বহু বছর আগে যাঁদের বেশ্যা, পতিতা, গণিকা, বারাঙ্গনা, দেহোপজীবিনী, বারবণিতা ইত্যাদি নামে বলা হত, গত দশ-পনেরো বছর ধরে অনেক ক্ষেত্রে তাঁদের যৌনকর্মী নামে উল্লেখ করা হচ্ছে। আজকাল পৃথিবীর সব দেশেই তাঁরা নিজেদের সেক্স ওয়ার্কার বা সমমানের অন্য কোনও প্রতিশব্দে অভিহিত হতে চান, কারণ তাঁরা মনে করেন অন্যান্য পেশার মতই যৌনকর্মও একটি পেশা। বৃটিশ যুগে যৌনবৃত্তির নিয়ন্ত্রণ থেকে আজকের যৌনবৃত্তির আইন, রাষ্ট্রের বিধি-নিষেধের ফাঁক দিয়ে বেড়েই চলেছে এ কর্ম। রাত বাড়তেই রাজধানী ঢাকার নানা এলাকায় দেখা মেলে ভাসমান যৌনকর্মীর। দুই পাশের রাস্তা, ফুটপাত ছাড়াও ফুটওভার ব্রিজে খদ্দেরের অপেক্ষায় থাকেন তারা। বিভিন্ন পার্কেও রাতভর দেখা মেলে অসংখ্য যৌনকর্মীর। ফার্মগেট পার্ক আর মানিক মিয়া এভিনিউ’র ফুটপাতে এমনি কয়জন ভাসমান যৌনকর্মী সাথে কথা হলে তারাও জানালেন, জীবিকার জন্য যৌনকর্ম করলেও এটাকে তারা ‘সেবামূলক’ কাজ হিসেবেও দেখেন। আর প্রাক্তন যৌনকর্মী বর্তমানে একটি নারী সংগঠনের কর্মকর্তা শাহানাজ আপাতো সহজ ভাষায় বলেই দিলেন, “আমাদের বিরুদ্ধে সমাজকে নষ্ট করার অভিযোগ তোলা হয়। ডাক্তাররা যেমন সমাজের সেবা করেন, তেমনি আমরাও সমাজের সেবা করি। তাই আমাদের সেবিকা হিসেবেই মূল্যায়ন করা হোক।”
রাজধানী ঢাকায় মাঝারী মানের একটা রেস্টুরেন্টে একবেলা খাবার খেলে কমপক্ষে প্রয়োজন পড়বে ২৫০ থেকে ৩০০ টাকার। আর সেই একই রাজধানীতে একটি মেয়ের দেহ ভোগ করতে চাইলে সেটা মাত্র ২৫০ থেকে ৪০০ টাকায় সম্ভব! কি বুজলেন? কতোটা সস্তায় নামিয়ে এনেছি নারীকে অাদিম ভোগ্যপণ্যের এই রাজত্বে, তাই না? তবে যেটা শুনলে আরো বেশী অবাক হতে হয় তাহলো একটি নারীদেহের জন্য যে পরিমাণ অর্থ আপনি খরছ করলেন তার পুরোটাই কিন্তু ঐ নারীর কাছে পৌঁছায়না। লালন ফকিরের গানে নিশ্চয় শুনেছিলেন কথাটি- ‘গোপনে যে বেশ্যার ভাত খায়, তার জাতের কি আসে যায়?’ হ্যাঁ, পতিতার পেছনে পতিত পুরুষের খরছের অর্থের সিংহভাগ চলে যায় আরো অনেকবেশী অধঃপতিত পুরুষদের পকেটে! কে নেই সে তালিকায়? রাজনীতিবিদ থেকে শুরু করে পুলিশ সদস্য, উঠতি মাস্তান অনেক পেশার নিত্য আনাগোনা সেই কাতারে। আপনি ভাবতেও পারবেননা ভদ্রলোকের মুখোশের আড়ালে কত ধরণের মানুষের দৈনিক আয়ের বিরাট একটা অংশ আমদানী হয় ঐ দেহ বিকি-কিনির রমরমা বাজার থেকে!
