কয়লার ময়লা পানিতে তাদের জীবিকা

রংপুর বিভাগীয় প্রতিনিধি: কয়লার ময়লায় থেকেই তাদের জীবিকার উৎস। বাঁচার জন্য জীবনের ঝুঁকি নিয়েই কয়লার ময়লা পানিতে তারা জীবিকার সন্ধানে নেমেছেন। এলাকার নারীদের কয়লার ডাস্ট খুঁজার দৃশ্য দেখলে যে কোন স্বাস্থ্য সচেতন মানুষের গাঁ শিউরে উঠবে। দিনাজপুরের পার্বতীপুর বড়পুকুরিয়া কয়লা খনির পাশ দিয়ে বয়ে গেছে নালা। পাশ দিয়ে যেতই চোখ পড়ে কিছু নারী নালায় নেমে কিছু খুঁজছেন। কাছে এগিয়ে যেতেই দেখা যায়, নালার পানিতে নেট দিয়ে কালো সোনা খ্যাত কয়লার ডাস্ট খুঁজছেন তাঁরা। ঠিক যেন প্রবাদের মতো, যেখানে দেখিবে ছাই উড়াইয়া দেখ তাই, পাইলেও পাইতে পার অমূল্য রতন। কয়লা খনির ময়লাযুক্ত পানি নিস্কাশনের জন্য এটি নালা। সেখানে নিজেদের তৈরি নেটের হালচা বানিয়ে ভাসমান কয়লার ডাস্ট সংগ্রহ করেন কয়েকজন নারী। খনির ভূ-গর্ভ থেকে কয়লা উত্তোলন এবং শোধনের পর অবশিষ্ট ময়লা পানি পা¤েপর মাধ্যমে ভূ-পৃষ্ঠে নালার মাধ্যমে খনির বাইরে অপসারণ করা হয়। ওই নালার পানিতেই দীর্ঘ সময় ধরে খুঁজে যতটুকু কয়লার ডাস্ট পান তা রোদে শুকিয়ে বিক্রি করে চলে তাদের সংসার। ঝড়-বৃষ্টি কিংবা হিম শীতের মধ্যেও তাদের ওই ময়লাযুক্ত পানিতে নেমে কয়লার ডাস্ট খুঁজতে হয়। এ যেন তাদের জীবন সংগ্রামের একটি অন্য অধ্যায়। চৌহাটি গ্রামের ফেরদৌসী বলেন, আশপাশের কয়েকটি গ্রামের ১২০ জন নারী মিলে সমবায় ভিত্তিক তারা এই কাজ করেন। দীর্ঘ ১৫ থেকে ১৬ বছর ধরে তাঁরা এই কাজ করছেন। ১২০ জনের মধ্যে ১২ থেকে ১৬ জন করে মোট আটটি দলে বিভক্ত হয়ে দিনে ও রাতে পালাক্রমে তাঁরা ময়লা পানিতে নেমে কয়লার ডাস্ট সংগ্রহ করেন। প্রতিটি দল সপ্তাহে একদিন করে কয়লা সংগ্রহের সুযোগ পায়। টানা ২৪ ঘণ্টা সময় থাকে কয়লা সংগ্রহের জন্য। এ সময় তারা ওই পানিতে থাকেন। তবে ২৪ ঘণ্টার মধ্যেও দুটি দলে ভাগ হয়ে একদল দিনে আর এক দল রাতে কয়লা সংগ্রহ করেন। তাঁরা আরও বলেন, খনিতে মাটির নিচ থেকে কয়লা তুললে এবং মেশিন চললে ড্রেন দিয়ে একটু বেশি পরিমাণে কয়লা আসে। কখনো কম কয়লাও আসে। ভাগ্য ভালো হলে প্রতিটি দল কোনো দিন ৭ থেকে ৮ মণ আবার কোনো দিন ১০ থেকে ১২ মণ কয়লাও পেয়ে থাকে। সংগৃহীত কয়লা ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা মণ দরে বিক্রি করেন। এসব কয়লা ইটভাটা চালুর সময় একটু বেশি দামে অর্থাৎ ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা দরে প্রতি মণ বিক্রি হয়। এতে প্রতিটি দলের সদস্য জনপ্রতি দিনে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা আয় করে। দলগত কাজ করায় একেক জন মাসে তিন দিন কয়লা সংগ্রহ করতে পারেন। কয়লা সংগ্রহকারী জেসমিন বলেন, যেদিন পানিতে নেমে কাজ করি, সেদিন সকাল সকাল রান্না করি। খেয়ে এসে সকাল ১১টার দিকে পানিতে নেমে পড়ি। বাড়িতে স্বামী সন্তানরা নিজের মতো খেয়ে নেয়। অভাবের কারণে এই পানিতে নেমে কাজ করতে হচ্ছে। তবে দুঃখের বিষয় হলো কয়লা খনির পাশের গ্রামের মানুষ হয়েও আমাদের স্বামী সন্তানরা এই খনিতে চাকরি পাইনি। বাইরের লোকজন এখানে চাকরি করছে। খনিতে তো অনেক রকমের কাজ থাকে। আমরা যারা স্থানীয় আছি তাদের কাজ দিলে ভালো হতো। মনোয়ারা বেগম বলেন, ১৬ বছর ধরে খনির নালা থেকে কয়লা সংগ্রহ করছি। এই কালো পানিতে নেমে কয়লা তুলে বিক্রি করে যে টাকা পাই এতে কোনো মতে সংসার চলে। কয়লা খনিতে তো কাজ পাইনি। আমার ছেলে বা নাতির কারও কাজ হয়নি। বাধ্য হয়েই এই কাজ করতে হয়। ভাগ্য ভালো হলে কয়লা একটু বেশি পাই। এমনও হয় কোনো কোনো দিন কয়লা তেমন পাই না। খালি হাতে ফিরে যেতে হয়। চৌহাটি গ্রামের মরিয়ম বলেন, নেট সেলাই করে নালার পিলারের সঙ্গে বেঁধে রাখি। পানির সঙ্গে কয়লার ময়লা ভেসে যাওয়ার সময় সেগুলো নেটে আটকা পড়ে। মাঝে মাঝে বাঁশের মাথায় লোহার তৈরি বিশেষ অস্ত্র দিয়ে নালার পানিতে থাকা ময়লা কাটি। এভাবে সবাই মিলে দল বেঁধে কাজ করা হয়। যেদিন যেমন কয়লা পাই সেগুলো বিক্রি করে সমানভাবে ভাগ করে নেওয়া হয়।

Exit mobile version