বর্তমান প্রেক্ষাপটে গণমাধ্যম যেন জনসাধারনের শত্রু ?

বর্তমান প্রেক্ষাপটে গণমাধ্যম যেন জনসাধারনের শত্রু ?
বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে গণমাধ্যমকে বা সাংবাদিকতা কে যেন শত্রু হিসাবে ভাবছে জনসাধারন। সাংবাদিকতা বুঝি অশিক্ষিত লোকের পেশায় পরিণত হয়েছে। অথচ হওয়ার কথা উল্টো। যে গণমাধ্যমকে রাষ্ট্রের অন্যতম স্তম্ভ বলে স্বীকার করা হয়, সে গণমাধ্যম কাদের হাতে চলে যাচ্ছে, কারা সাংবাদিকতার মতো গুরুত্বপূর্ণ পেশায় আসছে এবং তারা কী করছে তা নিয়ে প্রশ্নের অন্ত নেই। গণমাধ্যমের গুণগত, মানগত ও চরিত্রগত পরিবর্তন এবং সাংবাদিকদের চরিত্রগত পরিবর্তন যেন এর জন্য দায়ী মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। সাংবাদিকতার দিক থেকে যদি দেখতে চাই তাহলে বলতে হয়, নাগরিক সাংবাদিকতা, মূল ধারার সাংবাদিকতার ঠিক আগের ধাপ। একথা বলার সঙ্গে সঙ্গে নিশ্চই প্রশ্ন উঠবে গণমাধ্যমের পাশাপাশি এত দিনতো নাগরিক সাংবাদিকতা চলছিল, তাহলে এখন এনিয়ে নতুন করে আলোচনার দরকার পড়ছে কেন ? খুব সহজ উত্তর, কারণ হচ্ছে বর্তমান সময় । এই সময়ে গণমাধ্যমের কিছু অগ্রগামী পাঠক অথবা দর্শকের পুরনো আগ্রহের সঙ্গে মিলেছে ইন্টারনেট। সব শেষ যোগ হয়েছে ফেসবুক। সব মিলিয়ে নাগরিক সাংবাদিকতা মূলসাংবাদিকতার গতিও বাড়িয়ে দিচ্ছে । বেড়েছে ফেসবুক সাংবাদিকতা। এখন ইউটিউব ও ফেসবুকে ভুল ভাল সাংবাদ মানুষ কে বিভ্রান্ত করছে। ফলে সাংবাদিকতার মান নিন্ম মুখি হয়ে যাচ্ছে। আমার মনে হয় সাংবাদিকদের দোষারোপ করে কোনই লাভ নেই। সত্যি বলতে আমাদের সমাজ ব্যবস্থাই এর জন্য বড় দায়ী। একটু লক্ষ্য করলেই দেখবেন এমন কোন পেশা নেই যে, দূর্নীতি যেখানে রন্ধ্রে রন্ধ্রে পৌছায় নি। সবাই ছুটছে তার স্বার্থসিদ্ধির পিছনে..তাহলে সাংবাদিকেরা কেন পিছিয়ে থাকবে!! একটু লক্ষ্য করে দেখেন আমাদের সমাজের নগ্নতা সম্পূনভাবে প্রকাশ পেয়ে গেছে। একজন সাংবাদিক দেশে ও সমাজের কল্যাণে নিবেদিত হবেন। সাংবাদিকতায় এটি স্বতঃসিদ্ধ। কিন্তু কি হচ্ছে? নানা স্বার্থে সংবাদপত্রকে জড়িয়ে ফেলা হচ্ছে; সৎ সাংবাদিকদের বিতর্কিত করা হচ্ছে; মহান পেশার আদর্শ উদ্দেশ্য উল্টে দেয়া হচ্ছে। সাংবাদিকতা বাণিজ্যের ভিড়ে সংবাদপত্র এবং প্রকৃত সাংবাদিকরা অপসৃয়মাণ। মর্যাদা সম্পন্ন পেশা দিনদিন মর্যাদা হারাচ্ছে। শূদ্ধতার মাঝে ঢুকে পরেছে নাম সর্বস্ব অপ-সাংবাদিকতা। অনেক ক্ষেত্রে দুর্নীতি আর ভন্ডামি ডুকে গেছে এ পেশায়। পেশা নয় এ যেন অসুস্থ ব্যবসা। অশিক্ষিত, কুশিক্ষিতরা অর্থের বিনিময়ে আন্ডারগ্রাউন পত্রিকার পরিচয়পত্র সংগ্রহ করে মানুষকে ভয়ভীতি; আর সরলতার সুযোগ নিয়ে হরদম প্রতরণায় করছে। যা সাংবাদিকতা আর সংবাদপত্রের জন্য হুমকি স্বরূপ। এমনটা সব ক্ষেত্রে নয়। প্রকৃত সাংবাদিকের সংখ্যা দেশে এখনও অনেক। তাঁরা দেশ ও সমাজের কল্যাণে সর্বদা নিবেদিত। গুটি কয়েক নামধারী সাংবাদিকের কারণে সংবাদপত্র আজ মর্যাদা হারাচ্ছে। আসলে সমস্যাটা কোথায়? কেন আজ রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ এ ভাবে কলঙ্কিত হচ্ছে ? কিন্ত এ ভাবে আর কতদিন চলবে। এটা নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজন। আর এর জন্য প্রকৃত সাংবাদিকদের সাহসী উদ্যোগ নেয়া অতি প্রয়োজন। আজকাল সাংবাদিকতার পেশা হচ্ছে যেন ’হামছে বড় কৌন হ্যায়’ অবস্থা্। আসলে কিন্তু তা নয়, সাংবাদিকতা হচ্ছে একটি মহান পেশা যাদের রিপোর্টের উপর নির্ভর করে একটি কমিউনিটি, একটি জাতি, একটি দেশ। তাদের বিশ্বস্থ রিপোর্টের উপর বিশ্বাস করেই জনগণ যেমন জানতে পারে তাদের আকাঙ্খিত বিভিন্ন খবরাখবর, জানতে পারে রাষ্ট্রের ভালো মন্দের খবর। জনগণের বিশ্বস্ত বন্ধু হচ্ছেন সাংবাদিক সমাজ। বিশ্বের প্রতিটি দেশেই সাংবাদিকদের স্থান সবার উপরে। আমরা জানি তরবারীর চেয়েও কলম শক্তিশালী। কিন্ত এখন দেখি সেই কলম ক্ষমতার কাছে মাথা নত করে। প্রভাবশালীদের দ্বারা নিয়ন্তিয়ত হয়। এখন সাংবাদিকরা অপরাধির তথ্য সংগ্রহ করে শুধু নিজের স্বার্থ হাসিলের জন্য। অনেক সাংবাদিক রয়েছে তারা সব সময় ব্যস্ত থাকে কি ভাবে মানুষ কে বিপাকে ফেলে অর্থ আদায় করা যায়। তারা অপরাধীর তথ্য সংগ্রহ করেন সংবাদ তৈরী করার জন্য নয় অর্থ আদায় করার জন্য । অবশ্যই এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহন করা অতি জরুরী হয়ে পড়েছে। গত একদশকে গণমাধ্য গড়ার অবাধ স্বাধীনতায় মিডিয়ার সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রতিভাবান তরুণরা এই সেক্টরে যেমন আসছেন, সে সঙ্গে সংবাদপত্রের খরচ বাঁচাতে গিয়ে অযোগ্য কিছু মানুষকে দিয়ে কাজ চালানো শুরু করেছেন গণমাধ্য মালিকগণ। এদের কোনো প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেনি অধিকাংশ চাকুরিদাতা প্রতিষ্ঠান। এসব প্রশিক্ষণবিহীন, সাংবাদিকতা সম্পর্কে ন্যূনতম জ্ঞানবিহীন অদক্ষরা ও অশিক্ষিতরা বুকে আইডি কার্ড ঝুলিয়ে উন্মত্তের মতো আচরণ করছে। আর সাংবাদিকতার মান কে একে বারে নিন্ম স্তরে দাঁড় করিয়েছে। তারা নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে সাংবাদিকতাকে পুজি করে স্বঘোষিত ধান্দাবাজ’ হয়ে ওঠছে। এরা নিজেরাই কোন রকম একটি পত্রিকা বা অনলাইনের কাড সংগ্রহ করে স্বঘোষিত সাংবাদিক হয়ে পড়ছে। যেনতেন প্রকারে আন্ডারগ্রাউন্ড একটি পত্রিকা বের করে চলছে ব্লাকমেইলিং আর চাঁদাবাজির মহোৎসব। এসব ‘সাংবাদিক’দের দায় নিতে হচ্ছে প্রকৃত সাংবাদিকদের। আমার এ লেখা কাউকে ছোট করার জন্য নয়। যা ঘটে চলেছে আমি তারই বর্ণনা করছি। এ লেখায় কেউ ব্যথিত হলে আমায় ক্ষমা করবেন। গত এক দশকে দেশীয় গণমাধ্যমের ব্যাপক সম্প্রসারনের পরও এই পেশাটা কে একে বারে তলানীতে নামিয়ে দিয়েছে কতিপয় নামধারী সাংবাদিকরা। সাংবাদিক নামধারী একটি গোষ্ঠী তাদের স্বার্থ আদায়ের জন্য অবৈধ ভাবে টাকা রোজগারের লক্ষ্যে কাজে লাগিয়ে সৎ সাংবাদিকতার মূল্যায়ণকে কলঙ্কিত করতে শুরু করেছে। বিশেষ করে বাংলাদেশে এদের দৌরাত্ম চরমে পৌঁছে গেছে। অনুসন্ধানে জানা যায় চিহ্নিত সন্ত্রাসী, মাদক কারবারী, ওষুধ বিক্রেতা, সুদের