।
লেখক: প্রশান্ত এবং রাজা অঙ্কুর
।
কলকাতায় সাত্ত্বিক পা রাখল তখন তিলোত্তমা সবে আলমোড়া ভাঙছে। চারপাশে লোকের ভিড়, এতো গাড়ি, অন্ধ, ভিখারি। কিছুটা থমকায় সাত্ত্বিক। ব্যাগে তার সামান্য জামাকাপড় আর রেজাল্ট আছে। মাধ্যমিক আর উচ্চমাধ্যমিকে ভালো রেজাল্ট করে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়বার ইচ্ছে তার। কোন বড়োলোকের কাছে কি কাজের জন্য বলবে নাকি…
কি করবে সাত্ত্বিক?
কি খাবে?
পড়াশুনা কিভাবে করবে?
কয়েকদিনের মধ্যে সাত্ত্বিকের কাছের টাকা শেষ হয়ে আসতে থাকে কিন্তু সে নিজের কোন গতি করতে পারেনা। রাতে ফুটপাতে মশার কামড়ের দাগ সারা গায়ে।
চোখের সামনে ভেসে ওঠে মাধ্যমিক আর উচ্চমাধ্যমিকে সে সাবডিভিশানে সেরা রেজাল্ট করেছিলো। চারপাশে সুনাম, প্রশংসা, পুরস্কার। ভালো মুহুর্তগুলো আচমকা সাদা-কালো রঙে মিশে গেল। অজান্তেই চোখের জল মুছল সাত্ত্বিক।
ধিরে ধিরে ফুটপাতের ভিখারি, মস্তানদের সাথেই মিশে যায় গ্রামের ছেলে সাত্ত্বিক। নিজেকে ভীষণ অশায় লাগে তার। শুয়ে শুয়ে অনেকদূরের সেই মাঠঘাট, ক্ষেতআল পেড়িয়ে মায়ের নিশ্চিন্ত কোলের কথা ভাবে সাত্ত্বিক। সাত্ত্বিক নিজেকে বোঝায়…
“ভাবনাই শত্রু। এটা কলকাতা শহর, এটা চেনাপরিসর নিজের ছোটবেলার গ্রাম নয়। এখানে অতীতের কথা ভাবলে আরও বেশী ব্যথা লাগবে আরও ধাক্কা খাবি। বাস্তব জীবনের এটা কাঁটা বিছানো পথ। সামনের দিকে তাকিয়ে শুধুই লড়াইয়ের জন্য নিজেকে প্রস্তুত কর সাত্ত্বিক। এটা তোর বাবা-মায়ের স্বপ্ন, তোর জীবনযুদ্ধের লড়াই। সাত্ত্বিক এটা তোর লড়াই, তোর আগামীর লড়াই।
মা কি ভালো আছে?
ওরা মায়ের কোন ক্ষতি করেনি তো?
মা খেয়েছো তো?
সাত্ত্বিক চোখ বুজলেও ব্যস্ত কলকাতা এখনও ঘুমায় নি। সারারাত রাস্তেয় গাড়ির আওয়াজ। রাতে ঘুম ভেঙে যাওয়াতে আকাশের চাঁদ দেখছিলো সাত্ত্বিক। মা এই একই চাঁদ দেখতে পাচ্ছে। আজ থেকে মায়ের সাথে এটাই তার যোগাযোগ করবার উপায়।
একলা বসে চুপটি করে আঁকছি মনের ছবিটা
এক পশলা বাদল ধুয়েই দিলো সেটা।
একলা আমি লিখছি বসে মনের মাঝের কবিতা
খামখেয়ালী মনটা আমার পালিয়ে গেলো সেই কোথা।
সাত্ত্বিক বাধ্যহয়ে এখন মুটেগিরি করে পেট চালানোর জন্য। আজ দেখতে পায় অনেক মানুষ এক ধর্ষিতা মহিলার জন্য প্ল্যাকার্ড নিয়ে মিটিং-মিছিল করছে।
আপনমনে হাসে সাত্ত্বিক। আজ সমাজ মহিলার জন্য রাস্তায় নেমেছে কিন্তু তারা কি কোন ছেলের ওপর হওয়া জুলুমের প্রতিবাদে সামিল হবে?
সমাজ প্রকাশ্যে মশকরা করবে। ‘কাপুরুষ’ তকমা জুটবে।
শুধুই কি ছেলেদের দোষ? আজ তার সাথে যা হয়েছে সেটা কি?
