপর মন্দিরের প্রধান পুরোহিত উৎসর্গ করার নামে বিগ্রহের সঙ্গে কুমারী মেয়েদের তথাকথিত “বিয়ে” দিয়ে দেন৷ এরপর অন্য কোনো পুরুষ ওই মেয়েটির স্বামী হতে পারে না৷ খাওয়া-পরার বিনিময়ে মন্দিরে থেকেই তাঁদের সারাজীবন কাটে কায়িক পরিশ্রমের সঙ্গে মন্দিরের প্রধান পুরোহিত থেকে শুরু করে মন্দিরের অন্যান্য পুরুষদের যৌন লালসার শিকার হয়ে৷ কিংবা সমাজের উচ্চ বর্গীয় ধনী কিংবা সামন্ত প্রভুদের রক্ষিতার ভূমিকা পালন করতে হয়৷ মন্দিরের পূজারি ব্রাহ্মণ এবং সামন্ত-প্রভুদের যোগসাজশে কৃষক ও কারুশিল্পী বা কারিগরদের উপর ধর্মীয় প্রভাব খাটিয়ে দেবদাসীদের বেশ্যাবৃত্তিকে দেয়া হয় ধর্মীয় শিলমোহর৷ উৎসর্গের পর দেবদাসীকে ভোগ করার প্রথম অধিকার মন্দিরের প্রধান পুরোহিতের৷ এই সামজিক তথা ধর্মীয় প্রথার উৎপত্তির ইতিহাস নিয়ে নানা কাহিনি, বিতর্ক এবং বিভিন্ন মতবাদ প্রচলিত৷ এর ঐতিহাসিক বা পুরাতাত্ত্বিক উৎকীর্ণ আছে বিভিন্ন মন্দির গাত্রে৷ গুজরাটে প্রায় চার হাজার মন্দিরে ছিল প্রায় ২০ হাজার দেবদাসী, যাঁদের নাচনিও বলা হত৷
শাস্ত্রের পাশাপাশি ইতিহাসের সাক্ষ্যও দুর্লভ নয়। বাংলার তাম্রশাসন আমলের লেখমালায় সংগীত-নৃত্য পটিয়সী রাজনটী ওরফে রাজবেশ্যাদের পরিচয় মেলে। ধর্মীয় আচারের আড়ালেও আবার কখনো বেশ্যা ও বেশ্যাবৃত্তির জীবনযাপন করতে হয়েছে। দেবদাসী প্রথা তার একটি বড়ো দৃষ্টান্ত। কালীঘাটের পটচিত্রে বেশ্যাসম্ভোগের দৃশ্য যেমন আছে, তেমনই অনেক মন্দিরের গায়ে উৎকীর্ণ টেরাকোটাতেও এমন দৃশ্য মেলে। পাশ্চাত্য শিক্ষার আনুকূল্যে উনিশ শতক বাঙালি সমাজের সার্বিক উত্থানের কাল হয়ে উঠেছিল। অবশ্য এর পাশাপাশি সমাজ-অভ্যন্তরে অনাচারের একটি চোরাস্রোতও বহমান ছিল। ভুঁইফোঁড় নব্যধনী এবং সেই সঙ্গে শিক্ষিত সম্প্রদায়ের একাংশের মধ্যেও চারিত্রিক ভ্রষ্টাচার দেখা দেয়। এমনকি সমাজের নেতৃস্থানীয় খ্যাতিমান ব্যক্তিবর্গের কেউ কেউ এই নৈতিক স্খলন থেকে মুক্ত ছিলেন না। সুরাপান, বেশ্যাসক্তি ও রক্ষিতা-পোষণ সেকালে এক ধরনের সামাজিক স্বীকৃতি লাভ করেছিল। কোনো কোনো ক্ষেত্রে গণিকাচর্চা গৌরব ও মর্যাদার প্রতীক হিসাবে বিবেচিত হত।আঠারো-উনিশ শতকে কলকাতার নাগরিক জীবন এমনকি মফস্বল শহরেও গণিকাচর্চা জীবনযাত্রার অনিবার্য প্রয়োজনীয় অনুষঙ্গ হয়ে উঠে। নব্যবাবু সমাজে ‘বেশ্যাবাজি’ ছিল বাবুগিরির প্রধান অঙ্গ। আমাদের রথী-মহারথীদের কিছু নাম জেনে নেই যারা হামেশাই বেশ্যাবাড়ি যেতেন।ভারতপথিক রাজা রামমোহন রায় নিকির নাচ দেখেই সন্তুষ্ট ছিলেন না, বাঁধা রক্ষিতাও ছিল তাঁর।এই যবনী রক্ষিতার গর্ভে তাঁর একটি পুত্রও জন্মে ছিল।দ্বারকানাথ ঠাকুরের বাগান বাড়ি বিলাস ও বাইজি আসক্তি তাঁর সাধ্বী পত্নী বরদাস্ত করেননি।দ্বারকানাথকে বহির্বাটীতেই রজনী যাপন করতে হত, অন্দরমহলে প্রবেশ তাঁর জন্য নিষিদ্ধ হয়েছিল। কলকাতার বউবাজারে দ্বারকানাথের পরিবারের কোনো সদস্যের মালিকানায় ৪৩ কক্ষের এক বিশাল বেশ্যাবাড়িও ছিল। কারও কারও ধারণা, নটী সুকুমারী দত্তের প্রেমে মজেছিলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর — কাদম্বরী দেবীর আত্মহত্যার কারণ নাকি এই অবৈধ সম্পর্ক। ব্যভিচারী রমেশদার আত্মকথায় ঠাকুরপরিবার সম্পর্কে চাঞ্চ্যকর কিছু তথ্যের সন্ধান মেলে। প্রতিবেশী সম্পন্ন মুসলমান সম্প্রদায়ও এই হিন্দু বাঙালি’বাবু’দের অনুসরণ করতেন। পদমদীর নবাব মির মহম্মদ আলি তাঁদেরই একজন। সত্যনিষ্ঠ মশাররফ অকপটে তাঁর ডায়েরিতে লিখে গেছেন, গ্রামের বাড়ি লাহিনীপাড়ায় থাকায় সহজে শহরে যাওয়ার প্রয়োজন বা সুযোগ হত না। কিন্তু যেদিন হাতের কাছের শহর কুষ্টিয়ায় যাওয়া পড়ত সেদিন ছয়মাসের ‘দাদ’ একদিনে তুলে নিতেন, নিজে মজে অবিদ্যাদের মজিয়ে, উৎসবের আনন্দে শহরে অবস্থানের প্রায় পুরোটা সময়ই কাটিয়ে আসতেন বেশ্যাপাড়ায়। দেশীয় গণিকা শুধু নয়, ‘ইঙ্গ-বঙ্গ বারাঙ্গানা’র প্রতিও হাত বাড়িয়েছিলেন এবং তাঁকে সন্তানও উপহার দিয়েছিলেন। মরমি কবি হাসন রাজার তো হর হামেশাই পতিতা দর্শনে যেতেন।হাসন রাজার জ্যেষ্ঠ পুত্র দেওয়ান গনিউর রাজার বেশ্যাসক্তির বিবরণ তাঁর সফরভিত্তিক আত্মকথায় মেলে।কবি নজরুল তো কাননবালার ঘরে প্রায় নিয়মিতই যেতেন।কথা শিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের জীবনে পতিতা ও বৈধতাও প্রশ্নহীন নয়।সাহিত্যিক জগদীশ গুপ্তও রক্ষিতা পুষতেন।
উনিশ শতকের বাঙালি সমাজের বেশ্যামগ্ন পুরুষের চালচিত্র কেমন ছিল, তার বিবরণ সেকালের অনেক প্রখ্যাত কীর্তিমান মানুষের স্মৃতিচর্চায় পাওয়া যায়। এ থেকে বেশ্যা-সংস্কৃতির সামাজিক চিত্রের নিপুণ পরিচয় পাওয়া যায়। মনীষী রাজনারায়ণ বসু তাঁর “সেকাল আর একাল”-এ লিখেছেন — “এক্ষণকার লোক পানাসক্ত ও পূর্ব্বাপেক্ষা বেশ্যাসক্ত। যেমন — পানদোষ বৃদ্ধি পাইতেছে, তেমনি বেশ্যাগমনও বৃদ্ধি হইতেছে। সে কালে লোকে প্রকাশ্যরূপে বেশ্যা রাখিত। বেশ্যা রাখা বাবুগিরির অঙ্গ বলিয়া পরিগণিত হইত; এক্ষণে তাহা প্রচ্ছন্নভাবে ধারণ করিয়াছে, কিন্তু সেই প্রচ্ছন্নভাবে তাহা বিলক্ষণ বৃদ্ধি পাইতেছে। বেশ্যাগমন বৃদ্ধি পাইতেছে, তাহার প্রমাণ বেশ্যাসংখ্যার বৃদ্ধি। পূর্ব্বে গ্রামের প্রান্তে দুই এক ঘর দৃষ্ট হইত; এক্ষণে পল্লিগ্রামে বেশ্যার সংখ্যা বিলক্ষণ বৃদ্ধি পাইতেছে। এমন কি, স্কুলের বালকদিগের মধ্যেও এই পাপ প্রবলাকার ধারণ করিয়াছে। যেমন পানদোষ বৃদ্ধি পাইতেছে, তেমন বেশ্যাগমনও বৃদ্ধি পাইতেছে। ইহা সভ্যতার চিহ্ন। যতোই সভ্যতা বৃদ্ধি হয় ততোই পানদোষ, লাম্পট্য ও প্রবঞ্চনা তাহার সঙ্গে সঙ্গে বৃদ্ধি হইতে থাকে”।
বেশ্যালয় এবং বেশ্যাবৃত্তি মহানগর, মফস্বল শহর, গঞ্জ ছাড়িয়ে গ্রামীণ জনপদেও প্রসারিত হয়েছিল। কর্তাভজা সম্প্রদায়ের সতীমার মেলায় উল্লেখযোগ্য বেশ্যা-সমাগম হত। ১৮৬৪ খ্রিস্টাব্দের “সংবাদ প্রভাকর” পত্রিকার ৪ এপ্রিল সংখ্যায় জানা যায়, সেখানে ‘কুলকামিনী অপেক্ষা বেশ্যাই অধিক’। দীনেন্দ্রকুমার রায় সাক্ষ্য দিয়েছেন, গ্রামীণ মেলা বা আড়ঙে বেশ্যাদের ‘টং’ জাঁকিয়ে বসত। তাদের শিকার ছিল মোহিনী-মায়ায় মুগ্ধ গ্রামের চাষাভূষো ও সাধারণ মানুষ।
উনিশ শতকের বাংলার সামাজিক চিত্রাঙ্কন করতে গিয়ে শিবনাথ শাস্ত্রী তাঁর “রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ” গ্রন্থে কার্তিকেয়চন্দ্র রায়ের বিবরণে জানা যায় : “দেওয়ানজী তদানীন্তন কৃষ্ণনগরের যে অবস্থা বর্ণনা করিয়াছেন, তদনুরূপ অবস্থা তখন দেশের অনেক নগরেই বিদ্যমান ছিল। সে সময়ের যশোহর নগরের বিষয়ে এরূপ শুনিয়াছি যে, আদালতের আমলা, মোক্তার প্রভৃতি পদস্থ ব্যক্তিগণ কোনোও নবাগত ভদ্রলোকের নিকটে পরস্পরকে পরিচিত করিয়া দিবার সময়ে — ‘ইনি ইহার রক্ষিতা স্ত্রীলোকের পাকা বাড়ি করিয়া দিয়াছেন, এই বলিয়া পরিচিত করিতেন। রক্ষিতা স্ত্রীলোকের পাকাবাড়ি করিয়া দেওয়া একটা মান-সম্ভ্রমের কারণ ছিল। কেবল কি যশোরেই, দেশের সর্ব্বত্রই এই সম্বন্ধে নীতির অবস্থা অতীব শোচনীয় ছিল”।
কালীপ্রসন্ন সিংহ হুতোম প্যাঁচার নক্সায় উনিশ শতকের কলকাতার বেশ্যাবাজির বিবরণ দিয়েছেন : “বেশ্যাবাজিটি আজকাল এ শহরে বাহাদুরির কাজ ও বড় মানুষের এলবাত পোশাকের মধ্যে গণ্য, অনেক বড় মানুষ বহুকাল হলো মরে গ্যাছেন। কিন্তু তাঁদের রাঁড়ের বাড়িগুলো আজও মনিমেন্টের মতো তাঁদের স্মরণার্থে রয়েছে — সেই তেতলা কি দোতলা বাড়িটি ভিন্ন তাঁদের জীবনে আর এমন কিছু কাজ হয়নি, যা দেখে সাধারণে তাঁদের স্মরণ করে”। শুধুমাত্র অধমরাই নয়, যাঁরা ছিলেন সমাজপতি ও কীর্তিমান, পতিতা-রক্ষিতার প্রতি তাঁরাও মোটেই বিমুখ ছিলেন না। অনেক মহাত্মাই (!) সম্মান বাঁচিয়ে গোপনে বেশ্যাদের বাঁধা খরিদ্দার ছিলেন, রক্ষিতা-পোষণ করতেন না উচ্চবর্গের ধনী রাজা-জমিদার-জোতদার-বণিক-ব্যবসায়ী-উকিল-মোক্তার-আমলা এমন ব্যক্তি কমই ছিলেন। বেশ্যাচর্চা সেকালের অনেক বিত্তবান শিক্ষিত বাঙালির কালচারে পরিণত হয়েছিল। নদীয়ার মহারাজার দেওয়ান কার্তিকেয়চন্দ্র রায় তাঁর আত্ম-জীবনচরিত-এ “গণিকালয়ের ইতিহাস” নামে অধ্যায়ে এই বিষয়ে যে তথ্য পরিবেশন করেছেন, তা হল : “কৃষ্ণনগরের কেবল আমিনবাজারে বেশ্যালয় ছিল। গোয়াড়ীতে কয়েক ঘর গোপ ও মালো গাঁড়ার ও অন্যান্য নীচ জাতির বসতি ছিল। পরে যখন ইংরেজ গভর্নমেন্ট এই স্থান প্রশস্ত ও নদীতীরস্থ দেখিয়া ইহাতে বিচারালয় সকল স্থাপন করিলেন, সেই সময় সাহেবেরা গোয়াড়ীতে পশ্চিম দিকে, ও তাঁহাদের আমলা উকীল ও মোক্তারেরা ইহার পূর্ব্ব দিকে, আপন আপন বাসস্থান নির্মাণ করিতে লাগিলেন। তৎকালে বিদেশে পরিবার সঙ্গে লইয়া যাইবার প্রথামত অপ্রচলিত থাকাতে, প্রায় সকল আমলা, উকীল বা মোক্তারের এক একটি উপপত্নী আবশ্যক হইত। সুতরাং তাঁহাদের বাসস্থানের সন্নিহিত স্থানে স্থানে গণিকালয় সংস্থাপিত হইতে লাগিল। পূর্ব্বে গ্রিস দেশে যেমন পণ্ডিতসকলও বেশ্যালয়ে একত্রিত হইয়া সদালাপ করিতেন সেইরূপ প্রথা এখানেও প্রচলিত হইয়া উঠিল। যাঁহারা ইন্দ্রিয়াসক্ত নহেন, তাঁহারাও আমাদের ও পরস্পর সাক্ষাতের নিমিত্ত এই সকল গণিকালয়ে যাইতেন। সন্ধ্যার পর রাত্রি দেড় প্রহর পর্যন্ত বেশ্যালয় লোকে পরিপূর্ণ থাকিত। বিশেষত পর্ব্বোপলক্ষে তথায় লোকের স্থান হইয়া উঠিত না। লোকে পূজার রাত্রিতে যেমন প্রতিমা দর্শন করিয়া বেড়াইতেন, বিজয়ার রাত্রিতে তেমনই বেশ্যা দেখিয়া বেড়াইতেন”।
মোটামুটি আঠেরো শতক থেকেই কলকাতা তথা বাংলার নবাব-রাজা-জমিদার-বিত্তশালীদের বিনোদবৃত্ত ঘিরে থাকত বেশ্যা-বাইজির উষ্ণ সঙ্গ, যার অনুসঙ্গ ছিল সংগীত – যা বাইজিসংগীত বা বেশ্যাসংগীত নামে পরিচিত ছিল।অতিথি-পুরুষকে কতটা আনন্দ দান করবে, কতটা আনন্দ পাবে তা নিজে পরিমাপ করার অধিকার কার্যত সীমাবদ্ধ ছিল এই বারপল্লিতেই। তাঁদের কর্মসংস্কৃতি তথা বিনোদন চর্চা ছিল সমাজপতি এবং ধর্মপতিদের দখলে। তাঁদের আনন্দ-সম্ভোগ ছিল বহু বাধানিষেধে বন্দি।প্রচুর গান লেখা হয়েছিল সে সময়ে।সেসব গান আজ বড়োই অবহেলিত, বিস্মৃত-প্রায়। যেখানে বেশ্যা-বাইজিদের সম্মান নেই, সেখানে তাঁদের গান সম্মান পাবে কীরূপে !
