বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে স্বৈরাচারী ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনের ৮ মাস পেরিয়ে গেলেও সেই সময়ে সরকারের গুরুত্বপদগুলোতে হাসিনার ঘনিষ্ঠ কর্মকর্তারা এখনো বহাল তবিয়তে রয়েছেন। খোদ মাঠ প্রশাসনের দায়িত্বে থাকা মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে এখনও কর্মরত রয়েছে শেখ হাসিনার আস্থাভাজন ৪ জন জেলা প্রশাসক। প্রধান উপদেষ্টার দপ্তরেও রয়েছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের সাবেক নেতা। সম্প্রতি যুগ্মসচিব পদোন্নতিও বাগিয়ে নিয়েছেন এই ছাত্রলীগ নেতা।
এছাড়াও সচিব পদে পদোন্নতির জন্য জোর তদবির চালাচ্ছেন শেখ হাসিনার সুবিধাভোগী কয়েকজন অতিরিক্ত সচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তা। উপদেষ্টাদের ম্যানেজ করে আধাসরকারি পত্রও নিয়েছেন তারা। যদিও শেখ হাসিনার রোষানলে দীর্ঘদিন বঞ্চিত থেকেছেন এমন শতাধিক কর্মকর্তা সচিব পদে পদোন্নতির যোগ্য রয়েছেন। জনপ্রশাসন সূত্রে এসব তথ্য জানাগেছে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, সরকারের মাঠ প্রশাসন নিয়ন্ত্রণকারী মন্ত্রণালয় হলো মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। এই বিভাগে একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুবিভাগ হলো জেলা ও মাঠ প্রশাসন অনুবিভাগ। এই অনুবিভাগের প্রধান হলেন অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ খালেদ রহীম।
বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের ১৫তম ব্যাচের এই কর্মকর্তা শেখ হাসিনার আস্থাভাজন হওয়ায় ২০১৭ সালের ১১ মে নীলফামারীর জেলা প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ পান। এর আগে তিনি একজন সংসদীয় স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যানের একান্ত সচিব হিসেবে কাজ করেছেন। শেখ হাসিনার পতনের আগ পর্যন্ত শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ এই অনুবিভাগে তার যুগ্মসচিব হিসেবে কর্মরত রয়েছেন বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের ২২ ব্যাচের মোহাম্মদ খোরশেদ আলম খান। হাসিনার আস্থাভাজন হওয়ায় এই কর্মকর্তাকে ২০২০ সালের ৭ জুলাই নোয়াখালীর জেলা প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ পান। এর আগে তিনি ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রীর একান্ত সচিব হিসেবে প্রায় দেড় বছর দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়াও এই কর্মকর্তা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, ডাক ও টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের প্রশাসন অধিশাখার যুগ্মসচিব হিসেবে কর্মরত রয়েছে বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের ২০ ব্যাচের কর্মকর্তা মো: নজরুল ইসলাম সরকার। শেখ হাসিনার আস্থাভাজন হওয়ায় এই কর্মকর্তা ২০১৯ সালের ২২ আগষ্ট চুয়াডাঙ্গার জেলা প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ পান। প্রায় আড়াই বছর সেখানে দায়িতপালন শেষে তাকে যুগ্মসচিব পদোন্নতি দিয়ে বাংলাদেশ টেলিভিশনের উপমহাপরিচালক হিসেবে পদায়ন করা হয়। এরপর বেসামরিক বিমান পরিবহণ ও পর্যটন মন্ত্রণাল ও পরে ২০২২ সালে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পদায়ন করা হয়। এর আগে এই কর্মকর্তা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, সড়ক পরিবহণ ও মহাসড়ক বিভাগের মত গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ে কর্মরত ছিলেন।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের আইন অনুবিভাগের যুগ্মসচিব হিসেবে কর্মরত রয়েছেন বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের ২২ ব্যাচের কর্মকর্তা মো: জিয়াউল হক। শেখ হাসিনার আস্থাভাজন এই কর্মকর্তা তার কার্যালয়ের পরিচালক হিসেবে ২০১৮ সালের ১৬ জুলাই যোগদান করেন। প্রায় দুই বছর সেখানে দায়িত্ব পালন করার পর তাকে বগুড়ার জেলা প্রশাসক হিসেবে পদায়ন করা হয়। এছাড়াও শেখ হাসিনার শাসনামলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, কৃষি মন্ত্রণালয়, গৃহায়ন ও গণপুর্ত মন্ত্রণালয়ের মত গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ে তিনি কর্মরত ছিলেন।
