চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে বেসরকারি বিএম কনটেইনার ডিপোতে সেদিন অগ্নিদুর্ঘটনার সময় কৌতূহলবশত ঘটনাস্থলে জড়ো হয়েছিলেন অনেকেই। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া বিভিন্ন ছবিতে দেখা যায়, আগুন লাগার পরে সেখানে কয়েকশ’ মানুষের ভিড় জমেছিল। যারা বিপজ্জনক ওই আগুনের খুব কাছেই অবস্থান করে প্রত্যক্ষ করছিলেন। এর বেশ কিছুক্ষণ পরে যে ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটে, তাতে ঝরে যেতে পারতো আরও শত প্রাণ। কিন্তু তাদের তাৎক্ষণিক সরিয়ে দিয়েছিলেন পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসকর্মীরা। আর উৎসুক এই জনতাকে সরিয়ে দিতে গিয়ে ‘বিপজ্জনক অবস্থানে চলে যেতে হয়েছিল’ পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস সদস্যদের। পরে বিস্ফোরণে পা বিচ্ছিন্ন হয়েছে এক পুলিশ সদস্যের, প্রাণ গেছে ৯ ফায়ারম্যানের।
সোমবার (৬ জুন) ঢাকার শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন রোগীদের দেখতে আসা স্বজনরা আহতদের বরাত দিয়ে এমন দাবি করেছেন। তারা বলছেন, সেদিন পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসকর্মীরা সরিয়ে না দিলে লাশের সারি হয়তো আরও বাড়তো। এমনকি আড়াই থেকে তিনশো মানুষের তাজা প্রাণ ঝরে যেতে পারতো!
সীতাকুণ্ডের ঘটনায় অগ্নিদগ্ধ ১৬ জনকে এখন পর্যন্ত রাজধানীর বার্ন ইনস্টিটিউটে আনা হয়েছে। এর মধ্যে দগ্ধ না হওয়ায় একজনকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। বাকি ১৫ জন বর্তমানে বার্ন ইনস্টিটিটিউটে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। তদের মধ্যে চার জন ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট বা আইসিইউতে এবং ১১ জন পোস্ট অপারেটিং ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন।
বার্ন ইনস্টিটিউটে চিকিৎসা নেওয়া আহতদের মধ্যে পা বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া ইনডাস্ট্রিয়াল পুলিশের এসআই কামরুল হাসানও রয়েছেন। তার শারীরিক অবস্থা গুরুতর হওয়ায় চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় আনা হয়। খবর পেয়ে কিশোরগঞ্জ থেকে ছুটে আসেন তার ভাই নেয়ামত উল্লাহ জিসান।
বার্ন ইনস্টিটিটিউটের বারান্দায় বসে তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে এসআই কামরুলের মুখে শোনা অগ্নিকাণ্ড ও বিস্ফোরণের ঘটনার বর্ণনা দিচ্ছিলেন। এ সময় জিসান জানান, দুর্ঘটনার খবর পেয়ে টিম নিয়ে দ্রুত ঘটনাস্থলে গিয়ে উৎসুক জনতাকে নিরাপদ দূরত্বে সরিয়ে নেওয়া এবং উদ্ধার কাজ শুরু করেন এসআই কামরুল। ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরাও সেখানে পৌঁছে আগুন নেভানোর চেষ্টা চালান। এমন সময় বিকট শব্দে বিস্ফোরণ ঘটলে আগুনের লেলিহান শিখা ভয়াবহ রূপ নেয়।
এসআই কামরুলের বরাত দিয়ে জিসান বলেন, উৎসুক জনতাকে ঘটনাস্থল থেকে দূরে সরানোর চেষ্টা করছিল পুলিশ সদস্যরা। এ সময় বিস্ফোরণ হলে কেমিক্যালমাখা কিছু একটা এসে কামরুলের পায়ে আঘাত করলে মুহূর্তেই অঙ্গটি শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। কাছে থাকা একজন কনেস্টবল এগিয়ে এসে তাকে উদ্ধার করে নিরাপদ দূরত্বে নিয়ে ১১টা ২০ মিনিটের দিকে আমাকে কল করে ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলিয়ে দেন।
কামরুলকে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজে (চমেক) নেওয়ার খবর পেয়ে কিশোরগঞ্জ থেকে রওনা হন জিসান। পথিমধ্যে নরসিংদী আসার পর জানাতে পারেন, কামরুলকে ঢাকার পুলিশ লাইন্স হাসপাতালে নেওয়া হচ্ছে। ঢাকায় আসার পথে জানতে পারেন, সেখান থেকে বার্ন ইনস্টিটিউটে স্থানান্তর করা হয়েছে তার ভাইকে। এখন এখানেই চিকিৎসাধীন রয়েছেন তিনি, মঙ্গলবার তার অপারেশন হওয়ার কথা।
ভাইয়ের সঙ্গে আলাপের বরাত দিয়ে জিসান আরও বলেন, প্রথমে আগুন লাগলে তা দেখতে বিপুল সংখ্যক মানুষ জড়ো হন। তাদের পুলিশ দূরে সরিয়ে না দিলে পরবর্তী সময়ে ঘটা বিস্ফোরণে আরও অনেক মানুষ হতাহত হওয়ার আশঙ্কা ছিল। এমনকি এই সংখ্যাটা ৩০০ থেকে ৪০০ হতে পারতো!
