সাবেক গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জি. মোশাররফ হত্যা মামলায় কারাগারে, মিরসরাইয়ের ৫ মামলায় প্রধান আসামী

মিরসরাই প্রতিনিধি
পল্টন মডেল থানার মকবুল হত্যা মামলায় সাবেক গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনকে কারাগারে পাঠিয়েছেন আদালত। রোববার (২৭ অক্টোবর) ঢাকার চিফ মেট্টোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতে শুনানি শেষে মেট্টোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট জিয়াদুর রহমানের আদালত এ আদেশ দেন। এর আগে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পল্টন মডেল থানার উপপরিদর্শক (এসআই) নাজমুল হাচান সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে তদন্ত কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত আসামিকে কারাগারে আটক রাখার আবেদন করেন।
এসময় আসামির জামিন চেয়ে শুনানি করেন তার পক্ষের আইনজীবী মোর্শেদ হোসেন শাহীন। অন্যদিকে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ঢাকা মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) ওমর ফারুক ফারুকী জামিন আবেদনের ঘোর বিরোধিতা করে আসামিকে কারাগারে পাঠানোর প্রার্থনা করেন। উভয়পক্ষের যুক্তি-তর্ক শুনে এবং মামলার এজহারের গুণাগুণ বিবেচনা করে আদালত ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।
এদিন দুপুরে ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনকে রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করে ডিএমপির গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) একটি দল।
মামলার এজহার থেকে জানা যায়, ২০২২ সালের ১০ ডিসেম্বর বিএনপির ডাকা সরকার পতনের একদফা দাবি আদায়ের কর্মসূচি ঘিরে নেতাকর্মীরা সমাবেশের কয়েক দিন আগে থেকে রাজধানীর নয়াপল্টন এলাকায় জড়ো হতে থাকলে মামলার আসামিরা সমাবেশ বানচালের চক্রান্ত করে। এর আগে ৭ ডিসেম্বর পুলিশ কর্মকর্তা হারুন অর রশীদ, মেহেদী হাসান ও বিপ্লব কুমারসহ অন্যরা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের যোগসাজশে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে প্রবেশ করে ভাঙচুর ও লুটপাট করে। আন্দোলন দমন করতে নির্বিচারে লাঠিচার্জ, ককটেল হামলা, টিয়ার শেল নিক্ষেপ, সাউন্ড গ্রেনেড বিস্ফোরণ ও গুলিবর্ষণ করা হয়। এতে বিএনপির কয়েকশ নেতাকর্মী আহত হন এবং মকবুল হোসেন নামে এক বিএনপি কর্মী গুলিবিদ্ধ হয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। এ ঘটনায় ২০২৪ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর রাজধানীর পল্টন মডেল থানায় মাহফুজুর রহমান বাদী হয়ে শেখ হাসিনাসহ ২৫৬ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেন। মামলার ৯ নং আসামী করা হয় ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনকে।
১ মাসে মিরসরাইয়ে ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফের বিরুদ্ধে ৫ মামলা: ২০২২ সালের ১১ এপ্রিল বারইয়ারহাট পৌর এলাকায় খান সিটি সেন্টারের সামনে অস্ত্র-হাতুড়ি দিয়ে ৮-১০ জন চট্টগ্রাম উত্তর জেলা যুবদলের সহ-সাধারণ সম্পাদক ইফতেখার মাহমুদ জিপসনের উপর অতর্কিত হামলা করে। তখন স্থানীয়রা উদ্ধার করে প্রথমে বারইয়ারহাট কমফোর্ট হাসপাতালে পরবর্তীতে শারিরিক অবস্থার অবনতি হলে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (চমেক) প্রেরণ করা হয়। এই ঘটনায় ইফতেখার মাহমুদ জিপসন বাদী হয়ে চলতি বছরের ৬ অক্টোবর ২৯ জন এজাহারনামীয় ও অজ্ঞাত ১০-১৫ জনকে আসামী করে মামলাটি (নং-১৩) দায়ের করেন। মামলায় সাবেক মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেতা ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, সাবেক এমপি মাহবুব উর রহমান রুহেল ও বারইয়ারহাট পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক রেজাউল করিম খোকনকে হুকুমের আসামী করা হয়।
