নীলফামারীতে ভাষাসৈনিকদের স্মৃতি স্মারক নেই

 

রংপুর বিভাগীয় প্রতিনিধি: মায়ের ভাষার অধিকার আদায়ে ১৯৫২ সালে আন্দোলনে নেমেছিল বাঙালি জাতি। সেই আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ে নীলফামারীর প্রগতিশীল ছাত্র,যুবক, শিক্ষক ও রাজনৈতিক কর্মীসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ। তবে এ আন্দোলনের ৭১ বছর পেরিয়ে গেলেও তাদের স্মৃতি রক্ষায় জেলায় কোনও স্মারক ও স্থাপনা নির্মাণ হয়নি। নতুন প্রজন্মের অনেকে ভাষাসৈনিকদের নাম ও পরিচয় জানে না। কিভাবে ভাষাসৈনিকদের পরিচয় জানবে নতুন প্রজন্ম, এমন প্রশ্ন সুশীল সমাজের। সুশীল সমাজের লোকজন ও স্থানীয়রা বলেন, ভাষা আন্দোলনের সময় সারা দেশের ন্যায় উত্তাল হয়ে উঠে ছিল উত্তরের জনপদ নীলফামারী। সে সময় আবু নাজেম মো. আলী, খয়রাত হোসেন, দবির উদ্দিন আহমেদ, সামছুল হক ও শফিয়ার রহমানের নেতৃত্বে ছাত্র-শিক্ষক ও জনতা ঝাঁপিয়ে পড়েছিল ভাষা সংগ্রামে। তাদের অনেকে বেঁচে নেই। ফেব্রুয়ারি মাস এলেই ভাষাসৈনিকদের স্মরণ করা হয়। কিছু কর্মসূচী পালিত করা হলেও আর কোনও আলোচনায় থাকেন না দেশের সূর্যসস্তানগণ। ফলে নতুন প্রজন্ম জানতে পারছে না, ভাষাসৈনিকদের অবদানের কথা। তাদের স্মরণীয় করে রাখতে স্থানীয় পর্যায়ে নেই কোনও উদ্যোগ। নেই কোনও মূল্যায়ন।প্রয়াত ভাষাসৈনিক সফিয়ার রহমানের ছেলে এনায়েতুর রহমান বলেন, মাতৃভাষা বাংলার জন্য বাবা কারাভোগ করেছিলেন, নির্যাতন সহ্য করেছিলেন। অথচ এখন তার কোনও মূল্যায়ন নেই। নতুন প্রজন্ম জানে না নীলফামারীর ভাষাসৈনিক কারা। তাদের স্মরণীয় করে রাখতে ভাষাসৈনিকদের নামে সড়ক, স্থাপনার নামকরণ এবং স্মৃতিস্মারক নির্মাণের দাবি জানাই। তাদের প্রাপ্ত সম্মানটুকু দেওয়ার অনুরোধ জানাই। তাহলে বাবাসহ ভাষাসৈনিকের আত্না শান্তি পাবে। প্রশাসনের কাছে অনুরোধ, ভাষাসৈনিকদের স্মৃতি রক্ষায় যাতে উদ্যোগ নেওয়া হয়।বাবা মৃত্যুর আট বছর পেরিয়ে গেলেও স্মৃতি স্মারক নির্মাণের উদ্যোগ নেয়নি স্থানীয় প্রশাসন এমন অভিযোগ করে এনায়েতুর রহমান বলেন, ফেব্রুয়ারি মাস এলেই শহীদ মিনার ধোয়া-মোছা ও ভাষাসৈনিকদের স্মরণ করা হয়। এরপর সারা বছর কেউ কোনও খবর রাখে না। জেলা শহরের সড়ক ও সরকারি স্থাপনা ভাষাসৈনিকদের নামে নামকরণের জন্য জেলা প্রশাসনের কাছে অনুরোধ জানাই। যাতে পরবর্তী প্রজন্ম ভাষাসৈনিকদের স¤পর্কে জানতে পারে, তাদের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের ইতিহাস মনে রাখতে পারে। জানা যায়, নীলফামারী জেলা শহরে ভাষাসৈনিক ও সাবেক মন্ত্রী খয়রাত হোসেনের নামে কেবল থানা পাড়ায় একটি সড়ক ও পৌরসভার একটি মার্কেটের নামকরণ করা হয়েছে। তবে এসব স্থাপনা এখন অন্য নামে চেনেন স্থানীয়রা। কারণ মার্কেটে নামফলক নেই। ফলে খয়রাত হোসেন মার্কেট নামে পরিচিতি না পেয়ে, তা পৌর মার্কেট নামে পরিচিতি পেয়েছে। বাকিদের