২০২৪ সালের আগস্ট মাসে বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা
হয়েছে, যা ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের ফলে সম্ভব হয়েছে। দীর্ঘ সময় ধরে
চলমান রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং বিভিন্ন সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংকটের মধ্য
দিয়ে এগিয়ে যাওয়া দেশটি আজ এক নতুন পথে যাত্রা শুরু করেছে। নোবেল বিজয়ী
অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এ
যাত্রার প্রধান চালিকাশক্তি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেছে। তবে, এই
পরিবর্তনশীল সময়ে নতুন সরকারের সামনে রয়েছে নানা চ্যালেঞ্জ এবং সম্ভাবনা,
যা দেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
দেশের রাজনীতিতে একটি দীর্ঘস্থায়ী অচলাবস্থার মধ্যে ছাত্র-জনতা মঞ্চে
আসেন। শিক্ষার্থীদের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন এবং তাদের এক দফা দাবির মুখে শেখ
হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার পদত্যাগে বাধ্য হয়। ৩৬ দিনের এই আন্দোলন জাতিকে
একটি নতুন পথে পরিচালিত করে। জাতির ইতিহাসে এরকম আন্দোলন নতুন নয়; ১৯৫২,
১৯৬৯, ১৯৭১, ১৯৯০ সালের মতো এ বছরও ছাত্র-জনতা একটি বৃহত্তর সামাজিক ও
রাজনৈতিক পরিবর্তনের সূচনা করেছে।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস, একজন আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত অর্থনীতিবিদ এবং নোবেল
বিজয়ী, যিনি গরিবের কল্যাণে ক্ষুদ্রঋণ প্রদানের মাধ্যমে গ্রামীণ ব্যাংক
প্রতিষ্ঠা করে দারিদ্র্য বিমোচনে এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। তাঁর
নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে যুক্ত হয়েছে দেশের বিশিষ্ট
ব্যক্তি, মানবাধিকারকর্মী, আইনজীবী এবং শিক্ষাবিদ। ছাত্র আন্দোলনের দুই
সমন্বয়ক, মো. নাহিদ ইসলাম এবং আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়াও এই সরকারের
উপদেষ্টা হিসেবে শপথ নিয়েছেন, যা দেশে প্রথমবারের মতো ঘটেছে।
নতুন সরকারের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে দেশের আইনশৃঙ্খলা
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা। দেশের বিভিন্ন স্থানে সংঘাত, দখলদারিত্ব এবং
সহিংসতা বৃদ্ধি পেয়েছে। ড. ইউনূস তাঁর প্রথম ভাষণে এই বিষয়টির উপর
গুরুত্বারোপ করে বলেন, অরাজকতার বিষবাষ্প রোধ করতে বিজয়ী ছাত্র-জনতাসহ
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সম্পূর্ণ শক্তি প্রয়োগ করবে। এছাড়া, অর্থনীতির
পুনরুদ্ধার, ব্যাংকিং খাতের দুরবস্থা দূর করা এবং রাষ্ট্র সংস্কার নতুন
সরকারের প্রধান কাজ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।
ড. ইউনূসের নেতৃত্বে নতুন সরকার শিক্ষার মান উন্নয়ন এবং সাম্প্রদায়িক
সম্প্রীতি বজায় রাখার উপর গুরুত্বারোপ করেছে। কোটা সংস্কার আন্দোলনের ফলে
শিক্ষার্থীদের মধ্যে যে রাজনৈতিক সচেতনতা সৃষ্টি হয়েছে, তা নতুন সরকারকে
একটি শক্তিশালী ভিত্তি প্রদান করেছে। এছাড়া, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ওপর
গুরুত্বারোপ করে নতুন সরকার দেশের সব মানুষের জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টি করার
লক্ষ্যে কাজ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
বাংলাদেশের জনগণ নতুন সরকারের কাছে অনেক প্রত্যাশা নিয়ে আছে। গণতন্ত্র,
মানবাধিকার এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকারকে
নিরলসভাবে কাজ করতে হবে। বিশেষ করে, ছাত্র-জনতার অব্যাহত সমর্থন এবং সুশীল
সমাজের প্রতিনিধিত্ব সরকারের কাজকে সহজ করবে। তবে, স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে
লড়াই করে অর্জিত এই পরিবর্তন যদি সঠিকভাবে পরিচালিত না হয়, তবে এই
অর্জনের মহাত্ম্য ম্লান হয়ে যেতে পারে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে ২০২৪ সালের এই অধ্যায় একটি গুরুত্বপূর্ণ
মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত থাকবে। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার জনগণের আকাঙ্ক্ষা পূরণের একটি সুযোগ পেয়েছে। এই
সরকার যদি সঠিকভাবে দেশের গণতান্ত্রিক কাঠামো পুনর্গঠন করতে পারে, তবে তা
দেশের ইতিহাসে একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে। তবে, এই যাত্রা সহজ হবে না।
আইনশৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা, অর্থনীতির পুনরুদ্ধার এবং সামাজিক ন্যায়বিচার
প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সরকারকে প্রমাণ করতে হবে যে তারা এই দেশের জনগণের আস্থা
রাখতে সক্ষম। দেশের জনগণ এখন একটি সুস্থ, সুশৃঙ্খল ও প্রগতিশীল বাংলাদেশ
দেখার অপেক্ষায় আছে, যেখানে গণতন্ত্র, মানবাধিকার এবং সামাজিক ন্যায়বিচার
প্রতিষ্ঠিত হবে।
খাজা মোহাম্মদ মুস্তাকিম, সহযোগী অধ্যাপক, মার্কেটিং, হাবীবুল্লাহ্ বাহার
কলেজ, ঢাকা।