সরল মানুষের চেয়ে সৌন্দর্যবান আর কেউ নয়। যারা সাদামাটা জীবনযাপন করে
তাদের চেয়ে বেশি মানসিক প্রশান্তিতেও কেউ থাকে না। সরল মানুষ ঠকবে তবুও
কাউকে ঠকানোর কুচিন্তায় নিজেকে সঁপে দেবে না। ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে কথা বলতে পারে
না বলে বারবার আঘাত প্রাপ্ত হতে হবে, বিশ্বাস ভেঙে যাবে কিংবা অশ্রুর সাথে
জীবন গড়িয়ে যাবে তবুও কাউকে অভিশাপ দেবে না। মানুষের থেকে হাজারো দুঃখ
পেয়েও কাউকে দীর্ঘশ্বাসে বয়ে বেড়াবে না। কীভাবে অগাধ দুঃখের মাঝেও
নিজেকে সর্বোচ্চ তৃপ্তিতে রাখতে হয়- সেটা সরল মানুষ জানে। যাতের বিশ্বাসের
সাথে কথা-কাজের দারুন মিল তারাই সেই সরল মানুষ! দিন-দুনিয়ার সবচেয়ে আপন
মানুষ।
আমাদের জীবনে দু'একজন সাদামাটা মানুষের সাথে সখ্যতা গড়ে উঠলেই জীবন
সুন্দর হয়ে ওঠে! ধীরে ধীরে জটিল হতে থাকা সময়ের দুর্বিপাকে একজন
ভালোমানুষ পেলে তাকে ভরসা করে বাঁচা যায়। নতুন স্বপ্নে বিভোর হওয়া যায়।
তবে সমস্যা হচ্ছে, দুধ দিয়ে রাজার পুকুর ভরার গল্পের মত সেই সরল মানুষগুলো
কারা হবে? একজন সাদমাটা মানুষের সঙ্গ তখন-ই দারুণভাবে উপভোগ্য হয়ে
উঠবে যখন অন্য মানুষেরাও একটু-আধটু সরল হবে, সিস্টেম অনেকটাই স্বচ্ছ
হবে এবং আমানত দু'কূলেই রক্ষিত হবে! কেউ ত্যাগের সাগর খুঁড়বে আর কেউ
ভোগের পাহাড় গড়বে-এমন অসমতায় শান্তি প্রতিষ্ঠা করা অসম্ভব।
যে মানুষ নির্মলভাবে হাসতে পারে তার মধ্যে ভালোমানুষি জিইয়ে আছে। মানুষ কী
মন্দ হয়েই বাড়ে? না! আঘাত পেতে পেতে, ঠকতে ঠকতে এবং পারিপার্শ্বিক
অসংলগ্নতা তাকে লোভের দিকে, বর্বরতা এবং ভোগের দিকে ঠেলে নিয়ে যায়।
মানুষ যখন মিথ্যা বলে পার পায় তখন মিথ্যাকেই সে উত্তরণের বাহন করে। যখন
ফাঁকি দিয়ে প্রশংসা পায়, দুর্নীতি করে সাধুবাদ পায় কিংবা পাপ করেও পুরস্কৃত
হয় তখন সে মন্দটাকেই আঁকড়ে ধরে। একজন মানুষ ধীরে ধীরে অমানুষের
যাত্রাপথে এগিয়ে যায়!
বিশ্বাসের চরম ভাঙনের কালে, অন্যায়-দুর্নীতির মহোৎসবের হালে ভালো মানুষ
নাই? অনেকে-ই আছেন। তবে তারা পিছিয়ে আছেন; পিছিয়ে রাখা হয়েছে বললে ভুল
হবে, পিছিয়ে রাখা হয়েছে! দুষ্টরা শিষ্টদের ওপর প্রভূত্ব কায়েম করলে তখন
ন্যায়বিচার, সত্য ও সততা বাধাগ্রস্ত হয়। মানুষেরা দানবের কাছে হেরে যায়!
