সাংবাদিক সম্মেলন
স্থানঃ ঢাকা রিপোটার্স ইউনিটি নসরুল হামিদ মিলনায়তন
তারিখঃ ৩০ ডিসেম্বর, ২০২১ বৃহস্পতিবার, সকাল ১১.০০ টা
প্রিয় সাংবাদিক বন্ধুগণ,
প্রথমে আমাদের সকলকে পরিচয় করিয়ে দেই। লিখিত বক্তব্য পাঠ করছি আমি অ্যাডঃ গোবিন্দ চন্দ্র প্রামাণিক, মহাসচিব বাংলাদেশ জাতীয় হিন্দু মহাজোট, সাথে আছেন হিন্দু মহাজোটের নির্বাহী সভাপতি অ্যাডঃ দীনবন্ধু রায়, সিনিয়র সহ সভাপতি প্রদীপ কুমার পাল, প্রধান সমন্বয়কারী বিজয় কৃষ্ণ ভট্টাচার্য, প্রেসিডিয়াম মেম্বার অভয় কুমার রায়, যুগ্ম মহাসচিব ফনি গোপাল দাস, সহ দপ্তর সম্পাদক কল্যাণ মন্ডল, হিন্দু মহাজোট ঢাকা মহানগরের সাধারণ সম্পাদক শ্যামল ঘোষ, হিন্দু মহাজোট মুন্সীগঞ্জ জেলার আহ্বায়ক সুশান্ত চক্রবর্তী, ছাত্র মহাজোটের সভাপতি সাজেন কৃষ্ণ বল সাধারন সম্পাদক সজিব কুন্ডু, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক স্বপন মধু প্রমুখ।
প্রিয় সাংবাদিক বন্ধুগণ
আপনারা জাতির বিবেক, আপনাদের নিরপেক্ষভাবে দ্বায়িত্ব পালনের কারনেই সংখ্যালঘু সম্প্রদায় আপনাদেরকে একমাত্র আশা ভরসার স্থল মনে করে। আপনাদের মাধ্যমেই এদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের র্নিযাতন নিপীড়নের কথা দেশবাসী সহ বিশ্ববাসী জানতে পেরেছে।
প্রিয় সাংবাদিক বন্ধুগণ
সারা পৃথিবীর মত বাংলাদেশও করোনা ভাইরাসের দুর্যোগ মোকাবেলা করে একটু স্বস্তির নিশ্বাস ফেলছে। কিন্তু এদেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায় স্বস্তিতে নেই। প্রতিদিনই দেশের কোন না কোন স্থানে ঘটছে হৃদয় বিদারক ঘটনা ঘটছে। “মরার উপর খাড়ার ঘা”র মত হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়ীঘর, মঠ মন্দিরে হামলা, ভাংচুর, হত্যা, হত্যা প্রচেষ্টা, জমি দখল, দেশ ত্যাগে বাধ্যকরন সহ নানা নির্যাতন অতীতের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। নির্যাতন নিপিড়নে অতিষ্ঠ হিন্দু সম্প্রদায় দুর্বিসহ অবস্থার মধ্যে দিন যাপন করছে।
প্রিয় সাংবাদিক বন্ধুগণ
জানুয়ারী থেকে ২৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত গত এক বছরে দেশের সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের ১৫২ জন মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, হত্যার হুমকী ১২৫ জন, হত্যা চেষ্টা ৫০৪ জন, জখম ও আহত করা হয়েছে ১৯৬৪ জনকে, নিখোঁজ হয়েছে ১৪২ জন, চাঁদাবাজী হয়েছে ৩ কোটি ০২ লক্ষ ০৮ হাজার টাকা, পরিবার ও মন্দির লুঠ হয়েছে ১১৬২ টি। বসতবাড়ী হামলা ভাংচুর ও লুঠপাটের ঘটনা ঘটেছে ২০৯৪টি। অগ্নি সংযোগ ৪২৯টি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ৪৫১টি হামলার ঘটনা ঘটেছে, ভূমি দখল হয়েছে ৬,১৭৯ একর ৮১ শতাংশ, যার মধ্যে, ¤্রাে, ত্রিপুরা, সাঁওতাল ও তঞ্চঙ্গ্যা পাহাড়ী আদিবাসী হিন্দুদের ২৮৮২.