দশ সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে মাত্র ৬টি আসনে ‘সামান্য’ পরিবর্তন এনে বিদ্যমান ৩০০ সংসদীয় আসনের সীমানা পুনঃনির্ধারণের খসড়া প্রকাশ করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এ খসড়ার ওপর আগামী ১৯ মার্চ পর্যন্ত দাবি, আপত্তি করার সময় বেঁধে দেয়া হয়েছে। গতকাল রোববার ইসি সচিব মো. জাহাঙ্গীর আলম স্বাক্ষরিত এ সংক্রান্ত বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়েছে। যা গেজেট আকারেও প্রকাশ করা হবে।
সূত্রের তথ্য অনুয়ায়ী, যে ৬টি সংসদীয় আসনের সীমানায় ‘সামান্য’ বদল আনার প্রস্তাব করা হয়েছে সেগুলো হলো—
ময়মনসিংহ-৪, মাদারীপুর-৩, সুনামগঞ্জ-১, সিলেট-১, সিলেট-৩, কক্সবাজার-৩ এবং সুনামগঞ্জ-৩। ময়মনসিংহ-৪ আসনের সীমানায় পরিবর্তন প্রস্তাব করা হয়েছে ময়মনসিংহ নতুন সিটি করপোরেশন হওয়ায়। মাদারীপুর-৩ আসনের সীমানায় পরিবর্তন আনা হচ্ছে নতুন প্রশাসনিক এলাকা ঘোষিত হওয়ায়। একই কারণে সুনামগঞ্জ-১, সিলেট-১, সিলেট-৩, কক্সবাজার-৩ ও সুনামগঞ্জ-৩ আসনেও ‘ছোট’ পরিবর্তন প্রস্তাব করা হয়েছে।
ইসি সূত্রে আরও জানা যায়, সীমানা পুনঃনির্ধারণের খসড়া তালিকার বিষয়ে কেউ সংক্ষুব্ধ হলে তারা আগামী ১৯ মার্চের মধ্যে দাবি, আপত্তি নির্ধারিত পদ্ধতি ইসিকে জানাতে পারবেন। সংক্ষুব্ধ ব্যক্তিদের কাছ থেকে প্রাপ্ত দাবি, আপত্তি, সুপারিশ ও মতামত নিয়ে শুনানির আয়োজন করবে ইসি। শুনানি শেষে চূড়ান্ত সীমানা পুনঃনির্ধারণ করবে কাজী হাবিবুল আউয়াল কমিশন। চলতি বছরের মাঝামাঝি পুনঃনির্ধারিত সীমানা গেজেট আকারে প্রকাশ করার পরিকল্পনা রয়েছে ইসি। পুনঃনির্ধারিত নতুন সীমানায়ই অনুষ্ঠিত হবে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন।
জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর নয়া শতাব্দীকে বলেন, আবেদনের পর শুনানিতে কারও বক্তব্য যৌক্তিক হলে ইসি সে অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেবে। যাই হোক না কেন— আগামী জুনের মধ্যেই সব চূড়ান্ত করা হবে।
ইসির নির্বাচন শাখার কর্মকর্তারা জানান, শুধু প্রশাসনিক কারণে নামের পরিবর্তন হয়েছে অথবা প্রশাসনিক বিভক্তি যেগুলো হয়েছে, সেগুলো পুরোনো নাম বাদ দিয়ে নতুন নাম দিয়ে করা হয়েছে। এর বেশি কোনো পরিবর্তন এবারের সীমানা পুনঃনির্ধারণে নেই। কমিশনের অনুমোদন অনুযায়ী পাঁচটি পদ্ধতি অনুসরণ করে সীমানা পুনঃনির্ধারণের খসড়া প্রকাশ করা হয়েছে। পদ্ধতি পাঁচটি হলো—১. প্রতি জেলার ২০১৮ সালের মোট আসন সংখ্যা অপরিবর্তিত রাখা; ২. প্রশাসনিক ইউনিট বিশেষ করে উপজেলা ও সিটি ওয়ার্ড যথাসম্ভব অখণ্ড রাখা; ৩. ইউনিয়ন, পৌর ওয়ার্ড একাধিক সংসদীয় আসনের বিভাজন না করা; ৪. নতুন প্রশাসনিক এলাকার যুক্ত, সম্প্রসারণ বা বিলুপ্ত হলে তা অন্তর্ভুক্ত করা; ৫. ভৌগলিক বৈশিষ্ট্য ও যোগাযোগব্যবস্থা বিবেচনায় রাখা।
