যৌনকর্ম কি কোনো কর্ম ? তাহলে যৌনকর্মী কেন ? তার মানে তো যৌনকর্মের স্বীকৃতি ! বৈধতা দান ! তসলিমা নাসরিন বেশ্যাবৃত্তিকে বৈধতা দেওয়ার বিরুদ্ধে। বলেছেন – “পতিতাপ্রথাকে বৈধ করা মানে নারী নির্যাতনকে বৈধ করা। যে রাষ্ট্রে পতিতা প্রথা বৈধ সেই রাষ্ট্র সত্যিকার কোনও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র নয়। গণতন্ত্র মানবাধিকার নিশ্চিত করে, নারী-পুরুষের সমানাধিকার নিশ্চিত করে। কোনও সভ্যতা বা কোনও গণতন্ত্র মানুষের উপর নির্যাতনকে ছল-ছুতোয় মেনে নেওয়ার চেষ্টা করে না। করতে পারে না। যদি করে, সেই গণতন্ত্রের নাম নিতান্তই পুরুষতন্ত্র, আর সেই সভ্যতার নাম বর্বরতা ছাড়া অন্য কিছু নয়”।
যৌনকর্মী শব্দটি নতুন। এঁরা নিজেদেরকে কর্মী বলে মনে করে। বেশ্যাবৃত্তির মধ্যে একটা সামাজিক ঘৃণা যুক্ত আছে বলে সমাজের অনেক পতিরা মনে করেন। যৌনকর্মী শব্দটির মধ্যে সামাজিক মর্যাদা বা পেশাকে সম্মান দেওয়ার অভিব্যক্তি আছে বলে ধারণা। কিন্তু আমার তেমন মনে হয় না। আর-একটি নতুন বিশেষণ বা নাম ছাড়া অন্য কিছু নয়। বেশ্যা আর যৌনকর্মী শব্দটির মধ্যে মর্যাদাগতভাবে কোনো ফারাক নেই। দুটো শব্দই সমান ঘৃণার। তসলিমার সুরে সুর মিলিয়ে বলল, “নিজেদের যতই শ্রমিক বলে দাবি করুক, সমাজ জানে এঁরা বেশ্যার কাজই করছে। তকমা বদলালেই কি পরিবর্তন ঘটে যাবে ? মেথরের কাজকে জাতিভেদাশ্রিত সমাজ শ্রদ্ধার চোখে না দেখলেও সেটা শ্রমিকের কাজ। কিন্তু বেশ্যাবৃত্তির কখনও এরকম ব্যাখ্যা হতে পারে না”। একটা শ্রেণির নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যেই ‘যৌনকর্মী’ শব্দটির উদ্ভব। সেটি হল আইনি স্বীকৃতি। পেশার বৈধতা।বিপন্ন যৌনকর্মীদের সুরক্ষিত রাখতেই আইনি বৈধতা প্রয়োজন বইকি।আইনি স্বীকৃতি দিলেই যে সব মহিলারা দলে দলে এই বৃত্তিতে অশংগ্রহণ করবেন, এটা যেমন ঠিক ভাবনা নয় – ঠিক তেমনি এই পেশার সঙ্গে যুক্ত মহিলারা বুক চিতিয়ে “গতর খাটিয়ে খাই, শ্রমিকের অধিকার চাই” বলবেন এটাও সহ্য করা যায় না। যে পথেই হোক, যৌনবৃত্তিকে নিয়ে কখনোই আহ্লাদিত হওয়ার নয়।