আলিফ হোসেন,তানোরঃ
রাজশাহী অঞ্চলে সংঘবদ্ধ মাটিখেকো চক্রের দৌরাত্ম্যে পাল্টে যাচ্ছে বরেন্দ্রের চিরচেনা রূপ,বিপন্ন প্রায় হুমকির মুখে জীববৈচিত্র্য। ফসলি জমি বা উঁচু ভুমি কেটে মাটি বিক্রি যেনো নিয়মে পরিণত হয়েছে। সুত্র জানায়, সারাদিন কিংবা সারারাতের জন্য মাটি কাটতে বিভিন্নমহলকে ম্যানেজ করতে গুণতে হয় ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা। তবে মাঝে মাঝে প্রশাসনের কর্মকর্তারা এসে দিনে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করেন। কিন্তু রাতে আবার ঠিকই মাটি কাটা শুরু হয়ে যায়।
জানা গেছে, ফসলি জমির মাটি কেটে বিক্রি করা হয় ইটভাটায়। গত রবিবার সকালে গোদাগাড়ী উপজেলার মাছমারা শ্রীপুর গ্রামে মাটি কাটা দেখা গেছে।
উপরের উঁচু জমি ঢাল হয়ে নিচে নেমে এসেছে। আবার নিচ থেকে উপরে উঠেছে। কোথাও কোথাও আবার আঁকাবাঁকা। দূর থেকে দেখলে পাহাড়ি এলাকার ছোট টিলা বা ঢিবির মত মনে হয়। বরেন্দ্র এলাকার মানুষ ডাইং বলেন। গত এক দশক আগেও বরেন্দ্র অঞ্চলের মাঠে কৃষিজমির এ ধরনের চিত্র পরিলক্ষিত হয়েছে। এ অঞ্চলের মাটি অনেকটা লাল রংয়ের। এঁটেল ও দোআঁশ মিলিয়ে উর্বর মাটিতে ফলে নানান ফসল। কিন্তু মাটিখেকোদের কারণে এখন পাল্টে গেছে বরেন্দ্রের সেই চিরচেনা রূপ।
এদিকে দেশের প্রচলিত আইনে জমির উপরিভাগের মাটি কাটা নিষিদ্ধ। বরেন্দ্র অঞ্চল খ্যাত রাজশাহীর তানোর,পবা, মোহনপুর ও গোদাগাড়ী উপজেলায় একটি শক্তিশালী সংঘবদ্ধ মাটিখেকো সিন্ডিকেট বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। সিন্ডিকেটে সক্রিয় প্রায় ২০ জন সদস্য বরেন্দ্রর কৃষি জমির উপরিভাগের মাটি দিনরাত ২৪ ঘণ্টা কাটছে। এসব জমির মাটি ইটভাটায় ও পুকুর ভরাটের জন্য সরবরাহ করা হচ্ছে। ইটভাটায় রয়েছে এঁটেল মাটির ব্যাপক চাহিদা।
অভিযোগ উঠেছে, স্থানীয় প্রশাসনকে ‘ম্যানেজ’ করেই মাটি কাটছে মাটিখেকো সিন্ডিকেটের সদস্যরা। আর একাজ নির্বিঘ্নে অব্যাহত রাখতে সিন্ডিকেটের সদস্যরাই অনেতিক সুবিধা দিয়ে প্রশাসনকে ‘ম্যানেজ’ করছে বলে নিজেরাই স্বীকার করেছেন। তবে স্থানীয় প্রশাসন এবং পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, তথ্য পেলেই মাটি কাটা বন্ধ করা হয়। আমাদের অভিযান চলমান রয়েছে।
জানা গেছে, গোদাগাড়ী উপজেলার রাজাবাড়িহাট-ছয়ঘাটি এলাকায় মাটি কেটে বিক্রি করছেন জনৈক টিয়া আলম নামের এক ব্যক্তি। টিয়া মাটিখেকো সিন্ডিকেটের মূলহোতা বলে জানান স্থানীয়রা। তবে অভিযোগের ব্যাপারে টিয়াকে ফোন দেওয়া হলে তিনি ধরেন নি। উপজেলার মাছমারা এলাকায় মাটি কাটছেন জনৈক কামরুল ইসলাম ও জহুরুল ইসলাম। কামারপাড়া এবং অভয়াসহ আশপাশের এলাকায় মাটি কাটেন জনৈক শাহীন। ফুলতলা এলাকায় জনৈক শাকিল, সিধনা দরগা এলাকায় জনৈক মিনহাজ, ধনঞ্জয়পুর জনৈক বায়েজিদ,তানোরের মুন্ডুমালা এলাকায় জনৈক মমিন ও হাসান, কলমায় সাদেকুল,বিল্লীতে রকি, সরনজাইয়ে মতি ও আশরাফুল, মাদারীপুরে আলমগীর, মোহনপুরের কেশরহাট জামাল, নওগাঁর মান্দার ভারশোঁ জনৈক রাজু ও রাশেলপ্রমুখ।
