ভারত ও বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দুটি রাষ্ট্র। উভয় দেশের পররাষ্ট্রনীতিতে
একে অপরের জন্য সবসময়ই একটি বিশেষ স্থান বরাদ্দ থাকে। শুধু তাই নয়, এই দুই দেশের সম্পর্ক
ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, ভাষা এবং পারস্পরিক মূল্যবোধের মাঝে নিহিত রয়েছে। এই দুই দেশের পারস্পরিক
সম্পর্ক একে অপরের অর্থনীতি ও নিরাপত্তার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই সত্য অস্বীকার
করার আসলে কোনো উপায়ই নেই। বৈশ্বায়নের এই সময়ে দক্ষিণ এশিয়ার দেশ হিসেবে বিশ্বের
দরবারে নিজেদের পাকাপোক্ত অবস্থান তৈরি করতে উভয় দেশেরই একে অপরের প্রয়োজন। এজন্য
প্রয়োজন দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতার ক্ষেত্র। তাহলে ভারত ও বাংলাদেশ কী কী সহযোগিতার ক্ষেত্র
ভাগ করে নিচ্ছে?
ভারত-বাংলাদেশ সহযোগিতা
একে অপরের নিকটতম প্রতিবেশী হওয়ায় ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে বহুমাত্রিক ও সম্প্রসারিত
সম্পর্ক রয়েছে। ব্যবসা ও বাণিজ্য, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, পরিবহন ও সংযোগ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি,
প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা, জলবায়ু পরিবর্তন এবং টেকসই উন্নয়ন সহ সকল ক্ষেত্রে দুই দেশের
মধ্যে সহযোগিতা বিস্তৃত। ভারতের ফ্ল্যাগশিপ “প্রতিবেশী প্রথম” নীতিতে বাংলাদেশ একটি
গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শেষ ভারত সফরের সময়, দুই দেশ পানিসম্পদ, সক্ষমতা বৃদ্ধি, রেলপথ,
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি খাতে সাতটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষর করে তাদের অংশীদারিত্বকে
আরও জোরদার করেছে। বাণিজ্য ক্ষেত্রে, উদাহরণস্বরূপ, ভারত বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম
বাণিজ্য অংশীদার, যেখানে বাংলাদেশ ভারতের জন্য চতুর্থ বৃহত্তম রপ্তানি গন্তব্য। কোভিড-১৯
মহামারী দ্বারা সৃষ্ট অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব থাকা সত্ত্বেও দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ধারাবাহিক এবং
দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে, যা ২০২০-২১ অর্থবছরে ৯.৬৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার থেকে ২০২১-২২
অর্থবছরে ১৬.১৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে বৃদ্ধি পেয়েছে। সম্পর্ককে আরও দৃঢ় করার জন্য, ভারত
কেবলমাত্র দক্ষিণ এশিয়ায় তার সমস্ত প্রতিবেশীদের মধ্যে জি-২০ সম্মেলনে বাংলাদেশকে
আমন্ত্রণ জানিয়েছে। তাছাড়া, বাংলাদেশ ইতোমধ্যে ভারতের সাথে সমন্বিত অর্থনৈতিক
অংশীদারিত্ব চুক্তির আলোচনা শুরু করেছে।
বাংলাদেশের জন্য ভারত
এটা অনস্বীকার্য যে, ভারত বাংলাদেশের উন্নয়নে অনেক কিছু করেছে। দীর্ঘ আলোচনার পর ভারত
বাংলাদেশকে নেপাল থেকে জলবিদ্যুৎ আমদানির জন্য একটি বিদ্যুৎ করিডোর দিয়েছে। শুধু তাই নয়,
বাংলাদেশের জোরালো দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ভারত প্রথমবারের মতো ভারতীয় ঋণের শর্তাদি
আলোচনা ও পরিবর্তন করতে রাজি হয়েছে। ইন্ডিয়ান লাইন অফ ক্রেডিট (এলওসি) স্কিমের অধীনে
ভারত থেকে ৭৫% পণ্য কেনার বাধ্যবাধকতা মওকুফ করা ছিলো তার মধ্যে অন্যতম। এছাড়াও
সম্প্রতি ভারত কসবা রেলস্টেশন নির্মাণের পাশাপাশি আখাউড়ায় পুলিশের ইমিগ্রেশন ভবন নির্মাণে
আপত্তি প্রত্যাহার করেছে। শুধু তাই নয়, ভারত এখন রাশিয়ার পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের
উপকরণ বাংলাদেশে ওভারল্যান্ড রুটে পাঠানোর সুবিধা দিচ্ছে। এমনকি দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যের
সুবিধার্থে ত্রিপুরা-বাংলাদেশ সীমান্তে আরও তিনটি সীমান্ত হাট খোলা হবে। নরেন্দ্র মোদি এবং
ভারতের অন্যান্য নেতারা বাংলাদেশকে ভারতের উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলোর গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার
হিসেবে স্বীকার করে আসছেন।
সুসম্পর্কের অন্তরায়
দুই দেশের মধ্যে বেশ কয়েকটি অমীমাংসিত ইস্যু রয়েছে যার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল ভারতের
মধ্য দিয়ে প্রবাহিত তিস্তা নদী সহ অভিন্ন নদীগুলির জল ভাগাভাগি এবং সীমান্ত হত্যা সমস্যা।
কয়েক দশক ধরে আলোচনার পরও ভারত এখনো তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে
পারেনি বা ভারতীয় সীমান্তরক্ষীদের হাতে বাংলাদেশি নাগরিকদের হত্যা বন্ধ করতে পারেনি। যেহেতু,
ভূপ্রকৃতিগতভাবে বাংলাদেশ একটি ভাটির দেশ, ভারত সরকারের পক্ষ থেকে পানি বন্টনের ক্ষেত্রে
কিছু সময় বেশ আন্তরিকতা দেখা গেলেও পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের তীব্র বিরোধিতার কারণে ভারত এখনও
পর্যন্ত এই বিষয়ে একটি চুক্তি করতে পারেনি। শুধু তাই নয়, ভারতের নাগরিকত্ব (সংশোধন) আইন
(সিএএ) এবং ন্যাশনাল রেজিস্টার অফ সিটিজেন (এনআরসি) বাংলাদেশীদের মধ্যে নেতিবাচক ধারণা
তৈরি করেছে। এর সাম্প্রতিক উদাহরণ হল আদানি গোষ্ঠীর সাথে করা জ্বালানি চুক্তি যেখানে
ওয়াশিংটন পোস্ট এবং অন্যান্য সংবাদ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে বাংলাদেশ এটির চেয়ে বেশি অর্থ
প্রদানের জন্য একটি চুক্তিতে পড়ে গেছে।
লাভ ক্ষতির ঊর্ধ্বে ভাবতে হবে নিকট প্রতিবেশীর কথা
ভারত বাংলাদেশ সম্পর্কের অন্তরেয়ায় থাকা বিষয়গুলো বেশিদিন অমীমাংসিত রাখা কোনো অইক্ষের
জন্যই মঙ্গলজনক নয়। উদ্ভুত পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে, ভারতের সাথে দীর্ঘদিন ধরে তিস্তার
পানি বণ্টন সমস্যার একটি টেকসই সমাধান খুঁজে বের করা বাংলাদেশের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা
আর বলার অপেক্ষা রাখেনা। কয়েক দশক ধরে আলোচনা এবং আমাদের ভারতীয় অংশীদারদের
অসংখ্য প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তিটি নিষ্পত্তির
ধারে কাছেও নেই। এ পর্যন্ত ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে যেসব চুক্তি হয়েছে, তার মধ্যে সবচেয়ে
বেশি লাভবান হয়েছে ভারত। সেটা বাংলাদেশ থেকে ট্রানজিট এবং ট্রান্স-শিপমেন্ট করিডোর হোক বা
অন্য কোনো দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তি হোক; ভারত বরাবরই লাভবান। তিস্তার পানি বণ্টন ইস্যুটি
এমন একটি ক্ষেত্র হতে পারে যেখানে ভারত লাভ ক্ষতির ঊর্ধ্বে নিজের নিকটতম প্রতিবেশীর কথা
বিবেচনা করে নিঃস্বার্থভাবে প্রকৃত বন্ধুত্বের প্রতিমূর্তি ধরে রাখতে পারে। অন্যদিকে, আদানি
ইস্যুটি এখনও ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে অস্বস্তির একটি ক্ষেত্র। ভারত সরকার ব্যক্তিগতভাবে
বিষয়টি দেখতে পারে এবং বাংলাদেশের জন্য সুবিধাজনক মূল্যে বিদ্যুতের দাম কমাতে আদানি গ্রুপকে
সরাসরি চাপ দিতে পারে। বাণিজ্য হোক, রাজনীতি হোক কিংবা উত্তর-পূর্ব রাষ্ট্রগুলোর নিরাপত্তা
নিশ্চিত হোক, বাংলাদেশকে পাশে পেলে বরাবরই ভারতেরই লাভ। তাই ভারতের উচিত দ্রুত এসব বিষয়
আমলে নিয়ে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
সামারা আশরাত
লেখক : পিএইচডি গবেষণা ফেলো, বুখারেস্ট ইউনিভার্সিটি