বগুড়ার সরকারি আজিজুল হক কলেজ, যা ইতিহাসের পৃষ্ঠা জুড়ে রচিত, সেখানে ছাত্র-ছাত্রীদের অজস্র গল্প তৈরি হয় প্রতিদিন। সেখানেই একটি বিশেষ গল্পের জন্ম হয়েছিল, যেখানে নায়ক শ্রাবণ মোদক আর নায়িকা নূপুর দাসের প্রেমের শুরু হয়েছিল এক অদ্ভুত সাদৃশ্য থেকে, যা দিনদিন আরও জোরালো হয়ে উঠেছিল।
শ্রাবণ মোদক একদিন তার ফোন স্ক্রল করছিল। কিছু মুহূর্ত আগে ফেসবুকে এক ছবি দেখেছিল। ছবিটি ছিল এক তরুণী, সাদামাটা হলেও তার চেহারায় কিছু ছিল, যা শ্রাবণের মনকে অস্থির করে তুলেছিল। মেয়েটি ছিল নূপুর দাস। শ্রাবণ মেসেজটা পাঠানোর সাহস পেল—”হাই, আমি শ্রাবণ।”
মেসেজ পাঠানোর পর প্রথমে উত্তর আসেনি। শ্রাবণ মুচকি হেসে ভাবল, “এটা তো স্বাভাবিক, কেউ মেসেজ পেলে প্রথমে উত্তর দেওয়ার আগে ভাবতে পারে।” তারপর একদিন পর আবার মেসেজ পাঠায়, “হ্যালো, আমি শ্রাবণ।”
এবার উত্তর আসে, “হ্যালো! তোমার মেসেজ দেখে ভালো লাগলো।”
এরপর, দুজনের মধ্যে কথা জমতে থাকে। তারা জানলো, তারা এক কলেজে পড়াশোনা করছে। শ্রাবণ রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্র, আর নূপুর অর্থনীতির ছাত্রী। দুজনের মধ্যে খোলামেলা কথা বলতে শুরু করে, একে অপরকে আরও ভালোভাবে জানতে চেষ্টা করল।
একদিন শ্রাবণ সাহস করে একটি মেসেজ পাঠালো—”তোমাকে কাছে থেকে দেখার ইচ্ছা আছে, কি মনে করো?”
নূপুর কিছুক্ষণ চুপ করে থেকেছিল, তারপর লিখেছিল, “কাল সকাল দশটায় কলেজ গেটের সামনে দেখা হবে?”
সেদিন, বগুড়ার আকাশে সাদা মেঘের ছায়া, মাটিতে হালকা বৃষ্টির গন্ধ। শ্রাবণ সকাল দশটায় কলেজ গেটের সামনে অপেক্ষা করছিল। একটা অদ্ভুত উত্তেজনা ছিল তার মনে। কিছুক্ষণ পরেই, নূপুর তার সামনে এসে দাঁড়ালো। পরনে ছিল সাদার ওপর নীল সুতার কাজ করা কামিজ, তার মুখে এক অদ্ভুত আভা ছিল, যেন সে কোনো চিরকালীন রহস্যের অংশ।
শ্রাবণ প্রথমে কিছু বলার সাহস পেল না, তবে তার চোখে যে আনন্দ, তা পরিষ্কার ছিল। অবশেষে মুখ খুলে বলল, “তুমি তো বাস্তবে আরও সুন্দর।”
নূপুর হালকা হাসি দিয়ে বলল, “তুমি তো আসলে বাস্তবে আরও বেশি পাগল!”