একটা ছেলে-মেয়ের ঘটনাতে দোষের ভাগীদার শুধুই ছেলেটা কারণ মেয়েটার কথাই শোনা হয়। ছেলেটার কথা কেউ শোনে না। ঠিক যেমন সারা গ্রামের লোক ঝিলিকের কথা বিশ্বাস করেছিলো। এইরকম কতো অসংখ্য ঝিলিক আর কতো সাত্ত্বিকের জীবন-ভবিষ্যত নষ্ট করছে তার হিসেব কে রাখছে?
আচমকা ফুটপাতে পা হড়কে পাশের গাড়িতে ধাক্কা লেগে পড়ে ব্যথা পায় সাত্ত্বিক।
“এই রাসকেল!!! ভিখারি দেখে চলতে পারিস না।”
গাড়ি থেকে যে নামল তাকে চড়া রোদ আর মাথা ঝিমঝিম করবার কারণে দেখতে পায়না সাত্ত্বিক। একটু সামলে নিয়ে উঠে দেখে তার থেকে বয়সে প্রায় দ্বিগুণ একজন সুপুরুষ-সুদর্শন মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। সেই পুরুষ সাত্ত্বিককে দেখে জিজ্ঞেস করে…
“এই তোমার নাম কি? বাড়ি কোথায়?”
“আমার নাম সাত্ত্বিক। বাড়ি ঝাড়গ্রাম।”
“ঝাড়গ্রাম থেকে এখানে কেন? সিনেমাতে নামার ইচ্ছে?”
“নাহ। আমি এসেছি নিজের স্বপ্ন পূরণ করতে। আমি এসেছি জীবনে দাঁড়াতে, বড় হতে।”
“তাই!!!”
“জানি কষ্টের কিন্তু চেষ্টা চালিয়ে যাবো।”
“জানি না পারবে কিনা। কিন্তু তোমার তো অনেকটাই লেগেছে। আমার সাথে এসো একটা ডাক্তারখানায় যাই।”
সেই লোকটার সাথে সাত্ত্বিক সেই দামী গাড়িতে ওঠে। কিছুটা জড়তা থাকলে তারা পাশের একটা হাসপাতালে যায় এবং ডাক্তার প্রিয়র আঘাতের জায়গা ড্রেসিং করে ব্যান্ডেজ করে দেয়। তারপরে সেই লোকটা জোর করে তাকে একটা খাবারের দোকানে যায়।
“তোমার বয়স কতো?”
“১৮।”
“কি পাশ করেছো?”
“উচ্চমাধ্যমিক। আমার রেজাল্ট ভালো।”
“পড়াশুনা করতে চাও?”
“হ্যাঁ কিন্তু সেটা কিভাবে সম্ভব?”
“আমার কথা অনুসারে চললে আমি তোমাকে এখানকার নামী কলেজে ভর্তি করে দেবো। তুমি আমার বাড়িতে থাকতে পারবে। আসলে আমি জীবনে খুব একা।”
“আমি রাজী স্যার।”
“স্যার নয়। আজ থেকে আমি তোমার পলাশদা।”
ফুটপাত থেকে নিজের সম্বল নিয়ে সেই পলাশদার সাথে তার প্রাসাদোপম বাড়িতে ঢুকে চমকে যায় সাত্ত্বিক। সে কি স্বপ্ন দেখছে নাকি এটা বাস্তব। বাড়ির মধ্যে দামী আসবাব, দেওয়াল জুড়ে দামী ছবি ইত্যাদি।
“ফুলকি!!!”
“হ্যাঁ দাদা?”
“তাড়াতাড়ি রান্না কর। খিদে পেয়েছে। এই রামদিন।”
“জি বাবু।”
“দোতালার ওপাশের ঘরটা পরিষ্কার করে দাও। আজ থেকে সাত্ত্বিক এখানে থাকবে। এখানে বস তুই।”
পলাশদা একটা সিগারেট ধরিয়ে সোফাতে বসে।
“এবার বল দেখি কি হয়েছিলো গ্রামে? তুই পালালি কেন?”
