লক্ষ্মীপুরে কিশোর অপরাধ প্রতিরোধে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত
মিজানুর শামীমঃ লক্ষ্মীপুরে মনোবল মহিলা সমাজ উন্নয়ন সংস্থা কর্তৃক কিশোর গ্যাং ও কিশোর অপরাধ প্রতিরোধ বিষয়ে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। ১৪ জুলাই রবিবার বেলা এগারোটা সদর উপজেলা দালাল বাজারস্হ আলিফ-মীম হাসপাতালের কনফারেন্স রুমে সমাজের বিভিন্ন স্তরের প্রতিনিধিদের উপস্থিত এতে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন জেলা বিএমএ ও স্বাচিপের সভাপতি ডা. জাকির হোসেন। অনুষ্ঠানে সভাপতির বক্তব্যে আলিফ- মীম হাসপাতালের চেয়ারম্যান আলহাজ্ব আমির হোসেন বলেন, সন্তানকে বিভিন্ন চারিত্রিক গুণাবলির শিক্ষা দিতে হবে, তাকে সময় দিতে হবে এবং একইসঙ্গে সন্তানের আচার-আচরণের ওপর খেয়াল রাখতে হবে যাতে পারিবারিক শিক্ষা সমুন্নত থাকে। স্কুল কর্তৃপক্ষের নিয়মিত খোঁজখবর রাখতে হবে- ক্লাস ঠিকমতো হচ্ছে কিনা; স্কুলে মাদক সেবন, র্যাগিং ইত্যাদি হচ্ছে কিনা। সন্তানকে কখনও অতিরিক্ত অর্থ দিবেন না। মটর সাইকেল, মোবাইল ফোন বা আইফোন কিনে দিবেন না। এই অনুষ্ঠানে আমি কথা দিচ্ছি অত্র এলাকাকে মাদক ও কিশোর অপরাধ মুক্ত করার জন্য সব রকমের সহযোগিতা করবো। তিনি আরও এছাড়া দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকেও এগিয়ে আসতে হবে। গ্যাং সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করে ডাটা বেইজ তৈরি করতে পারলে এ সমস্যা নিয়ন্ত্রণ করা অনেক সহজ। যেসব স্থানে গ্যাং সদস্যরা আড্ডা দেয়, সেসব জায়গায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সরব উপস্থিতি থাকতে হবে। গ্যাংয়ের পৃষ্ঠপোষক ও নিয়ন্ত্রকদের আইনের আওতায় আনতে হবে। যে কোনো ধরনের অপরাধ বড় রূপ নেওয়ার আগে অপরাধীকে গ্রেফতার করতে হবে।
বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও সমাজসেবক মোশাররফ হোসেনের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানের শুরুতে পবিত্র কুরআন তেলওয়াত করেন মাওলানা ইসমাইল হোসেন। অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন দালাল বাজার পুলিশ ক্যাম্পের ইনচার্জ উপ পুলিশ পরিদর্শক এমদাদুল হক, দৈনিক জনতার স্টাফ রিপোর্টার ও লক্ষ্মীপুর সাংবাদিক কল্যাণ সংস্থার সভাপতি ভাস্কর বসু রায় চৌধুরী, রায়পুরের কেরোয়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি মাস্টার শাহআলম, চাঁদখালী উচ্চ বিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষক ইসলাম হোসেন, এডভোকেট রিয়াজ হোসেন, মনোবল মহিলা সমাজ উন্নয়ন সংস্থার নির্বাহী পরিচালক শামসুন্নাহার, দালাল বাজার ইউনিয়ন পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান কাজল খান, সমাজসেবক হাজী আব্দুর রহিম। এছাড়া গণমাধ্যমকর্মিসহ সমাজের বিভিন্ন পেশার মানুষ।
