প্রশ্নটি অনেক আগের। আমার ধারণা, আপনি ইতোমধ্যে আপনার উত্তর পেয়ে গেছেন। তারপরও, আমি আমার নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে আপনার প্রশ্নের জবাব দেয়ার চেষ্টা করছি।
একজন চাকুরীপ্রার্থী যখন বিসিএস পুলিশ ক্যাডারে যোগদানের জন্য নির্বাচিত হন, তখন থেকেই জীবনের গতিধারার পরিবর্তন শুরু হয়। ট্রেনিং এ যাওয়ার আগেই প্রতিবেশী, আত্নীয়, বন্ধুমহলসহ সর্বত্র বিশেষভাবে সম্মানিত হওয়া শুরু করেন।
১ বছরের ট্রেনিং নবনিয়োগপ্রাপ্ত এএসপি’র জীবনের মৌলিক পরিবর্তনের সুতিকাগার। তিনি শুধু আইন কানুনই শিখবেন না, তার রেজিমেন্টেশনও এই এক বছরেই হবে। ট্রেনিং শেষে ৬ মাসের জন্য কোন জেলায় সংযুক্তি- তারপর শুরু কর্মজীবনের। পোষ্টিং তার যে ইউনিটেই হোক না কেন, সেটা হবে কোন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বের। যত সময় যাবে, তত নিজের জীবন/ সামাজিক-পারিবারিক জীবনের আর কর্মজীবনের মধ্যে ফারাক তৈরী হবে। একজন এএসপির সাধারণতঃ ব্যক্তিগত সময় বলে কিছু থাকে না।
এএসপিদের জীবন কেমন, এ প্রশ্নের কোন সরল উত্তর আমার জানা নেই। তবে এটুকু বলতে পারি, তার পোষ্টিং কোথায়, তার উপর নির্ভর করবে তার দৈনন্দিন জীবনের গতিধারা। তিনি যদি কোন ডেস্ক জবে নিযুক্ত থাকেন, তবে অন্য আর দশজন চাকুরীজীবীর মতোই তার জীবন।
তবে, আপনার প্রশ্নের অন্তর্নিহিত অর্থ যদি বুঝতে ভুল না হয়ে থাকে, আপনি হয়তো মাঠ পর্যায়ে কাজ করে এমন এএসপি’র কথা বলতে চাইছেন। আরো নিশ্চিতভাবে বলতে গেলে, সার্কেল অফিসার হিসেবে নিযুক্ত কোন এএসপির কথা জানতে চাইছেন।
শুরুতেই বলে রাখি, একজন সার্কেল অফিসার তার অধিক্ষেত্রে (জুরিসডিকশনে) ‘চীফ ক্রিমিনাল এডমিনিষ্ট্রেটর’ হিসেবে বিবেচিত হন। অপরাধ জগত নিয়েই তার কাজ। অধীন থানাসমুহের অপরাধ নিবারন, নিয়ন্ত্রণ, উদঘাটন তার মূল কাজের অন্যতম। তদন্তসমুহের গুনগত মান নিশ্চিতের জন্য তিনি দায়ী থাকেন। তদন্তকাজে এ সহযোগীতা কেবল ঘটনাস্থল
পরিদর্শনসহ সরেজমিনে তদন্তকারীকে সহায়তার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। একটি সার্কেল অফিসকে আপনি ঐ এলাকার অপরাধ ও অপরাধীর ডাটাবেসও বলতে পারেন।
ফলে, নিজ এলাকায় কোন অপরাধ সংগঠনের সংবাদ পেলেই সার্কেল অফিসারের কাজ সম্ভাব্য দ্রুতসময়ে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হওয়া, তদন্তকারীকে অপরাধ উদঘাটনে প্রয়োজনীয় সহযোগীতা শুরু করা। এক্ষেত্রে আপনি হয়তো বুঝতে পারছেন, ঘড়ির কাটা কোন বিবেচ্য বিষয় নয়। আর সাধারণভাবে অপরাধ সংঘটনের যেহেতু কোন সুনির্দিষ্ট সময়সূচী নির্ধারণ করা যায় না, সেহেতু সার্কেল অফিসারের অফিস সময় বলে সুনির্দিষ্ট কোন সময়ের কথা বলা যায় না।