কারণ কোনো অপরাধেই অজুহাত আইনগ্রাহ্য হতে পারে না। ‘খাইতে পারিলে কে চুরি করে’ বললে কারোর চুরির করার অধিকার জন্মায় না, চৌর্যবৃত্তিও বৈধতা পায় না। পেটের জ্বালায় বেশ্যাবৃত্তি করাকে যদি সহানুভূতির সঙ্গে দেখতে হয়, তাহলে তো কোনো অপরাধকেই দণ্ডনীয় অপরাধ বলে শাস্তি দেওয়া যায় না ! মানুষ তো পেটের জ্বালা মেটাতেই চুরি-ডাকাতি-রাহাজানি করেন, তাই না ? যৌনব্যাবসাকে আইনি বৈধতা দিতে হলে তো চুরি-ডাকাতি-রাহাজানির মতো ঘটনাগুলিকেও বৈধতা দিতে হয়। যৌনব্যাবসাকে আইনি বৈধতা নয়, বরং তাঁদের নাগরিক অধিকার বা মানুষের মতো বাঁচার অধিকারকে সুনিশ্চিত করার আন্দোলন হোক।সেইসঙ্গে আড়কাঠি, দালাল, মেয়ে পাচারকারী এবং মাস্তানবাহিনীদের দৃষ্টান্তমূলক বা যাবজ্জীবনের সাজা দেওয়ার দাবি জানাতে হবে। কারণ যাঁরা মেয়েদের ধরে এনে বেশ্যাবৃত্তিতে ঠেলে দেয়, তাঁরা আসলে একটি মানবাধিকারকে হত্যা করে।এইসব হত্যাকারীদের চরম শাস্তি নির্দিষ্ট করা উচিত।তসলিমা নাসরিন অন্য এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, “যতদিন পুরুষতন্ত্র থাকবে ততদিন এ পেশা থাকবে। কিন্তু আমরা পুরুষতন্ত্রকে আর বেশিদিন টিঁকে থাকতে দেব না”।তসলিমা, যাঁরা বলছেন “এটা আর পাঁচটা পেশার মতো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পরিসেবা। আপনার প্রাত্যহিক প্রয়োজনে বাজার থেকে চাল কিনে খেতে যদি আপত্তি না-থাকে, তবে অর্থের বিনিময়ে যৌনতার কেনাবেচায় আপত্তি থাকবে কেন ? পৃথিবী থেকে বাজারের ধারণা যদি উঠে যায় তাহলে এ পেশা আপনা থেকেই বন্ধ হয়ে যাবে” — তাঁদের আপনি কী বলবেন ?
আরে বেশ্যাপল্লি ও বেশ্যাবৃত্তি নির্মূল করে দিলে বেশ্যাবাড়ির মাটির কী হবে ! দুর্গাপুজোও তো বন্ধ হয়ে যাবে ! আচ্ছা, দুর্গাপুজোয় যে বেশ্যাবাড়ির মাটি লাগে তা কি শাস্ত্রসম্মত ? কী বলছে শাস্ত্র ? লিঙ্গপুরাণে দুর্গাপুজোকে ‘চতুষ্কর্মময়ী’ বলা হয়েছে। ‘চতুষ্কর্ম’ বলতে (১) মহাস্নান, (২) ষোড়শোপচার পূজো, (৩) বলিদান এবং (৪) হোম। দুর্গাদেবীর স্নান একটি অত্যাবশ্যকীয় পূজাঙ্গ। সপ্তমী, অষ্টমী নবমী তিথিতে দেবীকে বহুবিধ উপাচার সহযোগে স্নান করানো হয়। এই উপাচারগুলির মধ্যে বেশ কিছু, মানে ১২টি মাটির উল্লেখ পাওয়া যায় — (১) রাজবাড়ির দুয়ারের মাটি, (২) চার মাথার মোড়ের মাটি, (৩) গঙ্গার মাটি, (৪) ষাঁড়ের শৃঙ্গস্থ মাটি, (৫) নদীর দুই কূলের মাটি, (৬) সর্বতীর্থের মাটি, (৭) উইঢিবির মাটি, (৮) সাগরের মাটি, (৯) বুনো শূকরের দন্তলগ্ন মাটি, (১০) গোষ্ঠের মাটি, (১১) দেবদুয়ারের মাটি এবং (১২) বেশ্যাদ্বারের মাটি।