পাঠকদের আন্দাজ নেওয়ার জন্য দু-তিনটি বেশ্যাসংগীত পরিবেশন করলাম : (১) তুমি আমার সোহাগ পাখি,/আমি তোমার পিঞ্জরা।/আমায় ছেড়ে যাবে কোথা,/ওহে কালো ভ্রমরা।/যে অবধি গেছ তুমি হয়ে আছি কাতরা।/হৃদয়খানি খুলে দেখ, হয়ে গেছে ঝাঁঝরা।।(২) তোর পিরিতে সব খোয়ালাম/বাকি কেবল টুকনি নিতে।/পাতা লতা কুড়িয়ে মলাম,/ পারলাম না আগুন পোয়াতে।।/তোর পিরিতে এমনি মজা,/ঘর থাকতে বাবুই ভেজা,/যেমন মজা, তেমন সাজা,/দিলি রে তুই বিধিমতে।।(৩) বেশ্যাগিরি কী ঝকমারি করব নাকো আর/জেনে শুনে প্রাণে প্রাণে সমজিছি এবার।/গিয়াছে যৌবন কেটে, (দিতে) একমুঠো ভাত পেটে,/জোটে নাকো মোটে/(এখন)ছাত পিটি পট পট, করি খিদের জ্বালায় ছটফট,/নাচার হয়ে আচার হারা, হারিয়েছি বিচার।।
আঠারো শতকের শেষের দিকে বিশেষ করে বাঙালি সমাজের তলায় যে ঘুণ ধরতে শুরু করেছিল তার একটা কারণ ইংরেজ বণিকদের আনুকূল্যে কিছু মানুষের হঠাৎ করে নবাব হয়ে যাওয়া। মদ্যপান, মেয়েমানুষ রেখে, বেশ্যাবাড়ি গিয়ে, লক্ষ টাকা দিয়ে বেড়ালের বিয়ে দিয়ে, মাইফেলি ও বাইজিদের মুজরা বসিয়ে এঁরা সমাজটাকে পাঁকপূর্ণ করতে চেয়েছিল।১৮৭২ সালে স্থাপিত হল বঙ্গ রঙ্গালয়ের সাধারণ মঞ্চ। শরৎচন্দ্র ঘোষের বেঙ্গল থিয়েটারে অভিনেত্রীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন একসঙ্গে চার-চারটি বেশ্যানারী। প্রসঙ্গত জানাই, সে সময় ভদ্র সমাজের মহিলারা পুরুষদের সঙ্গে একসঙ্গে (একা একাও নয়) মঞ্চে অভিনয় করবেন, এটা ভাবাই যেত না। যাই হোক, বাঙলার রঙ্গমঞ্চে প্রথম চার বেশ্যানারীরা হলেন – গোলাপসুন্দরী, এলোকেশী, জগত্তারিণী এবং শ্যামা।উপেন্দ্রনাথ দাসের “শরৎ-সরোজিনী” নাটকে গোলাপসুন্দরী সুকুমারীর ভূমিকায় এমন প্রাণবন্ত অভিনয় করেছিলেন যে, তিনি ‘সুকুমারী’ নামেই পরিচিত হয়ে গেলেন। বেশ্যার মেয়ে এবং নিজে বেশ্যা হলেও সুকুমারী স্ত্রীর মর্যাদা পেয়ে গেলেন উপেন্দ্রনাথ দাসের মধ্যস্থতায় তাঁরই দলের অভিনেতা সুদর্শন গোষ্ঠবিহারী দত্তের সঙ্গে বিয়ে হয়ে। পবদিহীন বেশ্যা হয়ে গেলেন মিসেস সুকুমারী দত্ত।এই কারণে গোষ্ঠবিহারী তখন সমাজে পতিত হয়ে গেলেন সত্যই, কিন্তু ভদ্রপল্লিতে সংসার পাতলেন।এইরকম বেশ্যাদের মধ্যে আর-একজন প্রখ্যাত বিনোদিনী, বিনোদিনী দাসী। চৈতন্যলীলায় তিনি নিমাইয়ের ভূমিকায় অভিনয় করে সাড়া জাগান। পরে শ্রী রামকৃষ্ণের স্পর্শে তাঁর ‘চৈতন্য’ হয় বলে কথিত আছে। বর্তমানে স্টার থিয়েটারের নামের সঙ্গে বিনোদিনীর নামও বিজড়িত হয়ে আছে।
ইহুদি ধর্ম গোত্রের ভেতরে গোত্রের সদস্য-সদস্যাদের কাউকেই গণিকাবৃত্তিতে উৎসাহিত করত না। বরং সেটা তাদের নৈতিক আইন অনুসারের জঘন্য অপরাধ বিবেচিত হত, তবুও ইতিহাসে খুব অল্প সময়ের জন্যই তারা রাষ্ট্র ক্ষমতায় ছিল, তাই তাদের নিজস্ব গোত্রে তারা বেশ্যাবৃত্তি দমন করতে পারলেও নগর থেকে পতিতাদের উচ্ছেদ করতে পারেনি। যত বড়ো নগর, তত বেশি গণিকা, তত বেশি ব্যাভিচার, এমনটাই বাস্তবতা। গ্রিক সভ্যতাও একটা পর্যায়ে শুধুমাত্র গণিকাবৃত্তির জন্যই বিখ্যাত। তাদের নগরে যদিও বেশ্যাদের নাগরিকত্বের অধিকার ছিল সামান্য, তবে নগরের অধিকাংশ সম্পদের মালিক ছিল এই গণিকারা, তারাই নগরের সম্ভ্রান্ত নাগরিকদের বিলাস ও ব্যভিচারের অর্থ প্রদান করত। উচ্চাভিলাষী যে-কোনো নারী সে সময়ে স্ব-ইচ্ছায় বেশ্যাবৃত্তি অংশগ্রহণ করত এবং তাঁরা অর্থে-বিত্তে-সম্মানে পিছিয়ে ছিল না। বরং সামনের কাতারেই ছিল। ভারত উপমহাসাগরের নারীরা যে সবাই দক্ষ গণিকা বা বেশ্যা হয়ে উঠতে পেরেছিল তা কিন্তু নয়। বরং চৌষট্টি কলায় দক্ষ যে রমণী, তাঁর শয্যাসঙ্গী হতে যে পরিমাণ আর্থিক সংগতি লাগত তা যোগান দিতে পারত শুধুমাত্র উচ্চতর রাজকর্মচারীগণ। সম্রাট নিজেই নিজের নগরে একজনকে উপঢৌকনসহ বহাল রাখতেন, যখনই অন্য দেশের কোনো সম্ভ্রান্ত নাগরিক কিংবা সম্রাট নগরে আসতেন, তখনই এই গণিকাগণ তাদের মনোরঞ্জন করত।
অর্থের বিনিময়ে যৌনতা বিক্রির ইতিহাস সুপ্রাচীন। ওয়েবস্টার অভিধান মতে, সুমেরিয়ানদের মধ্যেই প্রথম পবিত্র বেশ্যা বা পতিতার দেখা মেলে। প্রাচীন গ্রন্থাদিসূত্রে, যেমন ইতিহাসের জনক হিসেবে খ্যাত হিরোডেটাস (খ্রিস্টপূর্ব ৪৮৪ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ৪৩০/২০)-এর লেখায় এই পবিত্র বেশ্যাবৃত্তির বহু নমুনা পাওয়া যায়, যেটি প্রথম শুরু হয়েছিল ব্যাবিলনে। সেখানে প্রত্যেক নারীকে বছরে অন্তত একবার করে যৌনতা, উর্বরতা ও সৌন্দর্যের দেবী আফ্রোদিতির মন্দিরে যেতে হত এবং সেবাশুশ্রূষার নমুনা হিসাবে একজন বিদেশির সঙ্গে নামমাত্র মূল্যে যৌনসঙ্গম করতে হত। একই ধরনের বেশ্যা বৃত্তির চর্চা হত সাইপ্রাস এবং করিন্থেও। এটি বিস্তৃত হয়েছিল সার্দিনিয়া এবং কিছু ফিনিশীয় সংস্কৃতিতে, বিশেষ করে ইস্টার দেবতার সম্মানে। ফিনিশীয়দের মাধ্যমে ক্রমশ এটি ভূমধ্যসাগরের অন্যান্য বন্দর শহরগুলোতেও সংক্রমিত হয়ে পড়ে। যেমন — সিসিলি, ক্রটন, রোসানো ভাগলিও, সিক্কা ভেনেরিয়া এবং অন্যান্য শহরে। এক্ষেত্রে অনুমান করা হয় এশিয়া মাইনর, লাইদিয়া, সিরিয়া ও এট্রাকসনের নামও। ইসরায়েলে এটি একটি সাধারণ ব্যাপার ছিল। পাশ্চাত্য সভ্যতার জতুগৃহ প্রাচীন গ্রিকের এথেনাইয়ের কবি সোলোন (খ্রিস্টপূর্ব ৬৩ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ৫৯০), যিনি তৎকালীন গ্রিকের সাতজন জ্ঞানী লোকের একজন হিসাবে গণ্য হতেন, খ্রিস্টপূর্ব ছয় শতকে এথেন্সে প্রথম বেশ্যালয় স্থাপন করেন। এই বেশ্যালয়ের উপার্জন দিয়ে আফ্রোদিতিকে নিবেদন করে একটি মন্দির নির্মাণ করা হয়েছিল। মধ্যযুগে ইউরোপে ব্যাপকভাবে বেশ্যাবৃত্তি ছড়িয়ে পড়ে এবং পৌরসভার মাধ্যমে বেশ্যালয়গুলি পরিচালিত হতে থাকে।
বেশ তো চলছিল — হঠাৎ কী এমন হল, যে বেশ্যাবৃত্তি ছিল প্রাচীন যুগে এত আদরের-কদরের ছিল, সেই বেশ্যাবৃত্তি এত নিন্দনীয় এবং ঘৃণিত হল কীভাবে ? কবে থেকে ? যখন বেশ্যা এবং বেশ্যাবৃত্তির বিবর্তন নিয়ে একটা প্রবন্ধ লিখব ভাবছিলাম – ভাবছিলাম কেন, যখন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম সেই সময় আমার এক বন্ধু একটি মূল্যবান গ্রন্থ আমার হাতে তুলে দিল। বইটি আনন্দ পাবলিশার্সের “বেশ্যাপাড়ার পাঁচটি দুর্লভ সংগ্রহ”। বইটি শুরুতেই বিধিবদ্ধসতর্কীকরণ থাকলেও পাঠক এবং বেশ্যাদের স্বার্থে কিছু অংশ এখানে উল্লেখ করতেই হবে। “বেশ্যাপাড়ার পাঁচটি দুর্লভ সংগ্রহ” গ্রন্থ থেকে জানা যায়, “ব্রিটিশ আমলে ইংরেজ সরকারের কাছে তাঁদের সৈন্যরা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সেইসব সৈন্যদের ব্যাপকভাবে বেশ্যাদের সঙ্গে সংসর্গ স্থাপন করায় তাঁদের মধ্যে যৌনরোগের হার মাররাত্মকভাবে বেড়ে গিয়েছিল, যা সরকারের কাছে হয়ে উঠেছিল একটি বিপর্যয়ের কারণ। সেই সময়কার সরকারি রিপোর্টে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে ইংরেজ সৈনদের মধ্যে সেই যৌনরোগের হার ১৮২৭ সালে ২৯% থেকে বেড়ে ১৮২৯-এ ৩১%-এ গিয়ে দাঁড়ায়। আর ১৮৬০ সালে দেখা যায় এই মাত্রা বেড়ে দাঁড়াচ্ছে ৭০%। …..অনেক সৈন্যদের অক্ষম বলে বরখাস্ত করতে হয়। …..বেশ্যাবৃত্তিকে সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করে দেওয়া যায় না। তাই সমস্ত দিক বিচার করে ইংরেজ সরকার ১৮৬৪ সালে পাশ করালেন ‘ক্যান্টনমেন্ট অ্যাক্ট’(Act XXII of 1864। সেনাছাউনিগুলোতে ইংরেজ সৈন্যদের জন্য তৈরি হল আলাদা বেশ্যালয়, সেখানে যেসব বেশ্যারা আসতেন তাঁদের রেজিস্ট্রিভুক্ত করে পরিচয়পত্র স্বরূপ ‘কার্ড’ দেওয়া হত। যৌনরোগ থেকে তাঁদের মুক্ত রাখার জন্য ‘লক হসপিটাল’ নামে বিশেষ হাসপাতাল স্থাপন করা হয় প্রধান সেনাছাউনিতে। …… সরকারি নির্দেশে পুলিশ লালবাতি এলাকায় বাড়িগুলিতে তল্লাশি চালিয়ে মেয়েদের ডাক্তারি পরীক্ষা করতে নিয়ে যেত। সামাজিকভাবে সরকারের তাঁদের প্রতি এই ব্যবহার ক্রমশই নৃশংসতার মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছিল। তার ফলে প্রচুর বেশ্যা কলকাতা ছেড়ে গ্রামে বা অন্য কোথাও পালাতে শুরু করলেন। যাঁরা হাসপাতালে গেলেন তাঁদের মধ্যে অধিকাংশই ফিরে এসে আর পুরোনো পেশায় ফিরতে সাহস পেলেন না। তাঁদের যেন পেশায় টিকে থাকাটাই দায় হয়ে পড়েছিল। এমনকী শেষপর্যন্ত খদ্দেরদের মধ্যে একটা অংশের অনীহা জন্মাল লালবাতি এলাকায় যাওয়ায়। এত হেনস্থা সহ্য করে তাঁরাও খানিকটা বিমুখ হয়ে পড়েছিলেন। সব মিলিয়ে ব্রিটিশ সরকার প্রত্যক্ষভাবে না-হলেও পরোক্ষভাবে যেন একটা প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন বেশ্যাবৃত্তিকে তুলে দেওয়ার।
উনিশ শতকের বাঙালি সমাজে এই বেশ্যা সমস্যাকে কেন্দ্র করে মূলত দু’ভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছিল। একদল এই বেশ্যাবৃত্তির এবং বেশ্যাদের দুর্গতির সহমর্মী, যাঁদের মধ্যে সেকালের বিখ্যাত লোকেরা ততটা ছিলেন না, যতটা ছিলেন সাধারণ মানুষ। বিখ্যাত মানুষদের ‘ইমেজ’ রক্ষার দায়বদ্ধতা ছিল বলে তাঁরা প্রকাশ্যে অনেকেই বেশ্যাদের স্বপক্ষে দাঁড়াতে পারেননি। ……..অন্যদিকে মূল ক্ষমতাকেন্দ্রে বা জ্ঞানচর্চার মূল বৃত্তে বেশ্যাদের বিপক্ষে তৈরি হয়েছিল প্রবল বিরোধ, ক্ষোভ, প্রতিবাদ, প্রতিরোধের দৃষ্টান্তমূলক চিত্র। এখানে সংগঠিত হয়েছিল উনিশ শতকের প্রচুর নামকরা বুদ্ধিজীবী, মনীষী, সমাজ-সংস্কারক। এঁরা মনে করতেন বেশ্যাদের বাড়বাড়ন্ত সমাজকে কলুষিত করবে”।
অবশেষে নানা টালমাটাল ও অস্থিরতার পর “বেশ্যাদের সম্পর্কে নানাধরনের সামাজিক আপত্তির ফলে ১৮৬৮ সালে যে ‘চোদ্দো আইন’-এর প্রবর্তন করা হয়েছিল তাতে ইংরেজ সরকার এদেশীয় ভদ্রলোকদের দাবিকে যে শুধু রক্ষা করতে চেয়েছিলেন তা নয়, তাঁদের সেনাবাহিনীতে যাতে কোনও বেশ্যা সংসর্গে যৌনরোগের প্রাদুর্ভাব না ঘটে সে বিষয়েও সচেষ্ট হয়ে উঠেছিলেন। অন্যদিকে বেশ্যাদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করিয়ে রেজিস্ট্রি করে পেশা চালানোর সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। অর্থাৎ সরকারিভাবে বেশ্যাদের স্বীকৃতি”।
কেমন ছিল সেই কুখ্যাত ‘চোদ্দো আইন’ ? শ্রীগিরীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় কর্তৃক সংগ্রহীত “বেশ্যা গাইড” গ্রন্থে সংকলিত “১৪ আইন” হুবহু তুলে ধরলাম : “(১) ১৮৬৯ সালের ১ লা এপ্রেল তারিখে কিম্বা তাহার পর অবধি কলিকাতায় কিম্বা সহর তলিতে কোন স্ত্রীলোক কিম্বা কোন ব্যক্তি আপন২ বাসস্থান যে থানার অধীন সেই থানায় রেজিষ্টরি না করিয়া বেশ্যাবৃত্তি এবং বেশ্যালয় রক্ষকের কর্ম্ম করিতে পারিবে না। (২) প্রত্যেক থানায় ইনস্পেক্টর আপন২ থানার এলাকায় যে২ সামান্য বেশ্যা ও বেশ্যালয় রক্ষক বাস করে তাহাদের রেজিষ্টরি কার্য্য নির্ব্বাহ করিবেন। (৩) কোন স্ত্রীলোক সামান্য বেশ্যাবৃত্তি করিতে ইচ্ছা করিলে আপন নাম, বয়স, জাতি বা ধর্ম্ম, জন্মস্থান, বাসস্থান, ও যে সময়ে বেশ্যাবৃত্তিতে প্রবৃত্ত হইয়াছে এবং যদ্যপি সে কোন বেশ্যালয়ে বাস করে তাহা হইলে সেই বাটীর কর্ত্তারও রক্ষকের নাম এবং পরে লিখিত জেনরেল রেজিষ্টারি বহিস্থ তাহার নম্বর এই সকল বৃত্তান্ত থানায় নিজে আসিয়া লেখাইতে হইবেক। (৪) থানার ইনস্পেক্টর উক্ত সকল বিবরণ পাইবামাত্র থানায় রেজিষ্টরি বহি (ফারম A) রাখা হইবে সেই বহিবে তাহা লিখিয়া ঐ টিকিট কমিশ্যনার সাহেবের দস্তখতের নিমিত্ত তাহার আপিসে পাঠাইয়া দিবেন। (৫) থানায় রেজিষ্টরি বহির ন্যায় সমুদায় সহর ও সহরতলির জন্য পুলিশ আপীসে যে জেনরেল রেজিষ্টরি বহি রাখা হইবে সেই বহিতে কমিশ্যনার সাহেব ঐ স্ত্রীলোককে রেজিষ্টারি করিবেন, জেনরেল রেজিষ্টরি বহিতে ঐ স্ত্রীলোকের যে নম্বর পড়িবে সেই নম্বর রেজিষ্ট্রেসন টিকিটের প্রথম ঘরে লিখিতে হইবে। ইহা লেখা হইলেই উক্ত টিকিট কমিশ্যনার বা ডিপুটি কমিশ্যনর সাহেবের দ্বারা স্বাক্ষরিত হইয়া থানার ইনস্পেক্টরের নিকট প্ররিত হইবে। ইনস্পেক্টর আপন রেজিষ্টরি বহিতে উক্ত রেজিষ্ট্রেসন টিকিটে লিখিত নম্বর লিখিয়া লইয়া যাহার টিকিট তাহাকে দিবেন। (৬) প্রত্যেক বেশ্যালয় রক্ষক যে থানার এলাকায় আপন কর্ম্ম চালায় সেই থানায় তাহাকে রেজিষ্টরি করিতে হইবেক আর রেজিষ্টরি করিবার সময় আপন নাম, বাসস্থান এবং যে বাটীতে, কি ঘরে, কি স্থানে, আপনার বৃত্তি চালায় তাহা যে স্থানে থাকে তাহা লেখাইতে হইবেক থানার ইনস্পেকটর উক্ত বিবরণ থানায় যে রেজিষ্টরি বহি (ফারম C) রাখা হইবে সেই বহিতে লিখিয়া লই-বেন। তৎপরে রেজিষ্টরি টিকিট (ফারম D) লিখিয়া ঐ টিকিট কমিশ্যনার সাহেবের দস্তখতের নিমিত্ত তাহার আফিসে পাঠাইয়া দিবেন। (৭) কমিশ্যনার সাহেব তাঁহার আফিসে এক বহিতে প্রত্যেক বেশ্যালয় রক্ষকের নাম এবং অন্যান্য বৃত্তান্ত লেখাইয়া রাখিবেন। (৮) কমিশ্যনর সাহেবের আফিসের জেনেরেল রেজিষ্টরি বহিতে বেশ্যালয় রক্ষকদের রেজিষ্ট্রসনের যে নম্বর হইবেক টিকিটেও সেই নম্বর দেওয়া হইবেক, আর ঐ টিকিট কমিশ্যনার কিম্বা ডেপুটী কমিশ্যনার সাহেবের দস্তখত হইলে যে থানার এলাকায় ঐ বেশ্যালয় রক্ষক আপন বৃত্তি চালাইতে চাহে সেই থানার ইনস্পেক্টরের নিকটে পাঠান হইবেক। (৯) কমিশ্যনর সাহেবের দ্বারা টিকিটে যে নম্বর দেওয়া হইবেক সেই নম্বর ইনস্পেক্টর রেজিষ্টরি বহিতে লিখিয়া যাহার টিকিট তাহাকে ফিরাইয়া দিবেন। (১০) যদি কোনো স্ত্রীলোক কিম্বা কোন ব্যক্তি পূর্ব্বোক্তমতে রেজিষ্টরি না করিয়া এবং পূর্ব্বমতে রেজিষ্ট্রেসন টিকিট না লইয়া বেশ্যাবৃত্তি করে কিম্বা বেশ্যালয় রক্ষকের কর্ম্ম চালায় তাহা হইলে তাহার বিনা ওয়ারেন্টে গ্রেপ্তার হইয়া ১৮৬৮ সালের ১৪ আইনমতে বিচার হইবার জন্য ম্যাজিষ্ট্রেট সাহেবের নিকট সোপরর্দ্ধ হইবেক। (১১) কোন রেজিষ্টরি করা বেশ্যা আপন বাসস্থান পরিবর্ত্তন করিবার ইচ্ছা করিলে তাহাকে কমিশ্যনার বা ডেপুটী কমিশ্যনার সাহেবের সমীপে স্বয়ং কিম্বা ইংরাজি দরখাস্ত দ্বারা যে গলিতে উঠিয়া যাইতে মানস করে তাহার নাম ও নম্বর জানাইতে হইবেক, আর রেজিষ্ট্রেসন টিকিট ফিরাইয়া দিতে হইবেক। যদ্যপি কোন বেশ্যালয়ে থাকিতে মানস করে তবে সেই বেশ্যালয়ের রক্ষকের নাম ও রেজিষ্টেসন নম্বর লেখাইতে হইবেক। (১২) এরূপ দরখাস্ত পাইলে কমিশ্যনার সাহেব রেজিষ্ট্রেসন টিকিটে ও জেনেরেল রেজিষ্টরি বহিতে প্রয়োজনমতে পরিবর্ত্তন করিতে আজ্ঞা দিবেন এবং পূর্ব্বোক্ত টিকিট ঐ স্ত্রীলোককে ফিরাইয়া দিবেন এবং পূর্ব্বে ঐ স্ত্রীলোক যে থানায় রেজিষ্টরি হইয়াছে সেই থানা হইতে তাহার নাম পরিবর্ত্তন করিয়া যে থানার এলাকায় সে উঠিয়া যাইতে মানস করে সেই থানায় তাহাকে পুনরায় রেজিষ্টরি করিতে আদেশ করিবেন। (১৩) কোন বেশ্যা রেজিষ্টার করিয়া অত্র সহরে কিম্বা সহরতলীতে বেশ্যাবৃত্তি ত্যাগ করিতে ইচ্ছা করিলে তাহাকে স্বয়ং কিম্বা ইংরাজি দরখাস্ত দ্বারা কমিশ্যনার সাহেবকে জানাইতে হইবেক যে তাহার নাম রেজিষ্টরি হইতে উঠাইয়া ফেলা হয় এবং ঐ স্ত্রীলোক যথার্থ বেশ্যাবৃত্তি ত্যাগ করিয়াছে এমত প্রমাণ পাইলে কমিশ্যনার সাহেব তাহার নাম জেনেরল রেজিষ্টর ও থানার রেজিষ্টর হইতে উঠাইয়া দিতে আদেশ করিবেন এবং তাহার রেজিষ্ট্রেসন টিকিট ফিরাইয়া লইবেন। এবং যে পর্যন্ত ঐ দরখাস্তের চূড়ান্ত হুকুম না হয় সে পর্য্যন্ত কমিশ্যনার সাহেব যদি উচিত বিবেচনা করেন তাহা হইলে স্ত্রীলোককে ডাক্তারের পরীক্ষা হইতে মুক্ত করিতে পারিবেক। (১৪) যদি কোন বেশ্যালয়-রক্ষক আপন বাসস্থান কিম্বা ব্যবসার স্থান পরিবর্ত্ত করিতে চাহে তাহা হইলে সে যে স্থানে উঠিয়া যাইবেক তাহার নাম ও নম্বর দিয়া কমিশ্যনার সাহেবের নিকট এক ইংরাজি দরখাস্ত করিতে হইবেক আর সেই দরখাস্তের সহিত রেজিষ্ট্রেসন টিকিট দাখিল করিতে হইবেক”– ইত্যাদি।
ফরাসি, পোর্তুগিজ এবং সবশেষে ব্রিটিশ উপনিবেশ গড়ে ওঠার ফলে ভারত উপমমহাদেশে এক অদ্ভুত পরিবর্তন বেশ্যাদের পেশায়। বিদেশিদের অসংযমী এবং অবাঞ্ছিত যৌনজীবনে দরুন নতুন কিছু কালান্তক যৌনরোগের আমদানি হল। বেশ্যাবাড়ি যাওয়া যাঁদের কাছে স্ট্যাটাস-সিম্বল হয়ে দাঁড়াল, যাঁদের বেপরোয়া যৌন-সম্ভোগে সিফিলিস এবং গনোরিয়ার মারণরোগ ছড়িয়ে পড়ল সর্বত্র – সেই সময় থেকেই বেশ্যা এবং বেশ্যাবাড়ি ক্রমশ ঘৃণিত ও নিন্দিত হতে থাকল। কারণ সিফিলিস এবং গনোরিয়া অত্যন্ত ছোঁয়াচে রোগ ছিল। সংক্রমিত হত শরীর থেকে শরীরে। শোনা যায়, সিফিলিস যৌনরোগটি নাকি ফরাসিদের থেকেই আমদানি হয়েছিল। যাই হোক, এই দুটি রোগই যৌনাঙ্গটিকে প্রভূত ক্ষতিগ্রস্ত করে দিত। যৌন-সংসর্গের মধ্য দিয়েই এই রোগ দ্র্রুত ছড়িয়ে পড়ে। পুরুষ নারীর কাছ থেকে এবং নারী পুরুষদের কাছ থেকে সঙ্গমকালে এই রোগটি ছোঁয়াচ পায়। পুরুষেরা বহুগামী বেশ্যাদের কাছ থেকে, আর সংশ্লিষ্ট সেই পুরুষটির কাছ থেকে তার স্ত্রী এই রোগ শরীরে গ্রহণ করে থাকে। এইসব রোগগুলি থেকে অব্যাহতি পেতে হলে যাঁদের এই রোগগুলি আছে তাঁদের সঙ্গে এক্কেবারে যৌন-সংস্পর্শ করা চলবে না। অবিশ্বস্ত, অজ্ঞাত, অচেনা যৌনসঙ্গী মানেই সাক্ষাৎ সন্ত্রাস প্রতিপন্ন হল। বেশ্যা এবং বেশ্যাপল্লি মানেই সিফিলিস ও গনোরিয়ার আতুরঘর ! যতই বেশ্যাগণ ঘৃণিত ও পরিত্যাজ্য গণ্য হতে থাকল, ততই প্রান্তিক হতে থাকল। বেশ কয়েক যুগ কেটে গেল এইভাবে। এরপর রসিক-রসকিনীদের চোখেমুখে আলো দেখা গেল। সিফিলিস আর গনোরিয়া নির্মূলের অব্যর্থ প্রতিষেধক মেচনিকফ মলম, পেনিসিলিন এবং সালফাথিয়াজোল চলে এল হাতে। তখনও পর্যন্ত কন্ডোমের ব্যবহার তেমনভাবে গ্রহণযোগ্যতা লাভ করতে পারেনি। অতএব মেচনিকফ মলম, পেনিসিলিন এবং সালফাথিয়াজোলের আবির্ভাবে যৌনজীবনে নতুন করে বিপ্লব এলেও বিংশ শতাব্দীতে উদয় হল “এইডস” নামক ত্রাস। এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করতে পারি সুযোগ পেলে।
