বেলাল আজাদ:
এমন পুলিশী আচরণ আমার অতীত জীবনে কখনো দেখিনি! কল্পনায়ও ভাবিনি, এমন পুলিশও আছে। কিন্তু অবিশ্বাস্য ও কল্পনাতীত আচরণকারী পুলিশ কর্মকর্তাগণের এক একজনের আচরণ দেখে আমার বিস্ময়ের শেষ নাই।শুধু আমি একা নই, আমার সাথে ও যার যার প্রয়োজনে সে সময়ে থানায় আসা আরও বৃদ্ধ, যুবক, শিশু মিলিয়ে ১৫/২০ জনের প্রত্যেকেই পুলিশী এমন আচরণে আশ্চর্যান্বিত। সকলেরই একটাই কথা, একই অংক কষা, ‘পুলিশ এমনও আছে?’।
থানায় বা পুলিশের কাছে তেমন কোন কাজ বা প্রয়োজন পড়ে না বলে, সচরাচর আমার কখনো থানায় যাওয়া হয় না। শেষ বার কবে যে কত বছর আগে থানায় গিয়েছিলাম মনে নাই। কিন্তু সে দিন (৩০ মে) রাত পৌনে ১০ টায় যখন আমার ছোট (খালাত) ভাইটা কল করে কাঁদো কাঁদো কন্ঠে, ‘ভাই, আমাকে পুলিশ কোটবাজার স্টেশন থেকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে, তুমি এখুনি থানায় আসো’ বলে এবং পর মুহুর্তে থেকেই খালাম্মা, খালু, খালাত ভাই-বোন আরও স্বজনরা একের পর এক কল করতে করতে আমাকে অস্থির করে তুললো, তখন নিজের দু’দিনের ডায়রিয়া, বমি ও জ্বরের অসুস্থতায় কাহিল অবস্থায়ও থানার উদ্দেশ্যে বাড়ী থেকে বের না হয়ে উপায় নাই। অনিচ্ছা ও অসুস্থতা সত্বেও বাড়ী থেকে বের হয়ে ‘খাল, পুকুর সদৃশ ভাঙ্গাচোরা রাস্তা দিয়ে কশেকটা সিএনজি-টমটমে চড়ে থানায় পৌছতে পৌছতে আমার ১১ টা পার হয়ে যায়। থানায় তখন কেবল মাত ডিউটি অফিসার আর কয়েকজন কনস্টেবল ছাড়া আর তেমন কোন অফিসার নাই, লোকজনও তেমন নাই বলা যায়। তবে পুলিশে ধরে আনা আমার খালাত ভাইয়ের স্বজনের অভাব নাই।
আমি দ্রুত ডিউটি অফিসারের সাথে দেখা করে আমার ভাই কে কোন মামলায় বা কী অপরাধে ধরে আনা জানতে চাইলে, ডিউটি অফিসার (একজন এস.আই) ভদ্রলোকের কথাবার্তায়, তাঁকে পুলিশ বলেই মনে হলো না! একেবারে বিনয়ী, ধৈর্যশীল ও ঠান্ডা মেজাজের ডিউটি অফিসার আমার ভাইয়ের মামলার ওয়ারেন্ট কপি দেখিয়ে ওয়ারেন্ট মূলে ধরে আনার কথা জানালেন। কিন্তু অবাক ব্যাপার ২০১৩ সালের শুরুতে আদালত থেকে ইস্যু করা ওয়ারেন্ট দেখে হতভম্ব হয়ে যাই। কারণ, দীর্ঘ ৯ বছর ধরে থানায় ওয়ারেন্ট থাাকলেও পুলিশ কখন আসামী আমার ভাই বা আমরা কেউ বুঝতেও পারিনি, খুঁজতে কখনো পুলিশ তার ঘরে যায় নাই! দিব্যি থানার আশেপাশে উখিয়া ও কোটবাজার স্টেশনে ঘুরে বেড়ানো আসামী আমার