অভিজ্ঞতার বোঝা বইছে বাংলাদেশ

পলাতক সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জনপ্রশাসনে সিনিয়র সচিব পদটি তৈরি করেছিলেন ২০১২ সালে, নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে। মূলত অনুগত আমলাদের পুরস্কৃত করতেই এ পদের সৃষ্টি। ক্রিকেট দলেও অধিনায়ক, সহ-অধিনায়কের বাইরে আলাদা কোনো দায়িত্বশীল পদ নেই।

তবে জনপ্রশাসনের মতো বাংলাদেশ ক্রিকেট দলেও ‘সিনিয়র ক্রিকেটার’ নামের অদৃশ্য একটি কোটা চলমান বহু বছর ধরে। তারা সাধারণ নিয়মনীতির ঊর্ধ্বে।

একাদশে তাদের জায়গা দিতে বসে থাকতে হয় তরুণদের, সেরা সময়ে মেলে না সুযোগ। সিনিয়র ক্রিকেটারদের অভিজ্ঞতার বোঝা লম্বা সময় ধরেই বয়ে চলেছে বাংলাদেশ, কিন্তু ফল আসছে অল্পই।

চ্যাম্পিয়নস ট্রফি খেলতে যাওয়ার আগে দেশের মাটিতে অধিনায়ক নাজমুল হোসেন শান্তর সংবাদ সম্মেলন, মিরপুরের শেরেবাংলা ক্রিকেট স্টেডিয়ামে। সেখানে দলে মুশফিকুর রহিম এবং মাহমুদউল্লাহর গুরুত্ব সম্পর্কে শান্ত বলেছিলেন, ‘দুজনেই গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়, গত চ্যাম্পিয়নস ট্রফিও খেলেছেন। তাদের অভিজ্ঞতা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। তবে অধিনায়ক হিসেবে নির্দিষ্ট কারও ওপর নির্ভরশীল হতে চাই না। দল হিসেবে যেন খেলতে পারি।

যেই খেলবেন দায়িত্ব নিয়ে খেলেন, যেন দলকে জেতাতে পারেন। রিয়াদ ভাই মুশফিক ভাইয়ের অভিজ্ঞতা যেন সবাইকে দেন, তাদের ভাবনা যেন মাঠের ভেতর শেয়ার করেন।’

 

অধিনায়কের চাওয়াটা বিন্দুমাত্র পূরণের চেষ্টাও যেন ছিল না এ দুই সিনিয়র ক্রিকেটারের। ভারতের বিপক্ষে মাহমুদউল্লাহ খেলেননি পেশির চোটের কারণে, মুশফিক নেমে ব্যাটিংয়ে করেছেন শূন্য। অক্ষর প্যাটেলের বামহাতি স্পিনে ক্যাচ দিয়েছেন উইকেটরক্ষকের হাতে।

আফগানিস্তান সিরিজে চোট পাওয়ার পর লম্বা সময় আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের বাইরে ছিলেন মুশফিক, বিপিএলে তার দল ফরচুন বরিশাল শিরোপা জিতলেও মুশফিক ছিলেন নিষ্প্রভ। ১৪ ম্যাচে ৯ ইনিংসে ১৮৪ রান, সর্বোচ্চ ৪২*, স্ট্রাইকরেট ১২৮ প্রায়। তবুও তিনি জাতীয় দলে ‘অটোম্যাটিক চয়েজ’। অথচ উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যান হিসেবে বিপিএলে দারুণ ছন্দে থাকা মাহিদুল ইসলাম অঙ্কন সুযোগ পেতে পারতেন।

স্ল্যাগ সুইপ মুশফিকের অন্যতম প্রিয় শট, এই শটে খেলোয়াড়ি জীবনে অনেক রানও যেমন পেয়েছেন, তেমনি বহুবার আউটও হয়েছেন। গতকাল রাওয়ালপিন্ডিতে তাকে ব্যাটিংয়ে আসতে দেখেই ডিপ মিডউইকেটে ফিল্ডারকে বাউন্ডারির কাছে রেখেছেন মিচেল স্যান্টনার, তারপর মাইকেল ব্রেসওয়েল দিয়েছেন ঝুলিয়ে দেওয়া টোপ। তাতেই যদি বোকার মতো ফাঁদে পা দিয়ে বসেন মুশফিকের মতো অভিজ্ঞ ব্যাটসম্যান, তাহলে অভিজ্ঞতার মূল্য থাকল কোথায়?

