মিয়ানমার ও বাংলাদেশের মধ্যে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে চীন কেন ভূমিকা রাখছে?

 

সম্প্রতি বাংলাদেশি দৈনিকগুলোতে প্রকাশিত সংবাদের জন্য আমাদের এখন নতুন আশা আছে।
মিয়ানমার হঠাৎ করেই রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ নিয়েছে। এই উদ্যোগের অংশ হিসেবে
ইয়াঙ্গুনে নিযুক্ত আটটি দেশের কূটনীতিকদের গত সপ্তাহে রাখাইনে নিয়ে যাওয়া হয়। তাদের মধ্যে
বাংলাদেশ, ভারত ও চীনের কূটনীতিকরাও ছিলেন।
মিয়ানমার এখন পাইলট প্রকল্পের আওতায় বাংলাদেশ থেকে এক হাজারের বেশি রোহিঙ্গা
প্রত্যাবাসনের বিষয়টি সামনে এনেছে। স্থানীয় গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, মূলত চীনের চাপেই
মিয়ানমার এই উদ্যোগ নিয়েছে।
রাখাইন থেকে রোহিঙ্গাদের বিতাড়িত করার তিন মাস পর নভেম্বর ২০১৭ সালে প্রত্যাবাসনের
বিষয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে বাংলাদেশ। এই চুক্তির পেছনে ছিল চীন। কিন্তু
গত ছয় বছরেও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে কোনো অগ্রগতি হয়নি।
২০১৮ সালে বাংলাদেশ এবং মিয়ানমার নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রত্যাবাসনের একটি রাউন্ড শুরু
করতে ব্যর্থ হয়েছিল। ২০১৯ সালে প্রত্যাবাসন পুনরায় শুরু করার প্রচেষ্টা পরে চীন মধ্যস্থতা
করেছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত কিছুই হয়নি। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী একটি
অভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করে। এ ঘটনার পর রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে আলোচনা
কার্যত থেমে যায়।
২০২৩ সালের ১০ মার্চ বাংলাদেশ, ভারত, চীনসহ আটটি দেশের রাষ্ট্রদূত রাখাইন সফর করেন।
বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে প্রত্যাবাসনের প্রস্তুতি দেখাতে এই
কূটনীতিকদের নেওয়া হয়েছে।
চীন প্রত্যাবাসন আলোচনায় যোগ দেওয়ার পর ২০২০ সাল থেকে রাখাইনে রোহিঙ্গাদের স্বল্প পরিসরে
প্রত্যাবর্তন নিয়ে আলোচনা চলছে। কয়েক মাস ধরেই এই ইস্যুতে মিয়ানমারের ওপর চাপ দিয়ে
আসছে চীন। রোহিঙ্গা সমস্যার গভীরে না গেলেও, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর জোট আসিয়ানও
ছোট পরিসরে হলেও প্রত্যাবাসন শুরু করতে চায়। এরই অংশ হিসেবে মিয়ানমারের মংডু ও
সিটওয়ে শহরে অন্তর্বর্তী ক্যাম্পসহ ৮টি দেশের ১১ জন কূটনীতিককে মাঠে দেখানো হয়েছে।
রাখাইন পরিদর্শনকারী কূটনীতিকরা পর্যবেক্ষণ করেছেন যে ২০১৮ থেকে ২০২০ সালের তুলনায়
রাখাইনের পরিস্থিতি এখন কিছুটা ভালো। সেখানে অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুত (আইডিপি) ক্যাম্পে
বসবাসকারী রোহিঙ্গারা এখন সিটওয়ে শহরে যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। কিন্তু বছর দুয়েক আগেও

