এটা ঠিক উপমহাদেশে ডিভোর্স এর পরবর্তী জীবন সাময়িকভাবে হলেও অনেকটা নরকের মত হয়ে যায়। কিন্তু আফ্রিকার দেশ মৌরিতানিয়ায় বিষয়টি খুবই সহজ। তারা ডিভোর্স কে উদযাপন করে। সামাজিক চাপকে অস্বীকার করুন আর নিজের অর্থনৈতিক অবস্থানকে ক্ষতিগ্রস্থ হতে দেবেন না তাহলে আপনিও ডিভোর্সকে উদযাপন করতে পারবেন।
ডিয়ার ক্যামেলিয়া নামের একটি ফেসবুক গ্রুপে অসংখ্য মেয়ে এবং ছেলেরা ডিভোর্স হয়েছে বা ব্রেকআপ হয়েছে বলে তাদের নিদারুণ মর্মযাতনার কথা লিখে জানায়। এদের মধ্যে কেউ কেউ ২, ৩ অথবা ৫ বছর হওয়া সত্ত্বেও বিচ্ছেদের বেদনা ভুলতে পারছে না, মানসিক চাপে ভুগছে ফলে দৈনন্দিন জীবন, পড়াশোনা অথবা ক্যারিয়ার ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অনেকে আত্মহত্যা করার কথা পর্যন্ত ভাবছে। অথচ মৌরিতানিয়ায় বিষয়টি সম্পূর্ণ অন্যরকম।
মৌরিতানিয়ার ডিভোর্সি মেয়ে জিলানির ঘটনা শুনুন।
বিবাহবিচ্ছেদের বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার পর জিলানির মা তারস্বরে তিনবার উলুধ্বনি দিয়ে এবং প্লাস্টিকের ট্রে পিটিয়ে আশেপাশের পাড়াপ্রতিবেশিদের ডেকে বলেন, “বিবাহিত নারীরা সবাই শুনুন, আমার মেয়ে ইজেলেখে জিলানি এখন একজন ডিভোর্সি নারী!”
এদিকে জিলানির বিবাহবিচ্ছেদ নিয়ে মোটেই মাথাব্যথা নেই। সে হাসিমুখে নিজের ফোন নিয়ে ব্যস্ত, হাতে মেহেদি লাগিয়ে সেই ছবি ফেসবুকে পোস্ট করছিল সে- আর এই পোস্টের মাধ্যমেই সে সবাইকে জানিয়ে দিয়েছে যে তার ডিভোর্স হয়ে গেছে।
বিশ্বের অন্য অনেক অঞ্চলেই ডিভোর্স মানে বিভীষিকা হলেও মৌরিতানিয়ার পরিস্থিতি এমন নয়। এখানে কোনো নারীর ডিভোর্স হলে কান্নার রোল ওঠে না, তাকে লজ্জায় মুখ লুকাতে হয় না, পদে পদে অপমানিত হতে হয় না বরং ডিভোর্সের পর অন্য নারীরা আসেন, পার্টি হয় খাওয়া-দাওয়া হয় এবং নাচ গান চলে ।
নোউকেচোট বিশ্ববিদ্যালয়ের কালচারাল অ্যানথ্রোপলজি বিভাগের অধ্যাপক আলহাজ উদ ব্রাহিম বলেন, “ডিভোর্সি নারীদের ক্ষেত্রে অধিকাংশ দেশের রীতির ঠিক বিপরীত রীতি মৌরিতানিয়ায় প্রচলিত রয়েছে । অনেক দেশে ডিভোর্সি নারীদের নিয়ে সামাজিক কুসংস্কার এত বেশি যে ডিভোর্স মানেই মৃত্যুসম মনে করা হয়। আর মৌরিতানিয়ায় উলুধ্বনি আর ফেসবুক পোস্টের মাধ্যমে ডিভোর্সের কথা জানান দিয়ে পার্টি করার মাধ্যমে তা উদযাপন করা হয়।”
