বাংলাদেশের পাশাপাশি সারা বিশ্বের সকল বাঙালির একুশে ফেব্রুয়ারির সঙ্গে ভোরে খালি পায়ে প্রভাতফেরি আর ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী’ গান গর্বের-ভালোবাসার-শ্রদ্ধার। একুশের সেই আবেগ আর ঐতিহ্য বাদ দিয়ে রাত ১২টায় ইংরেজি নিয়মে প্রভাতফেরি করা হচ্ছে, যা ভাষা দিবসের মূল চেতনার ওপর আঘাত বলে আমি মনে করি। আমার এই মতামতের সাথে অনেকেই একমত হয়েছেন সাম্প্রতিক সময়ে। কিন্তু তারা রাজপথে নামতে ভয় পান, লিখতে ভয় পান নির্মম ‘মব’-এর ভয়ে। আমি ভাই ভয় পাইনি কখনোই। আর একারণেই ২০১৮ সালে লোভি-বাটপার রাজনীতিকদের রোষানলে গুম-এর শিকার হই। মৃত্যুকে খুব কাছ থেকে দেখে আসা আমি বরাবরের চেয়ে আরো গাঢ় সাহস নিয়ে এগিয়ে চলছি ছাত্র-যুব-জনতাকে সাথে নিয়ে। একথা সত্য যে, জাতি হিসেবে বাংলাদেশের বাংলা ভাষাভাষি সকলে আমরা একুশে ফেব্রুয়ারির অর্জন নিয়ে আত্মতৃপ্তিতে ভুগি। কিন্তু এখনো সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু হয়নি। উচ্চ আলাদতে এখনো বাংলার প্রচলন শুরু হয়নি। প্রভাতফেরির সংস্কৃতি আমরা নষ্ট করে রাত ১২টা এক মিনিটে শহীদ মিনারে ফুল দিচ্ছি। এখান থেকে বেরিয়ে আসতে হবে বাংলা ভাষার জন্য শাহাদাতবরণকারী ভাষা শহীদদেও প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে। সেই সাথে বাংলা ছাড়াও বাংলাদেশের অন্য যে আদিবাসী ভাষাগুলো রয়েছে তার অধিকার প্রতিষ্ঠায় এবং উৎকর্ষের জন্য আমাদের কাজ করার প্রয়োজনীয়তাও তৈরি হয়েছে। ভুলে গেলে চলবে না, বাংলাদেশের প্রতিটি বাংলাদেশীর একুশে ফেব্রুয়ারির সঙ্গে ভোরে খালি পায়ে প্রভাত ফেরি আর ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারিদ গান অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত।’ কিন্তু এখন একুশের সেই আবেগ আর ঐতিহ্য বাদ দিয়ে রাত ১২ টা ১ মিনিটে ইংরেজি নিয়মে প্রভাত ফেরি করা হচ্ছে, যা ভাষা দিবসের মূল চেতনার ওপর চড়ম আঘাত । এই সংস্কৃতি একুশের চেতনার সঙ্গে যায় না। বস্তুত, অমর একুশ বাঙালির ইতিহাসে শুধু একটি তারিখ নয়; একুশ হলো একটি চেতনার বীজমন্ত্র। একুশকে কেন্দ্র করে ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের রক্তাক্ত সংগ্রামের ভেতর দিয়ে বাঙালি জাতিসত্তার এক অবিনাশী চেতনার জন্ম হয়েছিল। আর এই চেতনার পথ ধরেই ছেষট্টির ছয় দফা, উনসত্তরের গণ-অভ্যূত্থান, সত্তরের নির্বাচন এবং ১৯৭১-এ আমরা পেয়েছি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। একুশ আমাদেরকে সামনে এগিয়ে চলার সাহস জোগায়। একুশের ভোরে ফুল হাতে নগ্ন পায়ে প্রভাত ফেরি আমাদের প্রেরনা দেয় সব বাধা অতিক্রম করে এগিয়ে যাওয়ার। একটি আমাদের সাংস্কৃতিক অগ্রযাত্রাকে আরও সুদৃঢ় করে। অবাক হওয়ার বিষয়, নাগরিক জীবনে একুশের এই আবেগকে খন্ডিত করে ফেলা হয়েছে! প্রায় তিন দশক আগে এক সামরিক শাসক নিজের নিরাপত্তার দিক বিবেচনায় একুশের প্রথম প্রহর নাম দিয়ে রাত ১২ টা ১ মিনিটে কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে পুস্পস্তবক অর্পনের রেওয়াজ চালু করে। একে বিনা প্রশ্নে