ক্যাম্পের ধারেকাছে কাউকে যেতে দেওয়া হয়নি। এছাড়া গত বছর সিটওয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায়
২৩০ জন রোহিঙ্গা শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছিল। ২০১২ সালের পর এই প্রথম এই বিশ্ববিদ্যালয়ে এত বেশি
রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধি ভর্তি হল। এছাড়া রাখাইনে রোহিঙ্গারা স্বাস্থ্যসেবা পাচ্ছে।
বর্ষার প্রস্তুতি
তিন বছর আগে বেইজিংয়ের মধ্যস্থতায় পরিবারভিত্তিক রোহিঙ্গাদের নির্দিষ্ট গ্রামে প্রত্যাবাসনের
বিষয়ে আলোচনা শুরু হয়। কিন্তু করোনা মহামারী ও মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ক্ষমতা দখলের
কারণে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া থমকে যায়। দীর্ঘ বিরতির পর মিয়ানমার এখন রোহিঙ্গাদের
প্রত্যাবাসনে তৎপর। এ কার্যক্রমের আসল উদ্দেশ্য কী, প্রত্যাবাসন সম্ভব কি না, এসব প্রশ্ন সামনে
আসছে।
রাখাইনের পরিস্থিতি এই মুহূর্তে ভালো। আরাকান আর্মি কয়েক মাস আগে মিয়ানমারের সামরিক
সরকারের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিল। তবে এখন পরিস্থিতি অনেকটাই শান্ত। এ অবস্থায়
হাজার হাজার রোহিঙ্গাকে নিয়ে প্রত্যাবাসন শুরু করা অসম্ভব নয়। চীন আগামী জুনে পুরোদমে বর্ষা
মৌসুম শুরু হওয়ার আগে প্রত্যাবাসনের জন্য চাপ দিচ্ছে। আসিয়ানও চায় প্রত্যাবাসন শুরু হোক,
ছোট পরিসরে।
চীন কেন হঠাৎ করে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ইস্যুতে এত জোর দিচ্ছে তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
প্রত্যাবাসন মিয়ানমারের সামরিক সরকারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ কমিয়ে দেবে। এছাড়া জান্তা
সরকারের কিছু গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হতে পারে বলেও মনে করছে বেইজিং।
বাংলাদেশে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের জন্য একটি ত্রিপক্ষীয় পদ্ধতি ২০১৯ সালের
সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের সময় বাংলাদেশ, মিয়ানমার এবং চীন
যৌথভাবে প্রণয়ন করেছিল। রাখাইন রাজ্যের নিরাপত্তা পরিস্থিতির কারণে এখন পর্যন্ত প্রত্যাবাসন
সম্ভব হয়নি। চীন ২০১৮ সালে ত্রিপক্ষীয় বৈঠকের প্রথম রাউন্ড শুরু করেছিল এবং ২০ জানুয়ারী,
২০২১-এ একটি ভার্চুয়াল ত্রিপক্ষীয় বৈঠক হয়েছিল। আলোচনার উপসংহারে ২০২১ সালের জুনের
মধ্যে প্রত্যাবাসন শুরু হওয়ার কথা ছিল, তবে এটি এখনও হয়নি। রোহিঙ্গাদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের
প্রক্রিয়া শুরু করে এবং চীনের নির্দেশে রাখাইনে তাদের প্রত্যাবর্তনের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি
করে।
চীনের ভাইস পররাষ্ট্রমন্ত্রী লুও ঝাওহুই রোহিঙ্গা মুসলমানদের প্রত্যাবাসন নিয়ে আলোচনার জন্য ১৯
জানুয়ারী, ২০২২-এ মিয়ানমার ও বাংলাদেশের মধ্যে একটি ভার্চুয়াল বৈঠকে মিয়ানমার ও
বাংলাদেশের প্রতিনিধিদের সাথে যোগ দিয়েছিলেন। আলোচনার পর সব পক্ষই প্রত্যাবাসন শুরু
করতে সম্মত হয়েছে। সংকটের অন্তর্নিহিত সমস্যার সমাধান এবং সেখানকার পরিস্থিতির উন্নতির
জন্য চীনের আন্তরিক প্রচেষ্টা।