এটা গেলো একটা মাত্র দিক। এর বাইরে প্রতিদিন একজন সার্কেল অফিসারের সময়ের একটা বড় অংশ ব্যায় করতে হয় নিজ দপ্তরে। অধীন থানা সমুহ থেকে প্রতিদিন আসা জিডি (সাধারণ ডায়েরী), পিডি (অধীন কর্মকর্তাদের ব্যাক্তিগত ডায়েরী) ও সিডি (কেস ডায়েরী) তাকে মনোযোগ সহ পড়তে হয় এবং প্রযোজ্য ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট ফর্মে আদেশ (ওবি) দিতে হয়। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজ, যার মুল উদ্দেশ্য নিজ এলাকার অপরাধ নিয়ন্ত্রণ ও উদঘাটনে অবদান রাখা।
একজন সার্কেল অফিসারের অন্যান্য কাজের বিবরণ দিতে গেলে আপনি নিশ্চয়ই বোরিং হয়ে যাবেন। নিয়মিত অফিসে দর্শনার্থীদের সময় দেয়া, বিজ্ঞ আদালত ও উর্ধতন কার্যালয়ের আদিষ্ট বিবিধ তদন্ত পরিচালনা করা, জনঅংশগ্রহণ নিশ্চিতে সভা সমাবেশ সহ বিভিন্ন কাজে সময় দেয়া, নিজ এলাকার টহলসহ বিভিন্ন পুলিশি কার্যক্রম তদারকি করা ইত্যাদি।
অনুমান করা সংগত যে, একজন সার্কেল অফিসারের জীবন করণীয় কার্যে পরিপূর্ণ। তবে, একটা বিষয় বিশেষভাবে উল্লেখ্যঃ
সার্কেল অফিসার তার সমপর্যায়ের ভিন্ন দায়িত্বে নিযুক্ত অন্য কর্মকর্তা থেকে অনেক বেশী স্বাধীনতা ভোগ করেন। তিনি যদি কাজে আগ্রহী হন, তার কর্মক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রাখতে পারেন ( He can create a difference)।
তার জীবন সম্পর্কে বলতে গেলে এককথায় বলা যায়- চ্যালেন্জিং, থ্রিলিং, রেসপনসিবল, পাবলিক, টিম-ওয়ার্ক ফোকাসড, চার্মিং। কোনকিছু বিশেষভাবে জানতে চাইলে মন্তব্যে লিখতে পারেন। চেষ্টা করবো জবাব দিতে, না পারলে নিশ্চয়ই অন্য কেউ সহায়তা করবেন।
একজন সার্কেল অফিসারের জীবন আরো নিবিড়ভাবে অনুধাবনের জন্য অনেক আগে সত্য ঘটনা অবলম্বনে লিখিত নিচের গল্পটি পডে দেখতে পারেন। গল্পটা আমার লেখা।
রহস্য গল্প: একটি গলিত লাশ ও কয়েকজন যুবক।
এক
সন্ধ্যা ৬ টা বেজে তিরিশ মিনিট। ক্লান্তিতে জাহিদের ঘুম ঘুম চোখ। সরকারী মোবাইল ফোনে রিং বেজে চলছে। অফিসার ইন
চার্জের চাকরির এই এক বিড়ম্বনা জাহিদের কাছে। ফোন না ধরেও উপায় নেই।
– হ্যালো, ওসি-ভুজপুর বলছি
– স্যার, আমার বাড়ি ইসলামপুর। বাজারের পাশে রাবার বাগানের ভিতর একটা লাশ পাওয়া গেছে।
– কোন বাগান? চৌকিদার কি ওখানে আছে?