৩০ একর এবং সমতলের হিন্দুদের ৩২৯৭.৫১ শতাংশ। দখলের তৎপরতা ৭৫০৮ একর ৬৮ শতাংশ। এর মধ্যে গারো, সাঁওতাল ও ¤্রােদের ৪৫৫৭.০০ একর। ঘরবাড়ী দখলের ঘটনা ঘটেছে ২২২টি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ১৫৩টি, মন্দিরের ভূমি দখল ৭৬টি, বসত বাড়ী থেকে উচ্ছেদ ৯৮০৯ টি পরিবার,
= ২ =
যার বেশীরভাগ আদিবাসী ¤্রাে ও চাক সম্প্রদায়ের। উচ্ছেদের চেষ্টা ৪১৭৯১ টি পরিবার, উচ্ছেদের হুমকী ৮৯৪৩ পরিবার। দেশত্যাগের বাধ্যকরণ ৯২৬১টি পরিবার। দেশত্যাগে হুমকীর শিকার ১৩,৪৪৮ট পরিবার, নিরাপত্তাহীনতায় ১,২৩,৭২২ টি পরিবার। সংঘবদ্ধ হামলা ১৯০২টি। মন্দিরে হামলা, ভাংচুর ও অগ্নি সংযোগ ৪৭২টি, প্রতিমা ভাংচুর ২১৩০টি, শ্রী শ্রী রাম ঠাকুর আশ্রমের বধূয়া সাজ নামের দোকানের ১২৩২ দেবদেবীর প্রতিমা আগুনে পুড়িয়ে ধ্বংস করা হয়। প্রতিমা চুরি ৩২২টি, বাড়ীতে হামলা ভাংচুর অগ্নি সংযোগের ঘটনা ঘটেছে ২০৫৩টি। অপহরণ করা হয়েছে ১৫১ জনকে, অপহরনের চেষ্টা ০৯ জনকে। ২৯ জনকে ধর্ষন করা হয়েছে, গণধর্ষনের শিকার ১৪ জন। ধর্ষনের পর হত্যা ৬ জন। ৪৬ জনকে ধর্ষনের চেষ্টা হয়েছে, ৪১১ জনের অধিক নারী যৌন ও শারিরীক লাঞ্চনার শীকার। ৬০৯ জনকে ধর্মান্তরিত করা হয়েছে। ধর্মান্তরের চেষ্টা ৭৩ জনকে। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত এর ঘটনা ঘটেছে ২৭৮ টি। মিথ্যা মামলায় আসামী, গ্রেফতার, বরখাস্ত, চাকুরীচ্যুত, জেল জরিমানার শিকার ৪২৫ জন, ১,১৩০ টি পরিবারকে অবরুদ্ধ করা হয়েছে। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান অপবিত্রকরণ ৩০৮টি, ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালনে বাধা ৪২০টি। ধর্মীয় নিষিদ্ধ গরুর মাংস খাইয়ে অপবিত্রকরন ৩২জনকে।
২০২১ সালে ১৯১৪টি আলাদা ঘটনায় একাধিক ব্যক্তি, পরিবার ও প্রতিষ্ঠান মন্দির ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে; যার সংখ্যা কমপক্ষে ১,৩৫,৯৪৮টি এবং ৬২৪৯ একর ২১ শতাংশ ভূমি হতে বেদখল করা হয়েছে। যার মধ্যে, ¤্রাে, ত্রিপুরা সাঁওতাল ও তঞ্চঙ্গা পাহাড়ী আদিবাসী হিন্দুদের ২৮৮২.৩০ একর এবং এবং সমতলের হিন্দুদের ৩২৯৭.৫১ শতাংশ জমি দখল হয়েছে। মোট ক্ষতির পরিমান ১,১৪৫ কোটি ৯৭ লক্ষ ৯,৫৯৯ টাকা।
প্রিয় সাংবাদিক বন্ধুগণ
