যেভাবে হজের সূচনা

হজের শাব্দিক অর্থ ‘জিয়ারতের সংকল্প’। আল্লাহর সান্নিধ্য পাওয়ার উদ্দেশ্যে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মুসলমানরা পবিত্র কাবা তাওয়াফ বা জিয়ারতের সংকল্প নিয়ে ছুটে আসেন বলেই এর নাম রাখা হয়েছে হজ। হজ ইসলামের পাঁচ স্তম্ভের একটি এবং অকাট্য এক ফরজ ইবাদত।

ইসলামের এই অকাট্য বিধানটি একাত্ম ও সাম্যের সুন্দরতম এক চিত্র। মহান আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের এক মহামিলনের অনুষ্ঠান। হজের এ বিধানটি বিশ্বভ্রাতৃত্বের উৎকৃষ্ট নিদর্শন।

হজের রয়েছে এক মহৎ ইতিহাস, আছে এর নানাবিধ তাৎপর্য ও বহুমুখী শিক্ষা। আজ থেকে প্রায় সাড়ে চার হাজার বছর আগে আল্লাহর নির্দেশে ইবরাহিম (আ.) সর্বপ্রথম হজের প্রবর্তন করেন। এরপর থেকে নবী-রাসুল পরম্পরায় চলে আসছে হজ পালনের বিধানটি।

মহান আল্লাহ কোরআনে সামর্থ্যবান মুসলমানদের ওপর হজ অবশ্য পালনীয় কর্তব্য বলে ঘোষণা দিয়েছেন। কাবাঘর নির্মাণ সম্পর্কিত বিষয় এভাবে এরশাদ হয়েছে: ‘আর আমি যখন কাবাঘরকে মানুষের জন্য সম্মিলন ও নিরাপত্তার স্থান করলাম আর তোমরা ইবরাহিমের দাঁড়ানোর জায়গাকে নামাজের জায়গা বানাও। আর আমি ইবরাহিম ও ইসমাইলকে আদেশ করলাম ঘরটিকে খুব পবিত্র রেখো তাওয়াফকারী ও অবস্থানকারী লোকদের জন্য এবং রুকু-সিজদাকারীদের জন্য।’ (সুরা বাকারা: ১২৫)

হজ প্রবর্তনের আগে ইবরাহিম (আ.) আল্লাহর নির্দেশে পুত্র ইসমাইল (আ.)-কে সঙ্গে নিয়ে পুনর্নিমাণ করেন কাবাঘর। উল্লেখ্য, কাবাঘরটি আদম (আ.) ফেরেশতাদের সহায়তায় সর্বপ্রথম নির্মাণ করেন। ইবরাহিম (আ.) ফেরেশতা জিবরাইল (আ.)-এর সাহায্যে একই ভিতে অর্থাৎ আদম (আ.) কর্তৃক নির্মিত কাবার স্থানে এর পুনর্নিমাণ করেন। নির্মাণকাজ শেষ হলে ইবরাহিম (আ.)-এর প্রতি নির্দেশ হলো হজব্রত পালনের। আল্লাহ তায়ালা জিবরাইল (আ.) মারফত তাকে হজের সব বিধিবিধান অবহিত করেন। ইবরাহিম (আ.) তার পুত্র ইসমাইল (আ.)-কে নিয়ে কাবাঘর সাতবার তাওয়াফ করেন, চুম্বন করেন হাজরে আসওয়াদ এবং একে একে সম্পন্ন করেন হজের সব বিধান।

এরপর আল্লাহর নির্দেশ এলো হজের দাওয়াত বিশ্ববাসীকে পৌঁছে দেয়ার। ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘যখন ইবরাহিম (আ.)-কে হজ ফরজ হওয়ার কথা ঘোষণা করার আদেশ দেয়া হয় তখন তিনি আল্লাহর কাছে আরজ করলেন, এটা তো জনমানবহীন প্রান্তর। এখানে ঘোষণা শোনার মতো কেউ নেই। যেখানে ঘনবসতি আছে সেখানে আমার আওয়াজ কীভাবে পৌঁছবে? আল্লাহ বললেন, তোমার দায়িত্ব শুধু ঘোষণা দেয়া। সারা বিশ্বে পৌঁছানোর দায়িত্ব আমার। এ কথা শুনে ইবরাহিম (আ.) তখন মোকামে ইবরাহিমে দাঁড়িয়ে ঘোষণা দিলেন। আল্লাহ তা উচ্চ করে দেন।’