– দাতমারা বাগান, স্যার। চৌকিদার আছে।
– কেউ যেন লাশ না ধরে। আমি আসছি।
ক্লান্তি মূহুর্তে দুর হয়ে যায়। গাড়ী নিয়ে জাহিদ ছুটে যায় অকুস্থলে। সাথে থানার আরো দুজন অফিসার। গলিত লাশের দুর্গন্ধ পরিবেশকে আরো ভৌতিক করে তুলেছে। চেহারা চেনার কোন উপায় নাই। আদ্যোপান্ত কালো পোশাক পরিহিত মরদেহের পেট ফুলে ফেটে গেছে। গলায় বাধা গামছা আর রশি দিয়ে হাত বাধা জানান দিচ্ছে যে লোকটিকে হত্যা করা হয়েছে। বডি ব্যাগ এ মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য প্রেরনের আগে ঘটনাস্থলে আর কোন আলামত পাওয়া যায়নি। হত্যা মামলা রুজু হলো -তদন্তকারী কর্মকর্তা সোহেল একটা তাগিদ অনুভব করে ভেতর থেকে: এই হত্যাকান্ডের রহস্য উদঘাটন করতে হবে। ইতিমধ্যে সংবাদ পেয়ে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে সার্কেল এএসপি মাসুদ।
দুই
দেখতে দেখতে তিন মাস পার হয়ে যায়। হত্যা রহস্যের কোন কুল কিনারা হয়না। একদিন সকালে এএসপি মাসুদের ফোনে ঘুম ভাংগে সোহেলের।
– সোহেল, কোন আপডেট আছে রাবার বাগান হত্যাকান্ডের?
– না, স্যার। এমনকি সব ব্যবস্থা নেয়ার পরও মরদেহের পরিচয়ও পাওয়া যায়নি।
– ইসলামপুরের আলমগীর সম্পর্কে খবর নিয়ে আমাকে জানাও তো। আর তাকে এলাকায় দেখা গেলে আমার অফিসে নিয়ে আসবে।
– অবশ্যই স্যার।
– ভালো থেকো।
– সালাম, স্যার।
তিন
তিন দিন পর। সার্কেল এএসপির অফিসে আলমগীরকে নিয়ে উপস্থিত এসআই সোহেল।
– সোহেল, আলমগীর সম্পর্কে বলো। তার আগে তাকে পাশের রুমে রেখে আসো।
– আলমগীরের সুনির্দিষ্ট কোন পেশা নেই। মাঝে মাঝে লাকড়ির ব্যবসা করে। বিবাহিত। দিনে তেমন একটা দেখা যায় না। সন্ধ্যার পর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত বাজার ও আশেপাশে মটর সাইকেল নিয়ে ঘুরতে দেখা যায়। একসময় পেশাদার চালক ছিল।
বছর খানেক আগে চাকরি চলে গেলে বাড়ীতেই থাকে। তার বন্ধু বান্ধবদেরও বলার মতো পেশা বা পরিচয় নেই।
– ভাল খোজ নিয়েছ। তাকে জিঙ্গাসাবাদ করবো আমরা রাবার বাগান হত্যা সম্পর্কে।
– কোন ক্লু আছে স্যার?
– ঠিক ক্লু না- একটা তথ্য পেয়েছি। আমার এক সোর্স জেলখানায় আছে। সে জানালো, এই লাশ উদ্ধারের সপ্তাহখানেক আগে রাত বারটার পর যেখানে লাশ পাওয়া গেছে তার পাশের পুকুর পাড়ে আলমগীরকে দাড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে। আমাদের জানতে হবে, কেন সে সেখানে ছিল? কি করছিল? বা সে কোন কিছু দেখেছিল কি-না?
– ঠিক আছে, স্যার। আমি জিঙ্গাসাবাদ কক্ষে তাকে নিয়ে যাচ্ছি, কাজ শুরু করছি।
সারাদিন চলে জিঙ্গাসাবাদ। আলমগীর অস্বীকার করে যে, সে কখনোই উক্ত পুকুর পাড়ে যায়নি; গভীর রাতে যাওয়ার তো প্রশ্নই ওঠে না। আদালতের অনুমতি নিয়ে বর্ধিত জিঙ্গাসাবাদ একটানা চলতে থাকে। তথ্যের অমিল, মিথ্যা থেকে মিথ্যার প্যাচ, বহুর্মুখি জিঙ্গাসাবাদ শেষ পর্যন্ত আলমগীরকে বাধ্য করে সত্য প্রকাশে।
চার
তিন মাস আগে। ইসলামপুর বাজারে আলমগীর আর কাশেম চায়ের দোকানে বসা। মাগরীবের পর ইসলামপুর বাজার সরগরম হয়ে ওঠে। আলমগীরের মোবাইলে রিং। উঠে গিয়ে কথা বলে সে। ফিরে এসে ডাকে কাশেমকে।
– জিয়া ভাই কল দিছিল। একজন গেষ্ট আসছে। তাকে রিসিভ করতে হবে।
– কক্কা পার্টি?
