আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে চাঁদাবাজি, দখলদারি ও নৈরাজ্যে লিপ্ত হয়েছে বিএনপি এবং এর অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা। যদিও বিএনপির পক্ষ থেকে ‘জিরো টলারেন্স নীতি’ ঘোষণা করা হয়েছে।
দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বিএনপি ও অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের পদধারী অনেক নেতার নেতিবাচক কর্মকাণ্ডে যুক্ত থাকার অভিযোগ উঠলে এ নীতিতে যেতে বাধ্য হয় দলটি।
সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে ইতিমধ্যে কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতাসহ সারা দেশে দলটির অন্তত আড়াইশ নেতাকর্মীকে বহিষ্কার, কারণ দর্শানোর নোটিস দেওয়া হয়েছে। জড়িতদের আইনের হাতে তুলে দেওয়ার নির্দেশনাও রয়েছে। এরপরও দলটির কেউ কেউ অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
‘নব্য বিএনপি’ ও দলের সুযোগসন্ধানী নেতাকর্মীদের দায়ী করছেন বিএনপির দায়িত্বশীলরা। তারা বলছেন, বিএনপি ও অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নাম ভাঙিয়ে চাঁদাবাজি ও দখলদারির সঙ্গে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ‘অনুপ্রবেশকারী’রা জড়িত।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সম্প্রতি বলেন, ‘এটা দুঃখজনক। এ বিষয়ে দল থেকে কঠোর বার্তা দেওয়া হয়েছে।
বিএনপিকর্মীদের ন্যূনতম সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেলে বহিষ্কার, কারণ দর্শাতে বলা হয়েছে। কেউ বিএনপির নাম ভাঙিয়ে চাঁদাবাজি করতে গেলে তাকে ধরে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়ার কথা বলেছি আমরা। এসব কর্মকাণ্ড বিএনপি বরদাস্ত করবে না।’
বিএনপির দপ্তর থেকে পাওয়া একটি উপজেলার চাঁদাবাজি, দখলদারি ও নৈরাজ্যের চিত্র পর্যালোচনা করলেই সারা দেশের চিত্র সম্পর্কে বেশ পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যায়।
৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া উপজেলার চিত্র বিশ্লেষণে দেখা যায়, চাঁদাবাজি, দখলদারি ও নৈরাজ্যের সবটুকুই হয়েছে এ উপজেলায়। উপজেলা বিএনপি, ছাত্রদল, যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল কেউ বাদ যাননি।
সরকারের পতনের পর মঠবাড়িয়ার বিভিন্ন স্থানে আধিপত্য বিস্তার শুরু করেন উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক রুহুল আমীন দুলাল ও পৌর বিএনপির আহ্বায়ক কেএম হুমায়ুন কবির এবং তাদের অনুসারীরা।
উপজেলায় ডায়াগনস্টিক সেন্টার দখল ও ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ, ড্রেজার ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ, ডিশ ও ইন্টারনেট ব্যবসা দখল, জমি দখল, চাঁদাবাজি কোথায় নেই তারা। নেতাদের এসব লুটপাট-দখলের ভিডিওচিত্র দলের হাইকমান্ডের অনেক নেতার কাছে পাঠিয়েছেন ভুক্তভোগীরা।
বিএনপির দপ্তরে এ উপজেলা নিয়ে একাধিক অভিযোগ জমা পড়েছে। অভিযোগে বলা হয়েছে, শিকদার ডায়াগনস্টিক সেন্টার, সেবা ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও যমুনা ডায়াগনস্টিক সেন্টার ৬ আগস্ট রুহুল আমীন দুলালের অনুসারীরা দখলে নেন।
