ঢাকা, ৮ জুন ২০২৩
প্রেস বিজ্ঞপ্তি
শিক্ষা মন্ত্রী ডা. দীপু মনি এমপি বলেছেন, আমাদের দেশে প্রচলিত রয়েছে অনেক ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থা। বঙ্গবন্ধু চেয়েছিল একমুখী শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তন করতে। কিন্তু ১৯৭৫ সালের পর সামরিক শাসনামলে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার পাকিস্তানিকরণ শুরু হয়। ২০০৯ সালে শিক্ষানীতি প্রণয়ন করার পর আমরা সেটি বাস্তবায়িত করার চেষ্টা করছি। যুগোপযুগী ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সমৃদ্ধ শিক্ষা ব্যবস্থা আমরা প্রণয়ন করার চেষ্টা করছি। মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থা প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা থেকে আলাদা। আমাদের মূলধরার শিক্ষাব্যবস্থার অনেক কিছুই তারা গ্রহণ করতে চায় না। কোনও কিছুই চাপিয়ে দেয়া যায় না। তাই আমরা আলাপ আলোচনার মাধ্যমে মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা সংস্কারের চেষ্টা করব।
তিনি আরো বলেন, ‘মাদ্রাসায় যে নির্যাতনগুলো হয় সেগুলো আইন বিরুদ্ধ। তাই আইন অনুযায়ী এই সমস্যার সমাধান করতে হবে। মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ, ছাত্র-শিক্ষকদের সাথেও কথা বলতে হবে। আলাপ আলোচনার মাধ্যমে বাংলাদেশের জন্য একটি বিজ্ঞানমুখী-যুগোপযোগী শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়ন করতে হবে।’ বৃহস্পতিবার (৮ জুন) বিকেল ৩টায় রমনার ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনের সেমিনার কক্ষে (দোতলায়) ‘সকল মাদ্রাসার শিক্ষা যুগোপযোগী করা প্রয়োজন’ শীর্ষক এক আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন শিক্ষামন্ত্রী।
‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’র সহসভাপতি ও ১৯৭১: গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘর ট্রাস্টের সভাপতি ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসীর মামুনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ পাঠ করেন অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট লেখক মওলানা হাসান রফিক এবং অনুষ্ঠানটি সঞ্চালন করেন একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির আইটি সেলের সভাপতি শহীদসন্তান আসিফ মুনীর।
আলোচনা সভায় বক্তব্য রাখেন একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সহসভাপতি শিক্ষাবিদ শহীদজায়া শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী, নির্মূল কমিটির কেন্দ্রীয় সদস্য কথাশিল্পী অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল, জঙ্গিবাদ প্রতিরোধ আন্দোলন বাংলাদেশের সভাপতি মওলানা এয়াকুব বাদশা এবং অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট ও কওমি মাদ্রাসার প্রাক্তন ছাত্র ফরহাদ হোসেন ফাহাদ।
১৯৭১: গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘর ট্রাস্ট-এর সভাপতি ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন বলেন, ‘কওমি মাদ্রাসায় এখন কি চলছে তা আমরা এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে জানতে পারলাম। অনেক ধনাঢ্য ব্যক্তি কওমি মাদ্রাসা স্থাপন করছে বেহেস্ত লাভের জন্য। কওমি মাদ্রাসা তো রাষ্ট্রের মধ্যেই। তাই রাষ্ট্র চাইলেই শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। মাদ্রাসা বোর্ডের সকলকে নিয়ে আলোচনায় বসতে হবে, মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরাও কীভাবে দেশের জনশক্তি, সম্পদ হয়ে উঠতে পারে এ ব্যাপারে কাজ করতে হবে।’
অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট লেখক মওলানা হাসান রফিক বলেন, ‘কওমি মাদ্রাসায় পড়াকালীন শিশুদের উপর যৌন নির্যাতনের ভয়াবহতা সচক্ষে দেখেছি। কওমি মাদ্রাসায় কমলসতি শিক্ষার্থীদের যৌন হয়রানি খুবই নিন্দনীয় দৃষ্টান্ত। কওমি মাদ্রাসার এসব নির্যাতন একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেছে। মাদ্রাসায় পড়াকালীন দেখেছি ওয়াজ মাহফিলের নামে সমাজে ভিন্নধর্ম, ভিন্নমত এবং নারীদের বিরুদ্ধে হিংসাবিদ্বেষ ছড়ানোর বাস্তবতা। ওয়াজের নামে উগ্র সাম্প্রদায়িক বক্তব্যের মাধ্যমে তৃণমূলে জঙ্গি মৌলবাদের যে বিস্তার ঘটছে তা একদিকে যেমন বাংলাদেশের সংবিধান, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থী, অন্যদিকে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার অন্তরায়। বাংলাদেশের প্র্রত্যন্ত অঞ্চলে কওমি শিক্ষক ও তথাকথিত আলেমদের ওয়াজগুলো ধর্মের নামে উন্মাদনা ছড়াচ্ছে। ছাত্র থাকাকালীন আমাদের কওমি মাদ্রাসায় স্বচক্ষে দেখেছি শতকরা আশিভাগ ছাত্র-শিক্ষক ২১ ফেব্রুয়ারির ইতিহাস জানেন না। কওমি মাদ্রাসায় জরিপ চালালেই বোঝা যাবে অধিকাংশ ছাত্র ও শিক্ষক নিজ দেশের ইতিহাস পর্যন্ত জানে না। দেশের কওমি মাদ্রাসায় পাঠ্যসূচিতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, ইতিহাস, ঐতিহ্য, সমাজ, সংস্কৃতির কোনো স্থান নেই। নেই মহান মুক্তিযুদ্ধের ত্রিশ লাখ শহীদের আত্মত্যাগের বর্ণনা।’