– হ্যা। ফারুকরে কল দে। বিয়ার জোগাড় করে আমার ঘরে বসতে বল। তুই চানাচুর-চিপস নিয়ে আমার ঘরে যা। জহিরের সাথে আমার আরো কাজ আছে। আমরা গেষ্টকে রিসিভ করে নিয়ে আসবো।
– গেষ্টের সাথে কথা বল। কোথায় আছে দেখ।
– না। যোগাযোগ জিয়া ভাই করবে। ভাই হেয়াকো আছে। ফোনে যোগাযোগ থাকবে আমাদের সাথে।
– ঠিক আছে, আমি গেলাম। তুই আয়।
– ওহ, এক সেট কার্ড নিয়ে যা।
– ওকে।
সন্ধ্যা সাতটা। বিদ্যুত চলে গেল একটু আগে। অন্ধকার পক্ষ চলছে। ইসলামপুর বাজারের উত্তর পাশে আলমগীর দাড়িয়ে। সাদা মাইক্রোবাস এসে থামে কিছুক্ষন পরেই। আলমগীর এগিয়ে যায়। জিয়া ফোন করে নিশ্চিত করে ইনিই তাদের গেষ্ট।
– আপনি নিশ্চয়ই সাঈদ ভাই?
– জি, আপনি আলমগীর?
– ঠিক বলেছেন। কষ্ট হয়নি তো?
– না। চলুন যাই।
– জিয়া ভাই বলছিল রাস্তা গরম। রাতও হয়ে যাচ্ছে। চালানটা আজ রাতে পার করা রিস্কি হবে।
– তাহলে আমি কাল আসি?
– ভাই বলছিল-আজ রাতটা আমাদের সাথে আড্ডা দিবেন কিনা? ইন্ডিয়ান মাল আছে। কার্ড খেলার ব্যবস্থা আছে। ভাই একটু কাজে আছে-চলে আসবে।
– আচ্ছা, আমি কথা বলে দেখি।
কথা শেষে সাঈদ রওনা দেয় আলমগীরের সাথে। তার আগে ভাড়ার মাইক্রোবাসটি বিদায় করে দেয় সাঈদ। দুর থেকে ফলো করতে থাকা জহির ফোনে ফারুককে জানায় যে, গেষ্ট আসছে।
পাচ
আলমগীরের ঘরটা নতুন। মুল বাড়ী থেকে একটু ভিতরে। রাস্তা থেকেও দেখা যায়না ঘরটা। সদ্য বানানো খাট, পুরানো আলনা, চারটা চেয়ার, একটা টেবিল – দুই রুমের ঘরটি মুলত: তার বন্ধুদের নিয়ে আড্ডা দেয়ার যায়গা। তার স্ত্রী থাকে তার মায়ের সাথে। বিদ্যুত চলে আসে ইতিমধ্যে। ঘরের এনার্জি বাল্বএর আলোয় গোল হয়ে বসা তারা পাচজন। সাঈদ-আলমগীর-জহির-ফারুক-কাশেম। জিয়া আসে কিছুক্ষন পরেই। অফিসার্স চয়েজ হুইস্কির এক বোতল ইতিমধ্যে শেষ। তিন তাসের খেলায় মাতোয়ারা সবাই। রাত তখন ১১ টা।
– জিয়া ভাই, খাবার আনি? আলমগীরের প্রশ্ন।
– খাবার পরে, আগে বসরে স্পেশাল কক্কাটা দেখাই।
– ভাই, ওইটা তো ৩৭ কোয়ার্টারের কাছে লুকাই রাখছি।
– সাঈদ ভাই, ওটা দেখবেন এখন?
