নোবেলজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস আবারও বলেছেন, রাজনীতিতে জড়িত হওয়ার কোনো ইচ্ছে তার নেই। যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যম সিএনএনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তার এ মনোভাবের কথা জানান তিনি।
সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন সিএনএনের সাংবাদিক ক্রিস্টিয়ান আমানপোর। যুক্তরাষ্ট্রের স্থানীয় সময় গত সোমবার সেটি প্রচার করে সংবাদমাধ্যমটি।
আলাপচারিতার একপর্যায়ে ক্রিস্টিয়ান আমানপোর ড. ইউনূসকে প্রশ্ন করেন, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে ক্ষমতার জন্য হুমকি মনে করেন কি না?
জবাবে ড. ইউনূস বলেন, ‘আমি জানি না তিনি (শেখ হাসিনা) কী মনে করেন। কিন্তু আমি রাজনীতির মাঠে নেই, আমি রাজনীতির সঙ্গে জড়িত এমন কোনো তথ্যও নেই। একবার আমি সরকারপ্রধান হওয়ার আমন্ত্রণ পেয়েছিলাম। তবে সেটি প্রত্যাখ্যান করেছি। রাজনীতিতে জড়ানোর কোনো ইচ্ছা আমার নেই। আমি অনেকবার এসব কথা বলেছি এবং এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই।’
আলাপচারিতার শুরুতে ক্রিস্টিয়ান আমানপোর ড. ইউনূসকে তার বিরুদ্ধে বাংলাদেশ ওঠা আইনি অভিযোগগুলো নিয়ে প্রশ্ন করেন।
এ ছাড়া তিনি যে তার প্রতিষ্ঠানগুলো জোর করে দখলে নেওয়ার অভিযোগ করেছেন সে বিষয়েও প্রশ্ন করা হয় তাকে। ওই প্রশ্নের জবাবে ড. ইউনূস বলেন, ‘হ্যাঁ। ভয়াবহ সব ঘটনা ঘটছে। ৩৫ জনের একটি দল আমাদের ভবনে জোর করে ঢুকে পড়ে।
আমরা যে সামাজিক ব্যবসাগুলো তৈরি করেছিলাম, যার অনেকগুলো দেশের অন্যতম নেতৃস্থানীয় ব্যবসা, সেই ভবন থেকে পরিচালিত হয়। কী হচ্ছে সেখানে, এটা নিয়ে সবাই ভয় পাচ্ছিলেন, উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলেন। তারা তখন জানায় যে তারা গ্রামীণ ব্যাংক থেকে এসেছে। তারা কিছু কোম্পানির নিয়ন্ত্রণ নিচ্ছে। তাদের দাবি এগুলো গ্রামীণ ব্যাংকের মাধ্যমে তৈরি হয়েছে এবং এজন্য তারা এখন সেগুলো নিয়ন্ত্রণে নিচ্ছে এবং তারা এসব কোম্পানির ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব নিচ্ছে।’
এমনটা কেন হচ্ছে ক্রিস্টিয়ান আমানপোর এমন প্রশ্নের জবাবে ড. ইউনূস বলেন, ‘আপনার যদি কোনো দাবি থাকে, কোনো আইনি ইস্যু থাকে, তাহলে সেগুলো নিষ্পত্তি করার জন্য আপনি আদালতে যেতে পারেন। কিন্তু সেগুলোর জন্য আপনি হঠাৎ করে জোর করে কোনো ভবনে ঢুকে যেতে পারেন না এবং বলতে পারেন না যে এগুলো আমরা নিয়ে নিচ্ছি।’
অবশ্য তিনি জানান, বেদখল হওয়া প্রতিষ্ঠানগুলো আবার তারা নিয়ন্ত্রণে নিতে পেরেছেন। ড. ইউনূস বলেন, ‘আমরা সেগুলো ফিরে পেয়েছি। আমরা গত ১৫ ফেব্রুয়ারি একটি সংবাদ সম্মেলন করেছি। সেখানে আমরা আমাদের ভবনে দেশের সব গণ্যমাধ্যমকর্মীকে আসার অনুরোধ করি এবং কী ঘটছে সেগুলো বিস্তারিতভাবে জানাই। তারপর থেকে আমরা আমাদের ভবনের নিয়ন্ত্রণে আছি এবং তারা আর আসেনি।’
এরপর ক্রিস্টিয়ান আমানপোর তাকে প্রশ্ন করেন, তার বিরুদ্ধে চলমান মামলাগুলো নিয়ে। সেগুলো ভবিষ্যৎ কী সেই প্রশ্নও করেন। জবাবে ড. ইউনূস বলেন, ‘আমি এরই মধ্যে সাজাপ্রাপ্ত। যেকোনো সময় আমার জামিন বাতিল হতে পারে। তারা আমার জামিন বাড়াতে পারে, নয়তো আমার কিংবা আমার সঙ্গে আরও যারা অভিযুক্ত হয়েছেন তাদের সবাইকে জেলে দিতে পারে।
