ডেটাবেইজের আওতায় আসছে তৃতীয় লিঙ্গ

রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তিদের হাতে নানা ধরনের নাজেহালের শিকার হচ্ছে সাধারণ মানুষ। বিষয়টি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার পর টনক নড়েছে পুলিশের ঊর্ধ্বতনদের। সম্প্রতি ডিএমপির এক চিঠিতে তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তিদের নাম ঠিকানা, মোবাইল নম্বর ও ছবিসহ তথ্য সংগ্রহে ১৩ নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। প্রাথমিক পর্যায়ে সতর্কতা না মানলে নিয়মিত মামলা দেয়ার নির্দেশ রয়েছে ওই চিঠিতে। এমন পরিস্থিতিতে গত কয়েকদিন ধরে ঢাকার কোথাও তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তিদের উপস্থিতি লক্ষ করা যায়নি। ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনারের নির্দেশনা সংবলিত ওই চিঠি রয়েছে নয়া শতাব্দীর হাতে।

জানতে চাইলে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার ড. খন্দকার মুহিদ উদ্দিন বলেন, আমরা তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তিদের সন্মান করি। কিন্তু কিছু রূপান্তরিত ও তৃতীয় লিঙ্গের কিছু অসাধু ব্যক্তিদের হাতে প্রায়ই সাধারণ মানুষের নাজেহালের খবর পাওয়া যাচ্ছে। এ কারণে ডিএমপির পক্ষ থেকে কিছু উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এতে প্রকৃত তৃতীয় লিঙ্গ এবং নকল ব্যক্তিরা চিহ্নিত হবে। এতে করে সাধারণ মানুষ ও প্রকৃত তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তিরা উপকৃত হবেন। মূলত সাধারণ জনগণের ভোগান্তি লাঘবেই এ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। জানা গেছে, গত ২৬ ফেব্রুয়ারি ডিএমপির সদর দফতরের (৩য় তলা) সম্মেলন কক্ষে অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনারের (ক্রাইম অ্যান্ড অপস), সভাপতিত্বে একটি বিশেষ সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় কার্যবিবরণীর ক্রমিক নং ৬ এ বর্ণিত তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তিদের সংক্রান্তে নিম্ন বর্ণিত নির্দেশনা প্রদান করা হয়। যার স্মারক নং ডিএমপি(সঃদঃ)/অপরাধ/প্রশাসন/২০২৩ / ২৩৬৬ (৮)। অতিরিক্ত কমিশনারের (ক্রাইম) পক্ষে শচীন চাকমা এ চিঠি পাঠান।

চিঠিতে বলা হয়, ঢাকা মহানগরীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মোড়সহ বিভিন্ন আবাসিক এলাকায় তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তিদের উৎপাত বেড়ে গেছে। এতে করে সম্মানিত নগরবাসী বিভিন্ন সময়ে বিব্রতকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হন। এ রকম পরিস্থিতি হতে উত্তরণের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। প্রাথমিক পর্যায়ে ডিএমপির সব অপরাধ বিভাগ তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তিদের উৎপাত রয়েছে সেখানে তাদের কার্যক্রম বন্ধ করতে সতর্ক করা। সতর্ককরণের পরেও যদি তারা একই কার্যক্রম চলমান রাখে তবে তাদেরকে আইনের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। প্রয়োজনে নিয়মিত মামলা রুজু করতে হবে। একই সঙ্গে ১৩ ধরনের তথ্য চেয়ে গত ৭ মার্চের মধ্যে ডিএমপির ই-মেইলে অথবা হার্ডকপি বিশেষ বাহক মারফত অত্রাফিসে পাঠানোর জন্য অনুরোধ করা হয়। কিন্তু ৭ মার্চের মধ্যে তাদের তালিকা পাঠানো সম্ভব হয়নি।

খবর নিয়ে জানা গেছে, ওই চিঠি পাওয়ার পর বিভিন্ন এলাকার তৃতীয় লিঙ্গের নেতাদের নিয়ে বৈঠকে বসেন ওসিরা। এ সময় তাদের নির্দেশনা জানানোর পর তারা রাস্তা থেকে তাদের লোকজনকে সরিয়ে নেয়ার আশ্বাস দেন। একই সঙ্গে তারা প্রকৃত লিঙ্গের ব্যক্তিদের একটি তালিকা দেয়ার প্রতিশ্রতি দেন। সে অনুযায়ী কাজ চলছে বলে একটি সূত্র দাবি করে।

তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানার ওসি মাজহারুল ইসলাম জানান, চিঠি পাওয়ার পর তারা তৃতীয় লিঙ্গের গুরুমাদের নিয়ে বৈঠক করেন। এ সময় তারা পুলিশকে সর্বাত্মক সহযোগিতার আশ্বাস দেন। সে অনুযায়ী তারা ছবিসহ তালিকা প্রস্তুত করছেন। আশা করা যাচ্ছে দ্রুতই তারা ডিএমপি কমিশনারের কাছে পৌঁছানো সম্ভব হবে।