– চলেন যাই।
– ভাই, এক রাউন্ড চা খেয়ে যাই। কাশেমের প্রস্তাব। সবাই রাজি হয়ে যায়।
ইতিমধ্যে শলা পরামর্শ হয়ে যায় আলমগীরদের মধ্যে। সাঈদ তার সাথে থাকা ছোট ব্যগটি হাতছাড়া করেনা এক মুহুর্তের জন্যও।
অবশ্য জিয়া তার বিশ্বস্ত লোক। তবুও সতর্কতা। সে আরো সতর্ক তার পরিচয় যেন প্রকাশ না পায় এই বিষয়ে। প্রায় মধ্যরাত।
সাঈদের একটু অস্বস্তিবোধ হয়। মুহুর্তে ঝেড়ে ফেলে সে তার অস্বস্তি। স্বপ্ন দেখে কোটি টাকার ব্যবসার। সাইজটা যদি ঠিক মতো হয় – এক চালানেই সব শখ পুরন করতে পারবে। সাথে থাকা সাত লক্ষ টাকা ক্রয়মুল্য। সব ঠিক থাকলে বিক্রি হবে প্রায় কোটি টাকা। কাশেমের ডাকে সম্বিত ফিরে পায় সাঈদ।
– চলেন ভাই, জিনিষটা দেখে আসি।
– চলেন।
ছয়
– জাহিদ, ভালো আছেন?
– স্যার, ভালো। কোন সংবাদ আছে, স্যার?
– হুম। নোট নেন। যে নাম গুলো বলছি-তাদেরকে গ্রেফতার করুন। দ্রুত।
– বলুন, স্যার।
সাত
– স্যার, পানি খাবো। আলমগীরের অনুরোধ।
– সামনের বোতল থেকে খাও। আর বলতে থাকো তার পরের ঘটনা।
– স্যার, আমি ভুল করেছি। ঘরের বাইরে যাওয়ার পর আমি আর জানিনা। আমি আমার ঘরে ছিলাম।
সেদিন সন্ধ্যা। ওসি ভুজপুর জাহিদ সার্কেল অফিসে উপস্থিত। গ্রেফতার করে এনেছে কাশেম, জহির আর ফারুককে। জিয়া পলাতক। মাসুদ, জাহিদ, সোহেল আলোচনায় বসে জিঙ্গাসাবাদের পরবর্তী কৌশল নিয়ে।
আলমগীর, কাশেম, জহির, ফারুককে গোল করে চারটি চেয়ারে বসানো হয়। চোখ বাধা-যেন তারা একে অন্যের সাথে যোগাযোগ না করতে পারে বা ইশারা বিনিময় না করতে পারে। তাদেরকে বলা হয় সত্য প্রকাশের জন্য। একজন মিথ্যা বললে বা কিছু মিস করলে অন্যজন শুধরে দেবে। আলমগীর শুরু করে। ঘরে বসে তাস খেলা, মদ খাওয়া পর্যন্ত একমত। আলমগীর ঘর থেকে বের হয়নি-এটা মিথ্যা বলে দাবী করে অন্যরা। ঘটনার পরবর্তী অংশটা এরকম:
একটি কক্কা দেখানোর জন্য আলমগীরের প্রস্তাবে সবাই রাবার বাগানের ৩৭ কোয়ার্টার নামক স্থানে গিয়ে বাগানের আরো ভিতরে প্রবেশ করে। পথিমধ্যে কাশেম এবং আলমগীর শলা পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নেয় যে, টাকা গুলো নিয়ে নেয়ার জন্য সাঈদকে হত্যা করার কোন বিকল্প নেই। বাইরে নজরদারীর দায়িত্বে থাকা জিয়া সহ অন্যরাও এই সিদ্ধান্তের সাথে একমত পোষন করে। কাশেম ভিকটিমকে ডেকে টাকা দিতে বললে এবং তিনি রাজি না হলে স্কচ টেপ তার মুখে লাগিয়ে দেয়, আলমগীর হাত ধরে – ব্যগ থেকে টাকা বের করে আনে। জিয়া অকুস্থলে উপস্থিত হয়ে সবগুলো টাকা নিজ দখলে নেয়-মোট ৬ লক্ষ ৭৫ হাজার টাকা। ফারুক ভিকটিমের পা ধরে রাখে-জহির আলমগীরের বাড়ী থেকে আনা গামছা ভিকটিমের গলায় পরিয়ে শ্বাস রোধ করার চেষ্টা করে।
