মনির হোসেন বরিশাল ব্যুরো॥ মেলা নামটি শুনলেই মনে এক ধরণের আনন্দের উচ্ছ্বাস জেগে ওঠে। আর সূর্যমণি মেলা সেই আনন্দ ও উচ্ছ্বাসের আরও এক ধাপ যেন বাড়িয়ে দেয়। বরিশাল বিভাগের বা আশেপাশের আরও অনেক জেলার মধ্যে এমন কোন লোক খুঁজে পাওয়া যাবে না, যারা সূর্যমণি মেলার নাম শুনেননি।২২৭ বছর ধরে ঐতিহ্যবাহী লোকজ আয়োজন নিয়ে সগর্বে টিকে আছে প্রাচ্যের ভ্যানিস খ্যাত বরিশাল জেলার সূর্যমণি মেলা। লোকজ মেলাটি বরিশাল জেলা শহর হতে প্রায় ২৯ কিলোমিটার পূর্বদিকে সন্ধ্যা নদীর তীরে বানারীপাড়া উপজেলার সলিয়াবাকপুর ইউনিয়নের বেতাল গ্রামের সূর্যাকৃতির মূর্তি পাওয়ার স্থানে প্রতি বছর মাঘী পূর্ণিমার শুক্লা তিথিতে অনুষ্ঠিত হয়।
মেলা উপলক্ষে এখানকার প্রতিটি বাড়িতে আত্বিয়-স্বজনরা এসে জড়ো হয়। চারিদিকে উৎসব মূখর অবস্থা বিরাজ করে। প্রায় মাস ব্যপী সেই উৎসব উদ্দীপনা চলতে থাকে। প্রতিদিন সকাল থেকে বিকেল আর বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত মেলামুখি মানুষের ঢল বাড়তেই থাকে। শুধু বরিশাল জেলা নয় আশেপাশের জেলা থেকেও মেলায় আসেন শত শত মানুষ। স্থানীয়রা বছর ধরে পয়সা জমান মেলা থেকে বিভিন্ন ধরণের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনা কাটার জন্য।
কথিত আছে আজ থেকে প্রায় ২২৭ বছর আগে বেতাল গ্রামে যেখানে মেলা অনুষ্ঠিত হয় সেখানে কৃষকরা চাষের জন্য জমিতে লাঙ্গল দেয়ার সময় ফলা আটকে যায়। তৎকালীন সময় ওই জমির মালিক গঙ্গু সরকারের মায়ের কাছে চাষীরা ছুটে গিয়ে বিষয়টি জানান।
পরে লাঙ্গলের ফলা আটকে যাবার স্থানে মাটি খুঁড়ে একটি কষ্টি পাথরের সূর্যাকৃতি মূর্তির পান তারা। দিনটি ছিলো সপ্তমী মাঘী পূর্ণিমার শুক্লা তিথি। সেই সময় থেকেই এই তিথিতে প্রতি বছর মেলা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। পরে মেলার নাম করণ করা হয় সূর্যমণি মেলা। এরপরে গঙ্গু সরকারের কয়েক পুরুষ এই মেলার আয়োজন করেণ। পরে তারা স্বপরিবারে ভারতে চলেযান।
তখন স্থানীয় ভট্টচার্য্য পরিবারকে সূর্যপূজার মাধ্যমে প্রতি বছর সূর্যমণি মেলার আযোজন করতে অনুরোধ জানিয়ে যান সরকার পরিবার। সাথে সাথে বেতাল গ্রামের ঐতিহ্যবাহী মোল্লা পরিবারকে ওখানকার সংখ্যালঘু পরিবার এবং মেলার দেখভাল করার অনুরোধ জানিয়ে সরকার পরিবারের স্থাবর অস্থাবর সকল সম্পত্তি তাদের কাছে বিক্রয় করেন। তবে তাদের বড় অনুরোধ ছিলো ওই জমিতে যেন স্থানীয় সংখ্যালঘু পরিবার পুজা এবং মেলার আয়োজন করতে পারেন।
সেই সময় থেকে মোল্লা পরিবার ভট্টাচার্য্য পরিবারের কয়েক পুরুষের পাশে থেকে মেলা আয়োজনে এবং সংখ্যালঘুরা যাতে করে ওই স্থানে সূর্যপুজা এবং মেলার আয়োজন করতে পারেন তার সহযোগিতা করে আসছেন। মেলার উল্লেখযোগ্য দিক হলো এখানে আয়োজক কমিটির সার্বক্ষণিক নিজস্ব নিরাপত্তা বাহিনী কাজ করেন।
আয়োজক কমিটিও নিরাপত্তার বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করেন, মাঠে উপস্থিত থেকে। গ্রামীন লোকজ ঐতিহ্য যাত্রাপালা, সার্কাস, পুতুল নাচ, বিভিন্ন ধরণের নাগর দোলা, যাদু প্রদর্শনী মেলায় বাড়তি আনন্দ যোগায়। এছাড়াও কাঠ, বেত ও মাটির বিভিন্ন রকমের সাংসারিক জিনিসপত্র এ মেলায় পাওয়া যায়।
আকর্শনীয় জিনিসের মধ্যে রয়েছে বাগেরহাট জেলার ১ থেকে ২ কেজি ওজনের মিষ্টি মেলা, অপরদিকে রয়েছে বাহারী খেলনা সামগ্রীর বিশাল সমাহারের পসরা, রয়েছে স্টীলের বিভিন্ন ধরণের ফার্ণিচার, রয়েছে জীবনকে রঙিন করে সাজাতে দেশি-বিদেশী কসমেটিকস, মেলায় লোভনীয় মসলার পানও উল্লেখযোগ্য। মেলাকে ঘিরে বানারীপাড়া ও আশেপাশের এলাকার মেয়েরা বাপরে বাড়িতে আসেন তাদের শ্বশুরবাড়ির আত্বিয়-স্বজন নিয়ে। এ সময়ে পুরো এলাকায় এক আনন্দ উৎসবের সৃষ্টি হয়।সূর্যদেব মন্দিরের পুজারী কৃষ্ণ কান্ত ভট্টাচার্য্য জানান, পৌর শহরের সংখ্যালঘু পরিবারের সমন্বয়ে তারা মেলা আয়োজনের কমিটি গঠন করেন। মেলা আয়োজন কমিটির সভাপতি শিক্ষক বাদল কৃষ্ণ সাহা ও সাধরণ সম্পাদক ভক্ত কর্মকার জানান, হাজার হাজার বছরের লোকজ সম্প্রীতির এক অনন্য দৃষ্টান্ত বহন করে ঐতহ্যবাহী এই সূর্যমণি মেলা।
তারা আরও জানান, দেশের বেশ কয়েকটি জেলার মানুষের মেলবন্ধন হয় এই মেলাকে ঘিরে যেখানে থাকেনা কোন হিংসা আর বিদ্বেশ,একে অপরে কেবলই আনন্দ ভাগাভাগি করেন। তারা জানান, এখনও মেলার প্রশাসনিক অনুমতি পাওয়া যায়নি তবে গ্রামীণ ঐতিহ্য লালিত করার জন্য অনুমতি পাবেন বলে তারা আশাবাদী।