সারা দেশের ২৫০০ সাবেক ও বর্তমান ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান ঢাকায় এনে মতবিনিময় করেছে বিএনপি। মতবিনিময় শুরু হয় গত ২৩ ফেব্রুয়ারি, শেষ হয় ১৬ মার্চ। ১০ দিনের রুদ্ধদ্বার এ মতবিনিময় সভায় মাঠ পর্যায়ের জনপ্রতিনিধিরা নানা ইস্যুতে তাদের মতামত তুলে ধরেন।
বিপরীতে হাই কমান্ড থেকে পেয়েছেন নানা দিকনির্দেশনা। দলটির দায়িত্বশীল একাধিক নেতা বলছেন, এ ধরনের মতবিনিময় সভা চলমান আন্দোলন কর্মসূচিতে নতুন মাত্রা যোগ করবে।
নগর-মহানগরের সীমা ছাড়িয়ে ১০ দফার দাবিতে সরব হবে সাধারণ মানুষ। ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার’-এ দাবি নতুন করে গ্রাম-গঞ্জের ঘরে ঘরে পৌঁছে দিয়ে সরকারবিরোধী আন্দোলনকে আরও বেগবান করতে চায় বিএনপি।
চেয়ারম্যানদের তৃণমূলে সক্রিয় আন্দোলন গড়ে তোলার নির্দেশনা দিয়েছেন হাই কমান্ড। তৃণমূলের ক্ষোভ-অসন্তোষ দূর করার সুযোগ মেলায় সুফল মিলবে আন্দোলন-কর্মসূচিতে। তারাও সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, বর্তমান সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে যেতে চান না তারা।
কেন্দ্রীয় নেতারা বলছেন, জনপ্রতিনিধি হিসেবে এলাকায় সাধারণ মানুষের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক রয়েছে। নিজ নিজ এলাকায় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, আছে আলাদা গ্রহণযোগ্যতা ও সর্মথক। মাঠ পর্যায়ের আন্দোলন-কর্মসূচিতে নেতৃত্ব দেন, তাহলে সাধারণ মানুষের মধ্যে একটা প্রভাব পড়বে।
সাধারণ মানুষের আন্দোলনে সম্পৃক্ত হতে সাহস পাবে। দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল আর কমিটি গঠনে অনিয়মের অভিযোগও জানান কেউ কেউ। তাদের উদ্দেশ্য হাইকমান্ড বলেন, ‘এখন দুঃসময় তাই বিবাদ ভুলে আন্দোলন-সংগ্রামে থাকতে হবে, দাবি আদায়ে সোচ্চার করতে হবে।’ তৃণমূলে দ্রুত দ্বন্দ্ব ও মতবিরোধ মিটিয়ে ফেলতে আহ্বান জানান।
দলীয় সূত্রমতে— কার্যত এ মতবিনিময়ের আয়োজন করা হয় তৃণমূলের গুরুত্বপূর্ণ ও জনসম্পৃক্ত নেতাদের আরও সক্রিয় করতে। ১০ দিনের রুদ্ধদ্বার এ মতবিনিময় সভায় সাবেক-বর্তমান মিলে অংশ নেন ২ হাজার ৩৬৭ জন চেয়ারম্যান। তাদের মধ্যে বক্তব্য দিয়েছেন ৩৫৭ জন।
তৃণমূল থেকে রাজধানীর গুলশানে এসে শীর্ষ নেতৃত্বের দেখা পেয়ে ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে সরাসরি কথা বলতে পেরে ভীষণ উজ্জীবিত তৃণমূলের প্রতিনিধিরা। তাদেরই একজন রাঙামাটি জেলার কাপ্তাইয়ের চিংমরম ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ৭৪ বছরের আজিজুল হক।
তিনি বলেন, ‘আমার মন এমন হয়ে গেছে যে, এক বিন্দু রক্ত থাকলেও তা দিতে রাজি আছি দলের জন্য।’ নাটোর সদরের তেবাড়িয়া ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান গোলাম সারওয়ার বলেন, ‘এ সরকারের পতন না হওয়া পর্যন্ত আমরা সবাইকে সঙ্গে নিয়ে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ব।’
কসবা উপজেলার খাড়েরা ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান মোখলেছুর রহমান বলেন, ‘আমাদের উনারা নির্দেশ দিয়েছেন, দলের সঙ্গে সব সময় থাকতে এবং দলের জন্য কাজ করতে। আন্দোলন সফল না হওয়া পর্যন্ত সঙ্গে থাকতে বলেছেন। আমরাও প্রতিশ্রুতি দিয়েছি, জীবন দিয়ে হলেও এ সরকারকে হটিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার এনে নির্বাচনে যাব।’
বাগেরহাট উপজেলার ৪ নং ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক এক চেয়ারম্যান বলেন, ‘মামলা-হামলায় তৃণমূলের নেতাকর্মীরা জর্জরিত। তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য, প্রতিষ্ঠান-পরিবার বিপর্যস্ত। সরকারি দলের দমনপীড়নে জীবন অতিষ্ঠ। এমন সময়ে নেতাদের পাশে থাকতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘এখন কঠিন কর্মসূচি দিতে হবে। দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। সরকারের পতন ছাড়া বিকল্প নেই। তারা কেন্দ্রীয় নেতাদের আরও দায়িত্বশীল হওয়ার কথা বলেছেন।