অর্ন্তবর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার ৮ মাস পরেও প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের পরিচালক হিসেবে কর্মরত আছেন বিসিএস গণপূর্ত ক্যাডারের ২১ ব্যাচের কর্মকর্তা একেএম ফজলুর রহমান। বুয়েট ছাত্রলীগের এই নেতা শেখ হাসিনার আস্থাভাজন হওয়ায় তার কার্যালয়ের পরিচালক হিসেবে ২০২০ সালের ৫ জুলাই পদায়ন করা হয়। এরপর অর্ন্তবর্তী সরকার দায়িত্ব নিলেও তাকে বদলী করা হয়নি। এর আগে এই কর্মকর্তা রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, গণপূর্ত অধিদপ্তর, নৌ পরিবহণ মন্ত্রণালয়, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ে কর্মরত ছিলেন।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে সচিব পদ শূন্য থাকায় সচিবের রুটিন দায়িত্ব পালন করছেন অতিরিক্ত সচিব মো: তোফাজ্জেল হোসেন। বিসিএস ১৫ ব্যাচের প্রশাসন ক্যাডারের এই কর্মকর্তা এখানে যোগদানের আগে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব হিসেবে কাজ করেছেন। ২০২৩ সালে শ.ম রেজাউল করিমের হাত ধরে এই মন্ত্রণালয়ে বদলী হয়েছিলেন।
স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার শাসনামলে গত ১৫ বছর প্রশাসনে দাপটের সাথে চাকুরী করেছেন এই কর্মকর্তা। পদোন্নতিও পেয়েছেন নিয়মিত। ২০০৬ সালের ৯ নভেম্বর থেকে ২০০৯ সালের ৮ অক্টোবর পর্যন্ত ছিলেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিবের একান্ত সচিব। এরপর মৎস ও প্রাণী সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিবের একান্ত সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ২০১০ সালের ১০ নভেম্বর পর্যন্ত। এরপর তাকে নিয়োগ দেয়া হয় স্বাস্থ্য মন্ত্রী আ.ফ.ম রুহুল হকের একান্ত সচিব হিসেবে। সেখানে তিনি ২০১৩ সালের ১৪ মার্চ পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন।
এরপর ১১ মাস পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে কাজ করার পর তাকে আবারও পানি সম্পদ প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম বীরপ্রতিক এর একান্ত সচিব হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। সেখানে তিনি ২০১৮ সালের নির্বাচনের পূর্ব পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। রাতের ভোটে পূনরায় ক্ষমতায় এসে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় পদায়ন করা হয় এই কর্মকর্তাকে। সেখানে প্রায় ৪ বছর দায়িত্ব পালনের পর গত ২০২৩ সালের ১১ জানুয়ারী মৎস ও প্রাণী সম্পদ মন্ত্রণালয়ে অতিরিক্ত সচিব হিসেবে পদায়ন করা হয়।
এই কর্মকর্তাকে সচিব পদোন্নতি দিতে আধা-সরকারি পত্র দিয়েছেন মৎস ও প্রাণী সম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার।
ডিওতে তিনি লিখেছেন, তোফাজ্জেল হোসেনের মতো একজন মেধাবী এবং প্রতিভাবান কর্মকর্তাকে মৎস ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব পদে পদায়ন করা হলে তিনি স্বীয় মেধা, সততা ও দক্ষতা কাজে লাগিয়ে এ মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক দায়িত্ব পালনসহ উন্নয়ন প্রকল্পসমুহের যাবতীয় কাজ সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে মর্মে আমি বিশ্বাস করি।
এমতাবস্থায় তাকে সচিব হিসেবে পদোন্নতি প্রদানপূর্বক মৎস ও প্রাণী সম্পদ মন্ত্রণালয়ে পদায়ন করার জন্য অনুরোধ করছি। আপনার সিদ্ধান্ত গ্রহণে সময়ের প্রয়োজন হলে এ মন্ত্রণালয়ের সচিব পদে অন্য কাউকে পদায়ন না করে তাকে আপাতত এ রুটিন দায়িত্বে রেখে দেয়ার অনুরোধ করছি।
এছাড়াও সচিব হওয়ার জোর তদবির চালাচ্ছেন বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের ১৫তম ব্যাচের কর্মকর্তা মফিদুর রহমান। এই কর্মকর্তা বর্তমানে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সচিবের রুটিন দায়িত্ব পালন করছেন। তার পদোন্নতির জন্য সরকারের একজন উপদেষ্টা জোর তদবির চালাচ্ছেন। যদিও এই কর্মকর্তা আওয়ামীলীগের আস্থাভাজন হওয়ায় নিয়মিত ব্যাচের সাথে ২০১২ সালে উপসচিব, ২০১৮ সালে যুগ্মসচিব এবং ২০২২ সালে অতিরিক্ত সচিব হিসেবে পদোন্নতি পেয়েছেন।
চাকুরীজীবনে কাজ করেছেন অর্থ বিভাগ, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, ঢাকা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তার মত গুরুত্বপূর্ণ জায়গায়। এই কর্মকর্তা অর্থ বিভাগের একটি প্রকল্পে পদায়ন থাকলেও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রকাশিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের প্রশাসন সান্নিধ্যের দুর্লভ স্মৃতি বইয়ের সহযোগী সম্পাদক হিসেবে কাজ করেছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে জনপ্রশাসনের অতিরিক্ত সচিব পদমর্যাদার একাধিক কর্মকর্তা বলেন, হাসিনার ঘনিষ্ট ও প্রভাবশালী এসকল কর্মকর্তাকে গুরুত্বপূর্ণ পদ থেকে বদলী করা হচ্ছেনা। নীরিহ কর্মকর্তদের বদলী করে স্বৈরাচারীর দোষর রাঘব বোয়ালদের বহাল তবিয়তে রেখে আইওয়াশ করছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।