মেনে নেয় নগরবাসী, সংস্কৃতিকর্মীসহ সর্বশ্রেণির মানুষ! আর সেই সঙ্গে একুশের চেতনায় জড়িয়ে থাকা প্রভাত ফেরি নতুন প্রজন্মের নিকট অচেনা হয়ে যায়। অথচ বায়ান্নের পর থেকে একুশের প্রত্যূষে প্রভাত ফেরির মধ্য দিয়ে শহিদ মিনারে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন একুশের মহিমাকে আলাদা উজ্জ্বল্য দিয়েছে। কাকডাকা ভোরে সাজ সাজ রব। স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত শিক্ষার্থী, শিক্ষক, পাড়ামহল্লার ক্লাবকর্মীসহ সর্বস্তরের মানুষ ফুল হাতে নগ্ন পায়ে এগিয়ে যেত শহিদ মিনারের দিকে; কন্ঠে থাকতো দআমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারিদ গানের সুর মূর্ছনা। এক অপর্থিব পরিবেশ সৃষ্টি করতো। এভাবে অমর একুশ যেকোনো জাতীয় দিবস থেকে আলাদা মাত্রা হিসেবে নিজের অবস্থান তৈরি করেছিল। ভাষা শহিদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের অন্যতম মাধ্যম প্রভাত ফেরিতে এমন আমূল পরিবর্তন সত্ত্বেও আমাদের নাগরিক জীবনের বাইরে গ্রাম-গঞ্জে আজও বাঙালিরা একুশের শ্রদ্ধা নিবেদন করে প্রভাত ফেরির মধ্য দিয়ে। একুশের প্রভাতে নিরবমিছিলে এর গানের সুর মূর্ছনা বাঙালিকে কৌতূহলী ও আবেগাপ্লুত করে তুলে। তাদের মাঝে ভাষাপ্রেম ও দেশপ্রেম জাগ্রত হয়।
মনে রাখতে হবে বাংলা ভাষার ইতিহাস সমৃদ্ধ একুশে ফেব্রুয়ারি এখন শুধু বাংলাদেশের গন্ডিতেই সীমাবদ্ধ নয়। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন করছে বিশ্বাবসী। এই ভাষা দিবসে বিশ্ববাসী একবার ফিরে তাকাবে ভাষা আন্দোলনের সূতিকাগার বাংলাদেশের দিকে। অনুকরণ করবে আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলির রীতি-রেওয়াজকে। মূলত প্রভাত ফেরি শব্দটির জন্মই হয়েছে একুশে প্রভাতের নিরব মিছিলকে বোঝাতে। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে এর উৎসভূমির অনুকরণে বিশ্ববাসীও প্রভাত ফেরিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেবে। অথচ আমরাই হঠকারী সিদ্ধান্তে ভোরের প্রভাত ফেরিকে বিসর্জন দিয়ে মধ্যরাতে একুশে চেতনাকে খুঁজে ফিরছি। নিঃসন্দেহে সংস্কৃতিভাবনার সুস্থ ধারা বলবে, আমরা একুশের প্রভাত ফেরিকে হারাতে চাই না। হারাতে চাই না একুশের অনুভূতিকে। রাত ১২ টা ১-এর পাশ্চাত্য সংস্কৃতি থেকে মুক্ত করে আবার সূর্যোদয়ের সময়কার প্রভাত ফেরির একুশে উদযাপনে ফিরে যেতে চাই। কারণ একুশকে তাঁর স্বমহিমায় পুনঃস্থাপন না করা গেলে নতুন প্রজন্মকে ভাষা প্রেমে উদ্বুদ্ধ ও জাগরিত করা যাবে না। কেননা, ইতিহাস বলছে- কবি আবুদল গাফফার চৌধুরীর লেখা একুশের অমর সঙ্গীতের সঙ্গে আমাদের পরিচয় ঘটে। “আমার ভায়ের রক্তে রাঙ্গানো একুশে ফেব্রুয়ারি”। এই কবিতাটিতে প্রথম সুরারোপ করেন আবদুল লতিফ। কিন্তু তাঁর সুরারোপিত গানটি তেমন সাড়া জাগাতে পারেনি যদিও তিনি তাঁর লেখা ও সুরে গাওয়া “রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন করিলিরে বাঙ্গালী। ঢাকার শহর রক্তে রাঙ্গাইলি” গানটির জন্য বিখ্যাত হয়ে গিয়েছিলেন যা জনপ্রিয়তার শীর্ষে উঠেছিলো তখন। দ্বিতীয়বার সম্ভবত: ১৯৫৭ /১৯৫৮ সালের দিকে অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম আবারো তাঁকে আবদুল গাফফার চৌধুরী কবিতাটি নতুন করে সুরদানের অনুরোধ করেন।