সত্যবাদীকে সংগ্রাম করে, নীতিবানকে লড়াই করে এবং সচ্চরিত্রকে
প্রতিকূলতা মোকাবেলা করে টিকে থাকতে হয়। যখন সবাই স্বার্থান্ধ আচরণ
করে, বিশ্বাস নড়বড়ে হয়ে ওঠে, ঋণ অস্বীকারকারীর সংখ্যা বাড়ে এবং কথায়
কথায় সত্য আড়াল করে তখন মানুষের ভেতর থেকে অমানুষের ছায়া বের হয়!
তখন সমাজের উপলব্ধি হওয়া উচিত ভালো মানুষের ও সুন্দর মানসিকতার মূল্য
কত। তবে মজার ব্যাপার, যারা সত্যিকারেই ভালো মানুষ তাদেরও মন খারাপ হয়।
তবে অশুভের কোন ছায়া তাদেরকে ছাপিয়ে যেতে পারে না!
আমরা যত স্বপ্নের কথা বলি, যত লক্ষ্যের ছবি আঁকি-এর কোনটাই অর্জন
সম্ভব নয় যদি ভালো মানুষদের সংখ্যা না বাড়ে। পরিবার, সমাজ এবং রাস্ট্র
ভালোমানুষদের সংখ্যা বৃদ্ধির জন্য প্রকাশ্যে-গোপনে কী কর্মসূচি গ্রহন
করেছে? ধর্মে-ধর্মে হানাহানি-রেষারেষির সময়ে আদৌ কি সেই আলোকিত মানুষ
তৈরি হবে? শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠ্য বইয়ের বাইরে শিক্ষার্থীদের আর কী
পড়ানো হয়? চাকুরি প্রার্থীরা সততার পরীক্ষায় নীতি-নৈতিকতার ব্যবহারিক
কিছু করে? পরিবারেও কী সেই সততার সংস্কৃতি এবং মূল্যবোধের চর্চা হয়?
সমাজস্থরা সততার কোন কোন ছাপ রাখে? রাষ্ট্র কী দু'পাঁচশো ভালোমানুষের
গল্প দেশবাসীর সামনের নজির হিসেবে উপস্থাপন করতে পেরেছে? আশা এবং
হতাশা- দু'দিকের গল্পই আছে। তবে আমরা আশায় বাসা বাঁধতে চাই।
সার্বিক পরিবর্তনের জন্য ব্যক্তির পরিবর্তন সর্বাগ্রে জরুরি। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র
পরিবর্তনের মাধ্যমে বৃহত্তর বিপ্লব সাধিত হয়। আমাকে ভালো মানুষ হিসেবে
জানুক-সেই ভালোটুকু আমাকেই ধারণ করতে হবে। একজন বিশ্বস্ত মানুষ, একজন
প্রতিশ্রুতিশীল মানুষ কতখানি দরকার তা বিভিন্ন সংকটের সময় অনুভূত হয়।
জাতীয়ভাবে আমরা যত শোক ও শূন্যতার মধ্য দিয়ে অনভূত হয়। শেষ ঠিকানা যে
মাটি সেটাও আপনাকে একজন ভালো মানুষ হিসেবে পেয়ে বুকে ধারণ করতে চায়।
যে সারল্যে সৌন্দর্য-শোভা সেটার ছায়াতে যেন আমরাও ঠাঁই পাই-আমাদের কথা-
কর্ম সেদিকেই ধাবিত হোক। তবেই বিশ্বাস হারানোর শোকে জর্জরিত হতে হবে
না। জীবন ও জীবনবোধের আমূল পরিবর্তন ঘটাতে আত্ম-জিজ্ঞাসার দৃঢ় রাখতে
হবে এবং আত্ম-উদবোধন সূচিত করতে হবে। তবেই আমরা আলোকিত জীবনের
মালিক হব।