ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর একের পর এক তথ্য বেরিয়ে আসছে। দেশের ব্যাকিংক খাতে হয়েছে সবচেয়ে ন্যাকারজনক দুর্নীতির ঘটনা। এইসব ঘটনায় দুর্নীতিবাজদের সহযোগিতা জুগিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
জানা গেছে, গত ১৫ বছর কেন্দ্রীয় ব্যাংকটির একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণে ছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান এবং এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলম। এ ক্ষেত্রে আরও কয়েকজন ব্যবসায়ী ছিলেন তাদের সহায়ক।
এক কথায় দেশের আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রণ চলে যায় মাফিয়াদের হাতে। আর সুযোগ বুঝে সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকগুলো থেকে লাখ লাখ কোটি টাকা নামে-বেনামে বের করে নিয়েছেন তারা। এর বড় অংশই বিভিন্ন দেশে পাচার করা হয়েছে।
জানা গেছে, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলেও ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর শুরু হয় ব্যাংক দখল ও লুটপাটের ধারা।
আওয়ামী লীগ শাসনামলের শুরুতে ২০০৯ সালের ১ মে গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন ড. আতিউর রহমান। দায়িত্বের প্রথম মেয়াদে তেমন কোনো অভিযোগ না থাকলেও দ্বিতীয় মেয়াদে সমালোচনার মুখে পড়েন এই অর্থনীতিবিদ। বিশেষ করে গণমাধ্যমে অতিপ্রচারের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণের কারণে বিতর্কিত হন তিনি। এসএমই ঋণ বিতরণের নামে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বহর নিয়ে ঘুরে বেড়ানোর অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
এমনকি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মূল কাজ বাদ দিয়ে তার এসব সফরে ব্যাংকগুলোকে গেট, পোস্টার, ফেস্টুন তৈরিতে বাধ্যও করেছেন তিনি। সে সময় বিভিন্ন গণমাধ্যমে এ বিষয়ে সংবাদ প্রকাশ হয়েছে।
সর্বশেষ ২০১৬ সালে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সার্ভারে ঢুকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে ৮১ মিলিয়ন ডলার চুরি করে নেয় হ্যাকাররা। ভয়াবহ ওই ঘটনা সরকারের কাছ থেকে ২৪ দিন লুকিয়ে রাখেন গভর্নর। এর জেরে ওই বছরের ১৫ মার্চ গভর্নর আতিউর রহমান পদত্যাগ করেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, আতিউর রহমান দায়িত্বে থাকা অবস্থায়ই এস আলম গ্রুপ নামে-বেনামে দেশের বৃহৎ বেসরকারি ব্যাংক ইসলামী ব্যাংকের শেয়ারের নিয়ন্ত্রণ নেয়। তবে সে সময় ব্যাংকটি দখলে বাধা দেন গভর্নর।
তার যুক্তি ছিল, এই ব্যাংক বিপদে পড়লে দেশের আর্থিক খাত পুরোটাই বিপদে পড়বে। এজন্য এস আলম গ্রুপের চক্ষুশূল হয়েছিলেন তিনি। ওই সময় সরকারে সঙ্গে আঁতাত করে নিয়োগ পাওয়া এস আলমের বিশ্বস্ত ডেপুটি গভর্নর সিতাংশু কুমার সুর চৌধুরী ইসলামী ব্যাংকের মালিকানা পরিবর্তনে চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন।
আতিউর রহমান পদত্যাগ করায় ২০১৬ সালের ১৬ মার্চ দেশের ১১তম গভর্নর হিসেবে নিয়োগ পান ফজলে কবির। সালমান এফ রহমান ও সাইফুল আলমের (এস আলম) পরামর্শেই তাকে সে সময়ে গভর্নর হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। প্রতিদান হিসেবে তিনি দায়িত্বে থাকা অবস্থায় এস আলমকে ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকসহ অন্তত পাঁচ ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণে নিতে সহায়তা করেন। অবশ্য নির্বিঘ্নে ব্যাংক দখল ও সেখান থেকে বিপুল পরিমাণ টাকা বের করার সুযোগ করে দিতে একের পর এক নীতি পরিবর্তন করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