পেশাগত জীবনে এনজিও’র অর্থে ভাত খেয়েছিলাম বলে সুযোগ হয়েছিল মানব সমাজেরই দুইটি প্রশ্নবিদ্ধ অংশ “পতিতা” আর “তৃতীয় লিঙ্গ” এর সাথে সরাসরি মিলেমিশে কাজ করবার। রাজধানী ঢাকার বুকে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের সবচেয়ে বড় সংগঠন “বন্ধন” আর পতিতাদের নিয়ে কাজ করা “দূর্জয় নারী সংঘ” এই দুইটি প্রতিষ্ঠানের সাথে কাজ করবার সুবাধে যে অভিজ্ঞতা অর্জন হয়েছিল পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ লেখকের লিখিত কোন গ্রন্থ কিংবা শিক্ষাঙ্গনের কোন সর্বোচ্চ ডিগ্রীও যে আমাকে সেই অভিজ্ঞতার সন্ধান দিতে অক্ষম তা চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলতে পারি আমি। হিজরাদের দেখে হাসি-ঠাট্টা করি আর পতিতা নারীকে দেখে নাক সিঁটকাই আমরা! অথছ কল্পনাই করতে পারবেন না কতখানি অসহায়ত্ব আর বিচ্ছেদের করুণ কাহিনী লুকিয়ে আছে প্রত্যেক হিজড়া কিংবা একজন পতিতা নারীর জীবনকথায়। আমি আপনি কত সহজেই কষ্ট পেয়ে চোখের জল ঝরিয়ে ফেলি। আর একজন হিজড়া বা একজন পতিতা নারী তারচেয়ে অনেক বেশী করুণ কাহিনীর কারণে জন্ম নেয়া চোখের জল কত সহজেই আড়াল করে রাখেন! চোখের জল আটকে রেখে জীবিকা নির্বাহের জন্য যদি কোন পুরস্কার প্রচলণ হয়ে থাকে তবে নিঃসন্দেহে তার দাবীদার হবেন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষগুলো আর পতিতা নারীরা।
তৃতীয় লিঙ্গ নিয়ে আজ থাক অন্য একদিন কথা বলা যাবে। আজ বলবো পতিতা নারীর কথা, একজন রাতের রানী সুমি’র কথা। সময়টা ২০১৪ এর নভেম্বর ছিল। অবশ্য তার আগেই দূর্জয়ের সাথে কাজ করার সময় পরিচয় হয়েছিল সুমি’র সাথে। সুন্দর গড়নের সুমিকে দেখে প্রথমে বিশ্বাস করতেই কষ্ট হয়েছিল সে একজন নিশিকন্যা! দূর্জয়ের প্রাক্তন সভানেত্রী শাহানাজ আপা (তিনিও একজন প্রাক্তন যৌনকর্মী) পরিচয় করিয়ে দিলেন সুমি’র সাথে। সুমি আমার সাথেই কাজ করবে যে কয়দিন আমি আছি দূর্জয়ের সাথে। আমি জড়তায় ভূগলেও সুমিকে দেখেছি সাবলীলভাবেই আমাকে গ্রহণ করতে। যে দুইটি সপ্তাহ কাজ ছিল তার প্রতিদিন সুমি অামার পাশেই ছিল ছায়াসঙ্গীর মতই। এক মুহুর্তের জন্যও কোন ধরণের সংকীর্ণতা বোধ করতে দেখিনি তাকে। সেই পরিচয়ের সূত্র ধরেই পরে একদিন সুমিকে জানালাম আমি তার সাথে তার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে কথা বলতে চাই। সুমি স্বাচ্ছন্দ্যেই সাড়া দিলো।
সুমি অবশ্য তার আসল নাম নয়। পিতার দেয়া নাম সে হারিয়ে ফেলেছে আরো প্রায় বছর সাতেক আগেই। এখন সুমি নামেই পরিচিত তার কর্ম এলাকায়। একটা রাত পুরো কাটিয়েছিলাম সুমি’র সাথে! বিছানায় নয়, মানিক মিয়া এভিনিউ’র চওড়া ফুটপাতে পাশাপাশি বসে। সন্ধ্যায় যখন সুমির সাথে দেখা করতে আসি তখন হাজারো সুমি সংসদ ভবনের সামনের ফুটপাতে অবস্থান করছিল। এক এক করে বাকী সুমিরা তাদের সংগী জোগাড় করে যার যার গন্তব্যে চলে গেলেও আমি অার আমার সুমি, আমরা