- ১৯৭৪ সালের সেপ্টেম্বরে সরকারিভাবে বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষ ঘোষণা করা হয়েছিল। স্বাধীনতার পরবর্তী সময় ৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুতর সংকটগুলোর একটি। মানবসৃষ্ট কারণ ছাড়াও প্রাকৃতিক কারণও এ দুর্ভিক্ষের জন্য দায়ী ছিল। ১৯৭৩ সালে কয়েকবার বন্যা এবং খরা দেখা দিয়েছিল। অন্যদিকে ১৯৭৩ সালের তুলনায় ১৯৭৪ সালে কম খাদ্যশস্য আমদানী হয়েছে। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশের জন্য দরকারি দু’টো মাস সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে খাদ্য আমদানীতে ব্যাপক ঘাটতি ঘটেছিল। তথ্য অনুসন্ধান করে দেখা যায়, ১৯৭৩ সালে যেখানে সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসে খাদ্য শস্য আমদানী করা হয়েছিল যথাক্রমে ২৬৩ ও ২৮৭ মেট্রিক টন ১৯৭৪ সালের একইসময়ে সেই আমদানী কমে আসে ২৯ ও ৭৬ মেট্রিক টনে। এদিকে, তখন কিউবাতে পাট রপ্তানী করার অপরাধে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে খাদ্য সাহায্য বন্ধ করে দিয়েছিল। তখন বিরাট শস্য ঘাটতি দেখা দেয়। সরকারের কাছেও পর্যাপ্ত পরিমাণ খাদ্যশস্য মজুদ ছিল না। সুতরাং ৭৪ এর দুর্ভিক্ষ অনেকটাই অবধারিত হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
- সদ্য জন্ম নেওয়া বাংলাদেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য সারা পৃথিবী থেকে- আর্জেন্টিনা হতে শুরু করে ইয়োগোশ্লাভিয়া, নেপাল থেকে নরওয়ে, ব্রিটেন থেকে বুলগেরিয়া খাদ্য সহায়তা আসতে থাকে। খাদ্য সাহায্যের দিক থেকে অবশ্য সবাইকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল ভারত। স্বাধীনতার পর হতে ১লা জানুয়ারি, ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত কেবল ভারতই দিয়েছিল প্রায় ১২ কোটি ডলারের সমপরিমাণ খাদ্য সাহায্য। এরপরও ৭৪ এর দুর্ভিক্ষে ভারতের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায় ।
১৯৭৪ এর দুর্ভিক্ষে ভারতের ভূমিকা:
- ৭৪ এর দূর্ভিক্ষের গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো চোরাচালান। সীমান্তের ১০ মাইল এলাকা ট্রেডের জন্য উম্মুক্ত করে দেয়া হয়। এর ফলে ভারতের সাথে চোরাচালানের জন্য “মুক্ত এলাকা” গড়ে উঠে। পাচার হয়ে যায় দেশের সম্পদ। চোরাচালানকৃত পণ্যের মধ্যে ছিল ধান, চাল, গম, পাট, যুদ্ধাস্ত্র, ঔষধ, মাছ, গরু, বনজ সম্পদ ইত্যাদি। জনতার মুখপত্র, ১ নভেম্বর ১৯৭৫ সালে প্রকাশিত সংবাদ হিসেবে সেই সময়ে ভারতে পাচার হয়ে যায় প্রায় ৫০০০ কোটি টাকার পন্য। চাউল চোরাচালন হয়ে (ভারতে) যায় তার পরিমাণ ১০ লাখ টন। মেজর অব: মো: রফিকুল ইসলাম বীরোত্তম “শাসনের ১৩৩৮ রজনী” পৃ: ১১৯-১২৬ তে উনি লিখেছেন, “দীর্ঘ ৩ টি বছর আমরা এমনটি প্রত্যক্ষ করেছি। আমাদের চোখের সামনে চাল-পাট পাচার হয়ে গেছে সীমান্তের ওপারে, আর বাংলার অসহায় মানুষ ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে বিশ্বের দ্বারে দ্বারে।”
- ৭৪ এর দুর্ভিক্ষের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল জালনোটের ব্যাপক বিস্তৃতি। স্বাধীন বাংলাদেশে টাকা ছাপানোর পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না থাকায় ভারতে টাকা ছাপানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তবে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য এটা ছিল একটি আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। এ কারণে অবাধে ভারত থেকে জাল টাকা বাংলাদেশে আসতে শুরু করে। বাজার ছয়লাপ হয়ে যায় জাল টাকায়। নামমাত্র মূল্যে পাটের চালান জাল টাকায় ভারতের পাচার হয়ে যায়। এভাবে অর্থনৈতিক অবক্ষয় আরো তরান্বিত হয়েছিল। সরকার ও জনগণও জিম্মি হয়ে পড়ে এই জালনোটের কাছে।
- ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষে সরকারী হিসেব অনুসারে ২৭,০০০ মানুষ অনাহারে মৃত্যুবরণ করে। বেসরকারি হিসেবে অনুমানিক ১,০০,০০০ থেকে ৪,৫০,০০০ জন প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে মৃত্যুবরণ করে। বাংলা ৭৬ এর মন্বন্তর এবং ৪৩ এর মন্বন্তরের পর ৭৪ এর দুর্ভিক্ষকে স্মরণকালের মধ্যে সবচেয়ে ভয়ানক হিসেবে গন্য করা হয়।