আওয়ামী লীগ সরকার, তৎকালীন নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা সংস্থা, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা, এর সহিংস গোষ্ঠী ও সংগঠনের সঙ্গে একত্রিত হয়ে পরিকল্পিতভাবে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনে জড়িত ছিল বলে জানিয়েছে জাতিসংঘ।
এসব মানবাধিকার লঙ্ঘনের মধ্যে রয়েছে কয়েকশ বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, হাজার হাজার বিক্ষোভকারীকে গুরুতরভাবে শারীরিক নিপীড়ন ও বলপ্রয়োগ, ব্যাপক হারে নির্বিচারে গ্রেপ্তার ও আটক এবং নির্যাতনসহ অন্যান্য ধরনের নিপীড়ন।
ওএইচসিএইচআর যুক্তিসংগত কারণে বিশ্বাস করে যে, রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং নিরাপত্তা সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের পরিকল্পনা, সমন্বয় ও নির্দেশনায় এ মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলো ঘটেছিল।’
২০২৪ সালের ১ জুলাই থেকে ১৫ আগস্ট পর্যন্ত বাংলাদেশে সংঘটিত মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ ও গুরুতর আহতসহ অনেক বিক্ষোভকারীর সঙ্গে কথা বলে একটি প্রতিবেদন দিয়েছে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তরের (ওএইচসিএইচআর) তথ্যানুসন্ধান দল। গতকাল বুধবার এই প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। সেখানেই বাংলাদেশ নিয়ে এসব তথ্য উঠে এসছে।
ভবিষ্যতে বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা বন্ধে র্যাবের বিলুপ্তি, বিচার ব্যবস্থায় সংস্কারসহ পাঁচটি খাতে জরুরি ভিত্তিতে ও ব্যাপক পরিসরে সংস্কার পদক্ষেপ গ্রহণের সুপারিশ করেছে জাতিসংঘ।
সংস্থাটি বলছে, মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা বন্ধ ও ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ বিনির্মাণ করতে সবার আগে পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনী; নাগরিক পরিসর; রাজনৈতিক ব্যবস্থা ও অর্থনৈতিক সুশাসন, এসব খাতে সংস্কারের উদ্যোগ নিতে হবে।
বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম, নির্যাতনসহ এ ধরনের অপরাধের তদন্ত ও বিচারের জন্য কার্যকর, স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ ও সমন্বিত প্রক্রিয়া নিশ্চিতের সুপারিশ করেছে জাতিসংঘ। সংস্থাটি বলছে, যাঁদের নির্দেশে এসব অপরাধ হয়েছে, বিদ্যমান আইন ও আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী তাঁদের বিচার নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি ভুক্তভোগীদের ন্যায্যবিচার নিশ্চিত করা ও ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করতে হবে। এছাড়া মানবাধিকার লঙ্ঘনের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগ আছে, এমন কর্মকর্তাদেরও বরখাস্ত করার সুপারিশ করেছে সংস্থাটি।
বিচারব্যবস্থাকে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপমুক্ত রাখার সুপারিশ জানিয়ে দেশের বিচারব্যবস্থায় সব পর্যায়ে স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা নিশ্চিতের পরামর্শ দিয়েছে জাতিসংঘ। সংস্থাটি বলছে, কাগজে–কলমে নয়, বাস্তবেও প্রতিফলন থাকতে হবে।
মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা বন্ধে পুরো পুলিশ প্রবিধান সংশোধনের সুপারিশ করেছে জাতিসংঘ। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মানবাধিকারবিষয়ক আন্তর্জাতিক বিধি ও মানদণ্ডের সঙ্গে সংগতি রেখে এতে সংশোধন আনতে হবে। সংশোধিত প্রবিধান অনুযায়ী গুরুতর আহত অথবা আসন্ন মৃত্যুঝুঁকি ছাড়া পুলিশ বলপ্রয়োগ এবং জনসমাগম ছত্রভঙ্গ করতে মারণাস্ত্র ও গোলাবারুদের ব্যবহার করতে পারবে না।
একই সঙ্গে সংস্থাটি র্যাব বিলুপ্ত করা এবং সামরিক বাহিনীর কর্মপরিধি সুনির্দিষ্ট করার পরামর্শ দিয়েছে।
মানবাধিকারবিষয়ক আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের সঙ্গে সংগতি রেখে বিতর্কিত ফৌজদারি আইনগুলো রদ অথবা সংশোধন করে এসব আইনে গ্রেপ্তার, তদন্ত ও বিচার স্থগিতের সুপারিশ করেছে জাতিসংঘ। এছাড়া সাংবাদিক, রাজনৈতিক নেতা-কর্মী, শ্রমিকনেতা, নাগরিক অধিকারকর্মীসহ অন্য মানবাধিকারকর্মীদের ওপর বেআইনি নজরদারি বন্ধে নিরাপত্তা বাহিনীগুলোকে অবিলম্বে নির্দেশ দেওয়ার কথা বলেছে জাতিসংঘের তথ্যানুসন্ধান দল।
অবাধ ও প্রকৃত নির্বাচনের জন্য একটি নিরাপদ ও সহায়ক পরিবেশ নিশ্চিতের তাগিদ দিয়েছে জাতিসংঘ। নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী সব দল ও প্রার্থীর জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিতে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নেয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশে বহুদলীয় গন্ত্রতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রত্যাবর্তন বাধাগ্রস্ত যেনো না হয় সেজন্য কোনো রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করা থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দিয়েছে জাতিসংঘ।
ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে আত্মসাৎসহ বড়মাপের দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত সম্পদ জব্দ ও বাজেয়াপ্ত করার জন্য বিদ্যমান আইনে জরুরি ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করেছে জাতিসংঘের তথ্যানুসন্ধান দল। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দুর্নীতি দমনসংক্রান্ত আইনের যথাযথ প্রয়োগ হচ্ছে কি না, তা নিশ্চিত করতে হবে। আর যাঁরা দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত, বিশেষ করে উচ্চ স্তরের কর্মকর্তা, রাজনীতিবিদ ও প্রভাবশালী ব্যবসায়ীদের বিচার করতে হবে। দুর্নীতি দমন কমিশনের সদস্যদের স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করতে ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও বলা হয়েছে প্রতিবেদনে।