ভাইকে পুলিশ এ্যারেষ্ট করে নাই, খুঁজেও নাই। ইতিমধ্যে ঐ মামলায় জামিন হয়ে সে একাধিকবার জামিনের রি-কলও থানায় দিয়েছিল, কিন্তু এই ওয়ারেন্ট এতো বছর কোথায় যে ছিল? জোলা পুলিশ-ম্যাজিস্ট্রেসি সভায় বহুবার থানা পুলিশ কে বলা হয়েছিল যে, কোর্টের ওয়ারেন্ট যেন মাসের মধ্যে তামিল হয়, অন্যথায় আদালতকে অবগত করে ঐ ওয়ারেন্ট ফেরত পাঠানো উচিত। বিলম্বিত ওয়ারেন্ট আসামীর ধরে কোর্টে চালান হলে, কোর্ট সংশ্লিষ্ট ও আসামীর উভয়ের মামলা খুঁজে পেতে ভোগান্তি হয়। আবার বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়, এ ধরনের বিলম্বে ধৃত ও কোর্টে সোপর্দকৃত আসামীর মামলা খুঁজে বের করতে করতে কয়েকদিন লেগেই যায়, খুঁজে পাওয়ার পর অধিকাংশ মামলাই নিষ্পত্তি/খারিজ হয়ে যায়। আশ্চর্য ব্যাপার হলো মাস নয় বছর নয় যুগ যুগ ধরেই বিনা তামিলের অনেক ওয়ারেন্ট কপি থানায় পড়ে থাকে। কিছু কিছু ওয়ারেন্ট বছরের পর বছর হদিস বিহীন থাকার পরে হঠাৎ করে আসামী ধৃত হয়। সেখানে পুলিশ নিজেরই এ্যারেষ্ট করে কোর্টে সোপর্দ করা আসামী ক’দিন পরে জামিনে ছাড়া পেলে, তার কাছ থেকেও পুলিশ-চোকিদারেরা জামিনের রি-কল চায়!!! কী আজব ব্যাপার। কোর্ট থেকে ওয়ারেন্ট ইস্যু হওয়ার পরে ঐ আসামী যদি কোর্টে আত্মসমর্পণ করে জামিন পায়, তখনই ‘থানায় ইস্যুকৃত ওয়ারেন্ট কপি বিনা তামিলে কোর্টে ফেরত দেওয়ার বা আসামীর জামিনের বিষয়ে অবগতির জন্য যে পত্র কোর্ট থেকে থানায় পাঠানো হয়, সেটাই রি-কল। এ ক্ষেত্রে পুলিশ কতৃক ধৃত ও কোর্টে সোপর্দকৃত আসামীও পরে জামিনে মুক্ত হলে থানা-পুলিশে রি-কল চাওয়ার মত হাস্যকর ব্যাপার আর নাই।
যাই হোক ধরে আনা আমার ভাইয়ের ওয়ারেন্ট (সি.আর) মামলাটা গত বছরের শুরুতেই বাদীর আপোষ সূত্রেই নিষ্পত্তি হয়ে যায় এবং তার খালাসের রি-কল টা এতদিন বাড়িতেই ছিল, বিধায় ততক্ষণে ঐ রি-কল’টাও থানায় আনা হয়। কিন্তু ততক্ষণে মধ্যরাত প্রায়, থানার বড় কর্তা বা আমার ভাইকে ধরে আনা পুলিশ অফিসার কেউ নাই বিধায় এবং এর মধ্যে ডিউটি অফিসার আসামী আমার ভাইকে ধরে আনা অফিসার কে অনেকবার ফোন করেও কথা বলতে ব্যর্থ হয়ে বিনয়ের সাথে আমাদেরকে সকালে আসতে বলেন। হতাশ আমরা উদ্দেশ্যহীন ঘুরাঘুরি করতে থাকি, রাত প্রায় সোয়া ১ টায় ঐ অফিসার থানায় আসেন। আমাদের কে নিয়ে নিজের চেয়ারে বসেন, এর মধ্যে আরও একজন অফিসার তার পাশে বসে এক মনে এক ধ্যানে লেখালেখি করতে থাকেন। আমার ভাইকে ধরে আনা অফিসার সব শুনে তৎক্ষনাৎ ‘..