ব্যস্ততা বেড়েছে কুমারপাড়ায়

এম আনোয়ার হোসেন, মিরসরাই (চট্টগ্রাম)
মৃৎশিল্প। ইতিহাস, ঐতিহ্য আর সংস্কৃতির এক অনবদ্য রূপ। রয়েছে হাজার বছরের ইতিহাস। এই শিল্পের সাথে জড়িয়ে আছে জীবনের প্রয়োজন, আছে চিত্রকলা ও নান্দনিকতার বহিঃপ্রকাশ। চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলার সবচেয়ে বড় কুমারপাড়া ১ নম্বর করেরহাট ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের ছত্তরুয়া কুমারপাড়া। পাড়ায় বেড়েছে ব্যস্ততা। আসছে মুসলমানদের বৃহত্তর ধর্মীয় উৎসব পবিত্র ঈদুল ফিতর এবং এর কিছুদিন পরেই বাঙালির প্রাণের উৎসব নববর্ষ। দুই উৎসবকে ঘিরে পাড়ার কুমারদের দম ফেলার ফুসরত নেই। বছরের অন্য সময়ে মৃৎশিল্পের কদর না থাকলেও ঈদ ও পহেলা বৈশাখকে কেন্দ্র করে মাটির তৈজসপত্রের পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের খেলনা তৈরি করেন মৃৎশিল্পীরা। বিশেষ করে মাটির দোয়েল, কচ্ছপ, মাছ, পুতুল, হাতি, ঘোড়া, নৌকা, টিয়া, সিংহ, হাঁসসহ নানা রকম ফল, ফুল ও বাহারি মাটির ব্যাংক, মগ, গ্লাস, প্লেট, চায়ের কাপ, পিঠা তৈরির ছাঁচও তৈরি করেন। মৃৎশিল্পীরা সারা বছর মাটির তৈজসপত্র তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করলেও ঈদ ও নববর্ষে বিভিন্ন স্থানে মেলা বসার কারণে বাহারি সব খেলনা তৈরি করেন ।
পাড়া ঘুরলে চোখে ধরা দেয় কারিগরদের বিভিন্ন ধরনের মাটির তৈরি সামগ্রী বানানোর ব্যস্ততা। কেউবা মাটি ঘুটছেন, কেউ সেই মাটি ছাঁচে দিয়ে তৈজসপত্র তৈরি করছেন। কেউবা খেলনা তৈরি করছেন কেউবা শুকানোর পর তৈজসপত্রে রং–তুলির আঁচড় দিচ্ছেন। এভাবেই ভোরের আলো ফুটা থেকে শুরু করে বিকেল পর্যন্ত চলে তাদের কর্মব্যস্ততা। পরিবারের সদস্যরা এসব কাজ একসাথে পাশাপাশি বসেই করে থাকেন।
পাড়ার বাসিন্দাদের মতে, আগের মতো এখন মাটির জিনিসের তেমন কদর নেই। সারা বছর টানাপোড়েনের মধ্যেই চলে তাদের সংসার। পূর্বপুরুষের কাছ থেকে শেখা কাজের প্রতি গভীর ভালোবাসা ও শিকড়ের টানে এই পেশা তারা ইচ্ছে হলেও ছাড়তে পারেন না। মিরসরাই উপজেলা ছাড়াও দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছত্তরুয়া কুমারপাড়ার মৃৎশিল্পের খ্যাতি রয়েছে। কিন্তু দীর্ঘ পথচলায় এই খ্যাতিও এখানকার শিল্পীদের জীবনমান বদলাতে পারেনি। দারিদ্র্যতার সাথে প্রতিনিয়তই যুদ্ধ করে তাঁরা পূর্বপুরুষের পেশাকে এখনো আঁকড়ে ধরে রেখেছেন। মৃৎশিল্পের জন্য প্রয়োজন পরিষ্কার এঁটেল মাটি। কিন্তু এখন মাটি পাওয়া সহজতর নয় এছাড়া বেড়েছে মাটি সরবরাহ ব্যয়ও। তার সাথে বেড়েছে আনুষঙ্গিক ব্যয়। সে অনুযায়ী উৎপাদিত পণ্যের দাম বাড়েনি। ব্যবহারিক জীবনে এখন মৃৎশিল্পের তেমন আর ভূমিকা নেই, যা আছে তাও খুবই নগন্য। প্রযুক্তিগত উন্নয়ন সাধিত না হওয়ায় বর্তমানে এই পেশায় টিকে থাকা অনেকটাই কঠিন হয়ে পড়েছে।
আধুনিকতার আশীর্বাদে সেই রমরমা অবস্থা হারিয়ে যেতে বসেছে কুমারপাড়ায়। একসময় মাটির তৈরি জিনিসপত্রের বিকল্প ছিল না। তবে আধুনিকতার ছোঁয়া ও মানুষের রুচির পরিবর্তনের সাথে সাথে মাটির তৈরি সামগ্রীর স্থান দখলে নিয়েছে প্লাস্টিক, সিরামিক, মেলামাইন, স্টিল আর অ্যালুমিনিয়ামের নানা সামগ্রী। বাজারে চাহিদা কম এবং কাঁচামালের চড়া মূল্য আর পুঁঁজির অভাবে টিকতে না পারায় সংকটে মৃৎশিল্পীরা। সেই সঙ্গে কুমারদের নতুন প্রজন্ম এখন অন্য পেশায় ভিড়তে শুরু করেছে। যদিও পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে তাঁদের অনেকে এই পেশা ছেড়ে দিচ্ছেন। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে বাঁচতে পারে হাজার বছরের হতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির এই শিল্প।
