Site icon দৈনিক দেশের সংবাদ deshersangbad.com

রংপুরে হারিয়ে যাচ্ছে মৃৎশিল্প

রংপুর বিভাগীয় প্রতিনিধি: গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্যের মধ্যে একটি হলো মৃৎশিল্প। অতি প্রাচীন শিল্পের একটি মৃৎশিল্প। আবহমান বাংলায় এ মৃৎশিল্পের বিরাট অংশজুড়ে রয়েছে পাল বা মৃৎশিল্পীগণ। প্রাচীনকাল থেকে এ শিল্পের সাথে জড়িত হিন্দু ধর্মাবলম্বী পাল বর্ণের লোকেরা। পালরা মাটি দিয়ে কঠোর পরিশ্রমে সুনিপুণ হাতে তৈজসপত্র তৈরির মাধ্যমে জীবন-জীবিকা নির্বাহ করে আসছে। আশির দশকের দিকেও গ্রামের মানুষরা মাটির তৈরি বিভিন্ন ধরনের হাঁড়ি, সরা, কলস, বাসন, বদনা, মুড়ি ভাজার খোলা, কোলা, ভাটি ও মঠসহ গৃহস্থালির নানা উপকরণ ব্যবহার করতো। আর এসব তৈরি হতো পাল পল্লীতে। বিশ্বায়নের ফলে ওসব এখন অচল ও বিলুপ্তির পথে। এখন পালরা মাটির তৈরি নার্সারির টব, দইয়ের পাতিল, বাটনা, ঢাকনা আর অনেকেই দেবদেবীর মূর্তি বানানোর কাজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে। ফলে অনেকেই পেশা বদলাতে বাধ্য হয়েছে। তারপরও যারা এখনো বংশ পর¤পরায় এ পেশার মায়া কাটাতে না পেরে এখনো কাজ করে যাচ্ছে তাদের সঙ্গী হয়েছে অভাব-অনটন। একে তো জীবিকার দুর্দিন তার উপর অভিযোগ রয়েছে এ জনগোষ্ঠীরা নাকি পান না কোনো সরকারি সহযোগিতা। সব মিলিয়ে ভালো নেই রংপুরের পীরগাছা উপজেলার পাল সম্প্রদায়ের মানুষ। উপজেলার দুধিয়াবাড়ী পালপাড়ায় দেখা যায়, অনেকেই মাটি দিয়ে দইয়ের সড়া, টব, বাটনা তৈরির কাজ করছে। কোথাও সেগুলো রোদে শুকাতে দেওয়া হয়েছে। কেউ আবার শুকানো মাটির জিনিসগুলো পোড়ানোর জন্য চুল্লির উপরে থরে থরে সাজাচ্ছে। আবার কোথাও বা বিক্রয়ের জন্য ভ্যানের উপর সাজানো হচ্ছে মাটির জিনিসগুলো।সত্তোর্ধ রনজিত পাল বলেন, শিল্পটি আর আগের মত নেই। স্টিল, সিরামিক, মেলামাইন, প্লাস্টিক ও সিলভারের তৈজসপত্রের ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় এখন মাটির জিনিষের চাহিদা নেই বললেই চলে। বেচা-বিক্রি কমে গেছে। এলাকায় এখন আর মাটি পাওয়া যায় না। বদরগঞ্জ উপজেলা থেকে মাটি ট্রাকে করে ক্রয় আনতে হয়। মাটির দাম, জ্বালানী খরচ বেড়েছে। আগের মতো আর আয় হয় না। অনেকেই পেশা বদল করছে। সরকার থেকে আমরা কোনো সাহায্য সহযোগিতা পাইনা। আগে এই গ্রামের সবাই এ কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতো। এখন ৪০টি পরিবার এ কাজের সাথে যুক্ত রয়েছে। যারা এ পেশার মায়া ছাড়তে পারে না, তারা কষ্ট হলেও বাপ-দাদার এ পেশাটাকে ধরে রেখেছে। আতশী রানি পাল বলেন, ৩ শত নার্সারির টব তৈরি করতে প্রায় ৩-৪ দিন লাগে। বিক্রয় হয় ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২শত টাকা। এর মধ্যে রয়েছে কাঁচামাল ও জ্বালানি খরচ। সব মিলে পুষিয়ে উঠতে পারা যায় না। সংসার চালাতে খুব কষ্ট হয়। ছেলে-মেয়েদেরকে ভালো স্কুলে পড়াতে পারি না। সুমতী রানী মৃৎশিল্পী আক্ষেপ করে বলেন, সবাই শুধু ছবি তোলে, ভিডিও করে নিয়ে যায়। কিন্তু কোনো সাহায্য সহযোগিতা পাই না। আমাদের যে খারাপ অবস্থা তা কেউ দেখে না। কি লাভ ছবি তুলে, ভিডিও করে। উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা এনামুল হক বলেন, সমাজসেবা অধিদপ্তর অসহায় ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জন্য কাজ করে যাচ্ছে। অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর মধ্যে পাল অন্যতম। তারা যে শুধু একটা জনগোষ্ঠী তা না, তারা একটি শিল্পের অংশ। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ণের একটি প্রকল্প রয়েছে। এ প্রকল্পের আওতায় তাদের শিল্পটাকে ধরে রাখার জন্য কাজ করা হচ্ছে। তারা এ প্রকল্পের মাধ্যমে যাতে স্বাবলম্বী হয় তা নিয়েও সমাজসেবা কাজ করে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে জরিপ করে তালিকা উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাদের সন্তানদের জন্য শিক্ষা উপবৃত্তি প্রদান করা হচ্ছে। এ ছাড়াও অন্যান্য ভাতা কার্যক্রমও চালু আছে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. নাজমুল হক সুমন বলেন, পাল বাংলাদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্যের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। সরকার সর্বস্তরের পেশার জনগণের জন্য বিভিন্ন ধরনের সুবিধা প্রদানের চেষ্টা করে যাচ্ছে। পালদের জন্য বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা রয়েছে। তারা চাইলে সমাজসেবা অধিদপ্তরের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে ঋণ পেতে পারে।

Exit mobile version