এদিকে, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ষষ্ঠ জনশুমারির প্রাথমিক প্রতিবেদন এরই মধ্যে প্রকাশ করা হয়েছে। তাতে দেশের মোট জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৫১ লাখ ৫৮ হাজার। বিবিএস-এরওই প্রতিবেদনের তথ্য যাচাই-বাছাই করে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএস তাদের প্রতিবেদন দিয়েছে গত ৬ ফেব্রুয়ারি। সেখানে বলা হয়েছে, প্রাথমিক প্রতিবেদন যাচাইয়ে ২ দশমিক ৭৫ শতাংশ তথ্যে অমিল পাওয়া গেছে। এ ২ দশমিক ৭৫ শতাংশ যোগ হলে চূড়ান্ত জনসংখ্যা দাঁড়াবে ১৬ কোটি ৯৮ লাখ ২৮ হাজার ৯১১ জন। সবশেষ জনশুমারিকে আমলে নেয়ার বিধান থাকলেও জনশুমারি চূড়ান্ত না হওয়ায় সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণে তা পুরোপুরি বিবেচনায় আনতে পারছে না ইসি।
এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর জানান, পরিসংখ্যান ব্যুরোর জনশুমারির চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করতে আরও বছরখানেক সময় লাগবে। কিন্তু ডিসেম্বর থেকে জানুয়ারির মধ্যে সংসদ নির্বাচন করতে হবে। তাই আমরা আর অপেক্ষা করতে পারছি না। তারা খসড়া যে প্রতিবেদন দিয়েছে সেটা আমলে নিয়েছি। তবে প্রশাসনিক অখণ্ডতা এবং ভৌগলিক বিষয়টাকেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছি। এটা প্রকাশ করার পর যদি জনপ্রতিনিধি বা স্থানীয় কেউ সমস্যা মনে করেন, তারা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে দাবি-আপত্তি জানাতে পারবেন। ইতোমধ্যে যেসব আবেদন পড়েছে, বেশিরভাগই পরিবর্তন না করার জন্য আবেদন করা হয়েছে। মো. আলমগীর জানান, প্রত্যেকটি আবেদনই শুনানি করা হবে। তাদের বক্তব্য সঠিক হলে, বা কেউই বিরোধিতা না করেন এবং ইসির কাছে যদি প্রতীয়মান হয় যে তাদের বক্তব্য যৌক্তিক, তখন হয়তো পরিবর্তন আনা হতে পারে। এর বাইরে খসড়া তালিকায় কোনো পরিবর্তন আনা হবে না।
এক প্রশ্নের জবাবে এ নির্বাচন কমিশনার বলেন, শুমারির খসড়া তথ্য নেয়া হয়েছে। তবে ইসি প্রশাসনিক ও ভৌগলিক অখণ্ডতাকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। আইনেও তাই বলা হয়েছে। আগে একটা উপজেলা ছিল— এখন দুইটা উপজেলা হয়েছে, এমন ক্ষেত্রে আমরা নতুন নাম অন্তর্ভুক্ত করেছি। আর কোনো পরিবর্তন আনিনি। যে কেউ এ ক্ষেত্রে সীমানা পরিবর্তনের আবেদন করতে পারবেন।
সূত্র জানায়, ১৯৮৪, ১৯৯১ সালের পর ২০০৮ সালে সংসদীয় আসনে ব্যাপক পরিবর্তন আনা হয়। ওই বছর নবম সংসদ নির্বাচনের জন্য ১৩৩ আসনে সীমানা পরিবর্তনের প্রস্তাব করে ইসি। কাজী হাবিবুল আউয়াল নেতৃত্বাধীন ইসি ২০২৩ সালের নভেম্বর থেকে ২০২৪ সালের জানুয়ারির মধ্যে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করবে। সবশেষ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ২০১৮ সালের ৩০ এপ্রিল ২৫টি আসনের সীমানায় পরিবর্তন এসেছিল। ২০০৮ সালে ড. এটিএম শামসুল হুদার কমিশন তৎকালীন আদমশুমারি অনুযায়ী জনসংখ্যার আনুপাতিক হার মেনে আঞ্চলিক অখণ্ডতা ও প্রশাসনিক সুবিধা বিবেচনায় নিয়ে জিআইএস পদ্ধতি অনুসরণ করে শতাধিক সংসদীয় আসনে পরিবর্তন আনে। এরপর কাজী রকিবউদ্দিন আহমদ কমিশন দশম সংসদ নির্বাচনে ৮৭ আসনে পরিবর্তন আনার প্রস্তাব করে আগের ইসির পদাঙ্ক অনুসরণ করে ৫০টি আসনে ছোটখাটো পরিবর্তন আনে। ২০১৮ সালে কে এম নূরুল হুদা কমিশন সীমানার খসড়ায় ৪০ আসনে পরিবর্তনের প্রস্তাব করে; পরে ২৫টি আসনে ছোটখাটো পরিবর্তন এনে একাদশ সংসদ নির্বাচন সম্পন্ন করে।