ব্যবসায়ী, চালকরা রাতারাতি সাংবাদিক হয়ে দাবিয়ে বেড়াচ্ছে রাজধানীর অলিগলি। কোন সংবাদ লিখতে না পারলেও গলায় ক্যামেরা ঝুলিয়ে মোটর সাইকেল নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে কথিত এসব সাংবাদিকরা। এ ধরণের কার্ড নিয়ে চাঁদাবজি, ব্ল্যাকমেইলিংয়ের সঙ্গে জাড়িতরাও সর্বত্র সাংবাদিক বনে যাচ্ছে। গত কয়েক বছর ধরে যেখানে সেখানে এ রকম কয়েকশ ভূয়া সাংবাদিক অবাধে বিচরন করছে। তারা নানা অনৈতিক কর্মকান্ড করে যাচ্ছে। এমন নীতিহীন কর্মকান্ডে সাধারণ মানুষ বিভ্রান্ত হচ্ছে। গুজব ও অপপ্রচার বাড়িয়েছে। পরিতাপের বিষয় হলো- অনেকে হুট করেই সাংবাদিক হয়ে যাচ্ছে যে কেউ। না, এক্ষেত্রে শিক্ষাগত যোগ্যতাও কোন বিষয় নয়। সু-শিক্ষিত ও মানসম্পন্ন সাংবাদিক ও কলামিস্ট এদেশে অনেকেই আছেন, যারা তাদের ক্ষুরধার ও বুদ্ধিদীপ্ত লেখনী দ্বারা সমাজের অনেক অসঙ্গতি সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলে আমাদেরকে সমাজ- সচেতন করে তোলেন প্রায়শই। সেই গুটিকয় নমস্য সাংবাদিকের সাথে মিশে গেছে সাংবাদিক নামধারী (লেবাসধারী) কিছু নর্দমার কীট; আসলে এরাই বর্তমানে সংখ্যায় বেশি। এসব অপ-সাংবাদিকতা ইদানীং সাংঘাতিক রকম বেড়ে গেছে। অপ-সাংবাদিক সৃষ্টি এক ধরনের সাংবাদিকতা নির্যাতন। এক দিকে সাংবাদিকদের মধ্যে ভেজাল ঢুকে পেশার সুনাম ক্ষুন্ন হচ্ছে । অযোগ্য অর্বাচীন কিছু মানুষের পদচারণায় কলঙ্কিত হতে দেখা যায় বাংলাদেশের সাংবাদিকতার গৌরবময় জগৎ। কোনো মহৎ উদ্দেশ্য থেকে নয় অর্থ লিপ্সুতা থেকে এবং সমাজে প্রভাব তৈরি করার ইচ্ছে থেকে অনেকে এ পেশার সঙ্গে যুক্ত হন। ভুঁইফোড় সংবাদ মাধ্যমের সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে। নানারকম অপতৎপরতায় লিপ্ত থাকে। বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে টার্গেট করে সংবাদ পরিবেশনের হুমকি দেয়। ভয় ভীতি প্রদর্শন করে দেদারসে অর্থ আদায় করে। খুব অল্পসময়ের মধ্যে এরা অর্থ সম্পদের মালিক হয়ে যায় এবং একই ধরনের কিছুসংখ্যক ব্যক্তি মিলে গড়ে তোলে সাংবাদিক সিন্ডিকেট। এদের পড়াশোনা ও মেধার ঘাটতি থাকে। সাংবাদিকতার সঠিক সংজ্ঞাও এরা জানে না। দু’য়েক জন সাংবাদিকের সঙ্গে এরা সুসম্পর্ক তৈরি করে। এবং তাদের কাছ থেকে প্রাপ্ত লিখিত নিউজ কপি করে সংবাদ মাধ্যমে প্রেরণ করে। অজ্ঞতা অনেক থাকলেও এরা সাংবাদিকতার তকমা পরে ঘুরে বেড়ায়। লেখালেখির দক্ষতা এদের একেবারেই ক্ষীণ। শুদ্ধভাবে একটি বাক্য লেখার ক্ষমতা অনেকেরই নেই। এদের কারণে সাংবাদিকতা পেশার মর্যাদা নষ্ট হচ্ছে। কলুষিত হচ্ছে সাংবাদিকতার জগৎ। এদের চিহ্নিত করার পাশাপাশি এসব ব্যক্তির বিরুদ্ধে সবার রুখে দাঁড়ানো প্রয়োজন। সাংবাদিকতার র্যাদা অক্ষুণ্ন ও সমুন্নত রাখার জন্য সাংবাদিকদেরই পদক্ষেপ নেয়া দরকার। এবং সাংবাদিকদের উচিত এদের অসহযোগিতা করা। ভুয়া সাংবাদিকদের নির্মূল করার জন্য মোক্ষম ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি।
আওরঙ্গজেব কামাল
লেখক ও গবেষক.

Exit mobile version