জানতে চাইলে তেজগাঁও, মিরপুর ও বনানী এলাকার গুরুমা রাখি সাগরিকা নয়া শতাব্দীকে জানান, প্রকৃত তৃতীয় লিঙ্গের লোকজন কখনো সাধারণ মানুষকে হেনস্তা করে না। কিছু রূপান্তারিত লোকজন মাঠে নেমে প্রকৃত তৃতীয় লিঙ্গের লোকজনকে হেনস্তা করে আসছিল। বিশেষ করে তাদের অবস্থান কড়াইল বস্তিতে। প্রতিবাদ করতে গেলে উল্টো তাদের মারধর করা হয়।

রাখি বলেন, প্রকৃত তৃতীয় লিঙ্গের লোকজনকে শনাক্ত করা এটা তাদের দীর্ঘদিনের দাবি। তাদের দাবি পূরণ হওয়ায় এখন তারা খুনি। রাখি এ সময় বিশেষ ধন্যবাদ জানান ট্যুরিস্ট পুলিশের অতিরিক্ত আইজিপি হাবিবুর রহমানকে। কারণ ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি থাকা অবস্থায় হাবিবুর রহমান বেদে পল্লির ব্যক্তিদের জন্য অনেক কিছু করেছেন। এরপর তিনি তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তিদের স্বাবলম্বী করতে নানা ধরনের উদ্যোগ নেন। কয়েকটি বিউটি পারলারও করে দেন। কিন্তু রূপান্তারিত ব্যক্তি ও পুরুষ মানুষ হয়েও তৃতীয় লিঙ্গের বেশ ধরে রাস্তায় নামা ব্যক্তিদের কারণে হাবিবুর রহমানের উদ্যোগগুলো থেমে যায়। এখন প্রকৃত তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তিদের তালিকা হলে সেই উদ্যোগ আবারও গতি ফিরে পাবে বলে আসা প্রকাশ করেন রাখি সাগরিকা।

জানা গেছে, সম্প্রতি তৃতীয় লিঙ্গের বেশ ধরে রাস্তায় নেমে এক শ্রেণির ব্যক্তিরা সাধারণ মানুষকে নাজেহাল ও সন্মানহানি করে টাকা আদায় করে আসছিল। এ নিয়ে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ও সামাজিক মাধ্যমে আলোচনা সমালোচনার এক পর্যায়ে পুলিশের পক্ষ থেকে এ উদ্যোগ নেয়া হয়। ওই উদ্যোগে ১৩টি নির্দেশনা রয়েছে।

ওই নির্দেশনাগুলো মধ্যে, প্রথমে ক্রমিক নাম্বার দিয়ে শুরু করা হয়েছে। এরপর ডিএমপির বিভাগের নাম, পরে থানার নাম, এরপর গুরুত্বপূর্ণ স্পট ও মোড়ের অবস্থান, তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তির নাম ঠিকানা ও মোবাইল নাম্বার, এরপর স্পটের নেতার নাম, তাদের উৎপাতের ধরন, টার্গেটের ধরন, এরপর প্রকৃত তৃতীয় লিঙ্গ না রূপান্তারিত, যদি রূপান্তরিত হয়ে থাকে তাহলে কোনো প্রতিষ্ঠানের মাধ্যেমে এবং সেই প্রতিষ্ঠানের নাম, তাদের সঙ্গে অন্য কোনো স্বার্থান্বেসী মহল জড়িত কিনা এবং তাদের পরিচয় বা ঠিকানা মোবাইল ফোন নাম্বার, তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তির ছবি ও সর্বশেষ মন্তব্য লিখে জমা দেওয়ার নির্দেশনা রয়েছে ওই চিঠিতে।

ডিএমপির পক্ষ থেকে ওই চিঠি পাওয়ার পর রাস্তায় থাকা তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তিদের থানার ওসিরা প্রাথমিকভাবে সকর্ত করেন। এরপর থেকে তাদের আর সড়কে দেখা যায়নি। সরজমিনে, গত দুদিন রাজধানীর মিরপুর-২,১০ এবং বনানী এবং বিশ্বরোড এলাকায় তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তিদের দেখা মেলেনি। তবে ছবিসহ তালিকা ডিএমপি কমিশনারের কাছে যাওয়ার পর তাদের একটি পরিচয়পত্র দেওয়া হতে পারে বলে একটি সূত্র দাবি করে। ওই পরিচয়পত্র নিয়ে তারা সাধারণ মানুষের কাছে সহযোগিতা চাইতে পারবে। তবে কোনো ব্যক্তি যদি নাজেহালের অভিযোগ করে তাহলে তাৎক্ষণিক তাকে আইনের আওতায় আনা হবে বলে ডিএমপির একটি সূত্র দাবি করেছে। যদিও এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো মন্তব্য করতে কেউ রাজি হয়নি।

Exit mobile version