পদ্মা সেতুকেও হার মানিয়েছে ধলেশ্বরীর ছোট্ট ব্রিজ

মুন্সিগঞ্জ জেলার কেরানীগঞ্জের মোল্লাবাজার এলাকায় ধলেশ্বরীর শাখা নদীতে ২০১৮ সালে ২৫২ মিটার দৈর্ঘ্যের সেতুর কাজ যখন শুরু হয়, বেলাল হোসেনের বয়স তখন ২০ এর কোঠায়। বিয়ে-থা করেননি। বাবা-মা দুষ্টমি করে বলতেন, এই সেতুর ওপর দিয়ে একদিন তোর বউ নিয়ে আসবো ঘরে। সেই বেলাল এখন দুই সন্তানের পিতা। বউ ঘরে এনেছেন ঠিকই কিন্তু সেতুতে ওঠার সৌভ্যাগ্য বিগত ৭ বছরেও হয়নি তাদের। শুধু বেলাল নয়, অত্র অঞ্চলের অন্তত ৮-১০ লাখ মানুষের গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে এই সেতু। সেতু দেখে মরতে পারবো কি না, এরকম হতাশাও প্রকাশ করছেন এলাকার বয়বৃদ্ধরা।

কেউ কেউ আবার বলছেন, ঐতিহাসিক পদ্মা সেতুকেও হার মানিয়ে দিয়েছে এই ব্রিজ। সাত বছরে খড়স্রোতা পদ্মায় সেতু দাঁড়িয়ে গেলেও দীর্ঘ সময় ধরে ছোট্ট ধলেশ্বরীর বুকে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে কেবল কয়েকটি পিলার। সেতুর নির্মাণ কাজ কবে শেষ হবে তা নিয়ে স্পষ্ট কোনো বক্তব্য নেই কারো কাছে।

নির্মাণাধীন সেতুর পূর্ব পাশ দিয়ে ছোট একটি ফেরিতে মুন্সীগঞ্জ সদর, সিরাজদিখান, লৌহজং ও টঙ্গিবাড়ী উপজেলার মানুষেরা যাতায়াত করছেন। এর ফলে একদিকে যেমন নষ্ট হচ্ছে সময় আবার অপচয় হচ্ছে অতিরিক্ত অর্থ।

মুন্সীগঞ্জ থেকে মাত্র ৩০ মিনিটে যানজটবিহীন ঢাকা পৌঁছতে দু’টি জেলার সীমান্ত এলাকা ঢাকার কেরানীগঞ্জের মোল্লাবাজারস্থ ধলেশ্বরীর শাখা নদী। এই সেতুটি নির্মিত হলে মুন্সীগঞ্জের ৪ উপজেলার সঙ্গে রাজধানী ঢাকার যানজটবিহীন চলাচল অনেক সহজতর হয়। এই সেতু থেকে ১ কিলোমিটার পশ্চিমে রাস্তার ওপরে নির্মাণ হয়েছে আধুনিক এলিভেটেড কেরানীগঞ্জ রেলওয়ে স্টেশন।

এছাড়া এই সেতু ব্যবহার করে সহজে ঢাকায় যেতে ১৬ বছর আগেই নির্মাণ করা হয়েছিল ১৬ কি. মি. পিচ ঢালাই সড়ক। কিন্তু সেতুটির নির্মাণ কাজ ২০২০ সালের আগে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও এখনো কাজের অর্ধেকাংশ বাকি।

রাজধানী ঢাকার সঙ্গে মুন্সীগঞ্জের চার উপজেলার যোগাযোগ সহজ করতে সিরাজদীখান উপজেলা ও দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত ধলেশ্বরীর শাখা নদীর ওপর ২০১৮ সালে ২৫২ মিটার সেতুটির নির্মাণকাজ শুরু হয়েছিলো। চারটি উপজেলার মানুষের আশার এ সেতুর নির্মাণ কাজ ৫ বছর আগে শেষ হওয়ার কথা ছিল। সময় মত কাজ সম্পন্ন করতে না পারায় কয়েক দফা সময়ও বাড়ানো হয়েছিল। এর পরেও তা সম্ভব হয়নি।

সময় মত কাজ শেষ করতে না পারার বিষয়ে এলজিইডি ও ঠিকাদারের লোকজন একে অপরকে দোষারোপ করছেন। তবে শেষ পর্যন্ত এ সেতুর কাজ কবে শেষ হবে, তা নিয়ে উদ্বিগ্ন এ পথে যাতায়াতকারীরা।