উপমহাদেশের বাইরের দলগুলো, বিশেষ করে নিউজিল্যান্ড বা দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দলের পেস আক্রমণটাই বেশি ভোগায় প্রতিপক্ষকে। প্রথাগতভাবেই তাদের স্পিন আক্রমণটা হয় দুর্বল, কারণ দেশের মাটিতে স্পিনারদের উপযোগী উইকেট বা পরিবেশই তো থাকে না। বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা সেই নিউজিল্যান্ডের অফস্পিনারকে দিলেন চার উইকেট। ব্রেসওয়েল নিজেও হয়তো নিজেকে এতটা ভালো স্পিনার মনে করেন না। নিউজিল্যান্ডের বিখ্যাত ব্রেসওয়েল পরিবারের সদস্য, যে পরিবার থেকে একাধিক ক্রিকেটার প্রতিনিধিত্ব করেছেন দেশের, তাদেরই বংশধর হিসেবে ৩১ বছর বয়সে আন্তর্জাতিক অভিষেক ঠিক ‘উজ্জ্বল প্রতিভা’ জানান দেয় না। ৩১ গড়, ইকোনমি ৫, এই ম্যাচের আগে ২৭ ম্যাচে ছিল ২৭ উইকেট, অনেক পুরনো সাংবাদিকদের ভাষায়, ‘এমন স্পিনার ঢাকা লিগেও দল পাবে না।’

 

অথচ এ রকম স্পিনারের বলে ডাউন দ্য উইকেটে এসে মারতে গিয়ে যেভাবে আউট হলেন মাহমুদউল্লাহ, তাতে অভিজ্ঞতার বিন্দুমাত্র চোখে পড়ে না। আনাড়ির মতো ডাউন দ্য উইকেটে এসে মারতে গিয়ে ব্যাটের কানায় লাগিয়ে বল তুলেছেন আকাশে। ক্রিকেটের ভাষায় ‘চিমনি শট’। সাধারণত টেলএন্ডার বা পেসাররা যারা শেষে ব্যাট করেন তাদের এভাবে আউট হতে বেশি দেখা যায়। সেখানে ৪৩০টা আন্তর্জাতিক ম্যাচখেলা, সঙ্গে দেশের প্রথম শ্রেণি ও লিস্ট এ মিলিয়ে আরও বেশি ম্যাচ খেলা মাহমুদউল্লাহ যেভাবে দলকে বিপদে ফেলে বিদায় নিলেন তাতে অভিজ্ঞতার চেয়ে আনাড়িপনাই বেশি। পরে ফিল্ডিংয়ের সময় সেঞ্চুরিয়ান রাচিনের ক্যাচও মিস করেন মাহমুদউল্লাহ।

অবশ্য এই অভিজ্ঞ দুজনেই ২০১৬ সালে নিশ্চিত জয়ের মুহূর্তে অবিমৃষ্যকারীতায় বাংলাদেশকে জয়বঞ্চিত করেছিলেন টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে। ভারতের বিপক্ষে ৩ বলে ১ রান নিতে না পেরে দুজনের পরপর দুই বলে বিদায়, এটা হার মানায় কল্পনাকেও। এখান থেকেও যে ম্যাচ হারা সম্ভব সেটা বুঝিয়ে দিয়েছিলেন দুই ‘ভায়রা ভাই’।

যেকোনো বড় আসর মানেই যেন সিনিয়র ক্রিকেটারদের ‘ফেয়ারওয়েল পার্টি’। জেতার চাইতে বিদায় সংবর্ধনা আর স্মৃতি জমানোই যেন মুখ্য উদ্দেশ্য। এভাবেই অভিজ্ঞতার বোঝা বয়ে চলেছে বাংলাদেশ, তাতে সুযোগ হারাচ্ছেন তরুণরা।

Exit mobile version