ভারতের কয়েকটি প্রদেশে রাজাদের অধীনে ‘নাইক’ নামে একটি সম্প্রদায় ছিল। নাইক মেয়েরা সংসারের ব্যয় নির্বাহের জন্য বেশবৃত্তি গ্রহণে বাধ্য হত। এনসাইক্লোপিডিয়ার ভাষ্য মতে, নগরসভ্যতা বিকাশের ফলে ক্রমশ যৌনতার প্রসার ঘটতে থাকে। ভুমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের লিভিয়ান ও সাইপ্রিয়ান জাতির মেয়েরা দূরবর্তী অঞ্চলগুলিতে গিয়ে বেশাবৃত্তি করে অর্থ সংগ্রহ করে নিয়ে আসত। পুরোহিতেরা সে সময় ধর্মের নামে কখনো-কখনো মেয়েদেরকে বেশ্যাবৃত্তিতে নিয়োজিত করত। চিনে তাঙ রাজবংশ একটি নির্দিষ্ট এলাকায় বেশ্যাবৃত্তি চালু করেছিল। পরবর্তী ”সাঙ” রাজবংশ বিভিন্ন স্থান থেকে পতিতাদের সংগ্রহ করে “হাঙ চৌ” শহরে সীমাবদ্ধ করে দেয়, অর্থাৎ তৈরি হয় একটি নির্দিষ্ট পতিতালয়। সেটা একাদশ শতাব্দীর ঘটনা। বহু আগে প্রাচীন গ্রিস ও রোমে এ ধরনের পতিতাবৃত্তির উৎপত্তি। এ ধরনের মানে হল নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে রেখে পেশা হিসাবে স্বীকৃতি প্রদান। ইউস্তিয়ানের স্ত্রী রোমক সম্রাজ্ঞী থেওডেরো প্রথম জীবনে বেশ্যা ছিলেন। বোসপোরুসে তিনি পাঁচশো পতিতার জন্য একটি নির্দিষ্ট আলয় নির্মাণ করেছিলেন। প্রাচীন হেল্লাস বা গ্রিস দেশের আথেনাই বা এথেন্সে বেশ্যালয় ছিল – ছিল ব্যাপকভাবে বেশ্যাবৃত্তি । পৃথিবীতে প্রথম বেশ্যাবৃত্তি পেশার মতো লাইসেন্স বা নিবন্ধন দেওয়া ও কর ধার্য করা হয় রোমান আমলেই। সে আমলে চিন, ভারতবর্ষ সহ অনেক দেশেই পতিতাবৃত্তি ধর্মীয় উপাসনার সঙ্গে যুক্ত ছিল। মহাভারতের সমাজে পতিতারা প্রান্তবাসিনী ছিলেন না। শহুরে সংস্কৃতিতে বেশ্যারা যে এক তাৎপর্যময় স্থান অধিকার করেছিল সে কথা মেলে মহাভারতের অনেক পর্বে, সে কথা আগেই বলেছি। বল্লালসেনের রাজত্বকালে প্রবর্তিত হয় কৌলিন্য প্রথা। মূলত এটাই এক ধরনের পতিতাবৃত্তি বলে মনে করে অনেকে। কুলীন ব্রাহ্মণ পুরুষেরা অর্থের বিনিময়ে ঘরে ঘরে গিয়ে বিয়ে করে আসত। এভাবে একেক জনের শতাধিক স্ত্রী থাকত। কিন্তু ব্রাহ্মণেরা সবাইকেই সময় দিতে পারত না। ফলে কখনো-কখনো অতৃপ্ত যৌবনবতী স্ত্রীরা লিপ্ত হত ব্যাভিচারে, মেতে উঠত বেশ্যাবৃত্তিতে।
আদিম সমাজে পতিতাবৃত্তি আয়ের উৎস হিসাবে যথেষ্ট আদৃত হত। ধর্মের দিক থেকে, সমাজের দিক থেকে, পিতা-মাতা, স্বামীর পক্ষ থেকে কোনোদিন ঘৃণা করা হত না। তা ছাড়া মেয়ের উপর পিতা বা স্বামীর একছত্র অধিকার ছিল বলে দুর্দিনে তারা আর্থিক উন্নতির জন্য তাদের কর্তৃত্বাধীন মেয়েদের যৌন ব্যবসায়ে উৎসাহ দিত। ঈশ্বরের পরেই স্বামীর স্থান, তাই স্বামীকে সাহায্য করা মানেই ধর্মীয় কাজ হিসাবে পরিগণিত হত।রোমানরা বেশ্যালয়কে নুপানরিয়া (Lupanaria) বলত। তারা ক্রীতদাসীকে সবসময় বেশ্যা হিসাবে কাজ করাত। যখন এদের সংখ্যা বেড়ে গেল, তখন বেশ্যাদের আলাদা করে রাখার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করল। অনেকসময় বেশ্যাদের রূপে মুগ্ধ হয়ে রোমান যুবকেরা বিয়ে করতে শুরু করল। তখন রক্তের পবিত্রতা ও বংশের ঐতিহ্য রক্ষার জন্য বেশ্যালয় তুলে দেওয়ার জন্য বিপ্লব দানা বেঁধে উঠে। কিন্তু সম্রাট বেশ্যালয় থেকে প্রচুর খাজনা পেত বলে আর্থিক দিক চিন্তা করে পতিতাবৃত্তি একেবারে নিষিদ্ধ করা সম্ভব হল না। প্রাচীন গ্রিসের লোকেরা স্ত্রী ছাড়া অন্য মেয়েদের সঙ্গে খুবই মেলামেশা করত। প্রাচীন যুগে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে যে বেশ্যাবৃত্তি প্রচলিত ছিল, তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায় ওল্ড টেস্টামেন্ট। পঞ্চদশ ষোড়শ শতাব্দীতে বেশ্যাবৃত্তির প্রসারে বাঁধা সৃষ্টি হয়। তখন ইউরোপের সর্বত্র সিফিলিস রোগ দেখা দেয় এবং সপ্তদশ শতাব্দীতে প্যারিসে রোগ নিয়ন্ত্রণ সংস্থা স্হাপিত হয়।পতিতাবৃত্তির প্রসার যেভাবে ব্যাপক আকার ধারণ করছে, তা বাংলা সংস্কৃতির মূলধারায় পরিণত হতে বেশি সময় লাগবে না। নারীর শরীর নিয়ে বিকিকিনি করার এই বর্বর চর্চার উনুনে নিঃশব্দে ফুঁ দিয়ে যাচ্ছি আমরা। আজ সারাবিশ্বের সমাজব্যবস্থায় পতিতাবৃত্তি নিচুতলা থেকে উঁচুতলায় প্রসারমাত্র এক দূরারোগ্য সামাজিক সংস্কৃতি।
মূলত শিল্প বিপ্লব পরোক্ষভাবে বেশ্যাবৃত্তিকে উৎসাহিত করেছে। এ বিপ্লবের ফলে ব্যাপক নগরায়ন ঘটে। অর্থনৈতিক শোষণের দরজা খুলে যায়। আধুনিক পতিতাবৃত্তি উম্মেষ ঘটে সঙ্গে সঙ্গে। নগরায়ন, অর্থনৈতিক শোষণ ও সাম্যজ্যবাদের বিস্তার — এই ত্রিবিধ কারণে আধুনিক বেশ্যাবৃত্তি বিশ্বব্যাপী সুদৃঢ়ভাবে প্রতিষ্টিত হয়েছে। নবাব সিরাউদদৌলার পতনের পর এই ভূখণ্ডে পতিতারা ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আমদানি হতে থাকে । ইংরেজ এবং তাদের রাজকর্মচারীদের মনোরঞ্জনের জন্যই লখনউ প্রভৃতি প্রদেশ থেকে বেশ্যাদের ঝাঁকে ঝাঁকে এই বাংলায় নিয়ে আসা হয়।
‘কোম্পানি আমলে ঢাকা’ গ্রন্থে জেমস টেলর উল্লেখ করেছেন যে, অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধেও ঢাকা শহরে সংগঠিত আকারে পতিতাবৃত্তির অস্তিত্ব ছিল। ১৯০১ সালের ব্রিটিশ আদমশুমারিতে পতিতাদের চিহিত করা হয়েছে ‘অদক্ষ শ্রমিক’, যারা কৃষি কাজে নিয়োজিত নয় বলে। বাংলাদেশে ১৯৭৪ ও ১৯৮১ সালের আদম শুমারি পতিতাদের পতিতা পরিচিতিকে তুলে ধরা হয় পেশা হিসাবে। বাংলাদেশের প্রায় ৩ লাখ নারী ভারতের পতিতালয় এবং ২ লাখ নারী পাকিস্তানের পতিতালয়ে কাজ করছে। ৬০ থেকে ৬৫ হাজার তালিকাভুক্ত পতিতা রয়েছে বাংলাদেশে। নিষিদ্ধপল্লিতে থেকে দেহব্যাবসা করার মতো রেজিস্ট্রেশন প্রয়োজন হলেও দেশব্যপী প্রায় লক্ষাধিক পতিতার আবাসস্থল এখন নিষিদ্ধপল্লিতে। এছাড়া প্রায় অর্ধলাখ পতিতা রয়েছে ভাসমান।
অর্থনৈতিকভাবে, নারীর দেহ এবং নারীর যৌনতা এক মূল্যবান পণ্য। অর্থনৈতিক পণ্য হিসাবে নারীর এই অবমূল্যায়ন হ্রাস করতে কেউ পছন্দ করুক-বা নাই করুক, দুনিয়ার প্রত্যেক সমাজেই এই ব্যবস্থা বাস্তবিক এবং নিত্য — তাই তা কোন্ স্থানের, সমাজের এবং সংস্কৃতির উট, গোরু, ভেড়া কিংবা ঘোড়াই হোক না-কেন অথবা অন্যদিকে ডলার, ইউরো, ইয়েন বা ইউয়ানের চুক্তি।
প্রাচীন যুগে বেশ্যাদের প্রকারভেদ পূর্বেই আলোচনা করেছি। সময় বদলেছে, সময় বদলেছে সর্বত্র। বেশ্যাবৃত্তির ধরনেও আমূল পরিবর্তন এসেছে। এসেছে নতুন ধরনের বিভাজন।
(১) Street Prostitute : এরা ক্লায়েন্ট বা খরিদ্দার ধরার জন্য বিভিন্ন রাস্তায়, পার্ক বা অন্যান্য পাবলিক জায়গা, রাস্তায় পাশে, যানবাহন বা সংকীর্ণ কোনো ঘুপচিতে যৌনক্রিয়া বা যৌন-পরিসেবা সম্পন্ন করে থাকে। (২) Brothel : Brothel বা বেশ্যালয় বা কোঠিতে ঘর ভাড়া দিয়ে বা ঘর ভাড়া নিয়ে ঘোষিতভাবে যৌনকাণ্ড চালানো হয়। এখানকার রাস্তার তুলনায় উন্নত নিরাপত্তা এবং রোজগারের নিশ্চয়তা বেশি। কোনো কোনো দেশে এরা কর্তৃপক্ষ দ্বারা লাইসেন্সকৃত। (৩)Escort : এই যৌনকর্মীরা ফোন করে বা হোটেল কর্মীদের মাধ্যমে বা বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে বা সেক্রেটারি বা এজেন্টের মাধ্যমে খরিদ্দারের সঙ্গে পারিশ্রমিকে রফা করে যৌনকর্মে লিপ্ত হয়। এটি হল যৌনকর্মের সবচেয়ে গোপন এবং আধুনিক ফর্ম। এরা ক্লায়েন্টের বাড়ি অথবা হোটেল-রিসর্ট, সার্কিট হাউসে মিলিত হন। তবে যে-কেউ এদের শরীর-সঙ্গ লাভ করে পারেন না। সমাজের উচ্চ মধ্যবিত্ত এবং উচ্চবিত্তদের মধ্যেই সাধারণত সীমাবদ্ধ থাকে। কারণ এরা তুলনামূলকভাবে কস্টলি বা ব্যয়বহুল। (৪) Private: এরা ব্যক্তিগতভাবে শাঁসালো ক্লায়েন্ট খুঁজে নিয়ে স্বাধীনভাবে কোনো বিলাসবহুল হোটেলে যৌনক্রিয়া করেন এবং তা অত্যন্ত গোপনে সম্পন্ন হয়।এঁদের পারিশ্রমিকও বেশ তুঙ্গে থাকে। এঁরা ভ্রমণসঙ্গী হিসাবেও ক্লায়েট সংগ্রহ করে ক্লায়েটের ঘাড় ভেঙে দেশ-বিদেশে ঘুরে বেড়ায়।(৫) Window or doorway : জানালা বা প্রবেশপথের মাধ্যমে বেশ্যালয়ের বেশ্যারা ক্লায়েন্টকে আহ্বান করেন। উইন্ডোরা সাধারণত উষ্ণ জায়গা পছন্দ করে এবং ডোরওয়েরা সাধারণত ঠান্ডা জায়গাই পছন্দ করে।(৬) Club, Pub, Bar, Karaoke Bar, Dancehall : এই ধরনের বেশ্যারা ক্লাব, পাব, বার, কারাওকে বার, নাচ হল, মদ ইত্যাদি টুকিটাকি জিনিস খুচরো বিক্রির স্থানগুলি থেকে ক্লায়েন্টদের যৌনমিলনের জন্য আবেদন রাখেন। (৭) Other all-male venues : এইসব বেশ্যারা যেখানেই নিয়মিত পুরুষের সমাবেশ (যেমন সেনা-ছাউনি. বাজার-ঘাট, ব্যস্ত রেলস্টেশন ও বাসস্টপ, খনি-ক্যাম্প, অপেক্ষারত ট্রান্সপোর্ট ইত্যাদি) সেখানেই হাজির হয়ে ছুকছুকে পুরুষদের কাছাকাছি এসে যৌনমিলনে আহ্বান করে। (৮) Door knock or hotel : এঁরা হোটেলে বসবাসরত পুরুষদের যৌনমিলনে আহ্বান করে।(৯) Transport (Ship, Truck, Train) : এইসব বেশ্যাগণ চলমান বাস, ট্রেন, জাহাজে উঠে ভ্রমণরত যাত্রীদের যৌনমিলনে আহ্বান করে।(১০) CB radio : এইসব যৌনকর্মীগণ সম্ভাব্য ট্রাক ড্রাইভার ক্লায়েন্টদের সঙ্গে এক্সচেঞ্জ (অপভাষা) বার্তা CB রেডিও ব্যবহার করে হাইওয়ে বরাবর ড্রাইভ করে ট্রাক স্টপ বা পার্কিং এলাকায় যৌন-পরিসেবা দেয়। (১১) Other methods of solicitation : বিভিন্ন মিডিয়ার মাধ্যমে, যেমন নোটিশ বোর্ড এবং সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন, মোবাইল ফোন নম্বর সহ ‘যৌন কর্মী ক্যাটালগ’, ইন্টারনেট মাধ্যমে ভার্চুয়াল পতিতালয় এবং অন্যান্য অন্তরঙ্গ স্থানগুলিতে যৌন-পরিসেবা বিতরণ করা হয়। (১২) Phone-Sex with Recharge : এই এক ধরনের যৌনকর্মীর দেখা মেলে যাঁরা মোটা অঙ্কের মোবাইল রিচার্জের শর্তে রগরগে ফোন-সেক্স করে থাকে। (১৩) Massage Parlour : বিভিন্ন ম্যাসাজ পার্লার, বিলাসবহুল ফ্ল্যাট, নামি-দামি বিউটিপার্লারে মেল টু মেল, মেল টু ফিমেল, ফিমেল টু মেল, ফিমেল টু ফিমেল ম্যাসাজ দেওয়া হয়। প্রথমে মিনিট দশেক ক্লায়েন্টকে নগ্ন করে শুইয়ে ম্যাসাজ করা হয়। এই ম্যাসাজটুকু ক্লায়েট সন্তুষ্ট হলে তার মূল্য একরকম হয়, যদি ক্লায়েট আরও বেশি চায় বা যৌনমিলনে আগ্রহী হন তবে তার মূল্য একটু চড়াই হয়। এ পর্যায়ে প্রতি ঘণ্টার স্লাভে মূল্য নির্ণয় হয়।আজকাল বেশ্যালয়ের অন্দরমহলেও এরকম ম্যাসাজ পার্লারের ব্যবস্থা রাখা হয়।
এখন প্রশ্ন হল কারা বেশ্যাবৃত্তিকে পেশা হিসাবে বেছে নেন ? সমাজতাত্ত্বিকরা প্রচুর গবেষণা করেছেন কোন্ শ্রেণির মেয়েরা এই পেশা বেছে নেন। তাতে দেখেছি প্রায় একবগ্গা সিদ্ধান্ত বেরিয়ে এসেছে বারবার। সমাজতাত্ত্বিকরা সেই ভাঙা রেকর্ডের মতো দুঃখের কাহিনি শোনাতে থাকে। সাহিত্যিক, কলামিস্ট, সাংবাদিকরাও একই গল্প শোনাতে থাকেন। দুঃখ বাজারে ভালো বিকোয়। তাই এরা শুধুই দুঃখ বেচেন। শুধু সাহিত্যিক, কলামিস্ট, সাংবাদিকরা কেন – বেশ কিছু এনজিও সংস্থাও দুঃখীদের দুঃখ-উদ্ধারকারী সেজে মোটা অঙ্কের বিদেশি মুদ্রা ঘরে তুলছেন। বেশ্যারা যে তিমিরে ছিলেন সেই তিমিরেই থাকেন।তবে দুঃখ যে একেবারেই নেই একথা আমি একবারও বলব না। দুঃখ অবশ্যই আছে। বিভিন্ন শ্রেণির বেশ্যাদের কাছাকাছি গিয়ে সমীক্ষা করে দেখেছি এই পেশায় আগতরা সবাই দুঃখী নয়। তবে মেয়েলি স্বভাবজাত কারণে “দ্যাখো, আমি কত সতী” বাধ্য হয়েই এসেছি এমন একটা গল্প শোনানোর প্রবণতা লক্ষ করা যায় কারোর কারোর মধ্যে। আমি ব্যক্তিগতভাবে দেখেছি অনেক বেশ্যাদের ঘরবাড়ি কীরকম আলিশান, সম্ভ্রান্ত। আর্থিক অবস্থাও যথেষ্ট সচ্ছল। গ্ল্যামার দুনিয়ার কত স্বনামধন্য মেয়েরা এসকর্ট গার্লের সার্ভিস দেয় তাঁর খবর কে রাখে ? টলিউড, বলিউড, কলিউড, হলিউড, মলিউড – সব জায়গাতেই একই ছবি লক্ষ করা যাবে।এরা কেউ গরিব নন, আর্থিক অনটনে দিন গুজরান করেন না। রাতারাতি ধনী হওয়ার লোভ ও যথেচ্ছ যৌনতার হাতছানিতে অত্যন্ত গোপনে দেহব্যাবসা অব্যাহত রাখেন এরা।ইচ্ছাকৃতভাবে যাঁরা দেহব্যাবসায় আসেন তাঁদের কথায় পরে আসছি। তবে অনিচ্ছাকৃতভাবে যাঁদের বেশ্যাবৃত্তিতে এসে পড়তে হয় তাঁদের কথা দিয়েই শুরু করব।
(১) প্রতারক কর্তৃক পাচারকৃত বেশ্যা : বেশ্যালয়ে যে সমস্ত বেশ্যারা বেশ্যাবৃত্তির মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করেন, তাঁরা প্রায় সকলেই কোনো-না-কোনো প্রতারকের হাত ধরে পতিত হয়েছেন। এই মহামান্য প্রতারকরা কখনো সৎ বাবা বা সৎ মা, কখনো দাদা-কাকা-মামা, কখনো-বা প্রেমিকপ্রবর, কখনো স্বামী, কখনো ওয়েল উইশারের ছদ্মবেশে সুজনবন্ধু। এরা দারিদ্রতার সুযোগ নিয়ে চাকরি বা কাজের বা বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে শহরে এনে বেশ্যাপল্লিতে মোটা টাকায় মেয়েদেরকে বিক্রি করে দেয়। অত্যন্ত সংঘবদ্ধ এই নারীদেহ পাচারের ব্যবসা – গুন্ডা. দালাল থেকে শুরু করে বাড়িওয়ালা-বাড়িওয়ালি পর্যন্ত বিভিন্ন ধরনের মানুষ মিলে এই জাল বিস্তার করেছে।
পণ্য সর্বস্য আগ্রাসী দুনিয়ায় সবচেয়ে লোভনীয় পণ্য হল মানুষ – লোভনীয় মানুষের চাইতে সবচেয়ে লোভনীয় পণ্য কী ? অবশ্যই মেয়েমানুষ। মেয়েমানুষের ব্যাবসা অত্যন্ত লাভজনক ব্যাবসা। প্রায় বিনিয়োগহীন ব্যাবসা, তাই এই ব্যাবসার সঙ্গে জড়িয়ে আছেন সমাজের হতদরিদ্র নিম্নস্তর থেকে সমাজের উঁচুস্তরের মহামান্য মানুষজনও।বেশ্যাপল্লির নারীর জোগান মিটবে কীভাবে ? কীভাবে সমৃদ্ধ হবে বেশ্যাপল্লি “নয়া চিড়িয়া”-য় ? অতএব পাচার – এ পাচার-যজ্ঞ আজ এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে, মাতৃগর্ভের কন্যাসন্তানটিও পাচার হয়ে যেতে পারে। এক্ষেত্রে অধিক উৎপাদনশীল বাবা-মায়েরাও মেয়ে-সন্তানদের বিক্রি করে থাকে।এইসব বাবা-মায়েদের কাছে প্রতিটি সন্তানই রোজগারের যন্ত্র।পুরুষ-সন্তানদেরও ঠেলে দেওয়া হয় অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ কর্মজীবনে, শৈশবেই।মেয়ে-সন্তানদের অগতির গতি পাচারকারী। পাচারকারী প্রাচীন যুগেও ছিল, এরাই “বিট” নামে পরিচিত ছিল – এখন এরা “আড়কাঠি”।একদা যেটা সম্রাট বা রাজা বা জমিদাররা নিজস্ব লেঠেল বাহিনীদের কাজে লাগিয়ে মেয়েদের তুলে আনত বাইজি বা বেশ্যা বা রক্ষিতা বানানোর জন্য, আজও মেয়েদের ফুসলিয়ে আনা হচ্ছে প্রলোভন দেখিয়ে। ভারতে ব্রিটিশ আমলে ইংরেজশাসকগণের এবং সেনাদের মনোরঞ্জনের জন্য নতুন নতুন বেশ্যাপল্লি গড়ে ওঠে। সেই বেশ্যাপল্লিগুলি ফলেফুলে ভরিয়ে তুলতে ইংরেজদের পা-চাটা কতিপয় নারী-পুরুষ প্রত্যন্ত গ্রামে পাড়ি জমাত অসহায় মেয়েদের সংগ্রহ করতে। তার বিনিময়ে পাওয়া যেত প্রচুর অর্থ ও উপঢৌকন।এমনকি অতি লোভে দেবদাসীদের (যদিও দেবদাসীদের দিয়েও বেশ্যাবৃত্তি করানো হত মন্দিরে মন্দিরে) পর্যন্ত তুলে আনা হত এই বেশ্যালয়গুলিতে। ১৯৬০ সালের এক সমীক্ষায় জানা যাচ্ছে, ভারতে দেহব্যাবসা এক ব্যাপক আকার ধারণ করে এবং এই ব্যাবসার রূপ ও চরিত্র বদলে যায়, বদলে যায় খরিদ্দারদের রুচি ও ধরন। একদা যে স্ফূর্তি শুধু রাজরাজড়া,জমিদার এবং উচ্চ শ্রেণিদের মধ্যে কুক্ষিগত ছিল, ক্রমে ক্রমে তা হল সাধারণেরও স্ফূর্তির ব্যাপার। যত পয়সা তত স্ফূর্তি – যথাযথ পয়সা ফেললেই নারী-শরীর এক্কেবারে হাতের মুঠোয়।কে নয় – ব্যাগ কাঁধে ছাত্র, বাস-লরির চালক, রিক্সাচালক থেকে শুরু করে পুরু চশমাধারী পড়ন্ত-যৌবন পুরুষ, ধুতি-পাঞ্জাবি লপেটাবাবু, জিনস, সাফারি, আদালতের সামলা-পরিহিত তাবৎ পেশার লোকজনদের দেখা মেলে বেশ্যাদের পাড়ায় পাড়ায়।ভারতের প্রধান প্রধান শহর কলকাতা, দিল্লি, মুম্বাইতেই বেশ্যালয় সীমাবদ্ধ রইল না – প্রধান প্রধান শহর ছাড়িয়ে-ছাপিয়ে একেবারে জেলায় জেলায় জেলার বিভিন্ন শহর পর্যন্ত বিস্তার লাভ করেছে। আর যত প্রসার ততই পাচার। যত চাহিদা ততই জোগান – যেমন চাহিদা চড়চড় করে বাড়ছে, তেমনি জোগানও তড়তড় করে আসছে। প্রথম প্রজন্মের মেয়েরা ছিল বেশিরভাগই বিধবা বা মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে বা এমন গৃহবধু যাদের প্রেমিকারা মায় পরিচিত জনেরা প্রতারণা করে এই পথে পাচার করে। উনিশ শতকের বেশিরভাগ সময় জুড়ে মূল কারণ এরকমটা থাকলেও পরবর্তীকালে দারিদ্রই মূল কারণ হয়ে ওঠে। প্রায় ৪৪ শতাংশ মেয়েই দারিদ্রের জন্য বেশ্যাবৃত্তির পথে এসে পড়ে।ধীরে ধীরে পাচারকারীদের হাত লম্বা হতে থাকে। এতটাই লম্বা যে, পাচারকারীদের সেই হাত আন্তর্জাতিক সিন্ডিকেট পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। পাচার-বাজারে অসহায়-হতদরিদ্র মেয়েরা মড়ি-মুড়কির মতো বিকিয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত-প্রতিক্ষণ। কারণ বিনাপুঁজিতেই এই ব্যবসা শুরু করে দেওয়া যায় – কে নেই এই পাচারের ব্যাবসায় ? অন্তিম-যৌবনা প্রাক্তন বেশ্যারমণী থেকে শুরু করে সাধারণ ঘরের পুরুষ, সাধারণ ঘরের নারী, পাশের বাড়ির বউদি, পাশের বাড়ির দাদা, ধনীঘরের লালটুস প্রেমিকপ্রবর, পাড়াতুতো জেঠিমা-কাকিমা সবাই এ কাজে নেমে পড়েছেন। শ্রমিক জোগান দেওয়া ঠিকাদার এবং কর্মনিয়োগকারী এজেন্টরাও এখন মেয়ে সাপ্লাইয়ের কাজে নেমে পড়েছে।
