অস্তিত্ব সংকটে আদিবাসী সাঁওতাল সম্প্রদায়

রংপুর বিভাগীয় প্রতিনিধি: ‘নাওয়া সেরমা’ যার আক্ষরিক বাংলা অর্থ শুভ নববর্ষ। সাঁওতাল পল্লীগুলোতে এখন আর পালিত হয় না এ নববর্ষ। সোহরাই সাঁওতাল সম্প্রদায়ের প্রধান উৎসব। এছাড়া বাহা, করম, দশইন, সক্রাত, মাহমোর, রুন্দো এবং ম্যাগসিম গুরুত্বপূর্ণ উৎসবগুলো ভুলতে বসেছে সাঁওতাল পল্লী। বৈষম্য, শিক্ষার অভাব, অজ্ঞতা, অসচেতনতা ও দারিদ্র্যের কারণে নিজ সংস্কৃতি হারিয়ে ফেলেছে এ জনগোষ্ঠী। সাঁওতালরা বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ আদিবাসী সম্প্রদায়। তাদের বাসস্থান মূলত রংপুর, গাইবান্ধা, রাজশাহী, দিনাজপুর ও বগুড়া জেলায়। তারা সান্তাল, সান্তালি, হোর, হর ইত্যাদি নামেও পরিচিত। তারা মূলত এ অঞ্চলে আসেন ১৮৪০ থেকে ১৯৪০ সাল, এ ১০০ বছরে। ‘জমি চাই, মুক্তি চাই’ শ্লোগানে ১৮৫৫ সালে সাঁওতাল নেতা সিধু, কানু, ভৈরব ও চাঁদ চার ভাই ইংরেজ শাসকদের বিরুদ্ধে প্রথম দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। ইতিহাসে যা ‘সাঁওতাল বিদ্রোহ’ নামে পরিচিত। আত্নদানে মহীয়ান ওই বিদ্রোহের ১৬৮ বছর পরও সেই ভূমির জন্যই স্বাধীন বাংলাদেশে আজও জীবন দিতে হচ্ছে সাঁওতাল আদিবাসীদের। এক সময় যথেষ্ট জমি থাকলেও বর্তমানে তাদের ৮৫ শতাংশই ভূমিহীন। ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের পর থেকে অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মতো আদিবাসী জনগণও নিজেদের জমি হারিয়েছে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের পর আরেক দফা বাস্তুচ্যুত হয় ক্ষুদ্র জাতি সত্তার লোকেরা। প্রভাবশালীদের ষড়যন্ত্র, মামলা-হামলার পাশাপাশি নিজেদের শিক্ষার অভাব, অজ্ঞতা, অসচেতনতা ও দারিদ্র্যের কারণে ভূমিহীন হচ্ছে আদিবাসী এ সম্প্রদায়। রংপুর পীরগঞ্জ উপজেলার খালাশপীর পল্লীতে প্রায় ৪৫ টির মতো বাড়ি। জনসংখ্যার চাপে এটি পরিণত হয়েছে বস্তিতে। কোন রকম মাথাগোঁজার ঠাঁই। পল্লীতে দারিদ্রতার ছাপ ¯পষ্ট। অধিকাংশই কৃষি কাজের সঙ্গে জড়িত। দিনের বেলা পল্লী প্রায় লোকশূন্য। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলে গেছেন কাজে। বয়সের ভারে নুয্য তলজা মারডিক রোদে বসে নষ্ট দায়ের হাতল লাগাচ্ছে। তিনি দীর্ঘ আলাপচারিতায় বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে কথা বলেন। তিনি বলেন, খেয়ে না খেয়ে বাস তাদের। সন্তানরা একদিন কাজ না পেলে উপোস কাটাতে হয়। আমাদের প্রধান সমস্যা হলো জমি। প্রভাবশালীরা জাল দলিল করে, মামালা-হামলার মাধ্যমে ভয়ভীতি দেখিয়ে এবং এক শ্রেণির অসাধু মানুষের সহযোগিতায় এসব জমি দখল করা হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে বন্ধকি জমি বিক্রি করতে বাধ্য করা হয়। ৪০ বছর বয়সী নরেন মারডিক বাঁশের চাটাই এর কাজ করছিলেন। তিনি বলেন, এ চারটা বাঁশের বেত বের করে পাবেন ৮শত টাকা। কিন্তু এ কাজ কোন বাঙালি করলে দেয়া হয় ১ হাজার টাকা। অর্থাৎ তাকে দেয়া হয় প্রতি বাঁশে ৫০ টাকা করে কম। এ ছাড়াও কৃষি শ্রমিক হিসেবে অন্য পুরুষদের দেয়া হয় দৈনিক মৌসুম ভেদে ৪শত থেকে ৬শত টাকা। সেখানে তারা পান ৩শত থেকে ৫শত টাকা। তাদের সন্তানরা দিনের বেলা শামুক, মাছ ধরে থাকে। কিন্তু দিনকে দিন তার সংখ্যাও কমে আসছে। এখন সারাদিন খুঁজেও তারা মেলাতে পারে না শামুক। আর বাচ্চাদের অধিকাংশের গন্ডি প্রাথমিক পর্যন্ত। তারা স্থানীয়দের সঙ্গে একই স্কুলে গেলেও পড়তে হয় নানা সমস্যায়। ভিন্ন চোখে দেখা হয় তাদের। তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী ইকনু মার্ডি বলেন, স্কুলে অনেক সময় তাদের পাশে বসতে চান না অন্যরা। বৃদ্ধ ভার্নিয়া মারডিক বলেন, আমাদের সঙ্গে প্রায় বিবাদের সৃষ্টি হচ্ছে। আমরা বাধ্য হয়ে পল্লীভুক্ত সমাজে আছি। সাঁওতাল পল্লীর পার্শ্ববর্তী বাসিন্দা মো. নজরুল ইসলাম বলেন, তাদের সঙ্গে আমরা দীর্ঘদিন একসঙ্গে আছি। আমাদের মাঝে বিবাদ নেই। তবে সমস্যাটা হচ্ছে অন্যদের সঙ্গে বিবাদ হয়। কিন্তু সে বিবাদ ছড়িয়ে যায় পাড়ায়। এ কারণেই কিছু সমস্যা দেখা দেয়।

 

Exit mobile version