২০১৬ সালের ৭ সেপ্টেম্বর মিরসরাই উপজেলা বিএনপির কার্যালয়ে সাবেক মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন ও সাবেক সংসদ সদস্য মাহবুব রহমান রুহেলের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের ৮০ থেকে ১০০ জনের একটি গ্রুপ দেশীয় অস্ত্রসস্ত্র নিয়ে ভাংচুর করে। বুলডেজার দিয়ে ভবন গুটিয়ে কার্যালয়ে থাকা টিভি, আসবাবপত্র ভাংচুর করে প্রায় ৬০ লাখ টাকার ক্ষতি করে। এসময় বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করে। মিরসরাই উপজেলা বিএনপির কার্যালয় ভাংচুরের ৮ বছর পর সাবেক, মন্ত্রী, এমপি ও উপজেলা চেয়ারম্যানসহ ৯০ জনের নাম উল্লেখ করে চলতি বছরের ১২ অক্টোবর চট্টগ্রাম উত্তর জেলা যুবদলের যুগ্ম সম্পাদক এস.এম হারুন বাদী হয়ে মিরসরাই থানায় মামলা দায়ের করেছেন।
২০১৭ সালের ২৮ অক্টোবর সাবেক প্রধানমন্ত্রী, বিএনপির চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার গাড়ি বহর নিয়ে কক্সবাজারে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে যাওয়ার পথে সকাল ১০ টায় বারইয়ারহাট খান সিটি সেন্টারের সামনে সাবেক মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন ও সাবেক সংসদ সদস্য মাহবুব উর রহমান রুহেলের নির্দেশে তাঁর গাড়ি বহরে হামলা ও ভাংচুর করা হয়। এসময় খালেদা জিয়াকে স্বাগত জানতে উপস্থিত হওয়া বিএনপি নেতাকর্মীদের উপর হামলা করে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগের সন্ত্রাসীরা। সেখান থেকে গাড়ি বহর যাত্রা শুরু করে বারইয়ারহাট রোজিনা হোটেলের সামনে আসার পর পুণরায় হামলা করে। এতে প্রায় সাড়ে ৪ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। এছাড়া তখন বিএনপি নেতা-কর্মী সমর্থকদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হয়। সাবেক প্রধানমন্ত্রী, বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার গাড়ি বহরে হামলার ঘটনায় ৭ বছর পর ১৮ অক্টোবর রাতে বারইয়ারহাট পৌর বিএনপির আহবায়ক দিদারুল আলম মিয়াজী বাদী হয়ে এই মামলা (নং-১২) দায়ের করেন। মামলায় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি মন্ডলীর সদস্য, সাবেক গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনকে প্রধান আসামী করা হয়। এছাড়া সাবেক সংসদ সদস্য মাহবুব রহমান রুহেল, সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান এনায়েত হোসেন নয়ন, বারইয়ারহাট পৌরসভার সাবেক মেয়র রেজাউল করিম খোকন সহ ৪২ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত ৪০-৫০ জনকে আসামী করা হয়েছে।
২০২৩ সালের ৫ অক্টোবর বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপির) মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ কেন্দ্রীয় নেতাদের পূর্ব নির্ধারিত কর্মসূচির অংশ হিসেবে রোড মার্চ করে চট্টগ্রাম যাওয়ার পথে বারইয়ারহাট পৌরসভার কাঠ মার্কেট এলাকায় আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সাবেক গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন ও তাঁর ছেলে সাবেক সংসদ সদস্য মাহবুব উর রহমান রুহেলের নির্দেশে হামলা করা হয়। এসময় বিএনপির দুই নেতাকেও পিটিয়ে গুরুতর আহত করা হয়। হামলার ঘটনায় চলতি বছরের ২০ অক্টোবর দুপুওে বারইয়ারহাট পৌরসভা বিএনপির সাবেক সভাপতি মাঈন উদ্দিন লিটন বাদী হয়ে মামলা (নং-১৩) দায়ের করেন। মামলায় আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য এবং সাবেক গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন ও তাঁর ছেলে সাবেক সংসদ সদস্য মাহবুব উর রহমান রুহেলকে হুকুমের আসামীসহ ৩৫ জনের নাম উল্লেখপূর্বক অজ্ঞাত ২৫-৩০ জনকে আসামী করা হয়।