সমাজবিজ্ঞানী আল কাত্তাব বলেন, “ডিভোর্স কাম্য নয় তবে মৌরিতানিয়ান সমাজ ডিভোর্সি নারীদেরকে নিন্দা করার বদলে বরং সহায়তা করে। তারা বিষয়টাকে খুব সহজ করে তোলে, তাই অতীত ভুলে সহজেই সামনে এগিয়ে যাওয়া যায়। আর ডিভোর্সি নারীকে সহমর্মিতা দেখানোরই একটা উপায় হলো ডিভোর্স পার্টি।”
জিলানি জানান, তিনি তার স্বামীকে ডিভোর্স দিয়েছেন কারণ তার স্বামী খুবই ঈর্ষাপরায়ণ ছিলেন, এমনকি মাঝেমধ্যেও তাকে বাইরে যেতে দিতেন না।
প্রায় শতভাগ মুসলমানের দেশ মৌরিতানিয়ায় প্রায়ই ডিভোর্সের ঘটনা ঘটে। এখানে একেকজন ব্যক্তি তার জীবনে ৫ থেকে ১০টি বিয়ের প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যান, এমনকি কেউ কেউ তাদের জীবনে ২০ বারও বিয়ে করেছেন বলে শোনা যায়।
ওয়াদানের আরেক বাসিন্দা রেইজিল জানান, তার বিয়ে হয়েছিল কিশোরী বয়সে। তাকে না জানিয়েই তার বাবা বিয়ের আয়োজন করেছিলেন। বিয়ের কিছুদিন পরেই তিনি তার স্বামীকে ডিভোর্স দেন। এরপর বিগত দুই দশকে তিনি একাধিকবার বিয়ে করেছেন।
রেইজিল জানান, তার ছয় স্বামীর কাউকেই তার পছন্দ হয়নি। “আমি তাদেরকে নিজের হৃদয়ের গভীরে স্থান দেই না। তারা আসে, যখন চলে যেতে মন চায় চলে যায়।”
– নিউইয়র্ক টাইমস।
এমন চেতনার ফলে রেইজিলের জীবন সহজ হয়েছে।
লক্ষণীয় বিষয় হল ডিভোর্স বা ব্রেকআপ হলে বাংলাদেশি মেয়ে বা ক্ষেত্রবিশেষে ছেলেরাও মানসিকভাবে ভেঙে পড়ছে এমনকি আত্মহত্যার চিন্তা পর্যন্ত করছে অথচ মৌরিতানিয়ার একটি মেয়ের জীবনে একই বিষয় ঘটা সত্বেও সে বিষয়টিকে উদযাপন করছে এবং স্বাভাবিকভাবে মেনে নিয়ে আবার নতুন জীবনে প্রবেশ করছে যা তাঁর জীবনকে সহজ সাধ্য করছে এবং উপভোগ্য করছে।
‘হোমো স্যাপিয়েন্স’ প্রজাতির মস্তিষ্ক একই পদ্ধতিতে কাজ করে কিন্তু সংস্কৃতি ভেদে তা ভিন্ন ভিন্ন ভাবে প্রতিক্রিয়া দেখায়- এই মৌলিক বিষয়টি বুঝতে পারলে মানুষ অনেক কষ্ট থেকে রেহাই পেতে পারতো। মানুষের জীবন আনন্দময় এবং সহজসাধ্য করার জন্য এমন বিষয়গুলোকে পাঠ্য ভুক্ত না করে বরং উনিশের নামতা মুখস্ত করানো হচ্ছে যেটি কিনা মোবাইল মুহূর্তের মধ্যে সঠিক ভাবে করে ফেলে। এমন পরিস্থিতিতে আমাদের নিজেদেরকেই কষ্টকর মনে হওয়া যেকোনো সংস্কৃতি বা প্রথাকে অন্য সংস্কৃতির সঙ্গে তুলনা করে নিজেদের মনকে প্রবোধ দেওয়ার মাধ্যমে শান্ত সুখী জীবনযাপন সম্ভব করে তুলতে হবে।
ছবি: ডিভোর্স পার্টিতে সবার সবাই একসঙ্গে বসে চলছে খাওয়াদাওয়া, সাদা ওড়না পরা জিলানিও আছেন এখানে। – লরা বুশনাক/দ্য নিউইয়র্ক টাইমস।