(২) যুদ্ধ-সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-দেশভাগের পরিণতিতে বেশ্যা : আদিম কাল থেকে যুদ্ধের নামে পুরুষের বর্বরতার শিকার নারী — এটা সর্বত্র সত্য, সব দেশেই। মধ্যযুগের ইউরোপেও কোনো গোষ্ঠী যুদ্ধে হেরে গেলে মহিলাদের ধরে ধরে ধর্ষণ করা হত।ইতিহাসেও দেখা যাবে মেয়েদের জ়োর করে ধর্ষণ করে নিজেদের ধর্মে আনার চেষ্ঠা করেছে বিভিন্ন ধর্মাশ্রিত শাসক-সম্প্রদায়।বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে পরিকল্পিতভাবে গণ ধর্ষণের শিকার হয়েছে প্রচুর বাঙালি রমণী। ঠিক কতজন যে ধর্ষণের শিকার হয়েছে তার সঠিক কোনো পরিসংখ্যান কারোর জানা নেই। বীণা ডি’ কস্টা তার “Bangladesh’s erase past” প্রবন্ধে জানাচ্ছেন যে, সরকারি হিসাব অনুযায়ী একাত্তরে ধর্ষণের শিকার হতে হয়েছিল দুই লক্ষ নারীকে। একটি ইটালিয়ান মেডিক্যাল সার্ভেতে ধর্ষণের শিকার নারীর সংখ্যা বলা হয়েছে চল্লিশ হাজার। লন্ডন ভিত্তিক International Planned Parenthood Federation (IPPF) এই সংখ্যাকে বলেছে দুই লাখ। অন্যদিকে যুদ্ধ শিশুদের ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত সমাজকর্মী ডঃ জিওফ্রে ডেভিসের মতে এই সংখ্যা এর চেয়েও অনেক বেশি। সুজান ব্রাউনমিলারও ধর্ষিতার সংখ্যা চার লাখ বলে উল্লেখ করেছেন। আট বছরের বালিকা থেকে শুরু করে পঁচাত্তর বছরের ঠাকুরমা-দিদিমার বয়সি বৃদ্ধাও এই ধরনের লালসার শিকার হয়েছিল। পাকসেনারা ঘটনাস্থলেই তাদের পৈচাশিকতা দেখিয়েই ক্ষান্ত হয়নি ; প্রতি একশো জনের মধ্যে অন্তত দশ জনকে তাদের ক্যাম্প বা ব্যারাকে নিয়ে যাওয়া হত সৈন্যদের জন্য। রাতে চলত আর-এক দফা নারকীয়তা। কেউ কেউ হয়তো আশিবারেও বেশি সংখ্যক ধর্ষিত হয়েছে ! এই পাশবিক নির্যাতনে কতজনের মৃত্যু হয়েছে, আর কতজনকে মেরে ফেলা হয়েছে তার সঠিক সংখ্যা হয়তো কল্পনাও করা যাবে না (Brownmiller, p. 83)। কতজন ধর্ষিতা নারী গর্ভবতী হয়েছিলেন এবং কতজন শিশু জন্মগ্রহণ করেছিল তা পুরোপুরি অনিশ্চিত। সামাজিক অপবাদের হাত থেকে বাঁচার জন্য অনেক মা-ই সেইসময় আত্মহত্যা করেছিলেন। অসংখ্য গর্ভবতী মহিলা চলে গিয়েছিলেন ভারতে বা অন্য কোথাও গোপনে সন্তান প্রসব করার জন্য। অনেক শিশু জন্মেছিল ঘরে দাইয়ের হাতে, যার কোনো রেকর্ড নেই।সরকারি এক হিসাবে জন্মগ্রহণকারী শিশুর সংখ্যা বলা হয়েছে তিন লাখ। কিন্তু সেই পরিসংখ্যানের পদ্ধতি ছিল ত্রুটিপূর্ণ। ডঃ ডেভিসের মতে প্রায় দুই লক্ষ রমণী গর্ভবতী হয়েছিলেন।শেখ মুজিব ধর্ষিতা নারীদেরকে বীরাঙ্গনা উপাধিতে ভূষিত এবং তাদেরকে নিজের মেয়ে হিসাবে উল্লেখ করলেও সেই মেয়েদের সন্তানদের ব্যাপারে তার কোনো আগ্রহই ছিল না। তিনি পরিষ্কারভাবে বলে দেন যে, পাকিস্তানীদের রক্ত শরীরে আছে এমন কোনো শিশুকেই বাংলাদেশে থাকতে দেওয়া হবে না। যে-কোনো যুদ্ধের বাস্তবতা এই যে, যুদ্ধ করেন পুরুষরা। বিজয়ী বা পরাজিত কোনো পক্ষে নারী-যোদ্ধা নেই। যুদ্ধে নারী লুণ্ঠিত হয়, নারী ধর্ষিত হয়, শত্রুপক্ষ যুদ্ধে নারীধর্ষণের তাণ্ডব চালায়। কারণ নারীরা হয় অধিকার স্থাপনের চূড়ান্ত উপায়।যুদ্ধের প্রান্তরে নয়, জয়-পরাজয় নারীর শরীরে হয় নির্ধারিত।ধর্ষণের গল্প বলছি না, বলতে চাই ট্র্যাজেডির কাহিনি। যাঁদের জন্য নারীর সম্মান ধুলিস্যাৎ হল তাঁরাই প্রত্যাখ্যান করল ঘৃণাভরে। সেইসব বীরাঙ্গনা নারীর বেশিরভাগটাই বারপল্লির বারাঙ্গনা হয়েই থেকে যেতে হল।দেশ স্বাধীন হয়ে যায়, সম্মান পায় না ধর্ষিতা বীরাঙ্গনা। মনে রাখতে চায় না কেউ। সমাজ “বেশ্যা” বলে তিরস্কার করে তাঁদের। অতএব অভাগাদের আশ্রয়ের শেষ ঠিকানা – বেশ্যালয়। সমৃদ্ধ হয় বেশ্যালয়। অবশ্য পরবর্তী সময়ে বীরাঙ্গনা নারীদের মুক্তিযোদ্ধা এবং তাদের সন্তানদের মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। কাজেই তাদের এখন ‘বেশ্যা’ বললে আইনত শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসাবে বিবেচিত হয়!
১৯৪৬-এ রক্তক্ষয়ী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হল, ১৯৪৭ সালে দ্বিজাতিতত্ত্বের উপর দাঁড়িয়ে ভারতের পাঞ্জাব এবং বাংলা ভেঙে পাকিস্তান হল। লাখো লাখো হত্যার মধ্য দিয়ে দুটি স্বতন্ত্র দেশের নতুন পতাকা উড়ল, লাখো লাখো নারীর ধর্ষণের বিনিময়ে শান্ত দুই যুযুধান সম্প্রদায়।কে মনে রেখেছে তাঁদের কথা, যে মহিলারা ভিন্ন সম্প্রদায়ের দ্বারা ধর্ষিতা হওয়ার অপরাধে সমাজে ঠাঁই না-হয়ে প্রান্তিক হয়ে গেল ? যুদ্ধ-সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-দেশভাগের পরিণতিতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন মেয়েরা। মেয়েদের দিকেই প্রথম আক্রমণটা নেমে আসে বুলডোজারের মতো। কারণ মেয়েরাই সবচেয়ে নরম শিকার — জাতে মারা যায়, ধর্মনাশ করা যায়। বেশ্যাপল্লিগুলি ভরে ওঠে।
(৩) উপনিবেশের ফলে বেশ্যা : শুধু ভারতবর্ষই নয়, পৃথিবীর এমন কোনো অবশিষ্ট দেশ নেই, যে দেশ কোনো-না-কোনো লুটেরা দ্বারা উপনিবেশ হয়নি। বিশেষ করে যদি ভারতের কথাই ধরি, তাহলে বলা যায় – সমগ্র পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বোধহয় ভারতই ধর্ষিত হয়েছে। প্রাচীন যুগের আর্য আগমন থেকে শুরু করে সর্বশেষ ব্রিটিশ আগমন পর্যন্ত – সর্বযুগে যুগান্তরে ধর্ষিত হয়েছে নারী, লুণ্ঠিত হয়েছে নারী। নারী অপহরণ আর ধর্ষণের মধ্য দিয়ে স্থানীয় প্রতিপক্ষকে শায়েস্তা বা জব্দ করেছে আক্রমণকারী প্রতিপক্ষ।স্থানীয় প্রতিপক্ষকে বশে আনতে ধনসম্পদ করায়ত্ত এবং নারী অপহরণ হারেম ভরানোই ছিল আক্রমণকারী প্রতিপক্ষের প্রধান কৌশল। সময়ের পথ ধরে ইতিহাসের নানা চড়াই-উতড়াই অতিক্রম করে অখণ্ড ভারত উপমহাদেশ খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে তৈরি হয়েছে আজকের ভারত, দক্ষিণ এশিয়ার দেশসমূহ।মধ্যযুগের ভারতের ইতিহাস জুড়ে রয়েছে বিদেশি শক্তির আগ্রাসন, পরাধীনতা এবং সাম্রাজ্যবাদ।লুণ্ঠিত হয়েছে নারী, বারবার। নারী ধর্ষিতা হয়েছে অত্যন্ত নির্দয়তায়।ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হয়েছে বেশ্যাবৃত্তির অন্ধকার গলিতে।
(৪) পর্নোছবির বেশ্যা : পর্নোবেশ্যামি ঠিক কবে থেকে শুরু হয়েছে ? দেখব Wikipedia কী বলছে – “Production of erotic films commenced almost immediately after the invention of the motion picture. Two of the earliest pioneers were Frenchmen Eugène Pirou and Albert Kirchner. Kirchner (under the name “Léar”)
নারী ও শিশুদেহের বাণিজ্যিক ব্যবহারের আর-এক ভয়াবহ রূপ পর্নোগ্রাফি। এর চর্চা আধুনিক প্রযুক্তির হাত ধরে গোটা পৃথিবীব্যাপী মহামারীর রূপ পরিগ্রহ করেছে। এ খাতটিরও অর্থনৈতিক বাজার অনেক বড়ো, অর্থাৎ বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের। বিশ্বখ্যাত নারীবাদী নেত্রী ও আইনজীবী ক্যাথরিন ম্যাককিননের মতে, পর্নোগ্রাফি শিল্প হিসেবে হলিউডের চেয়ে অনেক বড়ো। স্যাটেলাইট টিভি ও ইন্টারনেটের মাধ্যমে যার দ্রুত বিস্তার ঘটেছে। উচ্চবিত্ত, উচ্চমধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত পরিবারের ঘরে ঘরে ইন্টারনেট কানেকশন এখন আর বিস্ময়কর কিছু না। চাইলেই তারা সেক্স সাইট ব্রাউজ করতে পারছে, ডাউনলোড করে নিতে পারছে যে-কোনো পরিমাণ পর্নো ফুটেজ। যাদের ঘরে সে সুবিধে নেই তাদের জন্য রয়েছে অলিতেগলিতে গজিয়ে ওঠা সাইবার ক্যাফে। এক ঘণ্টা ব্রাউজ করার জন্য ক্যাফেগুলোতে চার্জ নেয়া হয় মাত্র ২০ থেকে ২৫ টাকা এবং এর বিনিময়ে একটিমাত্র ক্লিকেই পৌঁছে যাওয়া যায় ভারচুয়াল যৌনমিলনের জগতে।পর্নোগ্রাফির মাধ্যমে যারা যৌনসঙ্গম করে তারাও আর-এক ধরনের বেশ্যামি করে থাকে।এ ধরনের বেশ্যামি ভারত-বাংলাদেশসহ প্রায় সব বিশ্বেই নির্মাণ হয়ে থাকে। কোথাও গোপনে, আবার কোথাও ওপেনে। আমেরিকায় পর্নো-ইন্ডাস্ট্রি রাষ্ট্র-স্বীকৃত। বিভিন্ন বয়সের অসংখ্য মহিলারা পর্নোফ্লিমে অংশগ্রহণ করেন মোটা টাকা রোজগারের কারণে। পর্নো ইন্ডাস্ট্রিতে অসংখ্য মহিলারা প্ররোচনার শিকার হয় নিশ্চয়, একথা অস্বীকার করার কোনো জায়গা নেই। একইভাবে অসংখ্য মহিলা মোটা টাকা রোজগারের টানে চোখ বুঝে ঝাঁপিয়ে পড়ে। সারা বিশ্বে কত রেভিনিউ আদায় হয় এই সেক্স-অ্যাডভেঞ্চার থেকে ? Wikipedia বলছে — Globally, pornography is a large scale business with revenues of nearly $100 billion which includes the production of various media and associated products and services.
মোটা টাকার হাতছানি এড়ানো যে খুব কঠিন, তা বিশ্বের পয়লা নম্বর পর্নস্টার সানি লিওন একাধিক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, তাঁর সেক্স করাটা প্যাশন। তিনি স্ব-ইচ্ছায় এই পেশা বেছে নিয়েছেন। স্টেইট, লেসবো – সব ধরনের সেক্স করতে সানি লিওন সমান পারদর্শী।পর্ন-বাজারে সানি লিওন মুকুটহীন সম্রাজ্ঞী। কোটি টাকা তাঁর দাম। ন্যুড ফোটো-সেশন দিয়ে তাঁর যৌনজীবন শুরু করেছিলেন, তার পর বিশ্বের এক নম্বর পর্নস্টার। ৩৫ ঊর্ধ্ব প্রায় বিগত যৌবনা সানি লিওন বর্তমান বলিউডে অভিনেত্রী হিসাবে বাকি জীবনটা কাটাতে চান বলে অনেকে মনে করেন। স্বামী ড্যানিয়েল ওয়েবর সহ সানি লিওন প্রায় ৫৬টি পর্নছবিতে সেক্সপ্লে করেছেন এবং ৫৯ ব্লুফ্লিমও পরিচালনা করেছেন। শুধু সানি লিওন নয় – প্রিয়া অঞ্জলি রাই, দেবিকা, রেশমা, শাকিলা, Peta Jensen, Lisa Ann, Hitomi Tanaka, Christy Mack, Natasha Dalce, Kristina Rose, Holli Sweet, Alexa Loren, Olivia Lovely প্রমুখ পর্নস্টাররা রোজগারের উদ্দেশ্যে স্বেচ্ছায় সেলুলয়েডে যৌনমিলন করেছেন। বিশ্বাস না-হয় Wikipedia দেখুন।রেড লাইট এরিয়ার বাসিন্দাদের সঙ্গে পর্নস্টারদের বেশ্যামির মূলগত পার্থক্য হল – রেড লাইট এরিয়ার বাসিন্দারা নির্ধারিত অর্থের বিনিময়ে রদ্ধদ্বার কক্ষের ভিতরে খরিদ্দারদের সঙ্গে যৌনমিলন করেন, পর্নস্টাররা কোটি কোটি মানুষদের দেখানোর জন্য আর্থিক চুক্তিতে মুভি ক্যামেরার সামনে অত্যন্ত নিখুঁতভাবে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ প্রদর্শন সহ যৌনাচার করেন।পর্নস্টাররা লিখিত চুক্তির মাধ্যমেই তাঁদের যৌনকর্ম সেলুলয়েড বন্দি করেন, রেড লাইট এরিয়ার বাসিন্দারা সম্পূর্ণ মৌখিক চুক্তিতে যৌনমিলন করেন।
(৫) সেলুলয়েডের বেশ্যা : রাজকাপুর খুব কায়দা করে সেলুলয়েডে নারীর শরীর বিক্রি করেছেন। সেটাই সংশ্লিষ্ট ছবির জন্য সংশ্লিষ্ট নায়িকার প্রতি পরিচালকের মোলায়েম শর্ত। যেমন ‘সত্যম শিবম সুন্দরম’ ছবিতে জিনাত, রাম তেরি গঙ্গা মৈলি’ ছবিতে মন্দাকিনী।এরপর নির্মাতাদের আর পিছন ফিরে তাঁকাতে হয়নি।গুটি গুটি পায়ে সেলুলয়েডের পর্দায় যৌনমিলনের দৃশ্যও ক্যামেরা-বন্দি করার সাহস জুগিয়ে ফেলেছেন। সেইসব দৃশ্য সেন্সরের জ্যাঠামিতে (!) বাণিজ্যিক রিলিজ না হলেও ইন্টারনেট রিলিজ হতে কোনো বাধা নেই।গাণ্ডু, মাশরুম (ছত্রাক), রঙ রসিয়া, কামসূত্র, কামসূত্র থ্রিডি, সিদ্ধার্থ, মচালতা জওয়ানি, রেশমি কি জওয়ানি, গোলাবি রাতে, হর রাত নই খিলাড়ি ইত্যাদি। গাণ্ডুর নায়িকা, ছত্রাকের নায়িকা, রঙ রসিয়ার নায়িকা, কামসূত্রের নায়িকদের সাধারণ মানুষ ‘বেশ্যা’ বলেই অভিহিত করেন। এইসব মুভির নায়িকা-পরিচালকরা প্রায়ই একটা মজার কথা বলে থাকেন, তা হল – “চিত্রনাট্যের ডিম্যান্ড”। কী এই চিত্রনাট্যের ডিম্যান্ড” ? কে বানায় এই চিত্রনাট্য ? কে ক্রিয়েট করেন ডিম্যান্ড ? স্বর্গ থেকে কি আসে ডিম্যান্ড ? ঈশ্বর-প্রেরিত ? শিল্পের নামে বেশ্যামি ! সেন্সর ছাড়পত্র না দিলেও ওই যৌনমিলনের দৃশ্যগুলি টেক করা হয়। দৃশ্যগুলি যে সেন্সর ছাড়পত্র দেবে না, দৃশ্যগুলি যে দিনের আলোর মুখ দেখবে না – সেটা কি প্রযোজক, পরিচালক, অভিনেতা-অভিনেত্রীরা জানেন না ? কোন্ ধনকুবেরদের জন্য এই সেলুলয়েড ভরতি যৌনমিলন ? শুধু ভারতেই নয়, পৃথিবীর প্রায় সমস্ত দেশেই সিনেমার নামে এক শ্রেণির অভিনেতা-অভিনেত্রীরা যৌনমিলনের দৃশ্য সেলুলয়েড-বন্দি করেন। ‘গাণ্ডু’ ও ‘কসমিক সেক্স’ মুভির অভিনেত্রী ঋ এক সাক্ষাৎকারে কী বলছেন শুনুন, “আমার শরীরের মালিকানা আমার। দোকান সাজিয়ে বসেছি। বেচতে লজ্জা কীসের ! আমার বাবু আর দালাল আমি নিজেই। যাঁরা আমার শরীর দেখে লজ্জা পান, উত্তেজিত হয়ে পড়েন, তাঁরা হোন। কিন্তু এই যে প্রতিনিয়ত তাঁদের আদিম সত্তাকে ‘ট্রিগার’ করি, এটাই ‘কানেকশন উইথ মাই অডিয়েন্স’(সূত্র : http://eisamay.indiatimes.com/city/kolkata/an-intervew-with-rii-and-parno-mitra-about-tollygunge-nudity-by-starupa-basu/articleshow/45591512.cms)”।
অভিনেত্রী বা নায়িকারা কেন যৌনকর্মী নয় ? এমন প্রশ্ন উঠেছে খোদ যৌনকর্মীদের পক্ষ থেকেই।‘অল ইন্ডিয়া নেটওয়ার্ক অব সেক্স ওয়ার্কার্স’-এর পক্ষ থেকে যৌনকর্মীরা এমন প্রশ্নই বিশ্বের কাছে।যৌনকর্মীদের প্রশ্ন সিনেমার নায়িকা হওয়ার জন্যেও তো বিক্রি করতে হয় শরীর।সেক্ষেত্রে যিনি শরীর বিক্রি করলেন তাঁকে তো যৌনকর্মী বলা হয় না। তাঁর পরিচয় প্রদানেও তো কোনো অসম্মান অথবা রুচিহীন শব্দ ব্যবহার করা হয় না। তাহলে শুধুমাত্র বেঁচে থাকার জন্য শরীরের বিনিময়ে উপার্জনের ক্ষেত্রে কেন যৌনকর্মী পরিচয় পেতে হবে ? শরীরের বিনিময়ে নায়িকা হওয়ার বিষয়টি খুব প্রচলন একটি গোপন সত্য হিসাবে বাংলাদেশেও প্রতিষ্ঠিত হয়ে আছে। কথিত আছে, অধিকাংশ নায়িকাকেই শরীর উপঢৌকন দিয়ে থাকেন পরিচালক কিংবা প্রযোজক কিংবা প্রভাবশালীদের কাছে। শরীরের বিনিময়ে তারা সিনেমায়, নাটক ইত্যাদিতে কাজের সুযোগ পান এবং সমাজে তারকা খ্যাতি অর্জন করে বিখ্যাত হয়ে ওঠেন। যৌনকর্মীদের প্রশ্নটিকে সেক্ষেত্রে উড়িয়ে দেওয়া কেন ? নায়িকা পরিচয় নিয়ে তারকাখ্যাতি নিয়ে যৌন আবেদন ছড়িয়ে তারা তো সুখেই আছেন। তাহলে শুধুমাত্র বেঁচে থাকার জন্য শরীরের বিনিময়ে উপার্জনের ক্ষেত্রে কেন যৌনকর্মী পরিচয় পেতে হবে? কোনও কোনও ক্ষেত্রে যৌনকর্মীদের পরিচয়ে কেন ব্যবহৃত হবে রুচিহীন শব্দ ? সম্মানের সঙ্গে নিজেদের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে এবার এমনই প্রশ্ন তুলে দিলেন যৌনকর্মীরা। বদল ঘটছে ধ্যান-ধারণায়ও। বদল ঘটছে যৌনতা আর যৌনসুখের রকম-ধরনের ক্ষেত্রেও। তা সত্ত্বেও, সমাজের বিভিন্ন অংশে এখনও যৌনকর্মীদের প্রতি নানা রকমের মনোভাবও প্রকাশ পায়। অথচ ওই আদিম সুখের জন্যই আবার বিভিন্ন ক্ষেত্রে কৌতূহলও কম নেই। যৌনকর্মীদের সঙ্গে সিনেমার নায়িকাদের একাংশকে তুলনা করে প্রশ্নও তুলে দিয়েছেন । এই প্রসঙ্গে যে যৌনকর্মীরা যথেষ্ট ক্ষুব্ধ, তাও বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। এআইএনএসডব্লু-র নতুন কমিটির যুগ্ম সচিব তথা বিহারের পূর্ণিয়ার যৌনকর্মীদের সংগঠন আম্রপালি কল্যাণ সমিতির সচিব রেখা রানি বলেন, ফিল্মের নায়িকা হওয়ার জন্যেও তো শরীর বিক্রি করতে হয়। যাঁরা শরীর বিক্রি করে নায়িকা হন, তাঁদের কেন সেক্স ওয়ার্কার বলা হয় না ? অত্যন্ত ক্ষোভের সঙ্গে তিনি বলেন, যৌনকর্মীদের পরিচয় দেওয়ার জন্য কোনও কোনও ক্ষেত্রে এমন শব্দ ব্যবহার করা হয়, যে শব্দ ওই নায়িকাদের জন্য তো ব্যবহৃত হয় না ? রেখা রানি বলেন, শরীরের বিনিময়ে নায়িকা হওয়াও তো সেক্স ওয়ার্কারের মতো কাজ। আমরাও তো সেক্স করে উপার্জন করি। তাহলে আমাদের ক্ষেত্রে কেন অন্য রকমের আচরণ করা হবে ? নায়িকা হওয়ার জন্য সেক্স করতে হয়, আর আমরাও পেট চালাতে সেক্স করি। দুই ক্ষেত্রই তো একই রকমের। তাহলে কেন আমাদের প্রতি অন্য রকমের ব্যবহার করা হবে? মহারাষ্ট্রের নাসিকের যৌনকর্মীদের সংগঠন দিশা মহিলা বহুউদ্দেশীয় সংগঠনের সচিব তথা এআইএনএসডব্লু-র অপর যুগ্ম সচিব লতা কাপসে বলেন, শরীর বিক্রি করে নায়িকা হলেও সেক্ষেত্রে সেক্স ওয়ার্কার বলা হয় না। আর আমরা শরীরের বিনিময়ে বেঁচে থাকলেও আমাদের সেক্স ওয়ার্কার বলা হয়। বিভিন্ন ক্ষেত্রে আমাদের অসম্মানিত করা হয়।
(৬) শিল্পের ক্যানভাসে বেশ্যা : ‘রং রসিয়া’ মুভিতে দেখানো হয়েছে চিত্রশিল্পী রবি ভার্মার চিত্রশিল্পের মডেল সুগন্ধিকে, যিনি চিত্রশিল্পীর চিত্রশিল্পের জন্য নগ্ন হতেন এবং কখনো-সখনো চিত্রশিল্পীর সঙ্গে যৌনমিলনও করতেন। সুগন্ধি বিলক্ষণ বুঝেছিলেন তিনি শিল্প এবং প্রেমের জন্য নগ্ন হলেও রবি ভার্মা, রক্ষণশীল সমাজ, রাষ্ট্র তাঁকে ‘বেশ্যা’ হিসাবেই দেখত।স্বীকৃতিহীন এক নারী সুগন্ধির পরিণতি হল গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা। চিত্রশিল্পীরা ছবি আঁকবেন, ভাস্কররা ভাস্কর্য গড়বেন – এ তো খুব সুখের ব্যাপার। শিল্প মনের বিকাশ ঘটায়, চেতনার মুক্তি দেয়। তাই বলে কথায় কথায় নগ্ন নারী কেন, নারীর শরীর কেন ? Wikipedia বলছে — The ‘nude’ figure is mainly a tradition in Western art, and has been used to express ideals of male and female beauty and other human qualities.