শনিবারের (৪ জুন) সীতাকুণ্ডের আগুন নেভানোর ক্ষেত্রে সামনের সারিতে থেকে কাজ করা ফায়ার সার্ভিসের ৯ জন কর্মী জীবন দিয়েছেন। আহত হয়েছেন আরও কয়েকজন। পরিস্থিতি সামাল দিতে গিয়ে গুরুতর জখম হয়েছেন একাধিক পুলিশ সদস্য। হতাহতের তালিকায় সবার উপরে রয়েছেন খেটে খাওয়া শ্রমিকরা।
গুরুতর আহত দুই জন ফায়ারম্যান বার্ন ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। তারা হলেন- গাউসুল আজম ও রবিন, দুজনই বিবাহিত। তাদের একজন লাইফ সাপোর্টে এবং অন্যজন আইসিইউতে আছেন।
এই দুই ফায়ার সার্ভিসকর্মীর স্বজনরাও খবর পেয়ে বার্ন ইনস্টিটিউটে ছুটে এসেছেন। তাদের সঙ্গেও কথা হয় বাংলা ট্রিবিউনের। গাউসুল আজমের বাবা আজগর আলী বলেন, ‘দূর থেকে একবার দেখেছি ছেলেকে। ছেলের অগ্নিদগ্ধ হওয়ার খবরে পুরো পরিবার ভেঙে পড়েছে। সাতক্ষীরায় গ্রামের বাড়িতে জানানো হয়েছে, ছেলে ভালো আছে। গাউসুলের ৫ মাস বয়সী একটি সন্তান রয়েছে।’
আরেক ফায়ার সার্ভিসকর্মী রবিনের স্ত্রী বন্যা আক্তার বলেন, ‘একটি অপরিচিত মোবাইল নম্বর থেকে পাওয়া কলে স্বামীর অগ্নিদগ্ধ হওয়ার খবর পেয়েছি। এখানে ভর্তি হওয়ার কথা জানতে পেরে ছুটে এসেছি।’
প্রসঙ্গত, শনিবার (৪ জুন) রাত সোয়া ৯টার দিকে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের সোনাইছড়ি ইউনিয়নের কেশবপুর এলাকায় বিএম কনটেইনার ডিপোতে আগুন লাগে। সংশ্লিষ্টরা জানান, রাতে একটি কনটেইনারে আগুন লাগে। পরে সেটি বিকট শব্দে বিস্ফোরণ ঘটে। এতে আগুন ডিপোর বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে।
আগুন নেভানোর চেষ্টার মধ্যে ঘণ্টা দুয়েক পর রাসায়নিকভর্তি কনটেইনারে বিস্ফোরণ ঘটে। এতে নিহত হন ৪১ জন। আহত হন আড়াই শতাধিক মানুষ। নিহতদের মধ্যে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরাও রয়েছেন। যার মধ্যে ২২ জনের লাশ হস্তান্তর করা হয়েছে। বাকিদের পরিচয় নিশ্চিত হতে ডিএনএ টেস্ট করছে সিআইডি।