আঙ্কেল, ..আঙ্কেল, বলে থানার হাজতখানার সেন্ট্রি কে ডাকলেন এবং আমার ভাইকে হ্যান্ডকাফ ছাড়াই হাজতখানা থেকে বের করে আনতে বলবেন। একজন অফিসার হয়ে কনস্টেবল কে আঙ্কেল ডাকা ও বিনয়ের সাথে কথা বলা দেখে অবাকই হলাম। তখন থানায় থাকা ডিউটি অফিসার ও অন্য দু’জন অফিসারের কারও মধ্যেই কোন পুলিশী আচরণ দেখলাম না! সচরাচর পুলিশী আচরণ বলতে আমরা- বদ মেজাজী, দুর্ব্যবহারকারী, কথায় কথায় ‘শালারপুত…. গালিগালাজ, টাকা দাবী, হয়রানী, কঠোর মনোভাব ইত্যাদি বুঝি। তবে সব পুলিশ এমন নয় বটে কিন্তু অধিকাংশই বলা চলে।
সে তুলনায় আজকের নিশি রাতের থানায় থাকা ৩ পুলিশ অফিসারেরা এক একজন যেন মাটির মানুষ। আমি মনে মনে কিছুতেই হিসাব মেলাতে পারছিলাম না, একজন না হয় সিধে-শান্ত স্বভাবের হতে পারে, সব অফিসারই এমন ভালো মানুষ হয় কেমনে? আমাদের স্থানীয় ভাষায় ‘আইল্লা আচল’ (সিধে-শান্ত) স্বভাবের মানুষ গুলো যদি পুলিশ অফিসার হয়ে থাকেন, তাহলে অপরাধীরা তো পুলিশের মাথায় উঠে নাচানাচি করবে!
বাস্তবে উচ্চ শিক্ষিত, মেধাবী, টেনিংপ্রাপ্ত, বিচক্ষণ, অগণিত অপরাধী সায়েস্তাকারী, শত শত চাঞ্চল্যকর মামলার তদন্তকারী এই মহান মানুষগুলোর বিনয়, শান্তশিষ্টতা এবং নিরহংকারী স্বভাবে- রিক্সাওয়ালা, টমটম ওয়ালা, চা-ওয়ালা প্রত্যেককেই মাধুর্য্যতায় ‘অমুক ভাই, চাচা’ সম্বোধন ও কোমল আচরণ দেখলে মনে হবে, এরা পুলিশ নয়, যেনো শাশুর বাড়ীর ঘনিষ্ঠ স্বজন!
সবশেষে আমার ভাইয়ের জিম্মাদার হিসেবে আমাকে অফিসার বললেন, ‘বেলাল ভাই, আপনি কি দস্তখত দিতে জানেন? নাকি টিপসহি দেবেন?’ আমি মিনমিনে ভাবে, ‘স্যার, দস্তখত জানি’ বলে জবাব দিলেও, পাশের অন্যরা হাসাহাসি শুরু করলে, অফিসার স্যারেরা কী ভেবেছেন, জানি না; তবে রাত দু’টোয় যখন ভাইকে নিয়ে থানা থেকে বের হচ্ছিলাম, বারবার জানতে ইচ্ছে করছিল, ‘স্যারদের এমন কোমল আচরণ ও অমায়িক চাল-চলনের উৎস কী? পুলিশী সংস্করণ নাকি স্বভাবজাত আবরণ?
তবে মনে মনে আশ্বস্ত হয়েছি এই ভেবে যে, হয়তো অচীরেই রূঢ় স্বভাবের পুলিশী আচরণ বিলুপ্ত হয়ে যাবে, থানায় থানায় এমন মানবিক পুলিশের সভ্যতা গড়ে উঠবে, বেড়ে যাবে সেবা, পাল্টে যাবে পুলিশ প্রশাসন। (স্যালুট মহোদয়গণ)।