নামে এখনও কোনও স্থাপনা নির্মাণ বা নামকরণ হয়নি। প্রয়াত ভাষাসৈনিক দবির উদ্দিন আহমেদের ভাতিজা আহসানুল করিম বলেন, দীর্ঘদিন আন্দোলন সংগ্রামের পর ভাষাসৈনিক খয়রাত হোসেনের নামে পৌর কর্তৃপক্ষ একটি সড়ক ও মার্কেট করেন। তাও আবার সেগুলো ভিন্ন নামে পরিচিতি পেয়েছে। অন্য ভাষাসৈনিকের নামে কোনও কিছুই নেই। ভাষার জন্য যারা সংগ্রাম করেছেন, তাদের স্মৃতি চিহ্নটুকুও নেই। প্রত্যেকের নামে অবকাঠামো ও সড়কের নামকরণ করা হোক। তা না হলে ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস পরবর্তী প্রজন্ম জানতে পারবে না। তবে দায়সারাভাবে শহীদ মিনারের পাশে পাঁচ ভাষাসৈনিকের নাম লিখে রাখা হয়েছে। নীলফামারী সরকারি মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর ওবায়দুর আনোয়ার বলেন, যদি ভাষাসৈনিকদের ছবিসহ স্মৃতি স্মারক নির্মাণ করা যেতো, তাহলে ছাত্রছাত্রী এমনকি শিশুরাও দেখে বলতে পারতো, ওই যে তিনি আমাদের ভাষাসৈনিক। দুর্ভাগ্য এত বছরেও তাদের স্মৃতি স্মারক নির্মাণ করা হয়নি। জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও পৌর মেয়র দেওয়ান কামাল আহমেদ বলেন ভাষাশহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য ২০১৫ সালে সাড়ে ১২ লক্ষ টাকা ব্যয়ে একটি শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয়েছে। সেই শহীদ মিনারে প্রতি বছর ২১ ফেব্রুয়ারি ও বিজয় দিবসসহ জাতীয় দিবসে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। প্রয়াত ভাষাসৈনিক খয়রাত হোসেনের নামে সড়ক ও মার্কেটের নামকরণ করা হয়েছে উল্লেখ করে মেয়র দেওয়ান কামাল বলেন, বাকি চার ভাষাসৈনিকের নামে শহরের বিভিন্ন সড়কের নামকরণের পরিকল্পনা রয়েছে। এ ছাড়া শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে অবকাঠামো এবং সড়কের নামকরণের পরিকল্পনাও আছে। স্থানীয় সংসদ সদস্যের সঙ্গে কথা বলে দ্রুত সময়ের মধ্যে তাদের নামে সড়ক ও স্থাপনার নামকরণ করা হবে। জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ স¤পাদক ও জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মমতাজুল হক বলেন, বাংলা ভাষাকে পৃথিবীর মানচিত্রে স্মরণীয় করে রেখেছেন ভাষাসৈনিকরা। ভাষা সংগ্রামের ৭১ বছর পেরিয়ে গেছে। কিন্তু শিশুরা কিভাবে জানবে, বাঙালি জাতির উপর বাংলা ভাষার পরিবর্তে উর্দু চাপিয়ে দিতে চেয়েছিল পাকিস্তানিরা। জেলা পরিষদের পক্ষে ভাষাসৈনিকদের স্মৃতি রক্ষায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। নীলফামারী সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জেসমিন নাহার বলেন, ভাষাসৈনিকদের ছবিসহ স্মৃতি স্মারক নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে। স্মৃতি স্মারক নির্মাণ হলে এ প্রজন্মের শিক্ষার্থীরা সহজে ভাষাসৈনিকদের চিনতে পারবে।

 

Exit mobile version