দলীয় সূত্রমতে, দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে ‘সরকার পতন’ একদফা দাবিতে বৃহত্তর আন্দোলন গড়তে চাইছে বিএনপি। এতে সাধারণ মানুষসহ সব পক্ষের ব্যাপক অংশগ্রহণ আশা করছে দলটি।
সম্প্রতি ইউনিয়ন থেকে থানা, জেলা ও মহানগরে পর্যায়ক্রমে যে পদযাত্রার কর্মসূচিগুলো করা হয়, এর উদ্দেশ্য সাধারণ মানুষকে কাছে টানা। এ লক্ষ্যে সারা দেশের ২০০১ সাল থেকে এখন পর্যন্ত দলীয় সমর্থক সাবেক ও বর্তমান চেয়ারম্যানদের ঢাকায় এনে মতবিনিময় করা হয়।
প্রতিটি সভায় লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তিনি সরাসরি চেয়ারম্যানদের সঙ্গে কথা বলেছেন। চলতি মাসে উপজেলা ও জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যানদের সঙ্গে বৈঠক করবেন।
১০টি মতবিনিময় সভায় উপস্থিত থাকা দুই নেতার সঙ্গে আলাপকালে জানা যায়, বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব জনপ্রতিনিধিদের একটি বার্তা দিয়েছে, সেটি হলো এ সরকারকে ক্ষমতা থেকে হটাতে হবে। তা না হলে দলের অস্তিত্ব বিপন্ন হবে, দেশের মানুষেরও সংকট আরও বাড়বে।
এ বার্তার সঙ্গে সবাই একমত পোষণ করেছেন। রাজধানীতে সরকারবিরোধী বৃহত্তর আন্দোলন কীভাবে সফল করা যায়, সে কৌশল ঠিক করতে শীর্ষ নেতৃত্বকে পরামর্শ দিয়েছেন।
দলের দায়িত্বশীল একাধিক সূত্র জানায়, বৃহত্তর আন্দোলন গড়ার লক্ষ্য নিয়ে মতবিনিময় হলেও তা কতটা সফল হয়েছে, তা নিয়ে সংশয় আছে। কারণ, প্রতিটি মতবিনিময়ের আগে দলের শীর্ষ নেতারা সামনের আন্দোলনের কর্মসূচি ও কৌশল নিয়ে চেয়ারম্যানদের মতামত জানতে চেয়েছেন।
কিন্তু বেশিরভাগ চেয়ারম্যানই সুনির্দিষ্ট করে মতামত বা পরামর্শ দিতে পারেননি। বেশিরভাগের বক্তব্যে দলের স্থানীয় নেতৃত্ব ও সাংগঠনিক বিষয়ে ক্ষোভ-অসন্তোষ প্রকাশ করেন। অনেকে থানা, জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ের নেতাদের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ করেন।
অবশ্য বিএনপির নেতারা মনে করেন, মতবিনিময় সভায় মাঠপর্যায়ের জনপ্রতিনিধিরা সাংগঠনিক বিষয় নিয়ে অভিযোগ, ক্ষোভ-অসন্তোষ প্রকাশ করলেও এটিও দলের কাজে লাগবে। কারণ, এর মধ্য দিয়ে মাঠের একটি চিত্র ফুটে উঠেছে। এখন সাংগঠনিক দুর্বলতা বা ক্ষোভ-অসন্তোষ দূর করার সুযোগ মিলল। এ বিষয়ে শীর্ষ নেতৃত্ব উদ্যোগী হলে আন্দোলন-কর্মসূচিতে এর সুফল মিলবে।
জানতে চাইলে বিএনপির চট্টগ্রাম বিভাগের সাংগঠনিক সম্পাদক মাহবুবের রহমান বলেন, ‘চট্টগ্রাম বিভাগের চেয়ারম্যানদের মতবিনিময় সভায় সবাই আন্দোলনের প্রস্তুতির কথাই বলেছেন। তারা বলেছেন, এ সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে যাওয়া যাবে না। নির্বাচনে গিয়ে কোনো লাভ হবে না।’
জানতে চাইলে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আন্দোলনের পটভূমি জেলা-উপজেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে এরই মধ্যে তৈরি হয়েছে। চেয়ারম্যান পদে যারা দায়িত্ব পালন করেন, তাদের সঙ্গে সাধারণ মানুষের সম্পৃক্ততা অনেক বেশি। তৃণমূল পর্যায়ে তারা আন্দোলনের বার্তা ছড়িয়ে দেবেন। তারা নিজেরাও উদ্ধুদ্ধ হয়েছেন বেশ।’
জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আবদুল মঈন খান বলেন, ‘সবার বার্তা একই। কথা বলতে সুযোগ দিতে হবে, স্বাধীনতা দিতে হবে। গ্রামে-গঞ্জে মিথ্যা মামলায় জর্জরিত হয়ে মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে গেছে। এর থেকে মুক্তি চায়। আওয়ামী লীগের দুঃশাসন থেকে মুক্তি চান। এটিই তৃণমূল প্রতিনিধিদের বার্তা।’