দুর্গাপুজোয় বেশ্যাদ্বারের মাটির ব্যবহার প্রায় সর্বত্র প্রচলিত। তবে এই ব্যবহার শাস্ত্রসম্মত নয়।কারণ ‘বেশ্যা’ শব্দটি সাহিত্যে ব্যবহৃত হয়েছে ‘পতিতা’ অর্থে। কিন্তু বিভিন্ন শাস্ত্রে ‘বেশ্যা’ একটি ভিন্নার্থক পারিভাষিক শব্দ। আমরা লোকপ্রচলিত অর্থকে শাস্ত্র ব্যাখ্যার সময় গ্রহণ করায় বেশ্যাদ্বারমৃত্তিকার অর্থ গণিকালয়ের মাটি হয়ে গিয়েছে।অবশ্য এর সপক্ষে কোনো কোনো পণ্ডিত বলেছেন যে, বেশ্যাদ্বার পুণ্যশোষী। যে পুরুষ বেশ্যালয়ে প্রবেশ করে তার সমস্ত পুণ্যবল ওই বেশ্যাদ্বার শোষণ করে নেয়। বেশ্যাগামী পুরুষ পুণ্যরিক্ত হয়ে হয়ে পাপগৃহে প্রবেশ করে।যেহেতু বেশ্যাদ্বার সমস্ত পুরুষের পুণ্য শোষণ করে নেয়, তাই ওই ‘দ্বার’ সংলগ্ন মাটি পবিত্র। এবং অবশ্যই মহামায়ার স্নানের উপযোগী। ব্যাখ্যাটি সুখকর হলেও মোটেই শাস্ত্রসম্মত নয়। কেন-না পুণ্যবান ব্যক্তির পুণ্যফল কোনো তরল পদার্থ নয়। পাপ-পুণ্য মানুষের জন্মজন্মার্জিত কর্মফল বাহিত সূক্ষ্ম সংস্কার। সেটিকে কোনো কিছুর দ্বারাই শোষণ করা সম্ভব নয়। বেশ্যাদ্বারে কোনো অদৃশ্য ব্লটিং পেপার থাকে না, যা পুণ্য শোষণ করতে পারে। ‘বেশ্যা’ শব্দটি শাস্ত্রাদিতে পারিভাষিক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। ‘বেশ্যা’ শব্দটির বর্ণভিত্তিক অর্থ ব্যাখ্যা করলে এই তত্ত্ব খানিকটা প্রকাশিত হবে। ‘বেশ্যা’ শব্দটির বর্ণ বিশ্লেষণ করলে দাঁড়াল – ব্ ঋ এ ঋ শ্ ঋয্ ঋ আ। শ্রীপঞ্চানন শাস্ত্রী সম্পাদিত ‘তন্ত্রাভিধান’-এর ‘বর্ণাভিধান’ অবলম্বনে আমরা ‘বেশ্যা’ শব্দটির বর্ণগত অর্থ বিশ্লেষণ করব। শাস্ত্রে ‘ব’ অর্থে বাল বা নবকে বোঝানো হয়েছে। ‘এ’ অর্থে শক্তি। ‘শ’ অর্থে বৃষঘ্ন। শাস্ত্রে বৃষকে ধর্মস্বরূপ জ্ঞান করা হয়। তাহলে বৃষঘ্ন অর্থ দাঁড়ায় ধর্মহানি। ‘য’ অর্থে কালী এবং ‘আ’ অর্থে প্রতিষ্ঠা। সব মিলিয়ে অর্থ দাঁড়াল বাল শক্তি বা নবজাতক সাধনশক্তি সহায়ে বৃষঘ্ন বা ধর্মহানি (দূর করে) কালীতত্ত্বে প্রতিষ্ঠাতা সাধিকাই বেশ্যা। ‘বেশ্যা’ শব্দের আর-এক রকম ব্যাখ্যাও পাওয়া যায়। শাস্ত্রে ‘ব’ অর্থে মাতা। ‘এ’ অর্থে ভগবতী। ‘শ’ অর্থে বৃষঘ্ন বা ধর্মবাধা। ‘য’ অর্থে সর্বেশ্বরী এবং ‘আ’ অর্থে প্রতিষ্ঠা। সব মিলিয়ে