এমন ইতিহাসকে ভুলে যেতে বসেছে বর্তমানের বাংলাদেশ। যা কারো কাছে প্রত্যাশিত নয়। বায়ান্ন পরবর্তী সময়ে ফুল বাজারে বিক্রি হতো না। মফস্বল শহরগুলোতে একুশে ফেব্রুয়ারির আগে সারা রাত ধরে আশপাশের বাড়ি থেকে ফুল সংগ্রহ করা হতো। কী আশ্চর্য অন্য সময় যারা ফুল সংগ্রহ নিয়ে বকা দিতেন তারাও কেন যেন সেই রাতের জন্য ভীষণ রকমের ভালো হয়ে যেতেন। এমন দিনে তো ফুল যে যার মত করে সংগ্রহ করবেই- এটি মেনে নিতেন। সকাল হলেই প্রভাত ফেরিতে যাওয়ার প্রস্তুতি থাকতো কান্না আর বেদনার আবহে। পরবর্তীতে সেই ধারা অব্যাহত ছিলো বলেই আমি আমার কৈশোরে দ্বীপ উপজেলা মেহেন্দীগঞ্জের শহীদ মিনারে খালি পায়েই যেতাম, আমরা দেখে শিখে গিয়েছিলাম প্রভাত ফেরিতে খালি পায়েই যেতে হয়। আমাদের পায়ে কিছু বেঁধে যাবার চিন্তা ছিল না, প্রথম প্রহরে ঘর থেকে বের হবার ভয় ছিল না। সাদা জামার ওপর কালো ব্যাজ লাগানো হতো। সেই ব্যাজ লাগানোতেও শরীর ফুটো হবার কোনো শঙ্কা ছিল না। পুরো প্রভাত ফেরিতে আমরা সেই অমর গানটিই গাইতাম। সেই সময় সেই পথে কোউ স্লোগান দিতো না। এমনকি শহীদ মিনারেও কোনো রাজনৈতিক দলের স্লোগান হতো না। শুধুমাত্র মাইকে সংগঠনের নাম ঘোষণা করা হতো। আর সারা দিন রাস্তার মোড়ে মোড়ে বাজতো সালাম সালাম হাজার সালামসহ অনেক দেশাত্মবোধক গান। তবে এখন ফেব্রুয়ারি এলেই সবাই নড়েচড়ে ওঠে না। ফেব্রুয়ারির প্রথমদিন থেকেই ঢাকায় শুরু হওয়া একুশের মাসব্যাপী বইমেলা জমে না। সর্বস্তরে বাংলা ভাষা ব্যবহার নিয়ে টিভিগুলো সব টকশো সাজালেও দর্শক তা দেখে না। বাংলা ভাষা নিয়ে গর্বটা আগের মত এই মাসেও ভর করছে না। খালি পায়ের প্রভাত ফেরি সেই কবেই হারিয়ে গেছে! প্রভাত ফেরির জায়গায় স্থান পেয়েছে বাণিজ্যিক একুশ। এখন আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি গাইতে গাইতে একুশে প্রথম প্রহরে খুব কম লোকজনেই যায়। গানের পরিবর্তে এখন শোনা যায় দলীয় রাজনীতির স্লোগান। নেতানেত্রীর নামে স্লোগান। কে কার আগে ফুল দিবে সেটির প্রতিযোগিতা হয়, ছবি তোলা, মিডিয়ার সামনে যাওয়ার জন্য ছটফট করতে থাকে অনেকেই। আমি এই বর্তমানের পরিবর্তনের জন্য নতুনধারার রাজনীতি করি, নতুন চিন্তার লেখালেখি। গণমাধ্যম বা বাংলাদেশের হুজুগেরা না আসলেও প্রকৃত মানুষ সাড়া দেবে বলে আমি বিশ্বাস করি। আর তাই লিখি, কথা বলি। আমি ভাইরালের রাজনীতি নয়; জনতার রাজনীতি করি বলেই- দেশের রাজনীতি করি বলেই আমার চাওয়া ইতিহাসের সেই প্রভাত ফেরী। দয়া করে প্রধান উপদেষ্টাসহ কেউ রাত ১২ টায় শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা জানাবেন না। প্রথম প্রহরে প্রভাত ফেরীর মধ্য দিয়ে এই শ্রদ্ধা অর্পণ দেখতে চাই আমরা। রাজনৈতিক সরকারের মত নয়, প্রকৃত দেশবান্ধব সরকারের মত জনগণের কথা শুনলে ঋদ্ধ হবে বাংলাদেশ-বাংলা ভাষার ইতিহাস আর আমাদের প্রতিটি পদক্ষেপ…
প্রভাত ফেরীর রাজপথ থাকুক আগের মতই–মোমিন মেহেদী
