৭২’র ২২ জানুয়ারী স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন ইতহাসের মহানায়ক ভাসানী

।। এম. গোলাম মোস্তফা ভুইয়া।।
০১. ১৯৭১’র ১৬ ডিসেম্বর। একসাগরের রক্তের বিনিময়ে পৃথিবীর মানচিত্রে প্রতিষ্ঠিত হলো স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ আর লাল-সবুজের পতাকা। পরের বছর ১৯৭২ সালের ১০জানুয়ারি পাকিস্তানে কারাবাস শেষে প্রবাসী সরকারের রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান তার স্বপ্নের স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে আসেন। নয় মাসের সশস্ত্র ও রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে দেশ স্বাধীন হলেও প্রকৃতপক্ষে তার দেশে ফিরে আসার মধ্যদিয়েই বাঙালির বিজয় কিছুটা পূর্ণতা লাভ করে। এই পূর্ণতার মধ্যেও ছিল বিশাল শূণ্যতা। কারন, তখনও স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা, প্রবাসী সরকারের উপদেষ্টা কাউন্সিলের চেয়ারম্যান মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান তার দেশের মাটিতে আসেন নাই।

প্রবাসী সরকারের রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ১২ দিন পর যখন ঢাকায় পত্রপত্রিকায় মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে নিয়ে নানা ধরনের লেখালেখি শুরু হয়েছে, তখন ভারতের সরকার মওলানা ভাসানীকে দেশে ফেরার ব্যবস্থা করেন। তিনি যখন নিজ দেশের মাটিতে ফিরছিলেন তখন তাঁর স্বাস্থ্য বিশেষ ভালো ছিলো না। দিল্লী থেকে দেশে ফেরার আগে তিনি আসাম যান। সেখানে তাঁর পরিচিত জনদের সাথে দেখা করার অনুমতি চেয়েছিলেন ভারত সরকারের কাছে। ভারত সরকার তাতে সম্মত হয়েছিলেন।

০২. ২১ জানুয়ারি ১৯৭২ আসামের ফরিদগঞ্জে তিনি এক জনসভায় ভাষণ দিয়েছিলেন। সেখানে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের দীর্ঘ ইতিহাস, পাকিস্তানের বর্বরতা ও ২৩ বছরের শোষণের একটি চিত্র তুলে ধরেছিলেন। ২২ জানুয়ারি মেঘালয় থেকে তিনি ভারত সরকারের একটি জীপে বাংলাদেশের হালুয়াঘাটে পৌঁছেন। তাঁর সঙ্গে ভারতীয় সেনাবাহিনীর একজন চিকিৎসক ছিলেন। হালুয়াঘাটে বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টা মহান এই জাতীয় নেতা মওলানা ভাসানীকে মামুলি অভ্যর্থনা জানিয়েছিল ময়মনসিংহের জেলা প্রশাসক খসরুজ্জামান চৌধুরী ও স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাকর্মী ও তার ভক্তমন্ডলী।

০৩. সড়কপথে ক্লান্তশ্রান্ত দেহে ২২ জানুয়ারি ১৯৭২-এ শেষ রাতে মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী পৌঁছেন টাঙ্গাইলে। রাতে সার্কিট হাউসেই রইলেন তিনি। কারণ, মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই পাকিস্তানী সেনারা তাঁর সন্তোষের বাড়িটি পুড়িয়ে দিয়েছিল। পরদিন অর্থাৎ ২৩ জানুয়ারি সকালে মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা, স্থানীয় আওয়ামী লীগ, ন্যাপ-সহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা তাঁকে দেখতে সমবেত হন সার্কিট হাউসে। বহুদিন পর পরিচিত মানুষ ও সহকর্মীদের সঙ্গে দেখা হওয়ায় উৎফুল্ল হয়ে উঠেন মজলুম জননেতা। পকেট থেকে ১০ টাকা বের করে একজনকে দিয়ে বললেন, সন্দেশ নিয়ে এসো। ওই ১০ টাকার সাথে আরো টাকা যোগ করে আনা হলো সন্দেশ। সকলকেই মিষ্টিমুখ করালেন তিনি।
দেখতে দেখতে অসংখ্য মানুষ জড় হল, যেন ছোটখাটো জনসমাবেশ। ফুটপাতের এক দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে নাতিদীর্ঘ স্বভাবসুলভ ভাষণ দেন তিনি। বহুদিন পর টাঙ্গাইলবাসী শুনতে পায় তাদের পরিচিত কণ্ঠ। আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়ে উপস্থিত জনতা। এরপর টাঙ্গাইল থেকে গেলেন সন্তোষের নিজ বাড়িতে। তাঁর পোড়া ভিটেয় গিয়ে ঘুরে ঘুরে দেখলেন সব, কোথায় কি ছিল তা সনাক্ত করলেন। তাঁর যেসব প্রিয় বস্তু খোয়া গেছে সেগুলোর জন্য আপসোস করলেন। তাঁর গভীর অথচ চাপা দীর্ঘনিশ্বাস গোপন থাকলো না উপস্থিত শ্রোতাদের কাছে।