ফ্ল্যাশব্যাক
দুপুরবেলা সবে খেয়ে দাওয়াতে বসে গল্প করছে সাত্ত্বিক আর তার মা। মায়ের জন্য সাত্ত্বিক একটা শাড়ি কিনে এসেছে। মায়ের শাড়ি ছিঁড়ে গেলেও মা কিছু বলে না।
“বাবু, তুই আবার খামোখা এই শাড়ি আনলি কেন? আমি জানি ঈশ্বর তোকে যত্ন নিয়ে বানিয়েছেন। ঠাকুরের কাছে মানত করে তোকে কোলে পেয়েছি আমি…”
“কোথায় হারামি জানোয়ারটা…”
ঝিলিকের বাবার চিৎকারে সাত্ত্বিক আর তার মা তাকিয়ে দেখে সেখানে ঝিলিকের বাবা-মা-দাদার সাথে গ্রামের মাতব্বর আর অনেক মানুষ।
“কি হয়েছে মিত্তির মশাই?”
“কি হয়েছে জিজ্ঞেস করুন আপনার কুলাঙ্গারকে। আপনার ছেলে আমার মেয়ের সর্বনাশ করেছে। এবার কে বিয়ে করবে ওকে। ওকে তো গলায় দড়ি দিতে হবে।”
“আমি কি করেছি কাকু?”
“এই হারামি একদম চুপ। আমার বোনের সর্বনাশ করে এখন চোপা। সবাই ঠিক বলত জোয়ান ছেলের সাথে বাড়ির মেয়েকে না পাঠাতে।”
“ও দিদি। তোমার ছেলের জন্য আজ ঝিলিক পোয়াতি।”
সাত্ত্বিক হতবাক হয়ে যায়। পড়াশুনা, বাড়ি আর টিউশান বাদে সে কিছুতেই মাথা ঘামাত না। ঝিলিক তার সাথে গেলেও সে কোনদিন গায়ে পর্যন্ত হাত দেয়নি আর আজ এই অপবাদ। ঝিলিক নতুন কেনা মোবাইলে ফেসবুক আর ডেটিং অ্যাপ নিয়েই থাকত।
“ঝিলিক তুই তো ফেসবুকে তোর কোন সব নতুন বন্ধুদের ব্যাপারে দেখাতিস। কার সাথে কি করে এখন আমার…”
“শয়তান সেইদিন গ্রামের শেষে ওই পোড়ো বাড়িতে জোর করে। আমার এবার কি হবে।”
সাত্ত্বিককে তার মা ধরে নেয়। সাত্ত্বিকের চোখ দিয়ে জল পড়ছে।
“শালা ভদ্দরলোকের এই নমুনা…”
“ভাগ্যিস মেয়েকে দূরে পড়তে পাঠাইনি…”
বাবা মারা যাবার পড়ে অনেক কষ্ট করে মা তাকে পড়িয়েছে। আজ এই অপমান তার মায়ের। বিনা কারণে এই অপবাদের থেকে মরা ভালো ছিলো। শেষ পর্যন্ত একজন ছেলে পাগল মেয়ের কারণে…
“দাদা আমার কথা শোনো। ও অনলাইনে কতো বন্ধু…”
“একটা থাপ্পড়ে দাঁত ফেলে দেবো। পাপ করে এখন বোনের ঘাড়ে দোষ চাপাচ্ছিস। কিসের অনলাইনের বন্ধু রে।”
‘এই জন্য আমি তোকে পড়াশুনা শিখিয়েছি বাবু। এই আমার শিক্ষা?”
“আমাকে তুমি এই চিনলে মা?”
কান্নায় ভেঙে পড়ে সাত্ত্বিক।
“একজন মেয়ে জানে তার গর্ভের সন্তানের বাবা কে আর সে কোনদিন মিথ্যে বলতে পারে না। সেইদিন ঝিলিককে কলেজ যাবার কথা জিজ্ঞেস করতে গিয়ে ও গায়ে হাত দিয়েছিলো আমি আসতেই। ও ঠাকুর আমার কি হবে!!!”
গ্রামের লোকেরা সাত্ত্বিককে মারতে থাকে কিন্তু সে কিছুই স্বীকার করেনা।
“মেরে ফেলো আমার ছেলেকে। আমার দরকার নেই ওই ছেলের।”
বাড়ির দাওয়াতে সাত্ত্বিকের মায়ের চোখের জল কোন বাধা মানছিলো না।
“একটা কথা। আজই এই ছেলের সাথে অভাগী ঝিলিকের বিয়ে দিতে হবে। এই পাপ এই কলঙ্ক নিয়ে বিয়ে না হলে ঝিলিককে গলায় দড়ি দিতে হবে। এই সবাই জোগাড়যন্ত্র কর।”
জানি অনেকটা দূর…
কিন্তু গোধূলির লালিমায় মুখ কালো করা এই পৃথিবী
সামনে দেখল পড়ন্ত দিবাকরের লাল মুখ।
দহনজ্বালায় দগ্ধ দুইজনেই।
ডুবে গেলে আর কি কাজ?