তিনি আরো বলেন, ‘জাতীয় দিবসসমূহে কওমি মাদ্রাসা কর্তপক্ষ কোন আনন্দ অনুষ্ঠান আয়োজন করে না। এসব দিবসে ‘আমরা দোয়া করবো’ বলে গতানুগতিক কথা বলে থাকেন। শহীদ মিনারে যাওয়া সঠিক মনে করেন না কওমি মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ। প্রতিবছর কওমি মাদ্রাসা থেকে দাওরা হাদিস শেষ করে ২৬ হাজার আলেম বের হচ্ছেন। পড়ালেখা শেষ করে কর্মক্ষেত্রে পদার্পণের উপযুক্ত হচ্ছেন কিন্তু তাদের কর্মক্ষেত্র কী? কওমি মাদ্রাসার শিক্ষা সামান্যতম নজরদারি বা খবরা-খবর রাখেনি কোন সরকার। যার কারণে এসব মাদ্রাসায় নিরবে জঙ্গিবাদের চাষাবাদে একধরনের বিপ্লব ঘটেছে। আজকের তরুণরা মুক্তিযুদ্ধ দেখে নি। কিন্তু আমরা স্বপ্ন দেখি-তিরিশ লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত এই বাংলাদেশে সকল ধর্মের, সকল জাতিসত্তার, সকল বিশ্বাসের নারী পুরুষ সবাই সমান অধিকার ও মর্যাদা নিয়ে বাস করবে।’
নির্মূল কমিটির সহসভাপতি শিক্ষাবিদ শহীদজায়া শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী বলেন, ‘মাদ্রাসায় সাধারণত জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া হয় না। একদিন একটি মাদ্রাসার ছাত্রকে জিজ্ঞেস করেছিলাম তোমরা জাতীয় সঙ্গীত গাও? ছাত্রটি গর্ব নিয়ে উত্তর দেয়, না আমরা কাফের কবির গান গাই না। যারা মাদ্রাসায় পড়ে তাদেরকে এরকমভাবে তৈরি করা হয়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তারা এরকম না। তাদেরকে বিজ্ঞান ও শিল্প-সংস্কৃতি চর্চা থেকে দূরে রাখা হয়। তারা অফিস, আদালতে, বড় কোন প্রতিষ্ঠানে কাজ করতে পারে না কেন? তাদেরও তো অধিকার আছে। তাই মাদ্রাসার এই শিক্ষাকে যুগোপযুগী করে তাদেরকে দেশের দক্ষ সন্তান হিসেবে গড়ে তুলতে হবে।’
নির্মূল কমিটির কেন্দ্রীয় সদস্য কথাশিল্পী অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল বলেন, ‘একটি ছেলের বিজ্ঞানী হওয়ার শখ কিন্তু সে কওমি মাদ্রাসায় পড়ে বলে বিজ্ঞানী হতে পারবে না, এরকম হতাশামাখা অনেকগুলো মেইল আমার কাছে এসেছে। মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থা একটি জীবনব্যবস্থা যাতে পিষ্ট হচ্ছে লক্ষ লক্ষ শিক্ষার্থী। তাই মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থা যুগোপযোগী করা উচিৎ। একটি দেশের শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে সরকারকে অবশ্যই অবহিত হতে হবে। মাদ্রাসাশিক্ষা নেয়ার পর তারা জনশক্তি হিসেবে তৈরি হয় না। তাদের শিক্ষাব্যবস্থা আনন্দময় করার পাশাপাশি তাদেরকে মূলধারায় নিয়ে আসতে হবে, যেন তারা দেশের জন্য অবদান রাখতে পারে।’
জঙ্গিবাদ প্রতিরোধ আন্দোলন বাংলাদেশের সভাপতি মওলানা এয়াকুব বাদশা বলেন, কওমি মাদ্রাসার শিক্ষা সংস্কারে আমি সবসময় সোচ্চার ছিলাম। কওমি মাদ্রাসায় অধ্যয়নকালে আমার মাতৃভাষা বাংলাকে নিজ আয়ত্তে আনতে পারিনি কারণ আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় পাঠদানের মাধ্যম ছিল উর্দু, ফার্সি ও আরবি। বাংলা ভাষা ছিল সাধারণ ছাত্রদের ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। বাংলা ভাষাকে কোনরুপ মূল্যায়ন করা হতো না। আর ইংরেজি শেখা ছিল হারাম। যে কারণে মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা বাংলা ও ইংরেজিতে খুবই দূর্বল। যতোদিন না কওমি মাদ্রাসার শিক্ষা ব্যবস্থার আমূল সংস্কার হবে ততোদিন এসব বন্ধ হবে না। কওমি শিক্ষার্থীদের কর্মসংস্থানের বাজার খুবই সংকুচিত। পড়ালেখা শেষে আমরা চাকরির বাজারে দেখি চারদিকে অন্ধকার।
অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট ও কওমি মাদ্রাসার প্রাক্তন ছাত্র ফরহাদ হোসেন ফাহাদ বলেন, মাদ্রাসায় শৈশব থেকেই একটি শিশুকে সাম্প্রদায়িকতা শেখানো হয়। অমুসলিম তো পরের কথা, মুসলিমদের মধ্যে যারা স্কুলে পড়ে তাদের প্রতি শেখানো হয় বিদ্বেষ এবং করা হয় বিভক্তি; শেখানো হয় লৈঙ্গিক বৈষম্য। মাদ্রাসার আরেকটি সমস্যা হলো অমুসলিম বিদ্বেষ। সবসময় অমুসলিমদের নিয়ে বিষোদগার করা হয় এবং শেখানো হয় যে অমুসলিম মানে খুব খারাপ।