পরিসংখ্যান বলে দিচ্ছে দেশে প্রতিনিয়তই হিন্দু নির্যাতন বাড়ছে। ২০১৫ সালের তুলনায় ২০১৬, ২০১৭, ২০১৮, ২০১৯, ২০২০ এবং ২০২১ হিন্দু নির্যাতন বেড়েছে কয়েকগুন।
নির্যাতনের ধরন ২০১৫ ২০১৬ ২০১৭ ২০১৮ ২০১৯ ২০২০ ২০২১
হত্যা ২৪ ৯৮ ১০৩ ৯৬ ১০৮ ১৪৯ জন ১৫২
হামলা ৬৭১টি ১,৮৯৮টি
অপহরণ ১০ ৩৮ ১৪৯ ৩৫ ৭৬ ৯৪ জন ১৫১
প্রতিমা ভাংচুর ১০৮ ১০৯ ২১৫ ৩৮২ ২৪৬ ৩৭০টি ২১৩০
উচ্ছেদ/দেশত্যাগে বাধ্যকরন ৫০ ৭১১ ৫৩ ৬৫ ৩৭৯ ২১২৫ পরিবার ৯২৬১
চাঁদাবাজী ৪৫ লক্ষ ৫০ হাজার (২০২০) ৩ কোটি ২ লাখ ৮ হাজার (২০২১)
নিরাপত্তাহীনতা ৬৬১৩ টি ১,২৩,৭২২ টি পরিবার
ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত ৪৩ টি ২৭৮টি
মিথ্যা মামলায় আসামী, চাকুরিচ্যুতি, গ্রেফতার ১৭৭ জন ৪২৫ জন
লুঠপাট, মন্দির ও পরিবার ৬৬৮টি ৩২৫৬টি
মোট ঘটনা ২৬২ ৩৯২ ১১১৬ ৮৫০ ৬৮৩ ১০৫৫টি ১৯১৪টি
এককভাবে ক্ষতিগ্রস্থ ব্যক্তি, পরিবার, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ১৫৫২ ১৫,০৫৪ ৩৫,৩৩৪ ৩৭,২৫০ ৩১,৫০৫ ৪০,৭০৩ টি ১,৩৫,৯৪৮টি
১,৩২২ কোটি ২১ লক্ষ ৯৩ হাজার টাকা ১,১৪৫ কোটি ৯৭ লক্ষ ৯,৫৯৯ টাকা
গত ২০১৮ সালের তুলনায় ২০১৯ সালে হিন্দু নির্যাতন বেড়েছে। ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২০ সালে হিন্দু নির্যাতন বেড়েছে আশঙ্কাজনকভাবে। আবার ২০২০ সালের তুলনায় ২০২১ সালে হিন্দু নির্যাতন বেড়েছে ব্যাপকভাবে। ২০১৮ সালে হত্যা হয়েছিল ৯৬ জন, ২০১৯ সালে ১০৮ জন, ২০২০ সালে হত্যা হয়েছে ১৪৯ জন ২০২১ সালে ১৫২। ২০১৮ সালে বসতবাড়ী থেকে উচ্ছেদ হয়েছিল ২১৭টি পরিবার, ২০১৯ সালে ৪৩৪টি পরিবার, ২০২০ সালে ২১২৫টি পরিবার, ২০২১ সালে ৯৮০৯ পরিবার। ২০১৮ সালে দেশ ত্যাগের হুমকী ছিল
= ৩ =
২২৩ টি, ২০১৯সালে ৬৪১টি পরিবার, ২০২০ সালে ৮৯৩টি ২০২১ সালে ১৩,৪৪৮ টি পরিবার। ২০১৮ সালে দেশত্যাগে বাধ্য করা হয়েছিলো ৬৫টি পরিবারকে, ২০১৯ সালে ৩৭৯টি পরিবারকে, ২০২০ সালে ৬২৯টি, ২০২১ সালে দেশ ত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে ৯২৬১টি পরিবারকে। ২০১৮ সালে নিরাপত্তাহীনতায় ছিল ১৫১০ পরিবার, ২০১৯ সালে ২২৬১ পরিবার, ২০২০ সালে ৬৬১৩টি পরিবার, ২০২১ সালে ১,২৩,৭২২ টি পরিবার। ২০১৮ সালে মন্দিরে হামলা, ভাংচুর ও অগ্নি সংযোগের ঘটনা ঘটেছিল ১৩১টি, ২০১৯ সালে ১৫৩টি, ২০২০ সালে ১৬৩টি ২০২১ সালে ৩২৫৬টি, ২০২০ সালে মিথ্যা মামলায় আসামী, চাকুরিচ্যুতি, গ্রেফতার ১৭৭, ২০২১ সালে ৪২৫ জন। সর্ব ক্ষেত্রেই নির্যাতনের পরিমান বেড়েছে।
প্রিয় সাংবাদিক বন্ধুগণ
বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও এদেশের হিন্দু সম্প্রদায় কখনোই স্বাধীনতার স্বাদ লাভ করে নাই। স্বাধীনতার পরপরই ঐতিহ্যবাহী রমনা কালি মন্দির ধ্বংস করা হয়েছে; যদিও তা এখন ভারতীয় অর্থে পূনঃ নির্মান হয়েছে। ১৯৭৪ সালে শত্রু সম্পত্তি অর্ডিন্যান্সকে পরিত্যক্ত সম্পত্তি আইন নামে পাশ করে এদেশের ২৬ লক্ষ একর সম্পত্তি দখল করা হয়েছে। এর পর সংবিধান কেটে ছেটে সাম্প্রদায়িকীকরন করা হয়েছে। প্রতিনিয়ত হিন্দু ধর্ম নিয়ে কটুক্তি করলেও হিন্দু ধর্ম নিয়ে কটুক্তির অভিযোগে কাউকে শাস্তি বিধান করা হয় নাই। উপরন্তু ফেসবুক হ্যাক করে মিথ্যা গুজব ছড়িয়ে শতাধিক হিন্দু যুবককে গ্রেফতার করা হয়েছে। শত শত ঘরবাড়ী পুড়িয়ে, মঠ মন্দির ধ্বংস করে ভীতির পরিবেশ সৃষ্টি করে প্রতিনিয়ত হিন্দুদের দেশত্যাগে বাধ্য করা হচ্ছে। ২০০১ সালে নির্বাচন পরবর্তী ন্যক্কারজনক সহিংসতা নিয়ে সারা বিশ্বের বিবেকবান মানুষ ধিক্কার জানালেও সেই সমস্ত নির্যাতনকারী অপরাধীদের একজনকেও শাস্তি দেয় নাই বিএনপি সরকার বা বর্তমান সরকার। হিন্দু সম্প্রদায় দীর্ঘদিন যাবৎ সংখ্যালঘু নির্যাতন ও নিপিড়ন বন্ধে এবং সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব সুনিশ্চিত করতে ১। জাতীয় সংসদে ৬০ টি সংরক্ষিত আসন ও পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থা পূনঃ প্রতিষ্ঠা এবং ২। একটি সংখ্যালঘু বিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠার দাবী করেছে। উক্ত দাবী দাওয়া বাস্তবায়নের দাবীতে হিন্দু সম্প্রদায় সারা দেশে ব্যাপকভাবে আন্দোলন সংগ্রাম করেছে। কিন্তু বেদনার বিষয় সরকার দাবী দুটির প্রতি কর্ণপাত করে নাই। যে কারনে দিন দিন হিন্দু নির্যাতন বেড়েই চলেছে।
প্রিয় সাংবাদিক বন্ধুগণ
এমতাবস্থায় সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায় আপনাদের মাধ্যমে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রতি আহ্বান জানাচ্ছে-
১। হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর সহিংসতা ও নির্যাতন নিরোধ কল্পে এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব সুনিশ্চিত করতে জাতীয় সংসদে ৬০টি সংরক্ষিত আসন ও পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থা পূণঃ প্রতিষ্ঠা; ও
২। সংখ্যালঘু বিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠার দাবী জানাচ্ছে।
হিন্দু সম্প্রদায় আশা করে সরকার হিন্দু সম্প্রদায়ের উপরোক্ত দাবী দুটির প্রতি সম্মান দেখিয়ে আগামী অধিবেশনে বিল পাশ করে এদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের দীর্ঘদির আশা আকাঙ্খা পুরন করবে।