স্থানীয়রা জানান,এদের অধিকাংশ এক সময় দিনমজুরের কাজ করতেন। এখন প্রত্যেকে ৫ থেকে ১০টি পর্যন্ত ট্রাক্টরের মালিক হয়েছেন এই মাটি বিক্রি করেই। একেকটি ট্রাক্টরের দাম ১৪ থেকে ১৫ লাখ টাকা। মাটিখেকো সিন্ডিকেটের এসব সদস্যদের অনেকে ইতোমধ্যে অঢেল সম্পদের মালিক হয়েছেন।
সামগ্রিক বিষয়ে জানার জন্য গত শনিবার দুপুরে সিন্ডিকেটের সদস্য জনৈক কামরুল ইসলামকে মাটির ক্রেতা সেজে ফোন দেয়া হয়। তখন তিনি জানান, বর্তমানে তিনি সাহাব্দিপুর এলাকায় মাঠ (বরেন্দ্র ভূমি) থেকে মাটি কাটছেন। প্রতি ট্রাক্টর মাটির দাম নেবেন এক হাজার ৪০০ টাকা। কামরুল জানান, স্থানীয় প্রশাসনকে ম্যানেজ করেই মাটি কাটা হবে। একইভাবে প্রশাসনকে ম্যানেজ করে ভরাট করা হবে পুকুর। কোনো অসুবিধা নেই। তিনিই বিষয়গুলো দেখবেন।
সিন্ডিকেটের আরেক সদস্য অভয়ার শাহিনকেও ফোন করা হয়। তিনিও জানান, এখন তিনি ঘনশ্যামপুর মাঠের মাটি কাটছেন। তিনিও চাহিদা অনুযায়ী মাটি সরবরাহ করতে পারবেন। সব মাটিই বরেন্দ্র এলাকার জমি থেকে দেওয়া হবে জানিয়ে শাহিন বলেন, ‘তবে খরচ একটু বেশি পড়বে। পুলিশ-প্রশাসন সবাইকে ম্যানেজ করেই মাটি কাটতে হবে। তা না হলে মাটি কাটা যায় না।’
এবিষয়ে জানতে চাইলে গোদাগাড়ী থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) রুহুল আমিন বলেন, ‘আমাদের সঙ্গে ওদের কোনো যোগাযোগ নেই। টাকা নেওয়ার অভিযোগ ভিত্তিহীন। এগুলো এসিল্যান্ডের (সহকারী কমিশনার-ভূমি) এখতিয়ার। তিনি যখন ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার জন্য বের হন, তখন আমরা সহযোগিতা করি।’
এদিকে পবা উপজেলার বালিয়া এলাকায় হানিফ নামের এক ব্যক্তির পাঁচ বিঘা আয়তনের একটি পুকুর ভরাট চলছে। পুকুর ভরাটের কাজটি করছেন রাজশাহী নগরীর উপকণ্ঠ কাশিয়াডাঙ্গা এলাকার বাসিন্দা মিলন হোসেন। যোগাযোগ করা হলে মিলন জানান, গোদাগাড়ীর রাজাবাড়ি এলাকার টিয়া আলম তার পুকুরে বরেন্দ্র অঞ্চল থেকে মাটি সরবরাহ করছেন। গোদাগাড়ীর মাছমারা শ্রীপুর আবাসন প্রকল্প এলাকার ফসলি জমি থেকে বর্তমানে মাটি কেটে বিক্রি করা হচ্ছে। গত শনিবার সকালে সরেজমিন দেখা গেছে, আকবর, বুলবুল ও মোজাহার নামের তিন বর্গাচাষীর জমি থেকে মাটি কাটা হচ্ছে। এসব মাটি যাচ্ছে পার্শ্ববর্তী ইটভাটায়। আকবর জানালেন, তাদের জমির মালিকের নাম তেঁতুলি মাস্টার। ১০-১২ দিন আগে মাছমারা এলাকার মাটি সিন্ডিকেটের আরেক হোতা জহুরুল ইসলাম মাটি কাটা শুরু করেছেন। আকবর বলেন, ‘জমিটা পাশের জমির চেয়ে উঁচু। সেচ দিতে সমস্যা হয়। তাই মালিক উঁচু মাটি কেটে নিতে বলেছেন। জহুরুল তার স্কেভেটর দিয়ে মাটি কেটে তারই ট্রাক্টরে করে নিয়ে চলে যাচ্ছে। এসব মাটি তিনি ইটভাটায় বিক্রি করছেন। তবে এ জন্য জমির মালিককে কোনো টাকা দেওয়া হচ্ছে না।’ সাংবাদিক দেখেই ওই সময় সটকে পড়েন জহুরুল।
গত শনিবার দুপুরে গোদাগাড়ীর সাফিনা পার্ক সংলগ্ন খেজুরতলা মোড়ে ট্রলিতে করে মাটি নিয়ে যেতে দেখা গেছে। প্রত্যেকটি মাটির স্তুপেই লেগে ছিল ধান কেটে নেওয়ার পর গাছের নিচের অংশ। ট্রলির চালক আবদুল কাদের জানালেন, ট্রলির মালিক বায়োজিদ মাটি কাটছেন। এই মাটি কেটে আনা হচ্ছে ধনঞ্জয়পুর মাঠ থেকে। এই মাটিও যাচ্ছে ইটভাটায়।
এবিষয়ে হেরিটেজ রাজশাহীর সভাপতি গবেষক মাহবুব সিদ্দিকী বলেন, ‘বরেন্দ্র অঞ্চলের ভূমির বৈশিষ্ট্য আলাদা। তাকালে দেখতে সিঁড়ির মতো লাগে। এগুলো ছোট ছোট ঢিবি। অনেকে ডাইংও বলে। এগুলো কেটে সমতল করে দেওয়া হচ্ছে। এটা সমর্থনযোগ্য নয়। এগুলো বন্ধ না করলে প্রকৃতিতে বিরূপ প্রভাব পড়বে। তাই প্রশাসনের কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া দরকার।’
তবে সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রশাসনকে ম্যানেজ করেই মাটি কাটা হচ্ছে। সারাদিন কিংবা সারারাতের জন্য মাটি কাটতে বিভিন্নমহলকে ম্যানেজ করতে গুণতে হয় ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা। তবে কখনও কখনও সাধারণ মানুষ কিংবা মাঠের কৃষকেরাই বাঁধা হয়ে দাঁড়ান। তখন তারা বার বার পুলিশ-প্রশাসনের কর্মকর্তাদের ফোন করতে থাকেন। এর ফলে কখনও কখনও প্রশাসনের কর্মকর্তারা এসে দিনে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করেন। কিন্তু রাতে আবার ঠিকই মাটি কাটা শুরু হয়ে যায়। মাটি কাটা কখনও বন্ধ থাকে না।
এবিষয়ে গোদাগাড়ী উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) শামসুল ইসলাম বলেন, ‘যারা প্রশাসনকে ম্যানেজ করার কথা বলছেন, তারা মিথ্যা বলছেন। আমার এবং ইউএনও স্যারের অফিসের কেউই মাটিখেকো চক্রের কাছ থেকে কোনো ধরনের অনৈতিক সুবিধা নেন না। আমরা খবর পেলেই অভিযান চালাব। তবে কিছু ব্যক্তি পুকুর সংস্কার এবং উঁচু জমি চাষাবাদের উপযোগী করার জন্য মাটি কেটে বিক্রি করতে ইউএনও স্যারের কাছে অনুমতি চেয়েছেন। এটি আমাদের বিবেচনায় আছে।’
এবিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা
ইউএনও আবুল হায়াত বলেন, ‘ম্যানেজ করার অভিযোগ একেবারেই সত্য নয়। আমরা বিষয়টি শক্তভাবেই দেখছি। সমস্যা হলো এরা গভীর রাতে মাটি কাটে। তখন অভিযান করা বেশ কঠিন হয়ে পড়ে।#