পিলখানার শহীদদের ‘ভিন্ন আবহে’ স্মরণ

১৬ বছর আগে পিলখানায় সেনা সদস্যদের হত্যাকাণ্ডের দিনকে এবার ‘ভিন্ন আবহে’ স্মরণ করা হচ্ছে, মাত্র একদিন আগে যে দিনটিকে ‘জাতীয় শহীদ সেনা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করে সরকার।

২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি সীমান্তরক্ষা বাহিনীর সদর দপ্তরে একসঙ্গে ৫৭ সেনা কর্মকর্তাকে হত্যার এই ঘটনাকে ‘জাতীয়ভাবে স্বীকৃতি’ দিতে দাবি জানিয়ে আসছিলেন পরিবারের সদস্যরা।

এর পরিপ্রেক্ষিতে গত রোববার ২৫ ফেব্রুয়ারিকে ‘জাতীয় শহীদ সেনা দিবস’ ঘোষণা করে পরিপত্র জারি করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ।

প্রথমবারের মতো পালন হওয়া এই দিবসের শুরুতে মঙ্গলবার (২৫ ফেব্রুয়ারি) ঢাকার বনানী সামরিক কবরস্থানে নিহত সেনা সদস্যদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয়।

সকাল ৯টায় রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের তরফে পুস্পস্তবকের মধ্য দিয়ে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।

এরপর স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী, সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান, নৌবাহিনী প্রধান অ্যাডমিরাল এম নাজমুল হাসান ও বিমান বাহিনী প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল হাসান মাহমুদ খাঁন নিজ নিজ বাহিনীর পক্ষ থেকে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন।

 

পর্যায়ক্রমে শহীদদের ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিব নাসিমুল গনি, বিজিবির মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান সিদ্দিকী।

এরপর শহীদদের নিকটাত্মীয় ও স্বজনরা ফুল দিয়ে শ্রদ্ধে জানান। শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে শহীদদের স্মরণে আয়োজিত দোয়া মাহফিলে অতিথিরা অংশ নেন।

প্রতিবারের মতো দিনটি পালিত হলেও এবারের দিনটিকে ‘ব্যাতিক্রম’ হিসেবে মন্তব্য করেছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী।

তিনি বলেন, আমাদের ৫৭ জন অফিসার শাহাদাত বরণ করেছেন, সবমিলিয়ে ৭৪ জন শাহদাত বরণ করেছেন। তাদের আত্মার মাগফেরাতের জন্য এসেছি, এটা প্রতি বছরই আসা হয়।

কিন্তু এবার একটু ডিফরেন্স হইলো- এবার থেকে এটা শহীদ সেনা দিবস হিসেবে ডিক্লেয়ার করা হইছে। আমরা শহীদ সেনা দিবসে এখানে আসছি। শহীদদের পরিবাররাও আসছেন, তাদের আত্মার মাগফেরাতের জন্য।

শহীদ সেনা সদস্যদের দাবি প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তাদের দুইটা মেইন দাবি ছিল, একটা বিচারের দাবি আরেকটা শহীদ সেনা দিবস ঘোষণা করা। আমরা কিন্তু শহীদ সেনা দিবস ঘোষণা করেছি, আজকে শহীদ সেনা দিবস হিসেবেই কিন্তু পালন করা হচ্ছে।

আরেকটা দাবি ছিল বিচার, ওই জন্য কিন্তু আমরা কমিশন করে দিয়েছি এবং ২৪ জানুয়ারি থেকে শুরু হইছে কমিশনের কাজ। তাদের তিন মাস সময় দেওয়া হইছে, তাদের রিপোর্টের বেসিসে যারা দোষী সাব্যস্ত হবে, তাদেরকে বিচারের আওতায় নিয়ে আসা হবে।

 

বিডিআর বিদ্রোহের হত্যা মামলায় সাজা ভোগ শেষ হলেও বিস্ফোরক মামলাটি থেমে থাকায় অনেকে কারাগারে রয়েছেন।

এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, হত্যা মামলায় যাদের সাজা হয়েছিল, তারপরে বিস্ফোরক মামলার জন্য কিন্তু অনেকে তাদের সাজা ভোগ হওয়ার পরেও জেলে ছিল। তাদের কিন্তু অনেকেরই জামিন হয়ে গেছে।

আরও যদি এরকম থাকে- কোর্ট বসলে এটা দেখবে, এটা আমাদের হাতে না। সম্মানীয় কোর্ট যদি তাদের জামিন দিয়ে দেয় দেবে।

গত ১৫ বছরে কেন ‘শহীদ সেনা দিবস’ ঘোষণা হয়নি, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, গত ১৫ বছর কেন এটা ডিক্লেয়ার করে নাই, এটা তো আমার পক্ষে বলা সম্ভব না।

সঠিক বিচার নিয়ে স্বজনদের ‘অভিযোগ’ প্রসঙ্গে জাহাঙ্গীর আলম বলেন, আর সঠিক বিচার যেন হয়, এজন্যই কিন্তু একটা তদন্ত কমিশন গঠন করা হয়েছে। তাদের রিকমন্ডেশনের উপর ভিত্তি করে আমরা পরবর্তী অ্যাকশনটা নেব।

অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, গত ১৫ বছরের প্রশ্নগুলিতো আপনারা গত ১৫ বছর করতে পারতেন। গত ১৫ বছরের উত্তর তো আমি দিতে পারব না।

এই যে এখন যে হারে প্রশ্ন করতে পারতেছেন, এই প্রশ্ন কি আপনারা গত ১৫ বছরে করতে পারছেন? এ ধরনের প্রশ্ন তো আপনারা করতে পারেন নাই। আপনারা এখন স্বাধীনভাবে যেকোনো ধরনের প্রশ্ন করতে পারেন। গত ১৫ বছরে যে ঘটনা ঘটছে, আপনারা অনেক সময় মিডিয়ায় দিতেই পারেন নাই। আপনাদের ইচ্ছা ছিল, আপনাদের বুক ফাটছে, কিন্তু প্রকাশ করতে পারেন নাই। বাট এখন তো আপনারা সেটা প্রকাশ করতে পারেন।

২০০৯ সালে পিলখানা হত্যাকাণ্ড দেশের গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আলোড়ন তোলে। বিডিআরের দরবার হল থেকে সূচনা হওয়া ওই বিদ্রোহের ইতি ঘটে নানা ঘটন-অঘটনের মধ্য দিয়ে। পিলখানায় বিদ্রোহের মধ্যেই দেশের বিভিন্ন স্থানে জওয়ানরাও বিদ্রোহ করে।

সেই বিদ্রোহের পর সীমান্ত রক্ষা বাহিনী বিডিআরের নাম বদলে যায়, পরিবর্তন আসে পোশাকেও। এ বাহিনীর নাম এখন বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ বা বিজিবি।

 

বিদ্রোহ ও হত্যা মামলার বিচার হলেও ক্ষমতার পালাবদলের পর পুনরায় তদন্তের দাবি ওঠে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে গত ডিসেম্বরের সাত সদস্যের স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠন করে অন্তর্বর্তী সরকার।

পিলখানা হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং সাবেক সেনাপ্রধান মইন ইউ আহমেদসহ ৫৮ জনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে একটি অভিযোগও দায়ের করা হয়েছে।

বনানী সামরিক কবরস্থানে মঙ্গলবার শ্রদ্ধা নিবেদন করতে আসা শহীদ মেজর মাহবুবুর রহমানের স্ত্রী রিতা রহমান জুলি বলেন, আমরা খুব বেশি কিছু চাইনি, শহীদী মর্যাদা এবং বিচারটা যাতে সুষ্ঠুভাবে হয়। যারা দোষী- তারা যেন সামনে আসে, যেন সুষ্ঠু বিচারটা হয়। আমরা আশাবাদী, যেহেতু কমিশন গঠন হয়েছে। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাও বললেন। এখন আমাদের আশার উপরেই বেঁচে থাকতে হবে।

শহীদ মেজর হুমায়ুন হায়দারের স্ত্রী শামীমা পারভীন বলেন, আমাদের একটি দাবি পূরণ হয়েছে। এখন অপেক্ষা বিচারের।

আমরা একটি সুষ্ঠু বিচার চাই, যারা এই ঘটনায় জড়িত তাদের চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় নিয়ে আসা হোক। তদন্তের মাধ্যমেই বেরিয়ে আসবে- আসলে কারা দোষী৷

যে বাহিনীর সদস্যই হোক, ‘গাফিলতি’ করলে ব্যবস্থা : আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে যৌথবাহিনীর চলতে থাকা ‘অপারেশন ডেভিল হান্টের’ মধ্যেও নানা প্রশ্নের মুখে ঢাকায় বিভিন্ন বাহিনীর সমন্বয়ে সোমবার রাত থেকে ‘কম্বাইন্ড টহল’ পরিচালনার কথা জানানো হয়।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, সফলতা এবং ব্যর্থতা, আপনারা আমাদের তথ্য দিতে পারবেন। আমরা যেভাবে এটা সাজিয়েছি, এটার কোনো জায়গায় কোনো রকমের গাফিলতি আমার কর্মচারী বা আমার বাহিনীর ভেতরে থাকে, আমি তাদেরকে আইনের আওতায় নিয়ে আসব।

এখানে কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। এটা পুলিশ হোক, বিডিআর (বিজিবি) হোক, র‌্যাব হোক, আনসার হোক- ঠিক মতো তাদের কাজ যদি না করে, তাদেরকে আইনের আওতায় নিয়ে আসব।

সোমবার রাত থেকে সকাল পর্যন্ত অভিযান কেমন চলল, এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, “সকাল পর্যন্ত আপডেট ভাবছি, আপনারা দিবেন। আমার মনে হয় আল্লায় দিলে ভালো।

আপনারা কারেক্ট রিপোর্টটা দিবেন। আগে সংবাদ দিতে পারেন নাই, এখন সংবাদ দেন; কিন্তু সঠিক সংবাদটা দেন। আপনাদের কাছে অনুরোধ করবো সত্যি সংবাদ দেন। সত্যি সংবাদের বেজ কইরা দেখেন আমরা অ্যাকশন নিই কি না। কারেক্ট সংবাদ পরিবেশন করেন, আমরা অবশ্যই ব্যবস্থা নিব।

Exit mobile version