রয়ে গেছি মানিক মিয়া এভিনিউ’র ফুটপাতে। সেটাই ছিল আমাদের গন্তব্য। সুমি সেদিন সাজগোছ করেনি অন্যদিনের মত। কারণ সুমি জানে আজ সে কোন খদ্দের ধরতে যাচ্ছে না, যাচ্ছে তার জীবনের কিছু কথা কাউকে জানানোর জন্য। তাই স্বাভাবিক অন্য দশ মেয়ের মত সাবলীল পোশাকেই অপেক্ষা করছিল আমার জন্য ঠিক সেই জায়গাটায় যে পথ দিয়ে এই দেশের মাননীয় সাংসদগণ সংসদ ভবন ত্যাগ করে মানিক মিয়া এভিনিউতে নামেন। বেশীক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়নি, যে সময় নির্দিষ্ট করা ছিল তার থেকে মাত্র সাত-আট মিনিট দেরী হয়েছে আমার সুমির কাছে পৌঁছাতে। তারপর ভোরে ফজরের আজান দেওয়া অবধি আমি আর সুমি ছিলাম সংসদ ভবন এলাকায়। সবচেয়ে মজার বিষয়, সে রাতে কেউ আমাদের ডিষ্টার্ব করেনি। না পুলিশ, না কোন লোকাল মাস্তান, না কোন ছিনতাইকারী। অবশ্য কারণও ছিল। ঢাকা মহানগর পুলিশের তেজগাঁও জোনের তৎকালীন ডিসি বিপ্লব দাদা সব ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। তাই উল্টো দু’জন কনষ্টেবল দুর থেকে আমাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছিলেন সে রাতে। বিপ্লব দাদা’র প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে ভুল করিনি তাই আজকের এই লেখাতেও।
ইচ্ছে করে কেউ, কোন নারী পতিতা হয় না। একজন নারীর পতিতা হয়ে উঠবার পেছনে যে গল্পগুলো থাকে তা শুনলে যে কোন স্বাভাবিক আচরণের একজন মানুষ আঁতকে উঠবেন, এতে সন্দেহ নেই। আমার সুমি এখন রাজধানীর মানিক মিয়া এভিনিউ’র খেজুর বাগান কিংবা খামারবাড়ী এলাকায় রাতের রানী, ভাসমান পতিতা। অন্য পুরুষের যৌনতার ক্ষুধা নিবারণ করে আয় করে অর্থ। সেই অর্থে গ্রামের বাড়িতে থাকা সুমির অন্য দুই ভাই-বোন বড় হচ্ছে, পড়া-লেখা করছে। সুমি’র আদরের ছোট বোনটা গত বছর এসএসসি তে জিপিএ ফাইভ পেয়েছিল বলে সুমি আমাকে ফোন দিয়ে ডেকে নিয়ে মিষ্টি খাইয়েছিল। জীবনে পরীক্ষা পাশের মিষ্টি অনেক খেয়েছি, কিন্তু সুমির বোনের পাশের মিষ্টির স্বাদের কাছে বাকী সব যেন হার মেনেছিল সেদিন। অথছ সুমি হারিয়েছে তার ২৬টি বসন্ত পার করা শরীরের লাবণ্য আর সুখ, সাথে হারিয়েছে ভাই-বোনের ভালোবাসা। পিতা মাতার আদর শেষ কবে পেয়েছিল তা মনেই করতে পারেনি সুমি সেই রাতে। আজকের সুমি তার যৌবন বিলিয়ে অর্জন করেছে পদে পদে লাঞ্চনা-বঞ্চনা আর ঘৃণা।
সময়টা ছিল ২০০৭ সাল। মাসটা ঠিক মনে নেই। মঙ্গাপীড়িত দেশের উত্তরাঞ্চলের মেয়ে সুমি। বয়স সবে ২০ পার হয়েছে। দেখতে ভীষণ সুন্দরী, শরীরের গড়নটাও চোখে পড়বার মতই। দরিদ্র পরিবারের সুন্দরী যুবতী মেয়ের কপালে যে ধরণের দূর্দশা লিখা থাকে সচরাচর সুমি’র ক্ষেত্রেও তার বিপরীত কিছু ঘটেনি। পড়াশোনা পরিবারের আর্থিক দৈন্যতার কারণে বেশীদূর এগুতে পারেনি সুমি, ক্লাশ সেভেন পাশ করে ক্লাশ এইটে উঠবার সৌভাগ্য সুমি’র আর হয়নি। সেভেনের মাঝামাঝি সময়ে বাবা সাফ জানিয়ে দিলেন আর সম্ভব