কোনো কোনো বর্ণনায় আছে, তিনি আবু কুবাইস পাহাড়ে আরোহন করে ঘোষণা দিয়েছিলেন। বর্ণিত আছে, ‘আল্লাহর ইবরাহিম (আ.)-এর সেই আহ্বান জড় জগতের সীমা অতিক্রম করে রূহানি জগতে গিয়ে পৌঁছেছিল এবং লাব্বাইক বলে যেসব রুহ সেই আহ্বানে সাড়া দিয়েছিল আল্লাহ চান তো কেয়ামত পর্যন্ত তারাই পর্যায়ক্রমে আরাফাতের প্রান্তরে সমবেত হবে!’ এভাবে মক্কা পরিণত হলো হজব্রত পালনের ক্ষেত্রস্থল হিসেবে। এ হজ দ্বারা স্থাপিত হলো বিশ্ব মুসলিম উম্মাহর মহামিলনের সুন্দরতম এক দৃশ্য।

হজের গুরুত্ব ও তাৎপর্য সম্পর্কে আল-কোরআনে আরও এরশাদ হচ্ছে, ‘এতে রয়েছে মাকামে ইবরাহিমের মতো প্রকৃষ্ট নিদর্শন। আর যে লোক এর ভিতরে প্রবেশ করেছে, সে নিরাপত্তা লাভ করেছে। আর এ ঘরের হজ করা হলো মানুষের ওপর আল্লাহর প্রাপ্য, যে লোকের সামর্থ্য রয়েছে এ পর্যন্ত পৌঁছার। আর যারা অস্বীকার করবে (তাদের স্মরণ রাখা উচিত) আল্লাহ বিশ্ববাসীর মুখাপেক্ষী নন।’ (সুরা আলে ইমরান: ৯৭)

আবার একই বাণী প্রতিধ্বনিত হয়েছে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর ভাষায়। সাহাবি আবু সাইদ (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘রাসুল (সা.) আমাদের লক্ষ্য করে বললেন, আল্লাহ তোমাদের প্রতি হজ ফরজ করেছেন। সুতরাং তোমরা হজ কর।’ (মুসলিম)

প্রিয়নবী (সা.) হজের ফজিলত সম্পর্কে আরও বলেছেন, ‘বিশুদ্ধ ও মকবুল একটা হজ পৃথিবী ও পৃথিবীর যাবতীয় বস্তু অপেক্ষা উত্তম। জান্নাত ছাড়া আর কোনো কিছুই এর প্রতিদান হতে পারে না।’ আরেক বর্ণনায় জানা যায়, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে হজ করবে, হজ পালনকালে স্ত্রীমিলন কিংবা সে সম্পর্কে আলোচনা এবং কোনো প্রকার গুনাহের কাজেও লিপ্ত না হয়, সে (হজ শেষে) সদ্যোজাত শিশুর মতো নিষ্পাপ অবস্থায় ঘরে প্রত্যাবর্তন করবে।’

আসলে হজ আল্লাহ রাব্বুল আলামিন-প্রদত্ত একটি বিশেষ নিয়ামত। তাই উম্মতে মুহাম্মদির জন্য হজ একটা দুর্লভ প্রাপ্তি। প্রতি বছর ৮ থেকে ১২ জিলহজ হজের এ মিলন অনুষ্ঠানে কাবাঘরের চারপাশ মুখরিত হয়ে ওঠে লাখো মুসলমানের কণ্ঠের লাব্বাইক ধ্বনিতে।

লেখক: মুহাদ্দিস, মুফাসসির খতিব ও টিভি উপস্থাপক

Exit mobile version