২০১৪ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের অফ-সাইট সুপার ভিশন, ব্যাংকিং রেগুলেশন, বৈদেশিক মুদ্রা ও নীতি এবং পরিদর্শন বিভাগগুলো অন্তত অর্ধশত সার্কুলার পরিবর্তন করেছে। এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে একই বিষয়ে সপ্তাহের ব্যবধানে নতুন নীতিমালা করতেও দেখা গেছে।
এস আলম, বেক্সিমকোসহ বড় গ্রুপগুলোকে বিভিন্ন সুবিধা দেওয়ার কারণে ২০২০ সালে সর্বসম্মতিক্রমে দ্বিতীয় মেয়াদে ফের গভর্নর হন ফজলে কবির। এক্ষেত্রে তাকে নিয়োগ দিতে গভর্নরের সর্বোচ্চ বয়সসীমায়ও পরিবর্তন আনা হয়।
২০২০ সালের ১৫ জুলাই গভর্নরের সর্বোচ্চ বয়সসীমা ৬৫ থেকে বাড়িয়ে ৬৭ করা হয়। ফজলে কবির তার দায়িত্ব থাকা অবস্থায় দেশের বড় গ্রুপগুলোকে সুবিধা দিতে অন্তত ৩১টি সার্কুলার দিয়েছেন। দেশের আর্থিক খাতের দুর্গতির জন্য তার দায় সবচেয়ে বেশি বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন।
ফজলে কবিরকে গভর্নর করার ক্ষেত্রে এস আলম ও সালমান এফ রহমান ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারলেও আব্দুর রউফ তালুকদারকে নিয়োগে তাদের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দেয়।
ওই সময় সালমান এফ রহমান তৎকালীন বিএসইসি চেয়ারম্যান শিবলী রুবাইয়াতকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর করতে চেয়েছিলেন।
কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও এস আলমের পছন্দে দেশের ১২তম গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব পান আব্দুর রউফ তালুকদার। দায়িত্ব নিয়েই এক সপ্তাহের মধ্যে তিনি এস আলমের প্রতিষ্ঠানকে খেলাপি থেকে মুক্ত করতে একটি সার্কুলার জারি করেন। ওই সার্কুলার মনঃপূত না হওয়ায় ১৬ দিনের মাথায় ফের সার্কুলার জারি করতে হয়। এতে ঋণ পুনঃতপশিলে বড় ধরনের সুবিধা দেওয়া হয় খেলাপিদের।
শুধু তাই নয়, এস আলম ও সালমান এফ রহমানদের অনিয়মের তথ্য ফাঁস হওয়ার শঙ্কায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকে সাংবাদিকদের প্রবেশেও নিষেধাজ্ঞা দেন আব্দুর রউফ তালুকদার।
ওই নিষেধাজ্ঞার মধ্যেই নির্দেশনা জারি করে বেসরকারি খাতের ন্যাশনাল ব্যাংক তুলে দেওয়া হয় এস আলমের হাতে। শুধু তাই নয়, এরপর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চাপে এস আলম গ্রুপের ঋণের ২ হাজার ৩২০ কোটি টাকা মওকুফ করে ন্যাশনাল ব্যাংক।
ব্যাংকটির বোর্ডের বেশিরভাগ সদস্যই ছিলেন এস আলমের অনুগত। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর নতুন গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর দায়িত্ব গ্রহণের ন্যাশনাল ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন করেছেন।
তবে গভর্নর হিসেবে আব্দুর রউফ তালুকদার দায়িত্ব নেওয়ার পর বিপাকে পড়েন সালমান এফ রহমান। তিনি বেসরকারি খাতের আইএফআইসি ব্যাংকের মাধ্যমে বন্ড বিক্রি করে হাজার কোটি টাকা সংগ্রহের প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলেন গভর্নর। শ্রীপুর টাউনশিপ লিমিটেডের (এসটিএল) বন্ড আইএফআইসি ব্যাংক কীভাবে নিজেদের নামে বিক্রি করছে—তা জানতে চায় বাংলাদেশ ব্যাংক। পরে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে সালমানকে ছাড় দিতে হয়।
এরপর আলোচিত এই ব্যবসায়ীকে আরও বড় সুবিধা দিয়েছেন আব্দুর রউফ তালুকদার। জনতা ব্যাংক থেকে বিশেষ বিবেচনায় ২২ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিতে সহায়তা করেছেন তিনি। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক ও ব্যাংক কোম্পানি আইনের সব ধরনের নীতি লঙ্ঘন করা হয়েছে।