ভিকটিম বাচার তাড়নায় ধড়পড় করতে থাকে। জিয়া ভিকটিমের অন্ডকোষে ধরে চাপ দেয়। জহির ও জিয়া অত:পর গামছায় টান দিয়ে ভিকটিমের মৃত্যু নিশ্চিত করে। মারা যাওয়ার পর সবাই মিলে মৃতদেহ ঘটনাস্থল থেকে জংগলের আর একটু ভিতরের দিকে টেনে নিয়ে যায়। এরপর সবাই যার যার বাড়ীতে চলে যায়। পরদিন সকালে জিয়া টাকা ও মালামালের ভাগ বাটোয়ারা করে
এভাবে-
– কাশেম নিজামী ১,৪০,০০০/ টাকা
– আলমগীর ও ফারুক ১,৬০,০০০/ টাকা। এই টাকা দিয়ে তারা পরদিন একটি ডিসকভার মটরসাইকেল ক্রয় করে
– জহির ৫০,০০০/
– বাকী তিন লক্ষ পচিশ হাজার টাকা জিয়ার কাছে গচ্ছিত।
– ভিকটিমের টাচ-স্ক্রীন মোবাইল জিয়া নিলেও পরে তা আলমগীরের হাতে আসে। অন্য সিটিসেল মোবাইলটি আলমগীর নেয়। দুটি মোবাইল এবং এর ব্যবহৃত সিমকার্ড আলমগীরের দেখানো মতে তার হেফাজত থেকে উদ্ধার হয়।
– আলমগীরের ঘরের পাশে পুতে রাখা একরাউন্ড গুলি লোডেড অবস্থায় একটি এলজি উদ্ধার করা হয়।
নোট:
(১) পরদিন এদের চারজনের প্রত্যেকে বিজ্ঞ আদালতে দোষ স্বীকারোক্তিমুলক জবানবন্দি প্রদান করে। একটি নৃশংস হত্যাকান্ডের
রহস্য উদঘাটিত হয়, পুলিশের ভালো কাজের একটি নজির স্থাপিত হয়। এই গল্পটি সত্য ঘটনা অবলম্বনে। তবে নাম-পরিচয়
যৌক্তিক কারনে পরিবর্তন করা হয়েছে। চট্টগ্রাম জেলার হাটহাজারী সার্কেলাধীন ভূজপুর থানার ঘটনা এটি। সবচেয়ে বড় বিষয়- বাংলাদেশ পুলিশের অপ্রচারিত অনেক ভালো কাজের একটি নজির মাত্র এই মামলার তদন্ত ও রহস্য উদঘাটন।
(২) স্থানীয়ভাবে কক্কা নামে পরিচিত সরীসৃপ জাতীয় প্রাণীটি তক্ষক নামেও পরিচিত। কথিত আছে, নির্দিষ্ট মাপের চেয়ে বড় তক্ষক কোটি টাকায় বিক্রি হয়। এমন বিশ্বাস তৈরী করেছে এক ভয়ানক প্রতারনা চক্রের। অনেকে সর্বসান্ত হয়েছে। সাঈদের মতো অনেকে জীবন দিয়ে প্রমান করে গেছে যে এটি নিছক একটি প্রতারনার ফাদ। তবুও বন্ধ হয়নি এ প্রতারনা। ক্রেতার চাপ বিক্রেতা তৈরী করছে। প্রতারনা ছড়িয়ে পড়ছে পাহাড়ে। সম্ভবত: একটু সচেতনতা উন্নতি করতে পারে পরিস্থিতির।
সম্পাদনা-১ঃ এএসপি’র জীবন নিয়ে ছিলো মুল লেখাটা। একটু সারমর্ম বলি। উক্ত গল্পের মৃতদেহ যেদিন পাওয়া যায়, সেদিন ছিলো একটি পৌরসভার নির্বাচন। সার্কেল এএসপি সকাল ৬ টায় নিজ আবাস ত্যাগ করে। নির্বাচন ডিউটি শেষ যখন হবে প্রায় (আনুমানিক রাত ৮ টার দিকে), তখন মৃতদেহ প্রাপ্তির খবর আসে। অকুস্থলে পৌছে প্রাথমিক তদারকির কার্যাদি শেষে নিজ কার্যালয়ে পৌছতে বাজে প্রায় রাত ১২ টা।
আশা করি, এএসপির জীবন সম্পর্কে একটু ধারনা পাওয়া যাবে