তাদের প্রথম দেখা ছিল সাধারণ, কিন্তু সেই প্রথম আলাপেই যেন এক নতুন সম্পর্কের সূচনা হলো। প্রতিদিন পরবর্তী সময়ে তারা একে অপরের সঙ্গে আরও বেশি সময় কাটাতে শুরু করল। ক্যাম্পাসের প্রতিটি কোণায় তাদের হাসি, আড্ডা, ঘুরাঘুরি সব যেন এক অন্যরকম অনুভূতি তৈরি করছিল। শ্রাবণ বুঝতে পারল, সে নূপুরের প্রতি বিশেষ কিছু অনুভব করছে।
একদিন ক্যাম্পাসের ক্যান্টিনে বসে, নূপুর বলেছিল, “প্রেম শুধু অনুভূতি নয়, এটি এক ধরনের দায়িত্বও।” শ্রাবণ মৃদু হাসি দিয়ে বলেছিল, “তাহলে, আমি তোমার প্রতি আমার দায়িত্ব গ্রহণ করছি, যতদিন বাঁচব তোমাকে ভালোবাসা আমার কর্তব্য হবে।”
কিন্তু সবকিছু এত সহজ ছিল না। সম্পর্ক যখন গভীর হতে থাকে, তখন মাঝে মাঝে দুজনের মধ্যেও সন্দেহ ও শঙ্কা তৈরি হতো। একদিন, শ্রাবণ আর নূপুর কলেজ গেটের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল, তখন নূপুর বলেছিল, “তুমি কি কখনো ভয় পাও? আমি মানি যে ভালোবাসা সত্যিই শক্তিশালী, কিন্তু একদিন কি আমরা একে অপরকে হারিয়ে ফেলব?”
শ্রাবণ মুগ্ধ হয়ে নূপুরের দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ চুপ রইল। তারপর আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, “হ্যাঁ, আমি একদিন হারাতে ভয় পাই, তবে আমি প্রতিজ্ঞা করছি, যতদিন আমরা একে অপরকে ভালোবাসব, আমাদের সম্পর্ক কখনোই শেষ হবে না।”
নূপুরের চোখে তখন এক নতুন রকমের আলো ফুটে উঠল, সে বুঝতে পারল, শ্রাবণ যে শুধু কথার মাধ্যমে নয়, সত্যিই তার ভালোবাসার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। নূপুর তখন এক চিলতে হাসি দিয়ে শ্রাবণের হাত ধরে বলল, “তাহলে, আমি তোমার প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করি।”
তাদের সম্পর্কের ভিত আরও শক্তিশালী হলো। শ্রাবণ ও নূপুর জানত, সম্পর্কের শুরুতে যা কিছু ছিল, তা কখনোই নিছক মধুর কথাবার্তা ছিল না, বরং দুজনের একে অপরকে সত্যিকারের ভালোবাসার মধ্যে আবদ্ধ হওয়া ছিল।
আজিজুল হক কলেজের গেটটি এখনো দাঁড়িয়ে আছে। হাজার হাজার শিক্ষার্থী আসে, যায়, কিন্তু শ্রাবণ ও নূপুরের গল্পের স্মৃতি সেই গেটের চত্ত্বরে সবসময় লুকিয়ে থাকে। তাদের সম্পর্কের প্রতিটি মুহূর্তে ছিল এক প্রগাঢ় প্রতিশ্রুতি, এক শক্তিশালী অপেক্ষা। “তোমার অপেক্ষায়” এই গল্প আজও বগুড়ার বাতাসে ভাসে, আর কলেজ গেটটি তাদের ভালোবাসার এক চিরস্থায়ী সাক্ষী হয়ে রয়ে যায়।
একদিন, শ্রাবণ নূপুরকে বলেছিল, “তোমার জন্য সবকিছুই অপেক্ষমাণ থাকবে, তোমার পাশে আমি থাকব যতদিন না আমাদের ভালোবাসা পৃথিবীও ছাড়িয়ে যায়।”
নূপুর তখন শান্ত গলায় বলেছিল, “তুমি যেখানে থাকো, আমি সেখানেই আছি। আমার অপেক্ষা, তোমার অপেক্ষা কখনোই একে অপরকে ছাড়িয়ে যাবে না।”
এই প্রেমের গল্প আজও, কলেজের গেটের পাশে, কোনো এক ছায়ায় বাতাসে ভাসে—অথবা, একসাথে বসে থাকা দুজনের চোখে অমলিন ভালোবাসা হিসেবে জীবন্ত থাকে।