বক্তারা বলেন, কিশোর গ্যাং হিসেবে কেউ জন্ম গ্রহন করে না বা এসব গ্যাং এক দিনে গড়ে ওঠেনা। সমাজে সুশিক্ষা কমে যাওয়া ও দুর্নিতি বেড়ে যাওয়ায় সাধারণত কিশোরদের মধ্যে ‘অ্যাডভেঞ্চার ফিলিং’ বা ‘হিরোইজম’ ভাব দেখা যায়। ত্রুটিপূর্ণ সামাজিকীকরণ, নেতৃত্ব ও ক্ষমতার আকাঙ্ক্ষা, সামাজিক বৈষম্য ও বঞ্চনা, রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয়, নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ও বিচারহীনতার সংস্কৃতি এ ধরনের গ্যাংয়ের জন্ম দিচ্ছে। সমাজ মনোবিজ্ঞানী গ্যাব্রিয়েল টার্ডের ধারণা, অনেক সহজ-সরল, নিরপরাধ কোমলমতি কিশোর অপরাধীকে অনুকরণ করে অপরাধ জগতে প্রবেশ করে। তার মতে, অনুকরণের প্রথম শিকার হয় নবীনেরা এবং তারা সহজেই অপরাধের ফাঁদে পড়ে। টেলিভিশন, ভিডিও, সিনেমা, নাটক, ওয়েব সিরিজ, ইউটিউব ইত্যাদির মাধ্যমে কিশোরদের মনস্তাত্ত্বিক, চিন্তাভাবনা, দর্শন আকর্ষণ সহজেই পরিবর্তিত হচ্ছে এবং এভাবে অনেক কিশোর অপরাধ জগতে প্রবেশ করছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের বেশির ভাগ পরিবারের সন্তানের প্রতি অভিভাবকদের তেমন মনোযোগ নেই। তাই বিশেষ করে প্রতিটি অভিভাবকদের উচিত তাঁর সন্তানের প্রতিটি মুহূর্তের খোঁজ খবর নেয়া।
জানা গেছে, পুলিশ প্রতিবেদন-২০২২ অনুযায়ী, দেশে অন্তত ১৭৩টি কিশোর গ্যাং রয়েছে। বিভিন্ন অপরাধে এদের বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে ৭৮০টি। এসব মামলায় আসামি প্রায় ৯০০ জন। অন্য এক হিসাবমতে, দেশে ২০২০ থেকে ২০২৩ সালের অক্টোবর পর্যন্ত কিশোর গ্যাং-বিষয়ক ৩২৫টি মামলা দায়ের হয়েছে। মামলা সূত্রে ১১০টি গ্যাংকে শনাক্ত করা গেছে, যাদের সদস্য সংখ্যা প্রায় ১ হাজার। ওই সময়ে ঢাকা মহানগর এলাকায় প্রায় ৫৪টি কিশোর গ্যাংয়ের সন্ধান পাওয়া গেছে। এগুলোর সদস্য সংখ্যা প্রায় ৭১০। গোয়েন্দা সংস্থার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের সব বিভাগ, জেলা, থানা ও মেট্রোপলিটন এলাকায় গড়ে ওঠা অন্তত ৫ থেকে ৬ হাজার কিশোর গ্যাং সদস্যের দাপটে ও আতঙ্কে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে গ্রাম-গঞ্জ, পাড়া-মহল্লা, হাট-বাজার, শহর-বন্দর সর্বত্র। এক হিসাব অনুযায়ী শুধু রাজধানীতে কিশোর গ্যাং রয়েছে ৬৬টি। চট্টগ্রামে ৫৭টি এবং মহানগরের বাইরে ঢাকা বিভাগে রয়েছে ২৪টি। এসব বাহিনীর বেশির ভাগের সদস্য সংখ্যা ১০ থেকে ৫০ জন। ঢাকার শিশু আদালতের বিচারিক কার্যক্রমের নথি অনুযায়ী গত ১৫ বছরে রাজধানীতে কিশোর গ্যাং কালচার ও সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্বে ৮৫টি খুনের ঘটনা ঘটেছে।