স্থানীয় বাসিন্দা নিজাম উদ্দিন জানান, ঐতিহ্যবাহী এই শিল্পকে বাঁচাতে সরকারের বহুমুখী উন্নয়ন কর্মসূচি গ্রহণ করা খুবই প্রয়োজন। এক সময় এই কুমারপাড়ায় মৃৎশিল্পের রমরমা ব্যবসা ছিল। এ শিল্পের পুরনো ঐতিহ্য ও এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে হলে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে।
কুমারপাড়ার নক্ষত্র কুমার পালের স্ত্রী নিহার বালা পাল বলেন, আমার বয়স প্রায় ৫০ ছুঁই ছুঁই। আমার বিয়ের পর থেকেই এই পেশার সাথে আমি জড়িত। আগে মাটির সামগ্রীর প্রচুর চাহিদা থাকলেও এখন আর তেমন নেই। এই শিল্পের সাথে আমাদের জীবন-জীবিকা নির্ভরশীল।
কুমারপাড়ার লিটন কুমার পালের স্ত্রী শুক্লা রানী পাল বলেন, মৃৎশিল্প আমাদের জীবিকার প্রধান উৎস। আমাদের আর কোন আয়ের উৎস নেই। আমরা যে চাষাবাদ করে খাবো, সেই জমিটুকুও নেই। আমার মাও এই পেশায় জড়িত ছিল এখন বিয়ের পর আমার শ^াশুড়ীর পরিবারও জড়িত। সেই ছোটবেলা থেকেই আমরাও জড়িত হয়ে পড়েছি এই শিল্পের সাথে। মৃৎশিল্পের প্রয়োজনীয় উপকরণ এঁটেল মাটি, রং, যন্ত্রপাতি ও জ্বালানি এখন ব্যয়বহুল। কিন্তু বর্তমানে এসব প্রয়োজনীয় উপকরণের দাম বেড়ে যাওয়ায় হিমশিম খেতে হচ্ছে।
কুমারপাড়ার দুলাল চন্দ্র পালের স্ত্রী গীতা রানী পাল বলেন, আমাদের পূর্বপুরুষের ঐতিহ্যের এই পেশা ধরে রাখতে চাই। আগে ব্যবসা অনেক ভালো চলতো কিন্তু বর্তমানে প্লাস্টিক, সিরামিক, মেলামাইন, স্টিল আর অ্যালুমিনিয়ামের নানা সামগ্রী ব্যবহার করায় এখন মৃৎশিল্প কম চলে।
হারাধন চন্দ্র পাল ও তার স্ত্রী পনতি চন্দ্র পাল বলেন, পরিবারের নারী-পুরুষ সদস্যসহ সবাই মিলেমিশে আমরা জিনিস তৈরিসহ যাবতীয় কাজ করে থাকি। তৈরিকৃত সামগ্রী পাইকাররা এসে কিনে নিয়ে যান। অনেকে আবার বাড়ী বাড়ী ফেরি করেও বিক্রি করেন। শুধু ছত্তরুয়া কুমারপাড়া নয়, সারাদেশে এই পেশায় নেমে এসেছে চরম বিপর্যয়। এই ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে কারো যেন মাথাব্যথা নেই।
দিপালী রানী পাল বলেন, এখন মাটির জিনিসের তেমন কদর নেই বললেই চলে। সারা বছর টানাপোড়েনের মধ্যদিয়ে আমাদের সংসার চলে। পূর্বপুরুষের পেশা হওয়ায় ইচ্ছা হলেও ছাড়তে পারি না। বিশেষ করে ঈদ ও বৈশাখী মেলায় মাটির তৈরি খেলনা ও জিনিসপত্রের চাহিদা থাকে। এই সময়ে ভালো আয় হয়।
স্থানীয় বাসিন্দা মিলন পাল বলেন, বর্তমানে মৃৎশিল্পের প্রধান উপকরণ মাটি নিয়ে নতুন সংকট তৈরি হয়েছে। সব ধরণের মাটি দিয়ে তৈজসপত্র তৈরি করা যায় না। অন্য জায়গা থেকে মাটি কিনে আনার সময় পুলিশ গাড়ি আটকে রাখে। বিষয়টি কয়েক বছর আগে আমরা তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে লিখিতভাবে জানিয়েছি। মাটি ও পুঁজির যোগান দিতে স্বল্প সুদে ঋণের জন্য উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে একটি আবেদনও দেওয়া হয়েছে।
ছত্তরুয়া মৃৎশিল্প সমিতির সভাপতি মৃদুল চন্দ্র পাল বলেন, একাধিকবার সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার আবেদন করা হয়েছিল। কিন্তু কোন ফল পাওয়া যায়নি। সম্প্রতি আবারো আবেদন করেছি। সরকারি বেসরকারি অবহেলার কারণে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারছে না ওই পেশায় জড়িতরা। ফলে অচিরেই বিলীন হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে এই পেশাটি। কেবলমাত্র পূর্ব পুরুষের পেশাকে টিকিয়ে রাখার জন্যই এখনও তারা শত প্রতিকূলতা ডিঙ্গিয়ে জড়িয়ে রয়েছে এই পেশায়।
মিরসরাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাহফুজা জেরিন জানান, কুমারপাড়ার বাসিন্দাদের সংকটের কথা আমি জানতাম না। উনারা আমার সাথে যোগাযোগ করলে মাটির সংকটসহ বিরাজমান সমস্যাসমূহ আমার পক্ষে যতটুকু সম্ভব আমি তা নিরসনের জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো।

Exit mobile version