মার্চের ৩ তারিখে দুর্নীতি দমন কমিশনের করা নতুন একটি মামলা যেখানে আমাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আনা হয়েছে মানি লন্ডারিং ও আরও বেশ কিছু ইস্যুতে কার্যক্রম শুরু হতে যাচ্ছে। আমরা যদি পুরো প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাই, তাহলে ওই মামলায় আরও দীর্ঘ সময়ের কারাদণ্ডও দিতে পারে। আমরা জানি না এগুলো কবে শেষ হবে।’
তিনি বলেন, ‘এ নিয়ে দেশের ও দেশের বাইরের যেসব আইনজীবীর সঙ্গেই আলোচনা করেছি, তারা সবাই সম্মত হয়েছেন যে, এসব মামলার কোনো ভিত্তি নেই এবং তারা এ ধরনের কোনো মামলা এর আগে দেখেননি ও পরিচালনা করেননি। এটা এক ধরনের হয়রানি। এটা নিশ্চিত করা যে, আমি বা আমরা এ বার্তা পাচ্ছি, আমাদের ভালোভাবে নেওয়া হচ্ছে না।’
এ সময় বাংলাদেশ ছেড়ে যাবেন কি না এমন এক প্রশ্নের জবাবে ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘আমি অনেক বিদেশি বন্ধুর কাছ থেকে এই দেশ ছেড়ে তাদের দেশে চলে যাওয়ার আমন্ত্রণ পেয়েছি। তারা আমাকে সর্বাত্মক সহযোগিতা এবং আমার কাজ যাতে সারা বিশ্বে চলতে পারে তার সব ব্যবস্থা করে দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন। আমি যুক্তরাষ্ট্র থেকে দেশে ফিরে এগুলো শুরু করেছিলাম। যুক্তরাষ্ট্রের মিডল টেনেসি স্টেট ইউনিভার্সিটিতে আমি শিক্ষকতা করতাম। তারপর আমি বাংলাদেশে ফিরে আসি।
দেশে ফিরে আমি যা করেছি, তা সবই সাধারণ মানুষের জন্য। আমি দুর্ভিক্ষ দেখেছি, মানুষের বিভিন্ন সমস্যা দেখেছি। যে কারণে আমি চিন্তা করেছি গরিব মানুষ যেন উপকৃত হয়। এটাই আমার আকাক্সক্ষা, এটাই আমার জীবন। যার ফলে ক্ষুদ্র ঋণ এসেছে এবং বিশ্বে জনপ্রিয় হয়েছে। আমরা কথা বলছি একটা ব্যতিক্রমী সভ্যতা গড়ে তোলার। আজকের সভ্যতা একটি ভুল ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে।
আমরা বলছি, এ ভিত্তিটাকে নতুন করে নির্মাণ করতে চাই। আমরা এমন একটি সভ্যতা গড়ে তুলতে চাই, যেখানে আজকের সমস্যাগুলো থাকবে না। বর্তমান সভ্যতা একটি দুর্যোগ, আত্মবিনাশী সভ্যতা। ফলে মানুষ ক্ষুদ্র ঋণকে গ্রহণ করেছে এবং যুক্তরাষ্ট্রে এটি বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। যে কারণে গ্রামীণ আমেরিকা ৪ বিলিয়ন ডলার ঋণ দিতে পেরেছে।’
এ সময় ড. ইউনূসকে ক্ষুদ্র ঋণের নেতিবাচক প্রভাব নিয়েও প্রশ্ন করা হয়। জবাবে তিনি বলেন, “ক্ষুদ্র ঋণ সম্পর্কে ভুল ধারণার কারণে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে। আমরা সামাজিক ব্যবসা হিসেবে ক্ষুদ্র ঋণ তৈরি করেছি। আমরা ক্ষুদ্র ঋণের মাধ্যমে টাকা অর্জনের চিন্তা করিনি। আমরা গরিব মানুষকে সাহায্যের জন্য ক্ষুদ্র ঋণ এনেছি। কিছু মানুষ গরিবের কাছ থেকে টাকা উপার্জনের উপায় হিসেবে ক্ষুদ্র ঋণের ধারণাটি হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। তারা ‘লোন শার্ক পাথ’কে ব্যবহার করছে। উচ্চসুদসহ যে বিষয়গুলো শুনছেন এগুলো তাদের দিক থেকে আসছে।
কারণ, তারা টাকা আয়ের চিন্তা করছে। এটা ক্ষুদ্র ঋণের ভুল ধারণা। সঠিক ক্ষুদ্র ঋণের ধারণা হলো সামাজিক ব্যবসা। ক্ষুদ্র ঋণের মাধ্যমে টাকা উপার্জন করা নয়, যৎসামান্য যা নেওয়া হয় তা শুধুই প্রোগ্রাম পরিচালনার জন্য। এটুকুই। আপনি চ্যারিটি প্রোগ্রাম চালাতে চাইবেন না। আমরাও এটি পছন্দ করি না। চ্যারিটি প্রোগ্রাম দীর্ঘদিন পরিচালনা করা যায় না। যে কারণে টেকসই কিছুর প্রয়োজন। যে কারণে আমরা ক্ষুদ্র ঋণ নিয়ে এসেছি।
ক্ষুদ্র ঋণ নিয়ে আমরা আছি, কাজ করে যাচ্ছি এবং আমরা বেশ খুশি। কেননা আমরা সারা বিশ্ব থেকেই ব্যাপক সাড়া পাচ্ছি। তবে কোনো না কোনো কারণে আমার নিজের দেশে এটি সমস্যায় পড়েছে।”