শিক্ষার অর্জন প্লেটে পরিবেশন?

 

 

ফেব্রুয়ারিতে দেশে দুইটা সুন্দর কাজ হয়। প্রথমটি হচ্ছে, সারা দেশের স্কুল-কলেজগুলোতে বার্ষিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও ক্রীড়ানুষ্ঠানেরআয়োজন। দ্বিতীয়টি হচ্ছে, বাংলা একাডেমিপ্রাঙ্গণেবইমেলা। তবে দুঃখজনক হলে সত্য, দুই সুন্দরের মধ্যে সমন্বয় হয় না। স্কুল-কলেজে বার্ষিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারী প্রতিযোগীদের পুরস্কার হিসেবে দেওয়া হয় প্লেট-গ্লাস! পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানের সভা মঞ্চে থরে থরে সাজানো থাকে প্লেট-পিরিচ, মগ-গ্লাস। রুচিশীলদের কাছে এটা দেখতে কেমন লাগে, কী প্রতিক্রিয়া হয়- তা জানি না।

 

আয়োজকদের জন্য এই জাতীয় পুরস্কার জোগানো খুব সহজ! বাজেট ফিক্সড করে বাজারে গিয়ে দোকানিকে বললেই প্যাকেট ভর্তি করে দেয়। যাচাই-বাছাইয়ের ঝামেলা নাই। শিক্ষার্থীরা এই পুরস্কার পেয়ে এবং বাড়িতে নিয়ে তাতে ভাত খায়, পানি পান করে! মায়েরা সন্তানের পুরস্কার হাতে পেয়ে গর্বিত হয়ে সযত্নে সু-কেসে সাজিয়ে রাখে! বাবারা বন্ধু-বান্ধব, পাড়াপড়শিকে ডেকে ডেকে দেখায়। আমার সন্তানের কাণ্ড দেখো- বলে বলে গর্ব অনুভব করেন।

 

পুরস্কার হিসেবে বই কেনার জন্য বইয়ের খোঁজ খবর রাখতে হয়, বই পড়তে হয় এবং উপযুক্ত বইয়ের জোগান লাইব্রেরিতে থাকতে হয়। ধাপগুলো জটিল। খরচও কিঞ্চিৎ বেশি। আজকাল এতো ঝামেলা করার সময় আয়েজকদের আছে? বইতে আবার রাজনৈতিক মতাদর্শের গন্ধ থাকে, কালে কালে ভিন্ন ভিন্নমতাদর্শ নিষিদ্ধ থাকে- কাজেই বই দেওয়া চ্যালেঞ্জিং। অথচ প্লেট-গ্লাস মসৃণ- কোন বাড়তি ঝামেলা নাই। বিতর্কের সুযোগ নেই! তবে, প্লেট গ্লাস শিক্ষার্থীদের মনোজাগতিক পরিবর্তন ঘটাতে পারে কি-না জানি না। কিন্তু বই পারে। আলবত পারে। অতীতে পেরেছে, ভবিষ্যতেও পারবে।

 

কালো অক্ষরের বুকে এই প্রাণ আছে। শত মনীষীর জীবনী, বাণী চিরন্তনী কিংবা রবীন্দ্রনাথ-নজরুল কিংবা জীবনানন্দরা শিক্ষার্থীদেরকে নব্য রবীন্দ্রনাথ, বিস্তৃত হুমায়ুন কিংবা চিন্তক আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ হিসেবে সৃষ্টি করতে পারে। অথচ সেটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চায় না। অভিভাবকেরা তো একেবারেই চায় না। আমাদের অভিভাবকগণ বই বলতে শ্রেণি পাঠ্যকে বোঝেন।

 