প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণ : ‘‘দলে দলে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে ভক্তারা এসে পা ছুঁয়ে সালাম করতে লাগলো তাদের প্রিয় হুজুর ও পীরবাবাকে। যেন মাটিরই পৃথিবীতে এই সদ্য এসেছেন পথ ভুলে এক মহামানব মাটির মানুষের পরমাত্মীয়। এলাকার কে কোথায় মারা গেছেন, ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে বা কেমন আছে সে খবর নিলেন তিনি। ঘনিষ্ঠ কারো কারো নিহত হবার কথা শুনে তা চোখ অশ্রæসিক্ত ও কণ্ঠ বাকরুদ্ধ হলো।’’

০৪. মওলানা ভাসানীর প্রতিষ্ঠিত তাঁরই স্বপ্নের ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরোনো দালানের একটি কক্ষে তাঁর থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল। ইতোমধ্যেই যথা পূর্ব খিচুরী রান্না শুরু হয়ে গিয়েছিল সেখানে। কলার পাতায় যার যেমন খুশি খাচ্ছে। সকলের সঙ্গে মওলানা ভাসানীও খেলেন বেশ পরিতৃপ্তি সহকারে। শীতের ছোট দিন, তাড়াতাড়ি সন্ধ্যা এলো, দর্শনার্থীদের ভিড় কমলো কিছু। ঘরের যাবতীয় আসবাবপত্র বিছানা, মলিন কাথা-বালিশ পর্যন্ত ভস্ম করে দিয়েছিল ইয়াহিয়ার ফৌজ। তীব্র শীত পড়েছিল সেদিন। নেতার বিছানাপত্রের ব্যাপারে ভক্তেরা সত্যি সত্যি পুরু করে নাড়া বিছিয়ে তার ওপরে একটি চট দিয়ে বিছানা করে দিলেন তাঁকে। আশপাশের কারো বাড়ি থেকে যোগাড় হয়েছিল একটি জীর্ণ কাঁথা অপেক্ষাকৃত তাড়াতাড়ি সেদিন শুয়ে পড়লেন মওলানা। স্বাধীন দেশে ফিরে এসে মাটির শয্যায় প্রথমবার স্বাধীনভাবে পরম শান্তিতে ঘুমালেন এ মাটির এক উঁচু মানব।

০৫. পরদিন অবশ্য তার ভক্তরা একটি লেপ ও একটি তোষক তৈরি করে দেন। স্বাধীন বাংলাদেশে সেদিন এটাই কি প্রাপ্য ছিল মওলানা ভাসানীর? অনেকের প্রশ্ন বিষয়টি তাঁর অনেক রাজনৈতিক বিরোধীকেও বিদ্ধ করে। অথচ ভারতে নজরবন্দি থাকা অবস্থায়ও ইন্দিরা গান্ধীর সরকার তাকে একজন মহান জাতীয় নেতার মর্যাদা, পক্ষান্তরে নিজের দেশে প্রত্যাবর্তন করে তাঁর সহকর্মী ও প্রিয়জনের দ্বারা গঠিত সরকার থেকে পেলেন যেন ভারতে আশ্রয়গ্রহণকারী এক কোটি শরণার্থীর একজন হয়েই ফিরলেন মওলানা ভাসানী।

প্রত্যাবর্তনের দু’দিন পর স্বাধীন দেশে প্রথম সাংবাদিক সাক্ষাৎকারে তিনি দেশবাসীকে আহবান জানান সরকারকে সর্বাত্মক সহযোগিতা দেবার। তিনি বলেন, ‘‘আওয়ামী লীগ শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য যতদিন কাজ করবে এবং দেশের ও জনগণের কল্যাণের জন্য বাস্তব পদক্ষেপ নেবে ততোদিন তিনি সর্বাত্মক সহযোগিতা দিয়ে যাবেন। এই দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে, অতীতের স্বৈরাচারী সরকারগুলোর মতো তাঁর সরকারেরও পতন অনিবার্য।’’

০৬. স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা, উপমহাদেশের মেহনতি মানুষের কণ্ঠস্বর, মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রবাসী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের চেয়ারম্যান মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ছিলেন এ অঞ্চলের সকল নির্যাতিত মানুষের অবিসংবাদিত নেতা। উপমহাদেশের বৃটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের অগ্রনায়ক ও পাকিস্তানের শোষণের বিরুদ্ধে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার স্বপ্নদ্রষ্টা ও প্রধান প্রবক্তা।