রাতের সুর্য কি মৃত?
চাঁদ সবটাই অবগত বলেই
হাসিমুখে নিস্তব্ধতার মোহ ছড়ায় সে।
“কিন্তু সাত্ত্বিক তুই মানে তোর মনের মধ্যে তখন কি চলছিলো?”
“একসাথে অনেক প্রশ্ন জমা হয়েছিলো। কেন ঝিলিকের সাথে একসাথে যেতাম? কেন ওকে বিভিন্ন বিষয়ে সাহায্য করতাম? কেন কেন?”
“না করলে হয়ত তোর দেখা স্বপ্নগুলো পূরণ হতো।”
“সেটাই। বাইরে কলাগাছ বেঁধে মন্ডপ হয়েছে। ঝিলিককে শাড়িতে সাজাচ্ছে ওর বাড়ির লোক। আমি ভাবছি একা ঘরের মধ্যে বসে বিয়ে করে কি করে কিভাবে সংসার চালাব? আমার কাছে ঝিলিক ছোটবেলার বন্ধু আর কিছু না। আমার ওকে একটু পাগলপাগল মনে হতো।”
“আর নেটদুনিয়া হাতের কাছে চলে এলে যৌনতা অবাধ। অবশ্যে সেটা ছেলে-মেয়ের দুইজনের।”
“জানি না কারণ আমার সামর্থ ছিলো না ওই ফোন কেনার।”
“আচ্ছা শেষপর্যন্ত কি হলো।”
“সন্ধ্যের পরে মা আমার ঘরে এলো আমাকে পাঞ্জাবী পড়াবে বলে।”
ফ্ল্যাশব্যাক
“তোর বাবা আমার দেখা স্বপ্ন মিথ্যে বাবু?”
“আমাকে বিশ্বাস করো মা…”
“ওরে তোকে আমি পেটে ধরেছি। আমি চিনব না তোকে। আমি জানি তুই এটা করতে পারিস না। ঝিলিক মিথ্যে বলছে।”
“আমি পড়াশুনা করে বড় হতে চাই…”
“এই বাবু হেরে গেলে চলবে না। তোর বাবা মারা যাবার পড়ে আমি দাঁতে দাঁত চিপে লড়াই করে তোকে মানুষ করেছি এবার তোর পালা।”
“মা!!!”
“এই তুই পড়াশুনা করেছিস। একবার ভাব দেখি সুভাস বোস কিভাবে পালিয়েছিলেন সবার চোখের ধুলো দিয়ে কিংবা রাসবিহারী বসু। তোর পড়া শুনে আমি জেনেছি আর তুই শিখিস নি বাবু? তোরা আজকের প্রজন্ম যদি ওদের দেখানো পথে অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই না করতে পারিস তাহলে কি শিখলি?”
মাকে জড়িয়ে কাঁদতে থাকে সাত্ত্বিক।
রাতের ঝড়ে থমকে গিয়েছে
ছন্ধারা মুখ
ভোরের চোখে আলো মেখে
সকালবেলার সুখ।
“শোন সাত্ত্বিক। আমি তোকে এখানকার ভালো কলেজে ভর্তি করে দেবো। তোর দুরন্ত রেজাল্ট সমস্যা হবে না। তোকে বড় হতে হবে, আরও চটপটে আর স্মার্ট হতে হবে। তোকে লড়াইতে জিততে হবে।”
“ধন্যবাদ পলাশদা।”
স্নান করে সাজানো পোশাক পড়ে নিচে এসে দেখে হরেক রকম খাবার। গোগ্রাসে দুই-তিন গ্রাস খাবার পড়ে আচমকা মায়ের মুখ মনে পড়ে সাত্ত্বিকের।
মা কি করছে?
মা খেয়েছে?
নাকি চিন্তায় পাথর?
মাকে ফোন করার উপায় নেই। মা আসার আগে বলেছিলেন পায়ের তলার মাটি শক্ত করে মাকে নিয়ে আসার কথা।
কিন্তু সেটা তো কয়েক বছর। তাহলে কি সময়ে সে মায়ের কোন খোঁজ পাবে না। সাত্ত্বিক মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল পলাশদার সাহায্যে সে লেখাপড়া করবে। পড়াশুনা শেষ করে এই দাদার সাহায্যে সে ভালো চাকরি পেয়ে সেই মনখারাপের গ্রাম থেকে তার মাকে নিয়ে আসবে।
।