মায়ানমারের উপর চীনের প্রভাবের ফলে এই বিরোধ নিরসনে চীন গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে।
মিয়ানমারে চীনের স্বার্থ রক্ষার জন্য রাখাইন রাজ্যকে স্থিতিশীল রাখতে হবে। রাখাইন রাজ্যে চীন
যে অবকাঠামো তৈরি করেছে তা এই অঞ্চলের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে বড় প্রভাব ফেলবে। এই সমস্ত
সুযোগ-সুবিধা চালানোর জন্যও মানবসম্পদ প্রয়োজন। এই রোহিঙ্গা ও রাখাইনদের বিভিন্ন সুযোগ-
সুবিধা ও সেক্টরে দক্ষতার সাথে কাজ করার জন্য চীন প্রশিক্ষণ দিতে পারে। একটি স্থিতিশীল
রাখাইন পর্যটকদের আকর্ষণ করবে এবং এই অঞ্চলের পর্যটন শিল্প বৃদ্ধি পাবে। রাখাইন ও
রোহিঙ্গারাও ওই সেক্টরে কাজ করতে পারে। এটি রাজ্যের বেকারত্ব সমস্যা মোকাবেলা করবে।
অর্থনীতির উন্নতির সাথে সাথে জাতিগত বিদ্বেষের মাত্রা ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাবে এবং সম্প্রীতি নিশ্চিত
করা যেতে পারে। ভারত মহাসাগরে উপস্থিতি নিশ্চিত করার পাশাপাশি চীনের সামরিক পরিকল্পনার
জন্য রাখাইন অঞ্চল অপরিহার্য।
পশ্চিমা বিশ্ব রোহিঙ্গা সংকট সমাধান এবং তাদের নিজ দেশে ফিরিয়ে নেওয়ার বিষয়ে তেমন কিছু
বলেনি। অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞাসহ বিভিন্ন সিদ্ধান্তের কথা বলেছেন তিনি। বাস্তবতা হলো, তাদের এই
কথাগুলো শুধু ‘ঠোঁট সেবা’ ছাড়া আর কোনো কাজে আসেনি। আমরা সব সময় বলেছি, রোহিঙ্গা
সংকট সমাধানে চীনের ভূমিকা ও সহযোগিতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। চীন সক্রিয় হলে এই সংকট দ্রুত
সমাধান করা সম্ভব। বাংলাদেশ সরকারের উচিত চীনের পাশাপাশি মিয়ানমারের সঙ্গে ত্রিপক্ষীয়
সমঝোতার উদ্যোগ নেওয়া। অবশেষে সেই পথেই হাঁটতে শুরু করেছে সরকার। এটা খুবই ইতিবাচক
এবং সংকট সমাধানের পথ ধীরে ধীরে কিন্তু নিশ্চিতভাবে প্রশস্ত হচ্ছে। চীনের সঙ্গে মিয়ানমারের
বহুমাত্রিক ঐতিহাসিক সম্পর্ক রয়েছে। চীন দেশের কৃষি, শিল্প ও বাণিজ্যে ব্যাপক সহযোগিতা দিয়ে
আসছে। মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ও গৃহযুদ্ধ সত্ত্বেও দুই দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক সম্পর্ক প্রসারিত
হচ্ছে।
আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) রোহিঙ্গা গণহত্যা মামলায় মিয়ানমারের পাল্টা যুক্তির
সময়সীমা ২৪ এপ্রিল ধার্য করা হয়েছে। মিয়ানমারের জান্তা সরকারের হঠাৎ করে রোহিঙ্গাদের
প্রত্যাবাসনের সাথে এই বিষয়টির কোনো সম্পর্ক আছে কিনা তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
বিশ্লেষকরা অবশ্য স্বল্পমেয়াদী রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে মিয়ানমারের ভাবমূর্তি উন্নত করার সম্ভাবনা
দেখছেন না। তারা বলছেন, শুধু প্রত্যাবাসন শুরু করে গণহত্যার দায় থেকে রেহাই পাওয়ার
কোনো সুযোগ নেই। তবে মিয়ানমার হয়তো আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সাথে আইসিজেকে বোঝাতে
চাইবে যে তারা পরিস্থিতির উন্নতির জন্য পদক্ষেপ নিচ্ছে। আইন বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রত্যাবাসন
শুরুর উদ্যোগ নিলে মিয়ানমারের ভাবমূর্তি অনেক বেশি উজ্জ্বল হবে বলে মনে করার অবকাশ
রয়েছে।

তবে চীনের মধ্যস্থতায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে চলমান আলোচনা খুবই ইতিবাচক। এ ব্যাপারে
এগিয়ে আসার জন্য চীনকে ধন্যবাদ। বলাই বাহুল্য, বিশ্বের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক চীনের সঙ্গে
মিয়ানমারের। গোটা বিশ্ব যখন মিয়ানমারের বিরুদ্ধে, তখন চীন তার ছায়া ফেলছে। তাদের বন্ধুত্ব
দৃঢ় বন্ধনে আবদ্ধ। রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে সবচেয়ে প্রভাবশালী ভূমিকা রাখতে পারে চীন। এটা
প্রমাণিত হয়েছে যে, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র ও জাতিসংঘসহ পশ্চিমা বিশ্ব
মিয়ানমারকে যতই হুমকি-ধমকি দিচ্ছে না কেন, কিছুই করা হচ্ছে না।
চীন বাংলাদেশের শীর্ষ বাণিজ্য ও উন্নয়ন সহযোগী হওয়ার পাশাপাশি বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে
ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক ও সামরিক সম্পর্ক রয়েছে। রোহিঙ্গা ইস্যুটি অবশ্যই মিয়ানমারে সুরাহা করতে
হবে, একটি দেশ যেখানে চীনের উল্লেখযোগ্য প্রভাব রয়েছে। ফলে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে চীন বড়
ধরনের অবদান রাখতে শুরু করেছে।
আমরা মনে করি এই ক্ষেত্রে চীনের ভূমিকা বিশ্বশান্তিকে এগিয়ে নেওয়ার ভবিষ্যৎ প্রচেষ্টার জন্য
একটি মডেল হিসেবে কাজ করবে, বিশেষ করে মিয়ানমারের সরকারের নির্লজ্জ উদাসীনতার কারণে
এবং আংশিকভাবে আন্তর্জাতিকদের আন্তরিক প্রচেষ্টার কারণে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের বারবার
ব্যর্থতার আলোকে। সম্প্রদায় এবং যখন ইতিহাসের সবচেয়ে বড় শরণার্থী সংকটের দীর্ঘমেয়াদী
সমাধান খুঁজে বের করার কথা আসে, তখন আমরা চীনের সম্ভাবনার প্রতি আন্তরিকভাবে বিশ্বাস
করি।

 

লেখিকা: মেহজাবিন বানু, কলামিস্ট, উন্নয়ন ও স্থানীয় সমাজকর্মী।

Exit mobile version