কেরানীগঞ্জ এলজিইডি’র সূত্র মতে, ৩৩ কোটি ২৭ লাখ ৪২ হাজার টাকা ব্যয়ে ২০১৮ সালের ৬ জুলাই সেতুটির নির্মাণকাজ শুরু হয়। ১৩ খুঁটির ওপরে ১২ স্প্যান বসিয়ে নির্মাণ করা হবে ২৫২ মিটার দৈর্ঘ্য ও ৯.৮ মিটার প্রস্থের সেতুটি। সুরমা এন্টারপ্রাইজ নামে রাজধানীর এক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে এ কাজের দায়িত্ব দেওয়া হয়।

২০২০ সালের ৫ ডিসেম্বর সেতুর কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। সময় মত কাজ শেষ না হওয়ায় কাজের মেয়াদ দুই বছর বাড়িয়ে ২০২২ সাল পর্যন্ত করা হয়। ২০২৫ সালে এসেও কাজটি শেষ হয়নি। এ অবস্থায় অবশিষ্ট কাজের জন্য ১৬ কোটি টাকা বরাদ্দ চেয়ে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে চিঠি পাঠানো হয়।

এ বিষয়ে সিরাজদিখান এলজিইডি’র উপ সহকারী প্রকৌশলী খাইরুল বাসার সোনালীনিউজকে বলেন, ব্রিজের কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিলো অনেক আগেই। কিন্তু যে ঠিকাদার কাজটি নিয়েছিলেন তিনি মাঝ পথে ফেলে যাওয়ার কারণে কাজটি বন্ধ হয়ে গেছে।

তিনি বলেন, নতুন করে টেন্ডারের মাধ্যমে আবারও ঠিকাদার নিয়োগ করা হয়েছে। এখন ব্রিজের কাজ চলমান আছে। আশা করছি এবছরের মধ্যেই ব্রিজটি চালু করে দেওয়া যাবে।

এদিকে ভূমি অধিগ্রহণে এখনও কিছু জটিলতা রয়েছে বলে জানিয়েছে সেতুর ভায়াডাক্ট নির্মাণের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কিংডম বিল্ডার্স। প্রতিষ্ঠানটির দায়িত্বপ্রাপ্ত এক কর্মকর্তা সোনালীনিউজকে বলেন, সেতুর ভায়াডাক্ট নির্মাণের ক্ষেত্রে ভূমি অধিগ্রহণে এখনও কিছু জটিলতা রয়ে গেছে। সেতুতে সংযোগস্থলের কিছুটা আগে একটি বাড়ি রয়েছে। সেখানে একটি পিলার বসার কথা। কিন্তু বাড়িটি না সরানোয় জটিলতা দেখা দিয়েছে। তবে শিগগিরই এ সমস্যার সমাধান হবে বলেও আশা প্রকাশ করেছেন তিনি। বলেন, ইতোমধ্যে ভায়ডাক্টের ৬০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। আশা করছি আগামী ৬ মাসের মধ্যে ভায়াডাক্টের পুরো কাজ শেষ হয়ে যাবে।

এ বিষয়ে প্রথম ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সুরমা এন্টারপ্রাইজের দায়িত্বশীল কারো সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। জানা গেছে, দেশের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের ফলে প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন অবস্থায় রয়েছেন।

তবে ২০২৪ সালের জুন মাসে একটি গণমাধ্যমকে সুরমা এন্টারপ্রাইজের পরিচালক মাসুম আলী বলেন, এ বছর ফেব্রুয়ারীতে আমরা কাজটি করবো না বলে আত্মসমর্পণ করেছি। কাজটি না করায় এক কোটি টাকা জরিমানা গুনতে হবে। নির্মাণ সামগ্রীর চওড়া দাম। কাজটি করতে গেলে চার কোটি টাকা লোকসান হত।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, নির্মাণাধীন মূল সেতুর ৮টি পিলার নির্মাণ করা হয়েছে। পিলারের ওপর দুটি স্প্যান বসানো হয়েছে। ধলেশ্বরী নদীর উত্তর পাড়েও তিনটি পিলারে দুটি স্প্যান বসানো হয়েছে। তবে নদীর মধ্যখানে নির্মাণ করা পিলার দুটি এমনি পড়ে আছে। নদীর দু’প্রান্তে নির্মাণসামগ্রী ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে।