২০২২ সালের ১২ অক্টোবর বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপির) ঢাকা মহানগরের দক্ষিনের সদস্য ইশরাক হোসেন পূর্ব নির্ধারিত কর্মসূচির অংশ হিসেবে চট্টগ্রামে বিভাগীয় গণসমাবেশে যাওয়ার পথে মিরসরাই পৌরসদরে পৌঁছলে রাম দা, দেশী-বিদেশী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে এবং ককটেল বোমা ফাটিয়ে ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টি করে এবং নেতাকর্মীদের রক্তাক্ত জখম করে। পরবর্তীতে কিছুদূর এগিয়ে যাওয়ার পর আসামীরা আবারো গাড়ি বহরে হামলা করে ৩০টি গাড়ি ভাংচুর প্রায় দেড় ১ কোটি টাকার ক্ষতি এবং বিভিন্ন জনের পকেটে থাকা ১০ লক্ষ টাকা চুরি করে নিয়ে যায়। তারা যাওয়ার সময় বলে যায় বিএনপির সমাবেশে গেলে লাশ গুম করে হত্যা করে ফেলবে। ইশরাকের গাড়ি বহরে হামলা, ভাংচুর, লুটের ঘটনায় ফেনী সদর উপজেলা যুবদলের যুগ্ম আহবায়ক শাহাদাত হোসেন চৌধুরী বাদী হয়ে মিরসরাই থানায় ২৪ অক্টোবর রাতে মামলা (নং-১৮) দায়ের করেন। মামলায় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য এবং সাবেক গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, তাঁর ছেলে সাবেক সংসদ সদস্য মাহবুব উর রহমান রুহেল, সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান জসিম উদ্দিন, এনায়েত হোসেন নয়ন ও সাবেক মেয়র গিয়াস উদ্দিনকে হুকুমের আসামী করা হয়েছে। এছাড়া কেন্দ্রীয় যুবলীগের সদস্য নিয়াজ মোর্শেদ এলিট, উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি জাহাঙ্গীর কবির চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক একেএম জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া, চট্টগ্রাম উত্তর জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি এরাদুল হক নিজামী ভুট্টো, বারইয়ারহাট পৌরসভার সাবেক মেয়র রেজাউল করিম খোকন, সাবেক উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান ফেরদৌস হোসেন আরিফ, চট্টগ্রাম উত্তর জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি তানভীর হোসেন চৌধুরী তপুসহ ১২৬ জন এজাহারনামীয় ও অজ্ঞাত ৪০০-৫০০ জনকে আসামী করা হয়েছে।
এদিকে ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন গ্রেফতার হওয়ায় মিরসরাই উপজেলা বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা আনন্দ মিছিল বের করে। উপজেলার করেরহাট, জোরারগঞ্জ, ধুম, কাটাছরা, মিরসরাই পৌরসভাসহ বিভিন্ন ইউনিয়ন বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের আয়োজনেও আনন্দ মিছিল বের করা হয়। এসময় তার ফাঁসির দাবীও তুলেন।
উল্লেখ্য, চট্টগ্রাম-১ (মিরসরাই) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে ১৯৭৩, ১৯৮৬, ১৯৯৬, ২০০৮, ২০১৪ এবং ২০১৮ সালে এমপি হন। ১৯৭২ সালে তিনি সংবিধান প্রণেতাদের মধ্যে তিনি একজন। আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর এই সদস্য বিভিন্ন সময়ে সরকারের গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় এবং বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। চলতি বছর দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এই আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে এমপি হন ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফের ছেলে মাহবুব উর রহমান রুহেল।

Exit mobile version