রংপুর বিভাগীয় প্রতিনিধি: এক সময় রংপুর অঞ্চলের মানুষের জীবিকারস্থল থাকলেও এখন তিস্তা নদী দুঃখের এক নাম। পানির প্রবাহ, পাল ঊঠানো নৌকা, মাঝির কণ্ঠে ভাটিয়ালি গান, জেলের জালে উঠতো প্রচুর মাছ। এসব মিলেই নদীর তীরবর্তী মানুষের জীবিকার প্রধান উৎস ছিল তিস্তা নদী। সুখে শান্তি চলতো তাদের সংসার। চেখে মুখে ছিল তাদের সুখের হাসি। নেই আর তাদের সেই হাসি, নেই আর তাদের সেই তিস্তা নদী। সেই তিস্তা নদী এখন তাদের কাছে শুধু স্মৃতি। প্রতিবেশি দেশ ভারতের নির্মাণ করা বাঁধের কারণে শুষ্ক মৌসুমে তিস্তা নদীতে থাকে না পানি। আর বর্ষায় মাত্রাতিরক্ত পানি। এতে করে দেখা দেয় বন্যা। পাশাপাশি ভাঙন তো রয়েছে। তিস্তা পাড়ের মানুষদের দুঃখ ও দুর্দশার কথা শুনতে রংপুরের কাউনিয়ায় এসেছিলেন অন্তর্বর্তীকালিন সরকারের বন, পরিবেশে ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান এবং যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া। তারা শুনেছেন তিস্তা পাড়ের মানুষের দুঃখ-দুর্দশার কথা। তাতে বা লাভ কি? গত কয়েক বছরে অনেকেই এসে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তবে কাজে কাজ কিছুই হয়নি। এমনকি যারা প্রায় ১৬ বছর শাসনের নামে দেশে শোষণ করেছেন, সেই পতিত সরকারের প্রধান শেখ হাসিনা রংপুরে এসে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য প্রতিশ্রুতি দিলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি। রংপুর অঞ্চলের মানুষ দীর্ঘদিন ধরে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করলেও কোনো লাভ হয়নি। ফলে রংপুর অঞ্চলের মানুষের প্রাণ তিস্তা শুকিয়ে বালুচরে পরিণত হয়েছে। বহুরূপী তিস্তা নদীর কারণে স্থানীয়রা হয়েছে নিঃস্ব। রংপুর অঞ্চলের মানুষের ভাগ্য উন্নয়নের তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে প্রকল্পের অপেক্ষায় রয়েছে মানুষ। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন কররে ভারত না চীন। এখনো তা মানুষের জানা নেই। তবে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ভারতের অর্থায়নের সম্ভাবনার বিষয়টি ক্ষীণ হয়ে এসেছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। অপরদিকে এই প্রকল্পে নিজেদের যুক্ত করার ক্ষেত্রে প্রত্যাশা জেগেছে চীনের। কেননা প্রথম পর্যায়ে এই প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রস্তাব দিয়েছিল চীন। পরবর্তীতে প্রস্তাব দেয় ভারত। তবে শেষ পর্যস্ত তৃতীয় কোনো উৎস থেকে অর্থায়নের সম্ভাবনাকেও উড়িয়ে দিচ্ছেন না সংশ্লিষ্টরা। একটি নির্ভরযোগ্য সুত্রে জানা যায়, তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে অর্থায়ন করতে আগ্রহী চীন। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে চীনের আগ্রহ থাকলেও ভারত চেয়েছিল এটি যেন ভারতকেই দেওয়া হয়। এ অবস্থায় পতিত আওয়ামী সরকার দুটি দেশের কাউকেই অখুশি করাতে না পেরে প্রকল্পটি ঝুলিয়ে দেয়। এখন চীন মনে করে তারা এটি বাস্তবায়নের দায়িত্ব পেতে পারে। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ভারতের বিরুপ আচরণের কারণে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে ভারতকে যুক্ত করার সম্ভাবনা কমেছে। তবে অর্থায়নের উৎস যেখান থেকে আসুক না কেন, রংপুর অঞ্চলের মানুষের জন্য এটি অপরিহার্য মহাপরিকল্পনা। জনস্বার্থে এ প্রকল্পের বাস্তবায়ন জরুরি। একটি সূত্রে জানা যায়, চীনের প্রস্তাবিত তিস্তা প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে বদলে যাবে উত্তরাঞ্চলের পাঁচ জেলার মানুষের ভাগ্য। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে শুষ্ক মৌসুমে পানির জন্য ভারতের দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে না। নদীর গভীরতা প্রায় ১০ মিটার বাড়বে। বন্যার পানি প্লাবিত হয়ে ভাসাবে না গ্রাম-গঞ্জের জনপদ। সারা বছর নৌ চলাচলের মতো পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থা রাখা যাবে। এতে রয়েছে ১০৮ কিলোমিটার নদী খনন, নদীর দুপাড়ে ১৭৩ কিলোমিটার তীর রক্ষা, চর খনন, নদীর দুই ধারে স্যাটেলাইট শহর নির্মাণ, বালু সরিয়ে কৃষিজমি উদ্ধার ও ১ লক্ষ ১৩ হাজার কোটি টাকার স¤পদ রক্ষা এবং প্রতি বছরে ২০ হাজার কোটি টাকার ফসল উৎপাদন। নৌ-বন্দর এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় দুই পাড়ে থানা, কোস্টগার্ড ও সেনাবাহিনীর জন্য ক্যা¤েপর ব্যবস্থার প্রস্তাবও রাখা হয়েছে প্রকল্পটিতে। জানা যায়, প্রায় ২৪০ বছরের পুরোনো নদী তিস্তা। এর সঙ্গে রয়েছে উত্তরের ২৫টি নদীর প্রবাহ। শুষ্ক মৌসুমে নদীটি একেবারেই শুকিয়ে যায়। নীলফামারী, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম জেলার রাজাহাট, উলিপুর, চিলমারী, রংপুরের গঙ্গাচড়া, কাউনিয়া ও পীরগাছা, গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার ওপর দিয়ে বয়ে গেছে নদীটি। তবে শুষ্ক মৌসুমে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলা। এ উপজেলার ৯টি ইউনিয়নের মধ্যে সাতটিই তিস্তা নদীবেষ্টিত। নদীশাসন না হওয়ায় গত পাঁচ বছরে গতিপথ পরিবর্তন হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলেন, তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হলে তিস্তা পাড় হয়ে উঠবে পূর্ব চীনের জিয়াংসু প্রদেশের সুকিয়ান সিটির মতো সুন্দর নগরী। চীনের হোয়াংহো নদীকে একসময় বলা হতো চীনের দুঃখ। প্রতি বছর ওই নদীর পানি ভাসিয়ে দিত শত শত মাইল জনপদ। ভেঙে নিয়ে যেত বহু গ্রাম.পথ-ঘাট ও জনপদ। সেই সর্বনাশা নদীশাসন করায় চীনের মানুষের দুঃখ ঘুচেছে। হোয়াংহো এখন হয়েছে চীনের কৃষকদের জন্য আশীর্বাদ। হোয়াংহোর মতোই এখন বাংলাদেশের রংপুর অঞ্চলের পাগলা নদী খ্যাত তিস্তা ড্রেজিং করে কোটি মানুষের দুঃখ ঘোচানো সম্ভব বলে মনে করছে বিশেষজ্ঞরা। একটি সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড এবং চীনের পাওয়ার কনস্ট্রাকশন কর্পোরেশন অব চায়না বা পাওয়ার চায়নার মধ্যে ২০১৬ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। মহাপরিকল্পনায় পূর্ব চীনের জিয়াংসু প্রদেশের সুকিয়ান সিটির আদলে তিস্তার দুই পাড়ে পরিকল্পিত স্যাটেলাইট শহর গড়ে তোলার প্রাথমিক প্রস্তাব করা হয়। সরকার চীনের সেই প্রস্তাবনার আলোকেই তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের কথা বলেছিল। গত বছর ভারত সফর করেন পতিত আওয়ামী সরকারের (সাবেক) প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ওই সময় দিল্লিতে এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেন, ভারত ও বাংলাদেশকে সংযুক্ত করেছে ৫৪টি নদী। বন্যা ব্যবস্থাপনা, আগাম সতর্কতা, পানীয় জলের প্রকল্পের ক্ষেত্রে আমরা সহযোগিতা করছি। ১৯৯৬ সালের গঙ্গা পানি চুক্তি নবায়নের বিষয়ে কারিগরি পর্যায়ের আলোচনা শুরুর সিদ্ধান্ত আমরা নিয়েছি। বাংলাদেশে তিস্তা নদীর সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার বিষয়ে আলোচনার জন্য একটি কারিগরি দল শিগগিরই বাংলাদেশ সফর করবে। এরপর সেই কারিগরি দলের আর আসা হয়নি। রংপুর অঞ্চলের মানুষের দাবি দ্রুত তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে তিস্তা নদীর হারানো যৌবন ফিরে আনতে হবে।
তিস্তা নদী এখন দুঃখের এক নাম
-
by admin
![](https://i0.wp.com/deshersangbad.com/wp-content/uploads/2025/02/Picture-2.jpg?fit=943%2C544&ssl=1)
- Categories: জাতীয়, বাংলাদেশ, ভারত/কলিকাতা
Related Content
ঢাবিতে আলাদাভাবে বিক্ষোভ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও ছাত্রদলের
by admin ১৮/০২/২০২৫
পার্বতীপুরে রেললাইনে হাত বাধা মাথা কাটা মরদেহ উদ্ধার
by admin ১৮/০২/২০২৫
সাংবাদিক দম্পতি শাকিল ও ফারজানা ৫ দিনের রিমান্ডে
by admin ১৭/০২/২০২৫
আদালতে ফারজানা রূপার প্রশ্ন হত্যা মামলা দিয়ে কেন সাংবাদিক হয়রানি
by admin ১৭/০২/২০২৫
প্রস্তুতি ম্যাচে টাইগারদের বেহাল দশা
by admin ১৭/০২/২০২৫
বিপিএলে টিকিট থেকে আয় ১৩ কোটি
by admin ১৭/০২/২০২৫