ঠিক কবে থেকে শিল্পীদের নগ্ন নারী প্রয়োজন হয়েছিল তা ঠিকঠাক সাল-তারিখ জানা না-গেলেও একথা বলাই যায়, পুরুষ-পরিচালিত পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় পুরুষরা নারীদের নগ্ন করতে নগ্ন দেখতে নানা অছিলায় লালায়িত ছিল। শুধু ছিল বলব কেন? আছে এবং থাকবে যতদিন পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা থাকবে। নগ্নচর্চা শুরু হয়ছে সম্ভবত রাজাদের ইচ্ছাপূরণে শিল্পীদের নিয়োগে। রাজারা নগ্নতা খুব পছন্দ করতেন। তাঁরা আদিরসাত্মক কাহিনি পছন্দ করতেন বলেই প্রাচীন সাহিত্য রগরগে যৌনকাহিনিতে ভরপুর। রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণ, সংস্কৃত সাহিত্যে আদিরসাত্মক এতটাই যে, মূল ভাষার কাহিনি অপ্রাপ্তবয়স্কদের পাঠ করা নিষিদ্ধই।শুধু অক্ষর-লেখনিতেই নয়, তুলিতে-ছেনিতেও নারীকে নগ্ন করার প্রয়াস শুরু হয়েছিল। সমালোচনার ঝড় এড়াতে মাহাত্ম্য জুড়ে দেওয়া হল শিল্পের নামে। শিল্প, তাই নারীকে যত খুশি নগ্ন করো আর সামনে বসাও, শোয়াও এবং দাঁড় করাও।নারীর নগ্নতা কি শুধু শিল্পই? দেখি তো Wikipedia কী বলছে – “Kenneth Clark noted that sexuality was part of the attraction to the nude as a subject of art, stating “no nude, however abstract, should fail to arouse in the spectator some vestige of erotic feeling, even though it be only the faintest shadow—and if it does not do so it is bad art and false morals.” According to Clark, the explicit temple sculptures of tenth-century India “are great works of art because their eroticism is part of their whole philosophy.” Great art can contain significant sexual content without being obscene. However sexually explicit works of fine art produced in Europe before the modern era, such as Gustav Courbet’s L’Origine du monde, were not intended for public display. The judgement of whether a particular work is artistic or pornographic is ultimately subjective and has changed through history and from one culture to another. Some individuals judge any public display of the unclothed body to be unacceptable, while others may find artistic merit in explicitly sexual images. Public reviews of art may or may not address the issue.”
শিল্পীদের কাছে এঁরা ‘মডেল’ নামে পরিচিত। কোথা থেকে আসে এইসব মডেল-নারীরা ? কেন আসে ? কোনো বাছবিচার নেই – এরা সাধারণত সামান্য রোজগারের আশায় নিম্নবিত্ত থেকে এলেও মধ্যবিত্ত থেকেও প্রচুর মেয়েরা আসছে। জানা যায়, অনেক ক্ষেত্রে শিল্পীদের স্ত্রীরাও নগ্ন মডেল হয়ে থাকে।তবে বেশিরভাগই মেয়েরা দারিদ্রতার কারণে সংসারে অভাব মেটানোর তাগিদে মডেল হতে আসে আর্ট একাডেমিগুলোতে।অত্যন্ত গোপনীয়তার সঙ্গে এই পেশায় আসেন মেয়েরা। মেয়েরা বলতে গৃহবধূ বুঝে নিন। এইসব গৃহবধূরা কলকাতা বা শহরে কাজে যাচ্ছেন বলে শিল্পীদের সামনে নগ্ন হন। তবে শুধু যে নারীদেরই নগ্ন করা হয়, তা কিন্তু নয় – সংখ্যায় নগন্য হলেও পুরুষরাও ন্যুড স্টাডিতে অংশগ্রহণ করে থাকেন। শিল্পরসিকদের বাজারে নারীদের চাহিদাই বেশি, কারণ নগ্ন নারীদের চিত্র-ভাস্কর্য খুব চড়া দামেই বিকোয়। নারীর শরীরী বিভঙ্গ ক্রমশ পণ্য হয়ে ওঠে।শিল্পীরা ‘ন্যুড আর্ট’-এ যে মাহাত্ম্যই আরোপ করুক না-কেন, আসলে এঁরা সমাজে ঘৃণিতই।এঁদের সমাজ ‘বেশ্যা’ বলেই চিহ্নিত করে, দেবী নয়।
(৭) দেবদাসী প্রথায় বেশ্যা : দক্ষিণের তিরুপতি মন্দিরে দেবদাসী সংগ্রহের প্রাচীন পদ্ধতি সম্পর্কে খ্রিস্টান মিশনারি অ্যাবে জে এ দুঁবা এক সমীক্ষায় লিখেছেন, বছরের একটি বিশেষ দিনে এই মন্দিরের পুরোহিতরা ভগবান বেঙ্কটেশ্বরের প্রতিমূর্তি নিয়ে শোভাযাত্রা বের করতেন এবং পথে যত সুন্দরী মেয়ে দেখত তাদেরকে দেবদাসী করার দাবি জানাত। এমনকি শুধু কুমারী নয়, বিবাহিত মহিলাদেরও দাবি করত তারা। এ থেকেই বোঝা যায়, দেবদাসী করার জন্য অনেক মেয়েকে জোর করেই তুলে আনা হত।দুবাঁর এহেন অনুধাবনযোগ্য।
শুধু ভারতেই নয়, বিশ্বের অনেক জায়গাতেই দেবদাসী ব্যবস্থা চালু ছিল। গবেষক পণ্ডিত জি জি ফ্রেজার পশ্চিম আফ্রিকায় দেবদাসী সংগ্রহের যে অভিনব উপায়ের উল্লেখ করেছিলেন তাতেও জানা যায় যে, মেয়েদের জোর করে তুলে এনে দেবদাসী বেশ্যা বা গণিকা বানানো হত। ফ্রিজার লিখেছেন, পুরোহিতরা একটা বিশেষ দিনে নগরের পথে পথে ঘুরে বেড়াত দিনে এবং সেদিন দুয়ারের বাইরে যত কুমারী মেয়ে পেত তাদের সবাইকে ধরে নিয়ে যেত মন্দিরে দেবদাসী করার জন্য।
রাজ্য জয় করে রাজারা যেমন গোরু-ছাগলের মতো মেয়েদের ধরে নিয়ে আসত, তেমনই সেইসব মেয়েদের ধরে ধরে এনে দেবদাসীও বানানো হত। এভাবেই দেবতার বউ বানানোর ছলে মেয়ে তুলে এনে বেশ্যা বানানো হত।১৮৬৭-৬৮ সালে জন শর্ট লন্ডনের অ্যানথ্রোপলজিক্যাল সোসাইটিতে ভারতের দেবদাসীদের নিয়ে একটি রিপোর্ট পেশ করেন। রিপোর্টে বলা হয়েছে, মন্দিরের দেবদাসীদের কুমারীত্ব বহিরাগত ধনীদের কাছে বিক্রি হত চড়া দামে। তারপর তারা বেশ্যাবৃত্তিকে জীবিকা হিসাবে গ্রহণ করতে বাধ্য হয়।
“সুতনুকা নাম দেবদাসিক্যী তং কাময়িত্থ বালানশেয়ে দেবদিন্নে নাম লুপদকখে”।“দেবদাসী” শব্দটির এটিই প্রথম ঐতিহাসিক দলিল।কৌটিল্য ‘দেবদাসী’ শ্রেণির আইনকানুন লিপিবদ্ধ করেননি। বলেছেন, সে দায়িত্ব পুরোহিততন্ত্রের।অর্থাৎ মধ্যযুগ থেকেই দেবদাসীদের উপর ওই পুরোহিতকুলের অধিকার ইতিহাস স্বীকৃত। দেবদাসীদের ভালোমন্দ নিয়ে কোনো আলোচনা পুরোহিততন্ত্র বরদাস্ত করত না। তাঁরা নিজেরা যেসব আইনকানুন বা বিধিনিষেধ আরোপ করেছিল, তা অতি সযত্নে গোপন রাখা হত। পুরোহিততন্ত্র নিজেদের স্বার্থেই দেবদাসীদের লোকচক্ষুর আড়ালে রাখতে চাইত।যা কিছু আড়ালে-আবডালে তাতেই মানুষের মোহ। ভবিষ্যপুরাণে “বেশ্যাকদম্বকং যস্তু দদ্যাৎ সূর্যায় ভক্তিতঃ সগচ্ছেৎ পরমং স্থানং যত্র তিষ্ঠতি ভানুমান” উল্লেখ আছে। মহাকবি কালিদাস তাঁর “মেঘদূতম্” মহাকাব্যে উজ্জয়িনীর মহাকাল মন্দিরে চামরহস্তা যে দেবদাসীদের পাওয়া যায়, কবিবর তাঁদের ‘বেশ্যা’ বলেই পরিচিত করিয়েছেন।দেবদাসী সৃষ্টির পিছনে ছিল সাধারণ মানুষের ভুল ধারণা – সাধারণ মানুষের ধারণা ছিল আত্মজাকে দেবদাসী পদে অভিষিক্ত করলে শুধু দাতার নয়, কন্যারও স্বর্গলাভের ব্যবস্থা পাকা হয়।
দেবদাসীদের মোটামুটি ছয় ভাগে ভাগ করা হয়েছে। যেমন – (১) বিক্রিতা, (২) ভৃত্যা, (৩) ভক্তা, (৪) দত্তা, (৫) হৃতা এবং (৬) অলংকারা।
(১) বিক্রিতা : অর্থের বিনিময়ে এদের কিনে নেওয়া হত। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এরা অত্যন্ত গরিব ঘরের সুন্দরী মেয়ে।একাধিক মেয়ের পিতা অর্থের বিনিময়ে এরকম দু-একটি মেয়েকে তুলে দিত পুরোহিতদের মালিকানায়। দেবদাসীর গর্ভজাতা মেয়েও এই দলের অন্তর্ভুক্ত হয়। এইসব মেয়েরা যৌবনপ্রাপ্তা হলে মন্দিরের পুরোহিত নিজে অথবা তাঁর প্রিয়পাত্রকে দিয়ে কৌমার্য খতম করে দেবদাসী পদে নিয়োগ করত।
(২) ভৃত্যা : বিশেষণ পড়েই বুঝতেই পারছেন এরা ভৃত্য, মানে ভৃত্যশ্রেণির।তাই স্বাভাবিকভাবেই এরা পদমর্যাদায় দেবদাসীর নিচে।যৌবনাদের কর্তব্য ছিল মন্দিরের অতিথিবর্গকে দেহদানের মাধ্যমে শরীরী-পরিসেবা দিতে হত।
(৩) ভক্তা : স্বেচ্ছায় কোনো রমণী (কুমারী, সধবা, স্বামী পরিত্যক্তা) মন্দির কর্তৃপক্ষের কাছে আত্মসমর্পণ করে যখন দেবদাসী হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন, তাহলে সে ভক্তা। ভক্তিই এঁদের আধার।এঁরা অতি উচ্চ সম্মানের পদাধিকারী।এঁদেরকে দেহদানে লিপ্ত হতে হত না।
(৪) দত্তা : কোনো ধর্মান্ধ পুণ্যলোভী পিতা মনবাসনা চরিতার্থ করার জন্য, মানত রাখার জন্য, স্বেচ্ছায় নিজের মেয়েকে মন্দিরে দান করলে সেই মেয়ে দত্তা হয়।
(৫) হৃতা : এই মেয়েদের মূলত চুরি করে আনা হত।নিরদ্দিষ্টার সন্ধান পেত না সেই অঞ্চলের নগর-কোটাল।সেই মেয়ে বহু দূর দেশে মন্দিরের অন্ধকূপে বন্দিনী হিসাবে থাকত।
(৬) অলংকারা : যে-কোনো শ্রেণির দেবদাসীই রূপ-গুণ নৃত্যগীত পারদর্শিতার বিচারে ওই শীর্ষপদে উন্নীতা হতে পারে। ঐর্হিক বিচারে এই মেয়েরা শীর্ষস্থানীয় হলেও শ্রদ্ধা ও সম্মানের দিক থেকে ভক্তা শ্রেণির নিচে।
দেবদাসী প্রথা নির্মূল হয়ে গেছে বলে অনেকে নিশ্চিন্তের ঢেঁকুর তোলেন। না, ঢেঁকুর তুলবেন না। কর্ণাটক, অন্ধ্রপ্রদেশ, মহারাষ্ট্রের কিছু মন্দিরে এখনও বিগ্রহের কাছে মেয়েদের বিসর্জন দেওয়া হয়। আজকের দেবদাসীরা আর দেবতার দাস নয়, তাঁরা লোলুপ পুরুষের লালসার শিকার। আর এই লালসা তৃপ্ত করতে এগিয়ে এসেছেন যেসব মন্দিরের রক্ষক, সেগুলির মধ্যে কর্ণাটকের ইয়েলাম্মা মন্দির।যেহেতু মন্দিরকন্যাদের বিয়ে হয় না, তাঁদের বিনা দ্বিধায় সম্ভোগ করেন সমাজের বিভিন্ন স্তরের পুরুষেরা।যে পূজারী দেবদাসী অর্পণের কাজে লিপ্ত, তিনি মোটা অর্থ প্রাপ্ত হন। যাঁরা এই প্রথাকে তাঁদের জাতিগত ঐতিহ্যের অংশ মনে করেন, তাঁরা বড়োই তৃপ্ত হন।তা ছাড়া ইয়েলাম্মা মন্দিরের মেয়েরা প্রকৃত অর্থে দেবদাসী নন। এঁরা না বোঝেন চৌষট্টি কলা, না কোনো ধনীব্যক্তির রক্ষিতা। একপ্রকার খোলাখুলিভাবেই দেহবিক্রিই তাঁদের কাজ।
মহারাষ্ট্র ও কর্ণাটকের প্রান্তিক জেলাগুলি থেকে প্রতি বছর প্রায় পাঁচ হাজার হরিজন শ্রেণির মেয়েদের ইয়ালাম্মার কাছে অর্পণ করা হয়। এই প্রথার পিছনে শুধু বহু যুগের বিশ্বাস এবং অজ্ঞতা আছে তা নয় – আছে আর্থিক কারণ, আছে পুরোহিতদের প্ররোচনা।প্রাচীন প্রথার এই দুঃসহ আধুনিকীকরণ সব থেকে বেশি প্রচলিত কর্ণাটকের বেলগাঁও, ধারওয়ার, বিজাপুর, গুলবর্গা ও বেলারি জেলায়। অন্যদিকে মহারাষ্ট্রের সিতারা, কোলাপুর, শোলাপুর ও ওসমানাবাদ অঞ্চলে এই প্রাচীন প্রথা প্রচলিত আছে।জানা গেছে, অন্ধ্রের নিজামাবাদ অঞ্চলে এবং তেলেঙ্গানাতে যথাক্রমে ১০ হাজার এবং ২৫ হাজার দেবদাসী আছে।বংশপরম্পরায় এই মেয়েরা পুরুষদের গ্রাস হয়েই থাকল।
সর্বোপরি যেটা না বললে অন্যায় হবে, তা হল – দেবদাসীরা ভারত-সংস্কৃতিকে দিয়েছে অনেক সম্পদ। কথাকলি, ভারতনাট্যম, মোহিনী-আট্টম, কুচিপুডি এ সবই দেবদাসী-সংস্কৃতি। যুগে যুগে এঁর দেবদিন্নদের উদ্বুদ্ধ করেছে মন্দিরগাত্র অলংকরণে – কোণারক, খাজুরাহো, বেলুড়, হালেবিড থেকে বাঁকুড়ার মন্দিরেই রয়ে গেল শাশ্বত প্রমাণ। তাঁদের দান অবিনশ্বর।
(৮) আকর্ষণীয় পেশা হিসাবে বেশ্যা : ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন এবং থাইল্যান্ড — এই চারটি দেশে পরিচালিত জরিপ তথ্য সাক্ষ্য দেয় যে, নিরক্ষর ও অদক্ষ মেয়েদের পক্ষে যেসব কাজ করা সম্ভব তার মধ্যে যৌনকর্মই সবচেয়ে বেশি অর্থাগম ঘটায়। যেমন মালয়েশিয়ার ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানিতে কাজ করে ১৯৯০-এ একজন দক্ষশ্রমিক বছরে উপার্জন করত ২৮৫২ আমেরিকান ডলার এবং অদক্ষ করত ১৭১১ ডলার। বিপরীতে সে সময়ের হিসেবে কোনো নিম্নমানের হোটেলে যৌনপরিষেবা দিয়ে একজন যৌনকর্মী সপ্তাহে মাত্র একদিন বারো ঘণ্টা কাজ করেই বছরে আয় করতে পারত ২০৮০ ডলার। স্কুল-কলেজের ছাত্রীরা এবং গৃহবধূরা আজকাল এই পেশায় আসছেন, স্বেচ্ছায়। খুব গোপনে প্রচুর টাকা রোজগারের নেশায় এখন ছুৎমার্গ ঘুচিয়ে ফেলছেন অনেকেই। দারিদ্রতার কারণে বা প্ররোচনায় মেয়েরা বেশ্যাবৃত্তিতে এসে পড়ে, তা কিন্তু সবসময় ঠিক নয়।শাঁসালো পুরুষদের ফাঁসিয়ে রাতারাতি ধনী হয়ে যাওয়ার জন্য অনেক মেয়ে-গৃহবধূরা এটাকে সংযত-পেশা হিসাবে নিচ্ছেন।তাই সমাজে ছুকছুকে পুরুষদের উদ্দেশে ‘গা-ঢলানি’ মেয়ে-বউদের থেকে ‘সাবধান বাণী’ শোনা যায়। সমাজের কানাচে-কানাচে চলছে এই নিরন্তর কর্মযজ্ঞ, আর যত দোষ নন্দ ঘোষ !