এই সেতুর সড়কে মুন্সীগঞ্জ জেলা সদর, টঙ্গীবাড়ি, লৌহজং ও সিরাজদীখান উপজেলার যাতায়াতের জন্য বেতকা চৌরাস্তা হতে সিরাজদীখানের মোল্লাবাজার হয়ে ব্রিজের গোড়ার দূরত্ব ১৬ কিলোমিটার, সেখান থেকে ঢাকার পোস্তগোলা ব্রিজ পর্যন্ত সড়কপথে দূরত্ব ৬ কিলোমিটার যা অতিক্রম করতে সময় লাগে যানজটবিহীন ৩০ মিনিট। অথচ সিরাজদীখান হয়ে অপর সড়কে ঢাকা-মাওয়া হাইওয়ে দিয়ে ঢাকার দূরত্ব ৪২ কিলোমিটার। আর যেতে সময় লাগে প্রায় আড়াই থেকে তিন ঘণ্টা।

আরো দুটি পথ রয়েছে ঢাকা যেতে, তা হলো নারায়ণগঞ্জের চাষাঢ়া দিয়ে অপরটি পাগলা দিয়ে দুটি পথেই অসহনীয় যানজট। মুন্সীগঞ্জ থেকে ৩ ঘণ্টার আগে ঢাকা যাওয়ার কথা চিন্তাই করা যায় না। তাই মোল্লা বাজার সেতুটি নির্ধারিত সময়ে নির্মাণ না হওয়ায় দুই পারের লাখ লাখ মানুষ সহজে ঢাকা যাওয়া আসা করতে পারছেন না।

ওই পথের যাতায়াতকারীরা জানান, এই সড়কে যানজটহীন ভাবে সহজে আমরা ঢাকায় যাতায়াত করতে পারি। এদিক দিয়ে যেমন সড়কের দূরত্ব কম অন্যদিকে রাস্তায় কোন যানজট নাই। বেতকা চৌরাস্তা হতে ৪০ থেকে ৪৫ মিনিটের মধ্যেই এই সড়ক দিয়ে ঢাকায় যাওয়া যায়। সেতুটি হয়ে গেলে সময় আরো অনেক বেঁচে যাবে। মুন্সীগঞ্জ হতে অন্য সড়ক দিয়ে ঢাকায় পৌঁছাতে সময় লাগছে প্রায় আড়াই থেকে তিন ঘণ্টা।

এলাকাবাসী জানান, সেতুটি হয়ে গেলে মুন্সীগঞ্জ সদর, টঙ্গীবাড়ি, লৌহজংয়ের কয়েকটি ইউনিয়ন ও সিরাজদিখান উপজেলার প্রায় ৫-৬ লাখ মানুষের ঢাকাসহ আশাপাশের জেলাগুলোতে যাতায়াতে সময়, অর্থ, ভোগান্তি অনেকাংশে কমে যাবে। সহজ যাতায়াতের জন্য এসব উপজেলায় সম্প্রসারিত হবে ব্যবসা-বাণিজ্যও। অথচ ঠিকাদার ও সেতু সংশ্লিষ্টদের গাফলতিতে বছরের পর বছর পার হচ্ছে, কিন্তু এ সেতুটি নির্মাণ শেষ হচ্ছে না।

কেউ কেউ আবার বলছেন, সেতু হলে অত্র এলাকার জমির দাম বেড়ে যাবে কয়েকগুণ। তাই কম দামে জমি কেনার জন্য কয়েকটি বড় কোম্পানির অদৃশ্য শাক্তির কারণে সেতুর কাজ আটকে আছে।

ফেরিতে চলাচলকারী কয়েকজন জানান, সেতু নির্মিত হলে ফেরির ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাবে। এই পথে দৈনিক অন্তত ১০ হাজার মানুষ ফেরি পারাপার হয়। সেতু না হওয়ার পেছনে এটিও অন্যতম কারণ হতে পারে।

এ পথে যাতায়াতকারী জাকির আলী বলেন, মুন্সীগঞ্জ হতে ঢাকায় যাওয়ার এই রাস্তাটি একেবারে যানজট হীন। অন্য সড়ক দিয়ে ঢাকায় যেতে যেখানে দুই থেকে তিন ঘন্টা সময় লাগে সেখানে এক সড়ক দিয়ে ১ ঘণ্টারও কম সময়ে যাওয়া যায়। সেতুটি হলে একদিকে যেমন আরও সময় বাঁচাতো অন্যদিকে সেতুর স্থল দিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ফেরি পারাপার হতেও মুক্তি পেতাম।

Exit mobile version