মজলুম জনগণের স্বপ্ন বাস্তবায়িত করার জন্য অনুপ্রেরণা যুগিয়েছেন মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী। মওলানা ভাসানী আছেন এবং থাকবেন। যতদিন মেহনতি মানুষের সংগ্রাম চলবে ততদিন মওলানা ভাসানী বেঁচে থাকবেন। মওলানা ভাসানী ক্ষমতায় যাননি বটে, তবে তিনি ছিলেন ক্ষমতার পালাবদলের অনুঘটক। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলন, ৫৪ যুক্তফ্রন্ট গঠন, ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭১’মুক্তিযুদ্ধ, ৭২-৭৫ পর্যন্ত অপশাসন ও স্বৈরশাসনসহ সফল নেতৃত্বের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের স্থপতি।

মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী ছিলেন একজন দূরদর্শী রাজনীতিবিদ ও রাষ্ট্রনায়ক। আর এ কারণেই ১৯৫৭ সালের কাগমাড়ি সম্মেলনেই পাকিস্তানীদের প্রতি সালাম জানিয়েছেন যার বাস্তব রূপই হচ্ছে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ। ক্ষমতায় না গিয়েও কিভাবে দেশ-জাতির কল্যাণ করা যায় মওলানা ভাসানীর রাজনৈতিক জীবন তার প্রমাণ বহন করে। তাঁকে শুধুমাত্র মহাত্মা গান্ধীর সাথে তুলনা করা যায়। বাংলাদেশের কৃষক-শ্রমিক, কামার-কুমার, তাঁতি-জেলে চিরকাল স্মরণ রাখবে তাদের এই আপন মানুষটির কথা। তাদের মুক্তির জন্য উৎসর্গীকৃত ছিল যাঁর গোটা জীবন।

০৭. বাংলাদেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব সংরক্ষণ এবং দরিদ্র জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য মওলানা ভাসানী যে ঐক্যের বাণী রেখে গেছেন তা আজও আমাদের কাছে অবশ্যই স্মরণীয়। মওলানা ভাসানী আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় স্বাধীনতার পতাকা সমুন্নত রাখার দায়িত্বের কথা, বঞ্চিত জনগণের দরিদ্রের অন্ধকার থেকে তুলে এনে সমৃদ্ধির আলোকবৃত্তে প্রতিষ্ঠিত করার কাজের কথা।

পরিশেষে বলতে চাই এই কথাটিই যে, স্বাধীনতার ৫৪ বছরের সরকারগুলো তাঁকে তাঁর প্রাপ্য মর্যাদা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। এই ব্যর্থতার দায় এড়াতে পারে না কোন সরকারই। ২০২৪ সালের জুলাই-আগষ্টের বিপ্লবের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত সরকারও তাকে যথাযথ মূল্যায়ন করতে ব্যর্থ হয়েছেন বলেই প্রতিয়মান হয়। গত ১৭ নভেম্বর ছিল মওলানা ভাসানীর মৃত্যুবার্ষিকী, ১২ ডিসেম্বর ছিল ভাসানীর জন্মবার্ষিকী। দুঃখজনক হলেও সত্য এই দুই দিনের একদিনেও বর্তমান অন্তর্বতীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার কোন বাণী চোখে পড়ে নাই যা খুবই দুঃখজনক ও হতাশাজনক। জন্মবার্ষিকীর পুর্বে আমি নিজেই প্রধান উপদেষ্টার একজন প্রেসসচিবকে বিষয়টি দৃষ্টি আকর্ষন করার পরও বিষয়টি আড়ালেই রয়ে গেছে। আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের প্রয়োজনে মওলানা ভাসানীকে ব্যবহার করলেও প্রকৃত অর্থে তাকে তাঁর যথাযোগ্য মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করার কোন কর্মসূচিই গ্রহণ করেনি। এর ব্যাতিক্রম নয় নির্দলীয় সরকার বা অর্ন্তবর্তীকালিন সরকারগুলোও। আজ মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীকে যথাযোগ্য মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করার আহবান জানিয়ে বলতে চাই নিরপেক্ষ চিন্তায় অবশ্যই তিনি রাষ্ট্রীয় মর্যাদা পাওয়ার অধিকারী।

স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা মওলানা ভাসানীকে কেবলমাত্র জাতীয় নেতার গ্যালারিতে বসিয়ে রেখে তাঁর চেয়ে কম অবদানের ও স্বল্প মর্যাদায় জাতীয় নেতাদের বিভিন্ন মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করার একপেশে যে কোন আয়োজন সমগ্র জাতিকে হতবাক ও বিস্মিত করেছে, ভবিষ্যতেও করবে। স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা,উপমহাদেশের অত্যাচারিত ও নির্যাতিত মিহনতি জনগণের নয়নমণি, মজলুম জননেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীকে যথাযোগ্য রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করার জন্য সরকারের প্রতি আহবান জানাই। সরকার এই দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে ইতিহাস তাদেরও ক্ষমা করবে না।

[লেখক : কলাম লেখক ও রাজনীতিক, মহাসচিব, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-বাংলাদেশ ন্যাপ ও আহŸায়ক, জাতীয় কৃষক-শ্রমিক মুক্তি আন্দোলন] E-mail : gmbhuiyan@gmail.com

Exit mobile version