ঠিকানা : ভারতের একটি শহর। থানায় এসে এক মহিলা সটান বললেন, আমি বাজারের মেয়েছেলে নই, আমি যৌনকর্মী, এটাই আমার পেশা।পুলিশ অফিসারদের তো তখন ভড়কে যাওয়ার দশা। সম্প্রতি মুম্বইয়ের এক কলগার্ল উত্তরপ্রদেশের লখনউয়ে মহিলা থানায় অভিযোগ দায়ের করতে গিয়েছিলেন। শহরের কয়েকজন বিত্তবান ব্যক্তি এক পাঁচ তারা হোটেলে ওই মহিলার সঙ্গে ফুর্তি করে। এরপর কলগার্লকে পারিশ্রমিক দেওয়া তো দুরের কথা, তার কাছে থাকা টাকাপয়সা সহ অন্যান্য সামগ্রী লুঠ করে পালায় ওই ব্যক্তিরা। মুখে ইংরেজির ফুলঝুরি। এমন মেয়ের অভিযোগ শুনে তো হতবাক থানার আধিকারিকরা। জিজ্ঞাসাবাদের সময় তাঁর বেপরোয়া কথাবার্তায় ততক্ষণে থ বনে গিয়েছিলেন পুলিশ আধিকারিকরা। নিজের পুরো কাহিনী শুনিয়ে ওই মহিলা বলেন, আমি বাজারের মেয়েছেলে নই, আমি যৌনকর্মী, এটাই আমার পেশা।তিনি আরও বলেন, এই পেশা থেকে দুই কোটি টাকা আয় করে একটি বিউটি পার্লার খুলতে চান। তিনি পুলিশ আধিকারিকদের জানান, শরীরের ফিটনেস ধরে রাখতে তাঁর একজন প্রশিক্ষক রয়েছেন। খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারে ডায়েটিশিয়ানের পরামর্শ মেনে চলেন। শুধু তাই নয়, প্রতি ছয় মাস অন্তর মেডিক্যাল চেকআপও করান।
(৯) মধুচক্র : শত শত আবাসিক হোটেলের ফ্ল্যাট এবং নির্জন বাড়ি এখন একেকটি যৌনমস্তির লীলাভূমি হয়ে উঠেছে। এইসব স্থান নিষিদ্ধপল্লিগুলির চেয়ে অনেক বেশি সাফসুতরো, সহজগম্য এবং অনেকটা ফ্রেস এবং ঘরোয়া পরিবেশ এবং গায়ে বেশ্যা বা বেশ্যালয় নামটি সাঁটা নেই বলে মেয়েরা এবং রসিকপুরুষরা বেশি পছন্দ করেন। নিষিদ্ধপল্লিগুলির চেয়ে মধুচক্রগুলিতে রেস্ত অনেক গুণ বেশি গুণতে হলেও একটু পয়সাকড়ি যাদের পকেটে আছে তারা মধুচক্রই পছন্দ করছেন।তার উপর এখানে ক্রেতা এবং বিক্রেতা প্রায় সকলেই উঁচুতলার মানুষ হয়ে থাকেন। এখানকার শরীরবিক্রেতারা আসেন মূলত অতৃপ্ত যৌনবাসনা মেটাতে এবং অর্থলালসায়।অতৃপ্ত যৌনবাসনা যারা মেটাতে এহেন মধুচক্রে অংশগ্রহণ তারা সবসময়ই যে শরীরের বিনিময়ে অর্থ নেন, তা কিন্তু নয়। এরা সাধারণত পছন্দের পুরুষের সঙ্গে বা গ্রুপ সেক্স করেন। এন্টারচেঞ্জ (একে-অপরের স্বামী-স্ত্রী বদলাবদলা)সেক্সও সম্পন্ন হয়।এখানে তারাই আসেন যারা তাদের পছন্দের সঙ্গী বা সঙ্গিনীর সঙ্গে নিজের নিজের জায়গায় যৌনক্রিয়া সম্পাদন করতে বাধাপ্রাপ্ত হন। তবে এইসব পাত্রপাত্রীদের মধ্যে অর্থ লেনদেন না-হলে হোটেল বা ফ্ল্যাটের মালিক বা বাড়ির কর্তাকে অবশ্যই মোটা টাকার থাউকো ভাড়া দিতে হয়। সেই কারণে পতিতালয় ও রাস্তাঘাটের চেয়ে অনেক বেশি অর্থ খরচ করেও যৌনপরিসেবা ক্রয়ের জন্য শহরের আবাসিক হোটেলসমূহে ২৪ ঘণ্টা ধরেই কী ভয়ানক চাপ পড়ে তা হঠাৎ হঠাৎ পরিচালিত পুলিশ রেইডে ধরা পড়া নারী ও পুরুষদের সংখ্যার দিকে তাকালেই অনুমান করা যায়। আর ফ্ল্যাটবাড়ির আশ্রয়ে পরিচালিত হওয়া যৌনব্যাবসার চিত্রটি আমাদের কাছে আড়ালেই থেকে যায়, থেকে যাচ্ছে, থেকে যাবে। এইসব নারী এবং পুরুষদের গায়ে ‘বেশ্যা’ লেবেল না-থাকায় সমাজে বুক ফুলিয়ে চলতে কোনো অসুবিধা নেই। প্রতিবেশীদের কাছ থেকে অভিযোগ না-উঠলে কিংবা ওসব স্পটে কেউ খুন না-হলে সাধারণত সেগুলি আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা এবং গণমাধ্যমের আড়ালেই থাকে। উল্লেখ্য, এসব স্পট, স্পটের কর্তা এবং স্পটের গ্রাহকরা প্রায়শই হন উচ্চমধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তেরা এবং হোমড়া-চোমড়া দুনিয়ার ।সেই কারণে ঘটনার কথা জেনেও কেউ আগ বাড়িয়ে কাঠি দিতে যায় না।সম্প্রতি জানা গেছে, মুম্বাইয়ে নামজাদা এক চলচ্চিত্র অভিনেত্রীর লিজ দেওয়া ফ্ল্যাটে মধুচক্র চলত।সংশ্লিষ্ট অভিনেত্রী মধুচক্র পরিচালনা করতেন কি না তা যথাযথ জানা যাবে বলে মনে হয় না।কিছুদিন আগে হায়দরাবাদের বানজারা হিলসের একটি বিলাসবহুল হোটেলে মধুচক্র থেকে শ্বেতা (শ্বেতা বসু প্রসাদ) নামে এক মুম্বাইয়ের প্রাক্তন অভিনেত্রীকে হাতেনাতে ধরে ফেলা হয়।এই রাতে তার রেট ছিল ৫ লাখ, ১ লাখ টাকা অগ্রিমও পেয়ে গিয়েছিল।গ্ল্যামার জগতের খ্যাতির ছোঁয়া পেয়ে অভিনেত্রীদের উচ্চাকাঙক্ষা বেড়ে যায়। চিরদিন কাহারও সমান নাহি যায় ! অন্য পেশার মতো অভিনেত্রীদেরও সবসময় সুদিন থাকে না। দু-হাতে সমানে ডলার ঘাঁটতে ঘাঁটতে যখন কেউ কেউ সুদিন হারাতে থাকে তখনই এসে যায় শরীর-ব্যবসার মতো লাভজনক ব্যাবসার হাতছানি। ইচ্ছায়, অনিচ্ছায় এবং আম-ইচ্ছায় এই গোপন লীলায় সঁপে দেন নিজেদের। সেলিব্রেটি হওয়ার সুবাদে শরীর-মূল্যও অনেক চড়া হয়।শুধু শ্বেতা নয়, এর আগেও বেশ কয়েকজন অভিনেত্রীর বিরুদ্ধে দেহব্যাবসার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে। এরা হলেন ঐশ আনসারি, ভুবনেশ্বরী, সায়রাবানু, শ্রাবণী, যমুনা, দিব্যাশ্রী প্রমুখ। ২০০৯ সালে তামিল সিনেমার সুপারস্টার ভুবনেশ্বরী গ্রেফতার হয়েছিলেন, ইনি নিজের মোহময়ী রূপকে কাজে লাগিয়ে খরিদ্দার ধরতেন শুধু তা নয় – গ্ল্যামার জগতে উঠতি তারকাদের নিজের ফ্ল্যাটে নিয়ে এসে যৌনকর্ম করাতেন। শোনা যায়, ভুবনেশ্বরী নীল ছবির অভিনয়েও যুক্ত ছিলেন। ২০১৩ সালে যোধপুরের একটি হোটেল থেকে আপত্তিকর অবস্থায় হাতেনাতে ধরা পড়েছিলেন অভিনেত্রী ঐশ আনসারি। ২০১৩ সালেই আর-এক তামিল অভিনেত্রী সায়রাবানুও গ্রেফতার হন দেহব্যাবসায় জড়িত থাকার অভিযোগে। দক্ষিণী ছবির আরও দুইজন অভিনেত্রী শ্রাবণী এবং যমুনাকে মধুচক্র চালালোর অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়।শ্বেতার গ্রেফতারের পর মিডিয়া যখন তোলপাড় শুরু করে দিল তখন আর-এক বলিউডের প্রখ্যাত অভিনেত্রী শ্বেতাদের হয়ে জোরদার সওয়াল করলেন। বললেন, “শ্বেতাকে দোষের ভাগীদার বানানো হচ্ছে। তার দিকে আঙুল তোলা হচ্ছে। অথচ তাঁর বিত্তশালী খরিদ্দারদের নাম আড়াল করে যাচ্ছে পুলিশ। শ্বেতার পাশাপাশি ওইসব লোকগুলির নামও সামনে আসা উচিত। তাদের ঘরের মা-বোন-মেয়েরা জানুক তাদের ঘরের পুরুষ কত বিচিত্র চরিত্র”। পুলিশ চুপসে গেল, মিডিয়া হড়কে গেল। ২০১৩ সালে পুলিশ এবং মিডিয়ার এমনই পরিস্থিতি হয়েছিল শ্রাবণীকে গ্রেফতার করার পর। জানা যায়, শ্রাবণীর খরিদ্দারদের বেশিরভাগই হল অন্ধ্রপ্রদেশের কয়েকজন মন্ত্রী। এটা জানার পরই পুলিশ ও মিডিয়ারা রণে ভঙ্গ দেয়।পরে অবশ্য হায়দরাবাদের নামপল্লির মেট্রোপলিটন দায়রা আদালত শ্বেতাকে ক্লিটচিট দেওয়া হয়েছে বলে খবরে প্রকাশ হয়েছে।তাই বলে কি শ্বেতার কলঙ্ক ঘুচল !
(১০) যৌন-পর্যটন বা সেক্স ট্যুরিজম : বিশ্বায়নের ছোঁয়া লাগার সঙ্গে সঙ্গে যৌনবাণিজ্যের আরও নানা রূপ ও চেহারা স্পষ্ট হয়েছে। তার বড়ো ক্ষেত্র সেক্স ট্যুরিজম। প্রতিদিনই তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলি থেকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অপরিণত ও পরিণত বয়সি নারী পাচার হয়ে আন্তর্জাতিক এসব যৌনবাণিজ্যের কবলে পড়ছে। পাচারকারী ও যৌনবাণিজ্যের সমাজের বড়ো বড়ো মাথাওয়ালা হর্তাকর্তা শ্রেণির নেটওয়ার্ক এতই বিস্তৃত ও শক্তিশালী যে তাদের শক্তিমত্তার সঙ্গে পেরে ওঠার চেষ্টা প্রায়ই রাষ্ট্রগুলি করে না, কারণ অনেক রাষ্ট্রের মোটা আয়ই নির্ভর করে এ পেশার উপরে, বিশেষ করে, সেক্স ট্যুরিজম বা যৌন-পর্যটন যেসব রাষ্ট্রের আয়ের প্রধান উৎস।উইকিপিডিয়া অনুযায়ী, সেক্স ট্যুরিজম বা যৌনপর্যটন হল অর্থের বিনিময়ে যৌনসম্পর্ক স্থাপনের উদ্দেশ্যে কোনো বিশেষ স্থানে ভ্রমণ করা। জাতিসংঘের বিশেষ এজেন্সি বিশ্ব পর্যটন সংস্থার মতে, পর্যটন খাত কর্তৃক আয়োজিত অথবা এই খাতের বাইরের কারও আয়োজনে পর্যটন খাতের কাঠামো ও নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে গন্তব্যস্থানের বসবাসস্থলে পর্যটক কর্তৃক বাণিজ্যিকভাবে যৌনসম্পর্ক স্থাপনকেই সেক্স ট্যুরিজম বা যৌন-পর্যটন বলে। জাতিসংঘ যৌনপর্যটনকে সমর্থন করে না এই কারণে যে, এর মাধ্যমে পর্যটকের নিজের দেশ ও গন্তব্য দেশ উভয়েরই স্বাস্থ্যগত, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে বিরূপ প্রভাব ফেলে, বিশেষ করে পর্যটকের নিজের দেশের চেয়ে গন্তব্যদেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থা এবং পর্যটকের নিজের সঙ্গে ওখানকার মানুষের লৈঙ্গিক-বায়সিক অবস্থার বৈভিন্ন্যই এর জন্য দায়ী। যৌন-পর্যটকদের জন্য কখনো-কখনো গন্তব্য দেশে স্বল্পমূল্যে যৌন-পরিসেবা পাওয়ার আকর্ষণ থাকে। এমনকি সেসব দেশের থাকে যৌনসম্পর্ক স্থাপনের বিষয়ে আইনগত শৈথিল্য এবং শিশু যৌনকর্মী পাওয়ার আকর্ষণও।
যৌন-পর্যটনের জন্য পর্যটকদের প্রথম বাছাই দেশগুলি হল থাইল্যান্ড, ব্রাজিল, ডমিনিকান রিপাবলিক, কোস্টারিকা, কিউবা, জার্মানি, মেক্সিকো, আর্জেন্টিনা, নেদারল্যান্ডস এবং কম্বোডিয়া। সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা ভেঙে যাওয়ার পর রাশিয়া, হাঙ্গেরি, ইউক্রেন, পোল্যান্ড এবং চেক রিপাবলিকের নামও ওই তালিকায় সংযুক্ত হয়েছে। অবশ্য এসব গন্তব্যের খুব কমসংখ্যক যৌনকর্মীই কেবল যৌন-পর্যটকদের সেবা দিয়ে থাকে। ওসব দেশের মোট যৌনকর্মীর সিংহভাগই স্থানীয় পুরুষকুলের চাহিদা মেটায়। নির্দিষ্ট কোনো দেশের কেবল এক বা একাধিক নির্দিষ্ট স্থানই কেবল যৌন-পর্যটকদের গন্তব্য হয়। যেমন নেদারল্যান্ডের আমস্টারডাম, থাইল্যান্ডের ব্যাংকক, পাট্টায়া ও পুকেট। আমেরিকায় স্থানীয়রা নেভাদায় যৌন-পর্যটনে যায়। এছাড়া অন্যান্য কিছু শহরে স্থানীয় পর্যটকরা বিশেষ আইনগত অনুমোদন নিয়ে যৌন-পর্যটনে বেরয়। এসব পর্যটকের অধিকাংশেরই ঝোঁক থাকে শিশুর প্রতি, যদিও অধিকাংশ দেশেই শিশুদের যৌনকাজে ব্যবহার করা আইনসম্মত নয়। বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা যৌন-পর্যটন ও শিশু যৌন-পর্যটনকে আলাদা করে দেখে। সংস্থার মতে, যেসব পর্যটক শিশুদেরকে যৌনকাজে ব্যবহার করে তাঁরা ‘কনভেনশন অন দ্য রাইটস অব দ্য চাইল্ড’ এবং ‘অপশনাল প্রটোকল অন দ্য সেল অব চিলড্রেন’, ‘চাইল্ড প্রস্টিটিউশন অ্যান্ড চাইল্ড পর্নোগ্রাফি’ লঙ্ঘন করে। অনেক দেশই ‘ওরস্ট ফর্ম অব চাইল্ড লেবর কনভেনশন, ১৯৯৯’-এ স্বাক্ষর করেছে এবং নিজেদের দেশে সেটা বাস্তবায়ন করছে। সিঙ্গাপুরের এরকম কোনো আইন নেই বলে তারা ইতোমধ্যে অনেক নিন্দা অর্জন করেছে। ইন্দোনেশিয়ার বাটামও ওরকম একটি গন্তব্য, যেখানে প্রচুর পরিমাণে কমবয়সি শিশুকে যৌনকাজে ব্যবহারের জন্যে পাওয়া যায়। “ওয়ার্ল্ড অব ওয়ার্ক”-এর সেপ্টেম্বর-অক্টোবর, ১৯৯৮ ইস্যুতে মুদ্রিত একটি প্রবন্ধে ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন এবং থাইল্যান্ডের যৌনবাণিজ্যে কী পরিমাণ অর্থাগম ঘটে তার কিছু পরিসংখ্যান পাওয়া যায়। ওই প্রবন্ধে স্বীকার করা হয় যে, যৌনখাত একটি অর্থনৈতিক খাত হিসাবে অফিসিয়াল পরিসংখ্যান, উন্নয়ন পরিকল্পনা বা সরকারের বাজেটে এখনও স্বীকৃত নয়। কিন্তু এ খাতে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ অর্থের লেনদেন ঘটে। বলা হয়, যৌনখাতে এই চারটি দেশে প্রকৃতপক্ষে কী পরিমাণ নারী যুক্ত আছেন তা পেশাটি অনৈতিক ও গোপন হওয়ার কারণে বলা একেবারেই মুশকিল। তবে ধরে নেয়া যায়, দেশসমূহের মোট নারী জনগোষ্ঠীর ০.২৫ থেকে ১.৫ শতাংশ এ পেশায় যুক্ত। ১৯৯৩-১৯৯৪ খ্রিস্টাব্দে তৈরি একটি হিসাব অনুযায়ী ইন্দোনেশিয়ায় যৌনকর্মীর সংখ্যা দেখানো হয় ১৪০,০০০ থেকে ২৩০,০০০ জন। মালয়েশিয়ায় এই সংখ্যা ৪৩,০০০ থেকে ১৪২,০০০ জন, তবে আইএলওর মতে সে সংখ্যা আরও বেশি। ফিলিপাইনে যৌনকর্মীর সংখ্যা জানানো হয় ১০০,০০০ থেকে ৬০০,০০০ জন, তবে ৫০০,০০০ হওয়ার ব্যাপারে অনেকেই একমত বলে জানানো হয়। থাইল্যান্ডের জনস্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ১৯৯৭ খ্রিস্টাব্দের হিসাব করা জরিপ অনুযায়ী যৌনকর্মীর সংখ্যা দেখানো হয় ৬৫,০০০, কিন্তু আনঅফিসিয়াল সূত্র দাবি করে এ সংখ্যা ২০০,০০০ থেকে ৩০০,০০০ জন। এর বাইরে থাই এবং ফিলিপিনো আরও ১০ হাজার নারী, শিশু এবং হিজড়া যৌনকর্মী বিদেশে কর্মরত আছে।
বলা হয়, যৌনতাভিত্তিক প্রতিষ্ঠানসমূহ, সংশ্লিষ্ট অন্যান্য বিনোদনমূলক স্থাপনা এবং যৌনপর্যটনের সঙ্গে যুক্ত মালিক, ব্যবস্থাপক, দালাল, সহযোগী, ক্যাশিয়ার, নিরাপত্তারক্ষী এবং অন্যান্য কর্মকর্তা-কর্মচারী মিলে আরও কয়েক মিলিয়ন মানুষ প্রত্যক্ষভাবে ও পরোক্ষভাবে এ বাণিজ্যের মাধ্যমে জীবনধারণ করে থাকে। প্রতিবেদনটি বলছে, এই চারটি দেশের জিডিপির ২ থেকে ১৪ শতাংশই আসে যৌনখাত থেকে। সরকারি কর্তৃপক্ষ বৈধ-অবৈধভাবে বিপুল পরিমাণ করও আদায় করে থাকে সংশ্লিষ্ট স্থাপনাগুলি থেকে। থাইল্যান্ডের শহরে যৌনকর্মে নিবিষ্ট গ্রামীণ নারীরা বছরে তাঁদের উপার্জন থেকে ৩০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার গ্রামে তাঁদের পরিবারের কাছে পাঠান। ১৯৯৩-১৯৯৪ মেয়াদে দেশগুলি যৌনকর্ম বাবদ বছরে ২২.৫ থেকে ২৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করে। ইউনিসেফের তত্ত্বাবধানে হওয়া সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় আফ্রিকার দরিদ্র দেশ কেনিয়ায় শিশু পতিতাবৃত্তির এক ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে। প্রতিবেদনে জানা যায়, দেশটির উপকূলীয় এলাকায় যৌন-পর্যটন চালু থাকায় সেখানকার অজস্র শিশু যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। প্রায় ১০ থেকে ১৫ হাজার মেয়েশিশু দেশটির মালিন্দি, মোম্বাসা, কালিফি এবং দিয়ানি উপকূলীয় এলাকায় বাস করে, যারা মাঝে মাঝেই অর্থের বিনিময়ে যৌনকর্ম করে। এছাড়াও ২ থেকে ৩ হাজার শিশু ছেলেমেয়ে অর্থের বিনিময়ে সার্বক্ষণিক যৌনপরিসেবা দিয়ে থাকে। উপকূলীয় যৌনপেশায় কর্মরতদের ৪৫ শতাংশই আসে দেশের অন্যান্য এলাকা থেকে, যারা পূর্বেই এ কাজে হাতেখড়ি নিয়ে নেয়। অধিকাংশই আগে নিজেদের এলাকার বারে এ কাজে অভিজ্ঞতা অর্জন করে ও প্রয়োজনীয় কাপড়চোপড়, সাজগোজ করার কসমেটিক-গার্মেন্টস ও চুলের স্টাইল আধুনিককরণ করার জন্য অর্থ উপার্জন করে তারপর পর্যটকদের মনোরঞ্জনের জন্য আসে। এখানে শিশুদের মধ্যে যৌনকর্মের প্রাদুর্ভাব এমনই বেড়ে গেছে যে, প্রতি দশজন শিশুর একজন এ কাজে যুক্ত হয় তাদের বয়স বারোতে পৌঁছোনোর আগেই। চরম দারিদ্র্যের কারণে কেনিয়ায় এখন এটি সামাজিকভাবেও অনেকাংশে স্বীকৃতি পাচ্ছে। শিশুদের একটা অংশ সাধারণত সেসব পরিবার থেকে আসে যেসব পরিবারে উপাজনক্ষম কেউ নেই, অথবা কম উপার্জন করে কিংবা সেসব শিশু যাদের বাবা মা উভয়েই প্রয়াত হয়েছেন। তবে আগতদের ৫০ শতাংশের মা-বাবাই কর্মজীবী এবং তারা স্কুলেও যায়, তবে তারা চায় হাতখরচের জন্য বাড়তি কিছু টাকা। অবশ্য এরা সতর্ক থাকে যাতে সমাজের বয়সি কেউ বিষয়টি টের না-পেয়ে যায়। সূত্র জানায়, কেনিয়ার সৈকতে শিশু যৌন-পর্যটনে আগতদের ১৮ শতাংশ ইতালিয়ান, ১৪ শতাংশ জার্মান এবং ১২ শতাংশ সুইস। এরপরেই আছেন উগান্ডান, তাঞ্জানিয়ান, ব্রিটিশ এবং সৌদি আরবীয়রা। তবে দেশের ভিতরেও এই শিশুদের গ্রাহক প্রচুর। পর্যটকদের আগমন যে সময়ে কম হয় বা একেবারেই হয় না, তখনও এই শিশুরা একেবারে কর্মহীন থাকে না।
নাকি ঘৃণার সব ক্লেদ মাখবেন ওই জাতে উঠতে-না-পারা রেড লাইট এরিয়ার বাসিন্দারা অর্থাৎ বেশ্যাপল্লির বেশ্যারা ? হয় সব রকমের বেশ্যাবৃত্তি নিষিদ্ধ করা হোক, নতুবা সব রকমের বেশ্যাবৃত্তি বৈধ করা হোক।নাচ আর ঘোমটা – দুটো একসঙ্গে চলতে পারে না।
এই ভারত উপমহাদেশে সেই প্রাচীন যুগ থেকেই বহিরাগতের উপনিবেশের ফলে ভারতীয় সংস্কৃতি বারবার ছিন্নভিন্ন হয়েছে। শুরু আর্য তথা এরানীয় থেকে, শেষ হয়েছে ব্রিটিশরাজে। উপর্যুপরি পরীক্ষানিরীক্ষার পর আজকের ভারত, আজকের ভারতের সংস্কৃতি। সবচেয়ে বেশি সাংস্কৃতিক মিশ্রণ ঘটেছে প্রায় ৭০০ বছরের মুসলিম (মধ্যপ্রাচ্য, মঙ্গোলীয়) শাসনে, পরের ধাপে প্রায় ২০০ ব্রিটিশ শাসনে। ধর্মের এবং ধর্মীয় অনুশাসনের বড়ো একটা প্রভাব পড়েছে এই উপমহাদেশের মানুষদের জীবনচর্যায়। সনাতন ধর্ম বা বৈদিক ধর্ম বা পৌরাণিক ধর্ম বা হিন্দু ধর্ম, বৌদ্ধ ধর্ম, ইসলাম ধর্ম এবং খ্রিস্টান ধর্ম – সব মিলিয়ে এক্কেবারে এক জগাখিচুড়ি সংস্কৃতি হয়ে জেগে রইল এই উপমহাদেশ। ফলে প্রাচীন যুগে যে পেশা ছিল বৈধ, স্বীকৃত, সম্মানীয় – সেই একই পেশা না-ঘরকা না-ঘাটকা, না-বৈধ না-অবৈধ, ন যযৌ ন তস্থৌ। তাই বৃত্তি আছে, থাকবে – নিরাপত্তাহীনতাও আছে, আছে পুলিশের অনধিকারচর্চা-অনুপ্রবেশ, আছে মাস্তানের অপ্রত্যাশিত দৌরাত্ম্য। ঝেড়ে কাশেননি অনেক দেশের আইন-প্রণেতারা। সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না দেহব্যাবসা অবৈধ, না বৈধ। বৈধও না, আবার অবৈধও না – এটা কোনো দায়িত্বজ্ঞানসম্পন্ন রাষ্ট্রের কর্তব্য হতে পারে না।
পৃথিবীতে এমন কোনো দেশ কোনোদিন ছিল না যে দেশে বেশ্যা-বেশ্যাবৃত্তি-বেশ্যালয় নেই। বর্তমানে এমন অনেক দেশ আছে যেখানে বেশ্যা-বেশ্যাবৃত্তি-বেশ্যালয় আইনত বৈধ – সেখানে সকল নারীপুরুষ যেমন বেশ্যাবৃত্তিকে পেশা করেনি, ঠিক তেমনই এমন অনেক দেশ আছে যেখানে বেশ্যা-বেশ্যাবৃত্তি-বেশ্যালয় আইনত অবৈধ – সেখানেও বেশ্যা-বেশ্যাবৃত্তি-বেশ্যালয় বন্ধ হয়ে গেছে এমন কথা শুনিনি।
বেশ্যাবৃত্তি ১০০টি দেশের মধ্যে ৫০ ভাগ দেশে বৈধ, ৩৯ ভাগ অবৈধ এবং ১১ ভাগ দেশে সীমাবদ্ধ বৈধ। বৈধ, অবৈধ এবং সীমাবদ্ধ বৈধ দেশগুলি জেনে নিতে পারি –
৩৯টি অবৈধ দেশ : (১) আফগানিস্তান, (২) আলবানিয়া, (৩) অ্যাঙ্গোলা, (৪) অ্যান্টিগা ও বারবুদা, (৫) বাহামা, (৬) বারবাডোজ, (৭) কাম্বোডিয়া, (৮) চিন (তাইওয়ান সহ), (৯) ক্রোয়েশিয়া, (১০) কিউবা, (১১) ডোমিনিকা, (১২) ইজিপ্ট, (১৩) গ্রেনাডা, (১৪) গুয়ানা, (১৫) হাইতি, (১৬) ইরান, (১৭) ইরাক, (১৮) জামাইকা, (১৯) জর্ডন, (২০) কেনিয়া, (২১) উত্তর কোরিয়া, (২২) দক্ষিণ কোরিয়া, (২৩) লাইবেরিয়া, (২৪) লিথুয়ানিয়া, (২৫) মাল্টা, (২৬) ফিলিপিনস, (২৭) রোমানিয়া, (২৮) রুয়ান্ডা, (২৯) সেন্ট কিটস ও নেভিস, (৩০) সেন্ট লুসিয়া, (৩১) সেন্ট ভিনসেন্ট ও গ্রেনাডাইনস, (৩২) সৌদি আরব, (৩৩) সালভেনিয়া, (৩৪) দক্ষিণ আফ্রিকা, (৩৫) সুরিনাম, (৩৬) থাইল্যান্ড, (৩৭) ত্রিনিদাদ ও টোবাগো, (৩৮) উগান্ডা, (৩৯) সংযুক্ত আমির শাহি।
৫০টি বৈধ দেশ : (১) আর্জেন্টিনা, (২) আমেরিকা,(৩) অস্ট্রিয়া,(৪) বেলজিয়াম,(৫) বেলিজ,(৬) বলিভিয়া,(৭) ব্রাজিল,(৮) কানাডা,(৯) চিলি, (১০) কলম্বিয়া, (১১) কোস্টা রিকা, (১২) সাইপ্রাস, (১৩) চেক রিপাবলিক, (১৪) ডেনমার্ক, (১৫) ডোমেনিকান রিপাবলিকান, (১৬) ইকুয়াডর, (১৭) এল সালভাদর, (১৮) ইস্টোনিয়া, (১৯) ইথিয়োপিয়া, (২০) ফিনল্যান্ড, (২১) ফ্রান্স, (২২) জার্মানি, (২৩) গ্রিস, (২৪) গুয়াতেমালা, (২৫) হন্ডুরাস, (২৬) হাঙ্গেরি, (২৭) ইন্দোনেশিয়া, (২৮)আয়ারল্যান্ড,(২৯) ইজরায়েল, (৩০) ইটালি, (৩১) কিরগিজস্তান, (৩২) লাটভিয়া, (৩৩) লুক্সেমবার্গ, (৩৪) মেক্সিকো, (৩৫) নেদারল্যান্ডস, (৩৬) নিউ জিল্যান্ড, (৩৭) নিকায়াগুয়া, (৩৮) পানামা, (৩৯) পারাগুয়া, (৪০) পেরু, (৪১)পোল্যান্ড,(৪২) পোর্তুগাল, (৪৩) সেনেগাল, (৪৪) সিঙ্গাপুর, (৪৫) স্লোভাকিয়া, (৪৬) সুইজারল্যান্ড, (৪৭) তুরস্ক, (৪৮) ইউনাইটেড কিংডম (স্কটল্যান্ড সহ), (৪৯) উরুগুয়ে, (৫০) ভেনেজুয়েলা।
১১টি সীমাবদ্ধ বৈধ দেশ : (১) অস্ট্রেলিয়া, (২) বাংলাদেশ, (৩) বুলগেরিয়া, (৪) আইসল্যান্ড, (৫) ভারত, (৬) জাপান, (৭) মালয়েশিয়া, (৮) নরওয়ে, (৯) স্পেন, (১০) সুইডেন, (১১) ইউনাইটেড স্টেট।
বেশ্যাবৃত্তি প্রসঙ্গে ভারতীয় আইন কী বলছে ?