তথ্য বলছে, আব্দুর রউফ তালুকদারের দায়িত্বে থাকা অবস্থায় বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি বিভাগ থেকে সার্কুলার জারি করা হয়। কিন্তু যার স্বাক্ষরে ওই সার্কুলার প্রকাশ করা হয়েছে, তিনি সেসময় ঢাকায় ছিলেন না। পরে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা নাজিল হওয়া সার্কুলার ছিল। আমি বাড়ি ছিলাম। কিছুই জানতাম না। কিন্তু সার্কুলার জারি হয়ে গেছে।
এদিকে আব্দুর রউফ তালুকদার দায়িত্বে থাকা অবস্থায় খেলাপিদের সুবিধা দিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের সিআইবির নিয়ন্ত্রণ ব্যাংকগুলোর হাতে দেওয়া হয়। যাতে বড় খেলাপিরা ইচ্ছামতো ঋণের স্ট্যাটাস পরিবর্তন করতে পারেন। পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন বিভাগগুলোকে কার্যত অকার্যকর করে তোলেন।
এ কারণে তিনি দায়িত্ব নেওয়ার পর ব্যাংক খাতে অনিয়ম বাড়লেও পরির্দশন অর্ধেকে নেমে আসে। এসব সুবিধার বিপরীতে তিনি বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন বলেও আলোচনা রয়েছে। এর মধ্যে রাজধানীর দিয়াবাড়ি এলাকায় আলিশান সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে পাওয়া জমিতে একটি শিল্প গ্রুপ আলিশান বাড়ি তৈরি করে দিয়েছে। এ কাজের সমন্বয়ের দায়িত্বে ছিলেন ‘ছাগলকাণ্ডে’ আলোচিত এনবিআর কর্মকর্তা মতিউর রহমান।
এসব বিষয়ে কথা বলার জন্য সাবেক গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারকে একাধিকবার ফোন করা হলে প্রতিবারই তার নম্বর বন্ধ পাওয়া গেছে। হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ পাঠানো হলেও কোনো জবাব দেননি।
এদিকে এস আলম, সালমান এফ রহমানসহ বড় গ্রুপগুলো শুধু গভর্নরকেই কিনে নেননি। এই কাজে সহায়তার জন্য তারা নিয়োগ দিয়েছেন একের পর এক ডেপুটি গভর্নর ও নির্বাহী পরিচালক।
ডেপুটি গভর্নরদের তালিকায় আছেন সিতাংশু কুমার সুর চৌধুরী, এস এম মনিরুজ্জামান, আহমেদ জামাল, কাজী ছাইদুর রহমান, আবু ফারাহ নাসের ও খুরশিদ আলম। এদের মধ্যে এস কে সুর চৌধুরী এবং মনিরুজ্জামান এরই মধ্যে আর্থিক প্রতিষ্ঠানে কেলেঙ্কারিতে অভিযুক্ত। এ ছাড়া ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা কাজী ছাইদুর রহমান, আবু ফারাহ নাসের ও খুরশিদ আলমকে পদত্যাগে বাধ্য করেছেন।
শুধু ডেপুটি গভর্নররাই নন, এই তালিকায় রয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ও বর্তমান অন্তত অর্ধশত নির্বাহী পরিচালক। ভয়াবহ লুটপাট, স্বেচ্ছাচারিতা আর জাতীয় নিরাপত্তা এবং রাষ্ট্রীয় স্বার্থবিরোধী কাজে জড়িয়ে পড়ায় সম্প্রতি ডেপুটি গর্ভনরের খুঁজে গঠিত সার্চ কমিটির কাছে অভিযোগ করেছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা।
তারা হলেন নির্বাহী পরিচালক দেবদুলাল রায়, মেজবাউল হক ও আনোয়ারুল ইসলাম। এ ছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বর্তমান নির্বাহী পরিচালকদের অন্তত অর্ধডজন কর্মকর্তা এস আলম ও সালমান এফ রহমানকে সহায়তা দিতে কাজ করেছেন।
বিগত সরকারের সময়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভূমিকা মূল্যায়ন করে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ডক্টর জাহিদ হোসেন বলেন, গত কয়েক বছর দেশের ব্যাংক খাতে যে অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক তার দায় এড়াতে পারে না। বিভিন্ন সময় কেন্দ্রীয় ব্যাংক সার্কুলার জারি করে অনিয়ম-দুর্নীতির বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করেছে। এটা খুবই দুঃখজনক। বাংলাদেশ ব্যাংক যদি চেষ্টা করত হয়তো অনেক অনিয়ম ঠেকাতে পারত। আবার অনেক ক্ষেত্রেই হয়তো রাজনৈতিক প্রভাব বা হস্তক্ষেপের কারণে অনিয়ম ঠেকাতে ব্যর্থ হতো। তার পরও বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা অনিয়ম ঠেকাতে চেয়েছিলেন কি না—সেটা গুরুত্বপূর্ণ।