সম্মানিত শিক্ষকগণের অনেকেই বাইরের কোনো বই পড়তে উৎসাহিত করেন না। দুঃখজনকভাবে সত্য, নিজেরাও কোনো বই পড়েন না। এমনকি যা ক্লাসে পড়ান তাও পড়েন না- কেউ কেউ! সেজন্য শিক্ষার্থীদের মধ্যে পেটের ক্ষুধা, চোখের ক্ষুধা বাড়লেও মনের ক্ষুধা কিংবা মস্তিষ্কের ক্ষুধা বাড়ে না। যেহেতু প্লেট-গ্লাসে পেটের ক্ষুধা বাড়ায় সেহেতু ভোগের দিকে ধাবিত হওয়াই স্বাভাবিক। অথচ শিক্ষার্থীদের হাতে বয়সের উপযুক্ততা বিবেচনায় যদি চিন্তার বাঁকবদল ঘটানোর মতো দুইখানা বই তুলে দেওয়া যেতো তবে শিক্ষার্থীদের বহুমাত্রিক উপকার হতো। রাষ্ট্রকে বদলানোর যাত্রা সহজ হতো। বহুল কাঙ্ক্ষিত সংস্কার তখন ত্বরান্বিতহতো।

 

শিক্ষার্থীদের মনোজাগতিক পরিবর্তন ঘটানো, তাদের মধ্যে ইতিবাচকদৃষ্টিভঙ্গি আনয়ন এবং জ্ঞানের ক্ষুধা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে প্লেট-গ্লাসের চার আনার মূল্য নাই। বই যেটা পারে পিরিচ সেটা পারে না। বই কেবল মানুষকে জ্ঞানী করে গড়ে না বরং সৎ হতে, মানবিক হতে এবং দায়িত্ববান হতে উৎসাহিত করে। শিক্ষার্থীদেরকে দেশপ্রেমের মন্ত্রে উদ্ধুদ্ধ করে। প্রশ্ন করতে শেখায়, প্রতিবাদ করতে জানায়। পৃথিবীতে প্লেট-গ্লাসের বিকল্প বহুকিছুর উদ্ভাবন হয়েছে কিন্তু বই বিকল্পহীন। আদম সন্তানকে মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে ঐশী গ্রন্থসমূহ সর্ব কালে কাজে লেগেছে। চিন্তার খোরাক জোগাতে প্রয়োজন হয়েছে মনীষীদেরমলাটবদ্ধ চিন্তা।

 

জাতি হিসেবে আমরা যে পর্যায়ে দাঁড়িয়ে আছি সেখানে আমাদের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন মনোজাগতিক আলোড়ন তৈরি করা। এই দেশ ততদূর যাবে যতদূর আমাদের শিক্ষার্থীরা এই দেশকে নিয়ে যেতে পারবেন। দেশটাকে সঠিক ট্র্যাকে রাখার জন্য শিক্ষার্থীদের যেকোনো অর্জনের স্বীকৃতিস্বরূপ প্লেট-পিরিচ তুলে দেওয়ার চেয়ে উপযুক্ত বই তুলে দেওয়া কোটি গুণ বেশিদরকারি। এমন উদ্যোগের অভাব প্রকটভাবে লক্ষ্য করছি- যা এলার্মিং।

 

শুনতে খারাপ শোনালেও, শ্রেণি পাঠ্য বইগুলো প্রয়োজনীয় হলেও শিক্ষার্থীদের চিন্তার গভীরতা বাড়ানোর জন্য যথেষ্ট নয়! সেগুলো কেবল বছর পাল্টানোর উপকরণ। বই বলতে মূলত যা বোঝায় তা হচ্ছে কবিতা, গল্প, উপন্যাস কিংবা প্রবন্ধের সংকলন। বিখ্যাত ব্যক্তিদের আত্মজীবনী পড়া, সফলদের গল্প জানা- এসব শিক্ষার্থীদের চিন্তাকে প্রসারিত করে। গড়ে তোলে মানবিক মানুষ হিসেবে। যুগের এই অঙ্গনে গড়পড়তার মানুষের চেয়ে আমাদের প্রয়োজন সৃজনশীল মানুষ, দক্ষ মানুষ এবং সৎ মানুষ। বইয়ের কোলে চোখ রাখলে আমরা সেটা পেতে পারি। বই পড়ার মধ্য দিয়েই তো আলোকিত মানুষ গড়ে।

 

রাজুআহমেদ,  প্রাবন্ধিক।

raju69alive@gmail.com

Exit mobile version