প্রাচীন ও মধ্যযুগের বেশ্যাবৃত্তি এযুগে আর শিল্পের পর্যায়ে নেই। আঠারো শতকের শেষ দিক থেকে বেশ্যামির ভাষা বদলাতে থাকল। নারী এখন স্রেফ পণ্য।পনারীও নিজেকে পণ্য বানিয়ে ফেলেছে রাতারাতি ধনী হওয়ার লোভ এবং লালসায়। স্কুল-কলেজের ছাত্রী, গৃহবধূ, উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত – সব শ্রেণি থেকে এখন নতুন খেলায় মেতেছেন। শরীরটাকে উত্তরণের সিঁড়ি বানিয়ে নারী ক্রমশ আধুনিকতার দিকে এগিয়ে চলেছে। সরাসরি দেহব্যাবসার মাধ্যমে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার মুনাফা করা হচ্ছে। Havocscope সূত্রে জানা যাচ্ছে, সারাবিশ্বে শুধু শরীর বিক্রিতেই রেভিনিউ সংগ্রহ হয় প্রায় ১৮৬ বিলিয়ন ডলার। এ হিসাব শুধুমাত্র নথিভুক্ত পেশাদারদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। অর্থাৎ, সারাবিশ্বের ১৩,২৬৫,৯০০ দেহব্যবসায়ীদের হিসাবে। নথিভুক্ত নয় এমন দেহব্যবসায়ীদের হিসাব আরও কয়েক গুণ। কথা হচ্ছিল বেশ্যাবৃত্তির বিষয়ে। বিশ্বের অনেক দেশ, যাদের প্রধান আয় পর্যটন শিল্পনির্ভর, সেসব দেশে এখনও সরকারি তত্ত্বাবধানেই দেহব্যাবসা পরিচালিত হয়। এমনকি বাংলাদেশ রাষ্ট্রও এখনও এ প্রথাকে অনুমোদন করে যাচ্ছে পতিতাবৃত্তিতে আগ্রহী যে-কোনো আঠারো বছর বয়সোত্তীর্ণ নারীকে দেহব্যবসা চালাবার জন্য লাইসেন্স দিয়ে, সারাদেশে ১৪টি পতিতালয় পরিচালনা করে এবং সেখান থেকে রেভিনিউ গ্রহণ করে।
শুধু কি মহিলারাই বেশ্যাবৃত্তিতে আসে বা আসতে বাধ্য হয় ? তা কেন ? পুরুষরাও এখন রোজগার করতে বেশ্যাবৃত্তিতে আসছেন। সংখ্যায় তাঁরাও কিছু কম নন। ক্রমশ বাড়ছে মুক্ত অর্থনীতির বাজারে।যৌন-বাজারে আবার আর-এক শ্রেণির আবির্ভাব হয়েছে, এরা ব্যক্তিগত যৌন-অতৃপ্ততা থেকে অন্য পুরুষের কাছে শরীর সমর্পণ করে। এরা মূলত বিবাহিত মহিলা, এরা নিজেদের পছন্দমতো যৌনসঙ্গী খুঁজে নেন, যে পুরুষ এই নারীকে শরীরী-সুখে তৃপ্ত করতে পারবে সে পাবে পর্যাপ্ত অর্থমূল্য। ছুৎমার্গকে সরিয়ে দিয়ে সমাজে এক মহিলাদের সংখ্যা বাড়ছে, যাঁরা যথেষ্ট অর্থের বিনিময়ে পুরুষদের কাছ থেকে যৌন-পরিসেবা নিচ্ছেন। এইসব মহিলারা বেশিরভাগই উচ্চবিত্ত পরিবার থেকেই আবির্ভাব হচ্ছে। এইসব মহিলাদের যেসব পুরুষরা যৌনসুখ দান করেন তাঁদের ‘জিগোলো’ বলা হয়।এই বাজারে পুরুষক্রেতারা যেমন তার বয়সের থেকে তুলনামূলক অনেক কম বয়সি মেয়েদের পছন্দ করে, তেমনই নারীক্রেতারাও তার বয়সের থেকে তুলনামূলক কম বয়সি ছেলেদেরকে যৌনসঙ্গী হিসাবে বেশি পছন্দ করে। এখানে নারী ক্রেতা, পুরুষ পরিসেবাদাতা। আপাতত এরা সংখ্যায় অল্প হলেও এ ব্যাপারটা নারী-ক্ষমতায়নেরই ইঙ্গিত দেয়।
দেহব্যাবসার ইতিহাসে পুরুষ-বেশ্যা শব্দটি একটু নতুন হলেও সমকালীন সমাজতত্ত্বের এক নৈমিত্তিক অধ্যায়। ‘যৌনকর্মী’ হিসাবে অনেকপরে পুরুষের প্রবেশ। তাই পুরুষ-বেশ্যাদের জন্য বিশেষণের বড়োই অভাব। পুরুষের যৌনকর্মী হিসাবে জীবিকায় আসা নারী যৌনকর্মীদের মতো নয়। পশ্চিমের বিভিন্ন দেশে পুরুষ যৌনব্যাবসায় দালালের কোনো ভূমিকা নেই। এমন কি আমাদের দেশেও পুরুষ-বেশ্যাবৃত্তি দালালনির্ভর নয়। জার্মান মনোবিজ্ঞানী ম্যাগনাস হার্শফেল্ড যেসব গণিকালয় ঘুরে দেখেছেন সেসবই নারী গণিকালয়েরই অনুরূপ। খুবই সংগঠিত ও পরিকল্পিতভাবে এই ব্যাবসা চলত। সমুদ্রোপকূলের করাচী শহরের যৌনব্যাবসার ইতিহাস সুপ্রাচীন। এখানে অনেক পুরুষ বেশ্যালয় ছিল। ১৮৫২ খ্রিস্টাব্দে উত্তর-পূর্ব ভারতের মণিপুর রাজ্যের একদল নারীবেশী পুরুষ যৌনকর্মীদের দেহব্যাবসার সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়। এ থেকেই বোঝা যায়, এ অঞ্চলে পুরুষ যৌনব্যাবসার প্রচলন ছিল।
আলোচনার সুবিধার্থে পুরুষ-বেশ্যাদের দুই শ্রেণিতে ভাগ করে নিতে পারি।(১) শিমেল এবং (২) জিগোলো।
(১) শিমেল (Shemale) : এরা মূলত সমকামী বা রূপান্তকামী। সমকামী পুরুষ যৌনব্যাবসায় প্রচলন ঠিক কবে থেকে হয় তার ঐতিহাসিক প্রমাণ খুঁজে পাওয়া প্রায় দুঃসাধ্য। সুপ্রাচীনকাল থেকেই যে সমলিঙ্গের মধ্যে যৌন-সম্পর্ক গড়ে উঠেছে তার অনেক দৃষ্টান্ত বিভিন্ন দেশের সাহিত্য, ইতিহাস ধর্মশাস্ত্রে পাওয়া যায়।
শিমেল বা লেডিবয়দের আবার দুভাগে ভাগ করা যায়। (ক)পুরুষ অঙ্গে নারী চেতনায় এবং (খ) উর্ধাঙ্গ নারী ও নিন্মাঙ্গ পুরুষ।প্রকৃতিগতভাবে এই দুই শ্রেণিরই খরিদ্দার পুরুষ।তাহলে পার্থক্য কোথায় ?
(ক) পুরুষ অঙ্গে নারী চেতনায় : এরা বহিরঙ্গে পুরুষ, অন্তরঙ্গে নারী। এরা মেয়েলি ভাবের পুরুষ।এরা সাধারণত মেয়েদের সঙ্গে যৌনমিলনে তৃপ্ত হতে পারেন না, তাই পুরুষরাই এদের যৌনসঙ্গী।চাপে পড়ে মেয়েদের সঙ্গে দাম্পত্য জীবনে প্রবেশ করলেও সংসার সুখের হয় না। দু-চারদিন যেতে-না-যেতেই মনের মতো পুরুষসঙ্গীর সঙ্গে মিলিত হয়। এরা পুরুষ-শরীরে নারীর পরিধানে সজ্জিত হয়ে পুরুষ শিকার করে। এরা পুরুষ খরিদ্দারের সঙ্গে যৌনমিলনের জন্য নারীর যৌনাঙ্গের বিকল্পে তাঁর পায়ুপথ ব্যবহার করেন।পায়ুকামীদের কাছে এঁদের খুব চাহিদা।প্রসঙ্গত জানাই, গ্রিক ধর্মশাস্ত্রে জিউস ও গানাইমেডির বৃত্তান্তে সমলিঙ্গের প্রেম-ভালোবাসার কথা জানা যায়। রোম সম্রাট নিরো ছিলেন অত্যন্ত নিষ্ঠুর এবং খামখেয়ালি। তিনি একবার এক তরুণকে বিয়ে করার কথা ভাবেন এবং বিয়ে করেও ফেলেন। অবশ্য বিয়ের পরে সেই তরুণ সম্রাটের নির্দেশে স্ত্রীবেশ ধারণ করেছিল। জুলিয়াস সিজারেরও সমলিঙ্গের প্রতি ঝোঁক ছিল। হায়দরাবাদের নবাব টিপু সুলতানও কিন্তু পুরুষদের সঙ্গে যৌনমিলনে লিপ্ত হতেন।পাঞ্জাবের মহারাজা রঞ্জিৎ সিংহ মাঝেমধ্যেই বালকদের সঙ্গে যৌনক্রীড়া করতেন। শরিয়তি নির্দেশকে উপেক্ষা করেই মুসলিম শাসনাধীন রাষ্ট্রে শেখরা অন্য পুরুষদের সঙ্গে যৌন সম্পর্ক বজায় রাখতেন। খ্রিস্টীয় নবম শতাব্দীতে ইরানীয় এক প্রশাসকের মুখ্য সহকারী ছিলেন মুতাজিলি ইসলাম সম্প্রদায়ের এক ব্যক্তি। তিনি আমজনতার কাছে ঘোষণা রাখেন – মুতাজিলি হল শ্রেষ্ঠ ধর্ম এবং পুরুষ সম্ভোগই যৌন-আনন্দের শ্রেষ্ঠ মাধ্যম।
অবশেষে নিত্যনৈমিত্তিক বহুগামী যৌন-অভ্যাসের মধ্যেই একসময় অর্থের অনুপ্রবেশ ঘটে। অর্থে বিনিময়ে যৌন-আনন্দ পেতে কেউই পিছ-পা হন না। পুরুষ-যৌনতাকে নিয়ে শুরু হয় ব্যাবসা। এই ব্যাবসার একটি বিশেষ রূপ হল সমকামী যৌন-ব্যাবসা।খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে প্রাচীন গ্রিসেই খুব বিক্ষিপ্তভাবে এই ব্যাবসা শুরু হয়।
এ পথ মসৃণ নয়, দোষী হিসাবে পুরুষ যৌনকর্মীদের উপর কঠিন শাস্তি নেমে আসে। ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, অস্ট্রিয়া, জার্মানি প্রভৃতি দেশে পুরুষ যৌনকর্মীদের উপর রাষ্ট্রীয় নিষেধাজ্ঞা জারি হয়। শুরু হয় গ্রেফতার। পুরুষ যৌনকর্মীদের এই সময় অত্যন্ত ভয়াবহ অবস্থা হয়। পুরুষ যৌনকর্মীদের ফাঁসি পর্যন্ত দেওয়া হয়।
(খ) ঊর্দ্ধাঙ্গ নারী ও নিম্নাঙ্গ পুরুষ : এদের ঊর্দ্ধাঙ্গে নারীদের মতো সুডৌল এবং পুষ্ট স্তন থাকে। নিম্নাঙ্গে পুরুষের সতেজ লিঙ্গ। একই অঙ্গে নারী-পুরুষ একই সঙ্গে। খোদার উপর খোদগারি ! এঁরা যেমনই লেসবিয়ানদের সঙ্গে যেমন যৌনসম্পর্ক করেন, তেমনই হোমোসেক্সচুয়ালদের সঙ্গেও সেক্স করে রোজগার করেন। এরা সাধারণত ধনীদের যৌনসঙ্গী হয়ে থাকে। এছাড়া পর্নোছবিতেও এঁদের প্রচুর পরিমাণে দেখা যায়। ইন্টারনেট দুনিয়ায় এদের পর্নোছবির ছড়াছড়ি।
(২) জিগোলো (Gigolo) : জিগোলো শব্দটি ফরাসি। কী বলছে Wikipedia ? “A gigolo is a male escort or social companion who is supported by a woman in a continuing relationship, often living in her residence or having to be present at her beck and call.
আদতে যা Gigolo, তাই-ই Callboy।Callgirl-রা পুরুষ এবং নারীদের (যদি লেসবিয়ান) যৌনসুখ বেচেন, Callboy-রা নারীদের এবং পুরুষদের (যদি হোমোসেক্সচুয়াল) যৌনসুখ বেচেন। মধ্য চল্লিশের নিঃসঙ্গ মহিলা হোন কিংবা যৌনসুখে আসক্ত যুবতি সহ যেসব মহিলারা অর্থের বিনিময়ে উদ্দাম যৌনসুখ পেতে চায়, তাঁরা সোজা বাংলায় যাকে বলে “পুরুষ যৌনকর্মী”-দের “Call” করেন।এইসব পুরুষ-বেশ্যারা অধিকাংশই কম বয়সি, ফড়ফড় করে ইংরেজিতে কথা বলিয়ে, সৌম্যদর্শনযুক্ত এবং ফ্যাশন-দুরস্ত।কোনো কোনো পুরুষদের এটাই একমাত্র পেশা, কারোর কারোর আবার সাইড ইনকামের জন্য পার্ট-টাইম। কেউ অবিবাহিত, কারোর আবার স্ত্রী-সন্তানও আছে। মোটা টাকার রোজগার সহ স্রেফ স্ফূর্তির জন্য অনেকে এ পেশায় করতে করতে তারপর নেশায় পরিণত হয়ে যায়। জিগোলো বা কলবয়ের পেশায় চলে আসছে স্কুল-কলেজের ছাত্ররা।মধ্যবয়সি মহিলাদের কাছে এইসব কম বয়সি ছেলে-ছোকরা ব্যাপক চাহিদা। এই ক্ষেত্রে দেখা যায় খরিদ্দারদের বয়স যত বেশি হয় রেটও তত বেশি হয়। বিস্ময়াভূত হবেন না – জিগোলোদের মুখে শোনা যায়, ১৭ থেকে ৭০ সব বয়সের মহিলারা খরিদ্দার হয় জিগোলোদের। জনৈক জিগোলো তাঁর এক জবানবন্দিতে বলছেন – “একবার কিছুদিনের জন্য এক মহিলার স্বামীর ভূমিকায় থাকতে হয়েছিল। আবার আলিপুরের এক মহিলার স্বামী আমাকে ভাড়া করে নিয়ে গিয়েছিলেন তাঁর স্ত্রীর জন্য। ভদ্রলোক অসম্ভব পয়সাওয়ালা, কিন্তু অক্ষম।তাই স্বামী-স্ত্রী মিলে আপসে এই ব্যবস্থায় এসেছিলেন। ভদ্রলোকের একটাই শর্ত ছিল। তাঁর সামনে তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে কাজ করতে হবে। আর একবার খুব বড়োলোক বাঙালি বাড়ির ২৪-২৫ বছরের ছেলে তাঁর মধ্য-চল্লিশের মায়ের জন্য আমাকে ভাড়া করেছিলেন। অবশ্যই মায়ের সম্মতিতেই। অত্যন্ত সুন্দরী ছিলেন সেই মহিলা। আমাদেরই অন্য জনের কাছে শুনেছি, এক বয়স্ক মহিলা তাঁর ক্লায়েন্ট ছিলেন, তিনি তাঁর বিধবা মেয়ের জন্যও তাঁকে ভাড়া করতেন”।
কেউ কেউ ইন্ডিভিজুয়াল বা স্বাধীনভাবে কাজ করেন, কেউ-বা মেল এসকর্ট সার্ভিসের মাধ্যমে কাজ করেন।মেল এসকর্ট সার্ভিসের পুরুষই হোক কিংবা ইন্ডিভিজুয়াল—কেউই লোকলজ্জার ব্যাপারটা পুরোপুরি এড়িয়ে সামনে আসতে রাজি নন। বলতে চান না নিজেদের পরিচয়। জিগোলোদের বেশিরভাগই আসছেন তথাকথিত উচ্চ-মধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত, এমনকি উচ্চবিত্ত অংশ থেকে। তাঁদের সংসার, চাকরি, সামাজিক পরিচিতি সবই আছে। এঁরা সম্মান হারানোর ভয় পান।
এক এক রাতে ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা রোজগার ! কখনও হোটেল, কখনও খরিদ্দারের বাড়িতে – যৌনসুখ আর অর্থসুখ, একসঙ্গে ! বয়স ২৬ থেকে ৪৫ – কলকাতার পুরুষ যৌনকর্মীদের মধ্যে এঁরা প্রথম সারিতে। শুধু সিঙ্গল বেড পার্টনার নয়, গ্রুপ সেক্স বা কাপল সেক্সের জন্য পুরুষ বেশ্যাদের ডাক পড়ে। গ্রুপ সেক্স মানে, তিন-চারজন বা তার বেশি মহিলা এক সঙ্গে থাকবেন। তাঁরা পরস্পর পরস্পরের পরিচিতই হয়ে থাকে। তাঁদের সঙ্গে পালা করে সেক্স করতে হবে পুরুষ বেশ্যাদের। অপরদিকে, কাপল সেক্স হল স্বামী-স্ত্রী একসঙ্গে কোনো এক পুরুষ বেশ্যাকে ভাড়া করেন। সেক্ষেত্রে একজন কলগার্লকেও সঙ্গে করে নিয়ে যেতে হয় পুরুষ বেশ্যাকে। হবে পার্টনার সোয়াপিং। পুরুষ বেশ্যার সঙ্গে মহিলার মানে স্ত্রীটির এবং পুরুষটি মানে স্বামীটি যৌন সম্পর্ক করবে কলগার্লের সঙ্গে।হাই-প্রোফাইল মহিলারা চাকরি অথবা ব্যাবসা সূত্রে আসেন নামীদামি হোটেলে।এই মহিলারা কেউ ডমিনেটিং, কেউ বাইরে কঠিন, কেউ ভিতরে ভেঙে চুরচুর, কেউ প্রচণ্ড কামার্তা, কেউ বিকৃতিমনা।
সম্প্রতি বেশ্যাবৃত্তির দায়ে শ্বেতা বসু প্রসাদের গ্রেফতার হওয়ার পরপরই প্রশ্ন উঠল — বেশ্যাবৃত্তির দায়ে শ্বেতা বসু প্রসাদদের গ্রেফতার করা হলে গ্রেফতার করতে হবে সেইসব পুরুষদের যাঁরা শ্বেতাদের কাছে যৌনসুখ নিতে আসে।এ দাবি করলেন ধৃত শ্বেতা থেকে বলিউডের হার্টথ্রব অভিনেত্রী দীপিকা পাড়ুকন। খরিদ্দার পুরুষদেরও বেশ্যা বলে ফেললেন।ক্রেতা এবং বিক্রেতার সম্পর্ক ভুলে গেলে চলবে না। যে বেচে সে বিক্রেতা, যে কেনে সে ক্রেতা।এক্ষেত্রে শ্বেতারা বিক্রেতা, পুরুষরা ক্রেতা। একপক্ষ পরিসেবা দেন, অপরপক্ষ পরিসেবা নেন পর্যাপ্ত অর্থের বিনিময়ে।পরিসেবাগ্রহণকারী কখনও বিক্রেতা নন, পরিসেবাপ্রদানকারী কখনও ক্রেতা নন। একপক্ষ অর্থ গ্রহণ করে যৌনমিলনে ব্রতী হন, অপরপক্ষ অর্থ দেয়পূর্বক যৌনমিলনে প্রবৃত্ত হন।একদলের ব্যাংক-ব্যালান্স বাড়ান, একদল ফতুর হন। দুই পক্ষের ভূমিকা ভিন্ন। এক্ষেত্রে খরিদ্দারকে ‘বেশ্যা’ বলা যায় না।
বার্ট্রান্ড রাসেল (Bertrand Russel) অবশ্য তাঁর “ম্যারেজ অ্যান্ড মরালস” (Marriage and Morals) গ্রন্থে বলেছেন – “Marriage is for woman the commonest mode of livelihood, and the total amount of undesired sex endured by women is probably greater in marriage than in prostitution.