শিকদার ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মালিক অধ্যাপক আজিমুল হক সংবাদ সম্মেলনে করে জানান, সেনাবাহিনীর ধমকে আংশিক মালামাল ফিরিয়ে দিলেও ডায়াগনস্টিক মেশিনটি পিটিয়ে ভেঙে ফেলেছে। ওই উপজেলার যুবদলের সদস্য সচিব আবুল কালাম (আবু মাস্টার) ও মঠবাড়িয়া উপজেলা যুবদল নেতা মো. শাহীন রেজা ও যুবদল নেতা মো. বেল্লাল নিয়ন্ত্রণে নিয়েছেন উপজেলার ড্রেজার ব্যবসা।
আমড়াগাছিয়া দক্ষিণ সোনাখালীতে পল্লীবিদ্যুতের প্রকল্পের বালু ভড়াটের কাজ বন্ধ করে দিয়ে কাজ ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছেন উপজেলা ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক রিয়াজ উদ্দিন।
রিয়াজ উদ্দিন পিরোজপুর-২ আসনের সংসদ সদস্য মহিউদ্দিন মহারাজের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়। স্বেচ্ছাসেবক দল নেতা পিন্টু দফাদার ও ছাত্রদল নেতা খোকন মল্লিক এলাকার ডিশ ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিয়েছেন।
শুধু তাই নয়, চাঁদা দাবিরও অভিযোগ রয়েছে। উপজেলার বড় মাছুয়া ইউনিয়নের সাধারণ নাগরিক স্বপন বেপারি জেলা বিএনপির কাছে অভিযোগ করে বলেছেন, মাছুয়া ইউনিয়ন বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক নবী হোসেন পহলান তার কাছে ৫০ হাজার টাকা চাঁদা দাবি করেন।
মঠবাড়িয়া উপজেলার পূর্ব সাপলেজা গ্রামের বাসিন্দা আল-আমীনের কাছেও চাঁদা দাবি করেছেন উপজেলার বড় মাছুয়া ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মীর মনির উদ্দীন ছগির ও সাবেক ছাত্রদল নেতা রিমন মীর।
উপজেলার দুটি বাস টার্মিনাল দখল এবং ঢাকাগামী পরিবহনের কাউন্টারগুলো ১০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে শ্রমিক দল নেতাদের বুঝিয়ে দিতে এক গ্রুপ হুমকি দিচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
রুহুল আমীন দুলাল ও হুমায়ুন কবির এবং তাদের অনুসারীদের দখল-লুটপাটের বিষয়ে জেলা বিএনপির কাছে ১৫টির বেশি লিখিত অভিযোগ জমা পড়েছে। রুহুল আমীন দুলালকে কেন্দ্র থেকে শোকজ করা হয়েছে। এই শোকজ নোটিসের বিরুদ্ধে ২৫ আগস্ট সন্ধ্যায় মঠবাড়িয়া উপজেলায় মিছিল করেন দুলালের অনুসারীরা। এ ঘটনায় ২৯ আগস্ট বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের কাছে আরও একটি অভিযোগ করা হয়।
উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক রুহুল আমীন দুলাল তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘একটি চক্র তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে জেলা ও কেন্দ্রে অভিযোগ দিয়ে বেড়াচ্ছে। অভিযোগগুলোর কোনোটাই সত্যি নয়। বরং দুর্দিনের কর্মী হিসেবে আমি উপজেলায় নৈরাজ্য বন্ধের সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি।’
পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া উপজেলার মতো খোদ রাজধানী ঢাকায়ও চলছে চাঁদাবাজি, দখলদারি ও নৈরাজ্য। রাজধানীর লালবাগে বিএনপির পরিচয় দিয়ে বিভিন্ন ব্যক্তির বাসায়, তাদের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে চাঁদাবাজির অভিযোগ রয়েছে। এমন অভিযোগে লালবাগ থানায় সাধারণ ডায়েরি হয়।
৩০ আগস্ট লালবাগ থানায় হাজি শেখ আমির হোসেনের করা সাধারণ ডায়েরিতে উল্লেখ করা হয়, ‘৩০ আগস্ট যুবদল নেতা মো. চান মিয়াসহ অজ্ঞাত ব্যক্তিরা আমার বাসা ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে গিয়ে মোশারফ হোসেন খোকনের (কালা খোকন) নির্দেশে হুমকি-ধমকি দিয়ে চাঁদা চেয়েছেন। না দিলে প্রাণে মেরে ফেলার হুমকি দিয়েছেন।’