দাঁড়ালো – মাতা ভগবতীর ইচ্ছায় ধর্মবাধা জয় করে সর্বেশ্বরীত্বে প্রতিষ্ঠাতা সাধিকাই বেশ্যা। বৈষ্ণবাচার্য শ্রীমন্ মধ্ব বিরচিত একটি মাতৃকা-নিঘণ্টু আছে। এবার এই মাতৃকা-নিঘণ্টু অবলম্বনে ‘বেশ্যা’ শব্দের অর্থোদ্ধার করব। শ্রীমন্ মধ্বের মতে ‘ব’ অর্থে পুরুষোত্তম। ‘এ’ অর্থে দামোদর। ‘শ’ অর্থে লক্ষ্মীশ। ‘য’ অর্থে বাগীশ। ‘আ’ অর্থে বাসুদেব। অর্থাৎ বেশ্যা অর্থে ভগবান মহিমময় পুরুষোত্তম রূপে, দর্পহারী দামোদর রূপে, ধনৈশ্বর্য্যদায়ী লক্ষ্মীশ রূপে, জ্ঞানৈশ্বর্য্যদায়ী বাগীশ রূপে এবং পরম প্রেমময় বাসুদেব রূপে যাঁর হৃদয়কন্দরে সতত বিরাজমান তিনিই বেশ্যা।(শ্রীমৎ স্বামী পরমাত্মানন্দনাথ ভৈরব গিরি)
তাহলে এই মহৎ (!) বেশ্যাবৃত্তিকে কি আইনি স্বীকৃতি দেওয়া উচিত ? কেন আইনি স্বীকৃতি সঙ্গত নয় ? আইনি স্বীকৃতি নয়, এর সপক্ষে দশটি যুক্তিও পাওয়া যায়। যেমন—(১) বেশ্যাবৃত্তির আইনি স্বীকৃতি আসলে আড়কাঠি, দালাল ও যৌন-ব্যাবসার কাছে এক উপহারস্বরূপ। এই ছাড়পত্রের সুবাদে পতিতালয়, সেক্স ক্লাব, ম্যাসেজ পার্লার, মধুচক্র, যৌনঠেক – সবই বৈধতা পেয়ে যাবে। (২) বেশ্যাবৃত্তির বৈধতাদান বা নিরপরাধীকরণের অর্থ নারী-পাচারকে উৎসাহিত করা।(৩) যৌনপেশার আইনি বৈধতা বা নিরপরাধীকরণ বেশ্যাবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রিত করে না, বরং তাকে বাড়িয়ে দেয়।(৪) বেশ্যাবৃত্তি আইনি বৈধতা গোপন, বে-আইনি, খোলা রাস্তায় বেশ্যাবৃত্তি বাড়িয়ে দেয়। (৫) বেশ্যাবৃত্তির স্বীকৃতি দান ও নিরপরাধীকরণ যৌনশিল্পে নাবালিকাদের অনুপ্রবেশ বাড়িয়ে দেবে। (৬) বেশ্যাবৃত্তির আইনি স্বীকৃতি যৌনপেশার নারীদের নিরাপত্তা দেয় না। (৭) বেশ্যাবৃত্তির স্বীকৃতি ও নিরপরাধীকরণের ছাড়পত্র যৌন-ব্যাবসার চাহিদা বাড়িয়ে দেবে, এই আইনি প্রশ্রয় পুরুষকে আরও নারীদেহ ক্রয়ে আকৃষ্ট করবে। (৮) আইনি মেয়েদেয় যৌনপেশার স্বাস্থ্য প্রতিরক্ষা দেয় না। (৯) আইনি স্বীকৃতি বা নিরপরাধীকরণ বলবৎ হলেও যৌনপেশার নারীদের চাহিদা বা ইচ্ছা-অনিচ্ছার মূল্য বাড়ে না। (১০) বেশ্যাবৃত্তি-ব্যবস্থার ভিতরকার মেয়েরা চায় না এই পেশা আইনি স্বীকৃতি পাক। কারণ বেশ্যাপল্লির এমন একটা মহিলাকে পাওয়া যায়নি, যে চায় তাঁর সন্তান-আত্মীয়-বন্ধুদের কেউ এই পেশায় অর্থোপার্জন করুক।