Yahoo-র সাইটেও কী বলছে দেখব – “It’s an oversimplification to suggest marriage is JUST legalised prostitution … for many, of course, this is not the case at all.
Wikipedia বলছে – “Marriage is considered to be legalized prostitution by some feminist scholars, such as Dale Spender and women’s rights activist Victoria Woodhull. Despite this claim, many men and women are happily married in loving relationships. There are some who view doing anything that you don’t want to do, but are willing to do for money, as a form of prostitution. This would make most of the global work force, and almost all politicians, filthy stinking whores.”
বেশ্যাবৃত্তি বা Prostitution নিয়ে অন্যেরাও কে কী বলছেন একটু ধারণা নেব —
VICTOR HUGO (Les Misérables): We say that slavery has vanished from European civilization, but this is not true. Slavery still exists, but now it applies only to women and its name is prostitution.
EMMA GOLDMAN(Anarchism and Other Essays): To the moralist prostitution does not consist so much in the fact that the woman sells her body, but rather that she sells it out of wedlock.
ANGELA CARTER (Nights at the Circus): What is marriage but prostitution to one man instead of many?
ARTHUR SCHOPENHAUER, (“On Women,” Studies in Pessimism): There are 80,000 prostitutes in London alone and what are they, if not bloody sacrifices on the altar of monogamy?
RUTH MAZO KARRAS (Common Women): Prostitution exists today because women are objectified sexually, and because it is considered more permissible for men than for women to have purely sexual experiences.
NILS JOHAN RINGDAL (Love For Sale): If nobody wants to sell sex, it is a crime to force anyone to do so. But when men or women do want to sell their bodies, they should have that full right without encountering punishment or discrimination. If the client behaves decently, the relationship between the sex buyer and the sex seller must be considered a purely private transaction.
RAY ROMANO (Professional Therapist): I’d rather be in Las Vegas 104 degrees than New York 90 degrees, you know why? Legalized prostitution. In any weather that takes the edge off.
JESSE VENTURA, (Playboy interview, Nov. 1999): Prostitution is criminal, and bad things happen because it’s run illegally by dirt-bags who are criminals. If it’s legal, then the girls could have health checks, unions, benefits, anything any other worker gets, and it would be far better.
নিষিদ্ধ পাড়ায় কেন যায় পুরুষরা ? চারিদিকে যখন সেক্স র্যাকেট নিয়ে এত গুঞ্জন৷ তখন জানিয়ে রাখা ভালো দেহব্যাবসা চলছে, কিন্তু একমাত্র পুরুষের দয়াতেই৷ অনেকে বলতেই পারেন জিগোলো প্রথা এখনও বাড়ছে৷ কিন্তু তবুও যৌনপল্লিতে পুরুষ খদ্দেরদেরই রমরমা৷ সকলে বলবেন পারিবারিক জীবনে সুখশান্তির অভাবেই একজন পুরুষ যৌনপল্লির রঙিন আলোয় রাঙিয়ে তুলতে চান তার জীবন৷ কিন্তু যাঁরাই বেশ্যালয়ে যান সেইসব পুরুষের জীবনের গল্পটা কি একই ? যদিও সেটা নিয়ে ভিন্ন পুরুষের ভিন্ন মতামত৷ বিবাহত জীবনে সমস্যা বা জীবনের নিরাশা দূর করার পাশাপাশি অতিরিক্ত যৌনখিদে মেটাতেও বেশিরভাগ পুরুষই একজন বেশ্যার বিছানায় আশ্রয় নেন৷ এমনও কিছু পুরুষ রয়েছে যারা দীর্ঘদিন ধরে একজন বেশ্যার কাছেই যান৷ যেসব পুরুষরা যৌনকর্মীদের আশ্রয় নেন তাদের ছবি মোটামুটি একই ধরনের, কিন্তু তারা এই কাজের জন্য কি যুক্তি দেন ? ফ্রেড ও লারা প্রায় ছয় বছর ধরে একে অপরকে চেনে৷ কিন্তু তফাৎ একটাই যে লারার সঙ্গে সময় কাটাতে ও সহবাস করার জন্য টাকা দেয় ফ্রেড৷ সহবাসের জন্য টাকা দেওয়া ঠিক কি না তা নিয়ে দুজনে মাঝেমধ্যে ঝগড়াও করে৷ চাকরি ছাড়ার পর ইন্টারনেটের মাধ্যমেই লারার সঙ্গে আলাপ হয় ফ্রেডের৷ তাদের দুজনের মধ্যে খুব ভালো একটা সম্পর্ক তৈরি হয়৷ লারা বলেন, “আমি দেখা করতে আসার আগেই ফ্রেড আমার অ্যাকাউন্টে টাকা ট্রান্সফার করে দেয়”৷ অন্যদিকে রবার্টের জীবন আবার বেশ খানিকটা অন্য৷ বেশ কয়েকবছর হল তার বিয়ে হয়েছে৷ রবার্ট বলেন, “আমি সেক্স খুব পছন্দ করি, কিন্তু আমার যার সঙ্গে বিয়ে হয়েছে সে সেক্স তো দূরের কথা জড়িয়ে ধরা বা চুমু খাওয়াও পছন্দ করে না৷ যদিও জীবনসঙ্গিনী হিসেবেও খুব ভালো”৷ তিনি আরও বলেন, “আমি বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ থাকতে চাইতাম৷ এই কারণেই আমাকে বাধ্য হয়ে টাকার বিনিময়ে যৌনতা কিনতে হয়েছে৷” রবার্টের মতো অনেকেই মনে করেন সম্পর্কের জটিলতা কাটাতে এটি একটি ভালো উপায়৷ যদিও গ্রাহাম জানিয়েছেন, “এটা সত্যিই খুব রোমান্টিক, আর এতে মনে হয় যেন এক মিনিটে একটা গোটা সম্পর্ক তৈরি হওয়া”৷ গ্রাহামের মতোই অপর একজন হলেন সাইমন৷ লাজুক হওয়ার কারণেই মহিলাদের সঙ্গে সহজে মেশাটা তার কাছে চিরকালই ছিল দুঃসাধ্য৷ সাইমন বলেন, “সহবাসের জন্য আমার প্রবল ইচ্ছা হয়৷ কিন্তু শুধু সাময়িক আনন্দের জন্য আমি এটা করি না৷ আসলে ওই মুহুর্তে কিছু সময় যদি আমি একজন মহিলার সঙ্গে কাটাতে না পারি, তাহলে আমি নিজেকে শারীরিকভাবে অসুস্থ বলে মনে করতে থাকি৷” পুরুষদের বেশ্যাগমন কিন্তু শুধুই বীর্যস্খলনের জন্য – এটা ভাবলে বেশ ভুল হয়ে যাবে।কেউ যায় নেশা করতে, কেউ যায় নানা কারণে আত্মগোপন করতে, কেউ যায় বডি করাতে, কেউ-বা অত্যাচার করতে, কেউ যায় শুধুই ঘসাঘসি করতে, কেউ-বা আসে নির্ভেজাল গল্প করতে।কে, কী করতে বেশ্যার ঘরে রাত বা দিন কাটাচ্ছে তা এক প্রয়োজনের সঙ্গে আর-এক প্রয়োজন এমনভাবে মিশে আছে যে কোনো একটা উদ্দেশ্য আলাদা করে বাছা যায় না।
বেশ্যাপাড়ার বেশ্যারা কেমন মস্তি-স্ফূর্তি করে জানতে ইচ্ছা করে খুব। যে যৌনতা নিয়ে তামাম মানুষের কত ফ্যান্টাসি কত প্যাশন, সেই যৌনতা বেশ্যাপাড়ার বেশ্যাদের যৌনসঙ্গী যখন মোটেই দুর্লভ নয়, সেই যৌনতা কতটা উপভোগ্য ! একটিবার যৌনমিলনে জন্য নারীপুরুষনির্বিশেষে যে মানুষ হা-হুতাশ, তখন বেশ্যাপাড়ার বেশ্যারা ‘হর রাত নই খিলাড়ি’-দের পেয়ে জীবন কেমন সুখের সাগরে ভাসছে ? ক্ষেত্র-সমীক্ষার প্রয়োজন হয়ে পড়ল। কথা বলতে হবে তাঁদেরই সঙ্গে, যাঁরা প্রতি রাত নতুন নতুন যৌনসঙ্গীদের যৌনমিলনে মেতে ওঠেন।রাতভর যাঁরা স্ফূর্তি করে তাঁরা কী বলছে ? পৌঁছে গেলাম বি কে পাল অ্যাভিনিউয়ের একটি প্রসিদ্ধ বেশ্যাপাড়ায়।প্রথম দিন অনেকটা জড়তা-আড়ষ্টতা চেপে বসলেও, পরে সহজেই সহজ হয়ে গিয়েছিলাম। বিভিন্ন স্তরের মোট ১০ জন যৌনকর্মীর সঙ্গে কথা বলার সমর্থ হয়েছিলাম। ‘বাবু’ হিসাবেই কথা বলেছিলাম। সাংবাদিক, লেখকের পরিচয়ে নয় – সোজাসুজি ‘বাবু’ হিসাবে সময় চেয়েছি, পয়সা দিয়েছি, গল্প শুনেছি। কী গল্প ? যা শুনেছি তা যতটা সম্ভব মার্জিত ভাষায় শীলিত ঢঙে প্রকাশ করার চেষ্টা করব স্মৃতির কাছে ঋণী থেকে — “এ পাড়ার মেয়েরা কেউ মানুষ নয়, যোনি-সংবলিত যন্ত্রবিশেষ। ভালোবাসাহীন, প্রেমহীন, আদরহীন, আত্মীয়হীন, বন্ধুহীন, রুচিহীন এক যান্ত্রিক সম্পর্কহীন সম্পর্ক। পয়সার বিনিময়ে আমাদের প্রতি রাতে ক্লান্তিহীন যোনি বিলাতে হয় একাধিক পুরুষকে, যে পয়সার অনেকটা অংশ খেয়ে নেয় অনেক নেপো।প্রতি রাতের এক-একটি খরিদ্দার যেন এক-একটি বিভীষিকা, আতঙ্ক, অত্যাচারী, নির্যাতক।পুরুষ নয়, লিঙ্গনামক একটি মৃত্যুদণ্ড ! কেমন যৌনসুখ ? যৌনসুখ কী সেটা কোনোদিনই বুঝতে পারলাম না। কাকে বলে ভালোবাসা ? কাকে বলে সোহাগ-আদর ? কাকে বলে শৃঙ্গার ? যৌনসঙ্গী বেছে নেওয়ার কোনো স্বাধীনতা নেই। সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার নেই। কোনোদিন তা জেনেবুঝে উপভোগ করতে পারলাম কই ! জেনেবুঝে নেওয়া তো দূরের কথা – খরিদ্দারের সঙ্গে যখন প্রথম যৌনকর্মের অভিজ্ঞতা হয় তখন তো অজ্ঞান অবস্থা। যখন, মানে যে বয়সে সেক্স করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করার নয়, সেই বয়সে সঙ্গম ঘাড়ে চেপে বসে। বলাৎকার দিয়ে শুরু হয় আমাদের যৌনজীবন।তারপর একদিন সময়ের দাবি মিটিয়ে শরীরের এ ক্ষত ক্রমশ শুকিয়ে যায়। শরীর-মনের ভালো লাগা মন্দ লাগার কোনো দাম নেই। ইচ্ছা-অনিচ্ছার কোনো মূল্য নেই। ‘বাবু’ এলেই ‘বসতে’ হবে। এটাই দস্তুর। কখনো-কখনো খরিদ্দারের কাছে আমাদের শরীরটার জেল্লা বাড়াতে গর্ভধারণও করতে হয়। গর্ভধারণ করলে বুক–দুটো বেশ ভারি-ভারি হয়ে ওঠে, শরীরটা গোল-গোলপানা হয়। পোয়াতি মেয়ের ভরা বুক ভরা শরীর অনেক খরিদ্দারকে বেশ তাতিয়ে দেয়। কিন্তু সন্তান যতক্ষণ ধারণ করে রাখা যায় ধারণ করি, তারপর একসময় গর্ভপাত। পেটের ভিতর ছয়-সাত মাসের বাচ্চা তখন বেশ বড়ো। বাচ্চা এমন বড়ো হয়ে গেলে গর্ভপাত মানেই মৃত্যকে নেমন্তন্ন করা। তবুও করতে হয়। পেট খসাতে হাতুড়ে ডাকতে হয়, বাধ্য হয়েই। সেপটিক হয়ে কেউ কেউ মারাও যায়। কেউ সে খবর রাখে না। প্রতি মুহূর্তে তীব্র যন্ত্রণাদায়ক যৌনমিলনের আতঙ্কে দিন এবং রাত গুজরান।সারা পৃথিবীর যৌনপল্লির যৌনকর্মীরা যে-কোনোদিন যে-কোনো মুহূর্তে পেশার মুখে লাথি মারতে তৈরি।সুযোগ পেলে আমরা যৌনপল্লিগুলি নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারি। কিন্তু চাইলেও কোনোদিন নিশ্চিহ্ন হবে না। কারণ আমরা ছাড়া কেউই আমাদের পেশাকে নিশ্চিহ্ন করতে চায় না। বরং উলটোটাই হয়। সব ভণ্ড। কি সমাজ, কি রাষ্ট্র, কি সমাজসেবী সংগঠক সবাই আমাদের মঙ্গলের নামে নিজেরা গুছিয়ে নিয়ে আমাদের টিকিয়ে রাখার ষড়যন্ত্র রচনা করে যাচ্ছে। মস্তানদের মাস্তানি, পুলিশের বাড়াবাড়ি, দালালের রমরমা, আড়কাঠির সক্রিয়তা, শরীরের অন্য অংশ সহ যোনিদেশে সিগারেটের ছ্যাঁকা, কামড়ে রক্তাক্ত করা, যোনিমুখে মদের বোতল বসিয়ে সজোরে লাথি মেরে পেটের ভিতর ঢুকিয়ে দেওয়ার আতঙ্ক, যোনির ভেতর লঙ্কার গুঁড়ো দিয়ে দেওয়ার আতঙ্ক, পাড়ায় মেয়ে কেনাবেচা, নতুন নতুন মেয়েদের এ লাইনে নিয়ে আসা, সিফিলিস, গনোরিয়া, এইডস — সব আগের মতোই আছে, যেমন ছিল। যেটা হয়েছে, সেটা হল এলাকায় প্রচুর কন্ডোম বিক্রি বেড়েছে। আর ফি-বছর একটি মেলার আয়োজন হচ্ছে, যা “যৌনকর্মী মেলা”।
পরিণতি ? শেষপর্যন্ত এই দুর্দশাগ্রস্ত বেশ্যাদের পরিণতি কী ? দুটি পরিণতি – (১) গেরস্ত হওয়া এবং (২) হাফ-গেরস্ত হওয়া। গেরস্ত হওয়া মানে যদি কোনো বাঁধা ‘বাবু’, সে মজুর-দালাল-পাতি চাকুরে-ব্যাবসায়ী যাই হোক – ধরে তাকে দিয়ে কপালে সিঁদুর পরিয়ে কোথাও সত্যিকারের ঘর বসানো যায়।অপরদিকে হাফ-গেরস্ত মানে অন্তত কোনো বাঁধা ‘বাবু’ পাওয়া, যে তাকে বিপদে-আপদে দেখবে, হয়তো দু-পয়সা মূলধন দিয়ে সাহায্য করবে যাত কিনা সে কালে কালে বাড়িউলি হয়ে উঠতে পারে। এই তাঁর পেশায় একমাত্র উত্তরণ। এই দুয়ের মধ্যে কিছুই না হলে ক্রমে ওই পল্লিতেই ঝি-গিরি করতে হয়, নয়তো পথে পথে ভিক্ষে করে বেড়াতে হয়। যদি দেশ-গাঁ ঘর আত্মীয় বলে কিছু থাকে তো সেখানে বেঁচে থাকার অন্তিম ঠাঁই খুঁজে নিতে হয়।
যে সমস্ত পুরুষরা ওই পাড়ায় থাকে তাঁরা অধিকাংশই নেশাগ্রস্ত, বেকার, বেশ্যাদের উপার্জনের নির্লজ্জ পরজীবী।ওইসব নিকম্মা গুলিখোর পুরুষরাই ওদের মানে বেশ্যাদের প্রহার করে, অত্যাচার করে। সংগঠনের পদ দখল করে, মতামত দেয়। এইসব পুরুষপুঙ্গবদের হাত থেকে, দালালদের হাত থেকে, মাসিদের হাত থেকে অত্যাচারিত মেয়েদের রক্ষা করতে পারবে কারা ? সংগঠন ? সংগঠনের কর্মসূচিতে মিশে গেছে অত্যাচারী যাঁরা ? দুর্ভাগা বেশ্যাদের কথা কে বলবে কারা ? সংগঠন ? ওদের কণ্ঠ কারা ? সংগঠক ও স্বেচ্ছাসেবীরা, যাঁরা মৌচাকে রানি-মৌমাছি হয়ে বসে চূড়ায় ? সংগঠনের অফিস আছে, অফিসে মোটা বেতনের চাকুরে আছে, সংগঠনের প্রেস আছে, সভা-সমিতি আছে। সংগঠনের রাজনীতি আছে। পাড়া কোন্ রাজনৈতিক দলের কুক্ষিগত থাকবে তা নিয়ে নিত্য লড়াই-সংঘর্ষ আছে।
গড়পড়তা একটা মেয়েকে প্রতিদিন কমবেশি চারবার যৌন সম্পর্ক করতে হয়। দিনের বা রাতের শেষতম খরিদ্দারটির জন্য যখন কোনো মেয়ে ‘বসছে’ তখন তথাকথিত সেই ‘যৌনসেবা’ দিতে শরীর কতটা প্রস্তুত।সপ্তাহে সাতদিন, মাসে তিরিশ দিন, বছরে তিনশ পঁয়ষট্টি দিন মেয়েটির জীবন এভাবে চলতে থাকে। কখনো-বা পেটের জন্য অস্থায়ী আস্তানা গাড়তে হয় শহরের কোনো এক উপকণ্ঠে। বিচ্ছিন্ন প্রবাসী শ্রমিকদের বস্তির মধ্যে বেশ্যাপল্লি এখনও জাঁকিয়ে বসতে পারেনি। কলকাতার মেয়েরা যেখানে ওভারটাইম খাটে। দিনে ৫০-১০০ শরীরের সঙ্গে মিলিত হতে হয়। বেশ্যাদের কাজ হল যথাযথ অর্থের বিনিময়ে পুরুষদের যৌনসুখ দিয়ে তৃপ্ত করা। শুধু কি যৌনসুখ দেওয়া ! একজন পুরুষ যখন মূল্য দিয়ে একতাল মাংস ভাড়ায় নেয়, তখন সেই মাংস কেমনভাবে খাবে সেটা পুরুষটির উপরই নির্ভর করে।সে সঙ্গম করতে পারে, যৌন বিকৃতি চরিতার্থ করতে পারে, যৌনকর্মীকে প্রহার করতে পারে, ধর্ষকাম মেটাতে পারে, যোনিদেশে জ্বলন্ত সিগারেট দলে দিতে পারে।প্রতিটি বিক্রি হওয়াই তো মোটামুটি একইরকম যন্ত্রণাক্লিষ্ট – দেহে ও মনে দুই-ই।বেশ্যাপল্লির বেশ্যাদের যৌনকর্মী বা বেশ্যা যাই-ই বলা হোক-না-কেন “যৌন-ক্রীতদাস” বললেই এঁদের অবস্থানে অনেকটা কাছাকাছি পৌঁছোনো যায়।সিটি কলেজের অধ্যাপক রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য এক সাক্ষাৎকারে স্পষ্টভাবে বলেছেন, ‘’যাঁদের দেহ বেঁচে খেতে হয়, তাঁদের ‘যৌনকর্মী’ বলে এই কুপ্রথাটিকে এক ধরনের অনুমোদন (স্যাংশান) দেওয়ায় আমার প্রবল আপত্তি আছে। পদ্মলোচন বললে কানার চোখ ফোটে না। দেহব্যাবসা শ্রেণিসমাজের বহু কলঙ্কের একটি ; শ্রেণিপূর্ব সমাজে এমন কোনো কুৎসিত পেশা ছিল না। জীবনধারণের কোনো উপায় না থাকলে তবেই মেয়েদের এই পথ বেছে নিতে হয় – তার কারণ বেছে নেওয়ার মতো আর কোনো বিকল্প তাঁদের থাকে না। এই পেশা বন্ধ করাই হবে শ্রেণিহীন সমাজের দিকে যাওয়ার অন্যতম প্রধান কাজ। যৌনকর্মী নাম দিয়ে, ট্রেড লাইসেন্স চালু করে যাঁরা এই পেশাটিকে টিকিয়ে রাখতে চায়, তাঁরা আসলে শ্রেণিসমাজেরই পক্ষে : আরও বহুরকম শোষণের মতো এই শোষণেও তাঁদের কোনো আপত্তি নেই”।(টপ কোয়ার্ক. ডিসেম্বর ২০০৪, ৬৯ পৃষ্ঠা)
http://blogger-anirban.blogspot.com/