ঢাকা-৭ নির্বাচনী এলাকার হাজি মো. সেলিমের বড় ছেলে সাবেক এমপি সোলায়মান সেলিমকে সঙ্গে নিয়ে গত ১৬ আগস্ট চকবাজার শাহি মসজিদে জুমার নামাজ আদায় করেন মোশাররফ হোসেন। সে সময় সোলায়মান সেলিমকে সহযোগিতার আহ্বান জানান তিনি।
এ অভিযোগ বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে জমা পড়লে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক মোশাররফ হোসেন খোকনকে (কালা খোকন) কারণ দর্শানোর নোটিস দেওয়া হয়।
ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা উপজেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক কামরুজ্জামান লেবু, জাহাঙ্গীর হাসান ও মুক্তাগাছা পৌর বিএনপির সভাপতি শহীদুল ইসলাম শহীদ প্রমুখ উপজেলার ১০টি ইউনিয়ন পরিষদ ভবনে তালা দিয়ে চেয়ারম্যান এবং মেম্বারদের কাছ থেকে চাঁদা দাবি করেছেন। তারা মুক্তাগাছা উপজেলা বিএনপির নাম ব্যবহার করে মুক্তাগাছা মোটর মালিক সমিতির অফিস, সিএনজি, অটোস্ট্যান্ড, পল্লীবিদ্যুৎ অফিস দখল ও সাব-রেজিস্ট্রি অফিসসহ বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি স্থাপনা দখল করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। কামরুজ্জামান লেবু দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘দুর্দিনে আমরা হামলা-মামলার শিকার হলাম। কিছু ষড়যন্ত্রকারী আমাদের সরিয়ে, তাদের উদ্দেশ্য হাসিলের চেষ্টা করছে।’
বরিশালের বাকেরগঞ্জের ফরিদপুর ইউনিয়ন ছাত্রদল সভাপতি ইলিয়াস গাজীর বিরুদ্ধে ব্যবসায়ীর কাছ থেকে ৩০ হাজার টাকা চাঁদা নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। তার বিরুদ্ধে জেলা ছাত্রদলের কাছে অভিযোগ জমা পড়েছে।
এ প্রসঙ্গে জেলা ছাত্রদলের সহসভাপতি সবুজ আকন্দ জানান, ‘কিছু অভিযোগ রয়েছে, সেগুলোর ব্যাপারে আমরা ব্যবস্থা নিয়েছি। এখনো এলাকায় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা রয়েছেন। যাদের পদ নেই, তারা বিএনপি নেতাদের সঙ্গে মিশে এসব অপকর্ম করে থাকতে পারেন।’
বিএনপিও সতর্ক হওয়ার নোটিস দিচ্ছে। বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ ও যুগ্ম মহাসচিব খায়রুল কবির খোকনকে সম্প্রতি কারণ ব্যাখ্যা চেয়ে নোটিস দেওয়া হয়েছে।
এর আগে দলের চেয়ারপারসনের সাবেক উপদেষ্টা রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু, বরিশাল বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক বিলকিস জাহান শিরিনকে সব পদ থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। হবিগঞ্জ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক আবুল হাশিমকে বহিষ্কার করা হয়েছে।
বিএনপির কেন্দ্রীয় দপ্তর সূত্র বলছে, নানা অপকর্মে জড়িত থাকার অভিযোগে বিএনপির ও অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের অন্তত আড়াইশ নেতাকর্মীকে বহিষ্কার করা হয়েছে। কারণ দর্শানো হয়েছে বা পদ স্থগিত করা হয়েছে অর্ধশত নেতাকর্মীর।
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, ‘চাঁদাবাজি, দখলদারি ও নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে কেন্দ্র খুবই কঠোর অবস্থানে রয়েছে। এ জাতীয় ঘটনায় নজর রাখার জন্য কয়েকজন নেতাকে আলাদাভাবে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।’ সূত্র : দেশ রূপান্তর