নয় পড়ালেখার খরছ যোগান দেয়া। কথা বাড়ানোর মত সাহস সুমি’র ছিলনা বলে বাবার কথার প্রতিবাদ করেনি সে। মুখ বুঁজে মেনে নিয়েছিল বাবার কথা। তারপর ঘরে থেকে মাকে কাজে সাহায্য করাটাই সুমি’র মূলকাজ হয়ে পড়লো। ঘরের প্রয়োজনেই বাজার ঘাটে যাতায়াত করতে হতো সুমিকে। চোখ পড়লো এলাকার কিছু ছেলের। নানাভাবে পথে-ঘাটে সমস্যার মুখোমুখি হতে লাগলো সুমি। ভয়ের চোটে না পারে বখাটেদের কিছু বলতে, না পারে সে বাড়ী ফিরে বাবা-মা’কে কিছু জানাতে। এভাবেই কাটছিল সুমি’র প্রতিটা দিন। এরমাঝে একবার শারীরিকভাবে লাঞ্চনার শিকারও হয়েছিল সুমি বখাটেদের হাতে। ভাগ্য ভাল ছিল বলে খারাপ কিছু ঘটেনি, রাস্তায় হাত-কাপড় ধরে টানাটানিতেই সীমিত ছিল সেটা।
এরই মধ্যে পাশের গ্রামের এক দোকানীর ছেলের সাথে সুমি’র বিয়ের প্রস্তাব এলো সুমি’র বাবার কাছে। বাবা যেন হাতে আকাশের চাঁদ পেলেন। ছেলে ঢাকায় কি যেন চাকরী করে বলে ছেলের বাবা সুমি’র বাবাকে বলেছিলেন। অতকিছু যাচাই করার মত সময় সুমি’র বাবার হাতে ছিলনা বলে তিনি প্রথমেই রাজী হয়ে গিয়েছিলেন বিয়ের প্রস্তাবে। সুমি’র একমামা বাঁধা দিলেন, বললেন তিনি ঐ ছেলেটাকে চিনেন আর এক নম্বরের বদমাশ বলতে যা বুজায় ছেলেটা নাকি তাই। কিন্তু সুমি’র বাবা শ্যালকের কথায় কানই দিলেন না। মেয়েকে পাত্রস্থ করাটাই তার কাছে তখন ফরজ হয়ে গিয়েছিল। তাই সব বাঁধা উপেক্ষা করে অল্প সময়ের ব্যবধানেই তিনি সুমিকে বিয়ে দিলেন সেই ছেলের কাছে। কিন্তু অবাক করার ব্যাপার হলো পাত্রপক্ষ বিয়ের দিন সুমিকে তাদের বাড়ীতে নিয়ে যাননি, উল্টো সুমিদের বাড়ীতেই সুমি’র বাসরঘর সাজাতে হয়েছিল। ধনী কি দরিদ্র, প্রতিটি মেয়ের জীবনে যে রঙিন স্বপ্নটা থাকে সেটা একটা সুন্দর বাসরের- বাসর রাতের। আর সুমি তাদের বাড়ীতেই সাজানো তার বাসর ঘরে বাসর রাতেই আবিস্কার করলো একটা মানুষরূপী পশুর সাথে তার বিয়ে হয়েছে! তার স্বামী বাসর ঘরে সুমিকে রেখেই নাকি মদ খেয়েছিল। তারপর ভোরবেলা যখন ছেলেটা ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায় তখন সুমি’র ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল বিছানা থেকে উঠতে। কোনভাবেই সে নাকি উঠে দাঁড়াতে পারছিলনা শরীরের বিশেষ অংগগুলোর ব্যাথার চোটে! তখনও নাকি তার নিন্মাঙ্গে রক্ত ঝরছিল।
সেই রাতটাই ছিল সুমি’র বিবাহিত জীবনের প্রথম এবং শেষ রাত। পরদিন ভোরে বেরিয়ে যাবার পর সকাল ১০টার দিকে নাকি তার স্বামী অাবার তাদের বাড়ী আসে। জানায় সে ঐদিনই ঢাকা চলে যাচ্ছে, তার জরুরী কাজ আছে। সুমি বাঁধা দেয়নি, বাঁধা দেয়নি স্বামীর কাজের গুরুত্বের কথা বিবেচনা করে নয় বরং দুঃস্বপ্নে পরিণত হওয়া স্বপ্নের বাসর রাতের অভিজ্ঞতার কথা চিন্তা করেই। তারপর পরই স্বামী চলে যায়, আজ অবধি অার স্বামীর মুখ দ্বিতীয়বার দেখবার সৌভাগ্য কি দূর্ভাগ্য তার কোনটিই সুমি’র আর হয়নি। এমনকি শ্বশুর বাড়ীর কেউও আর কখনোই সুমি’র কোন খোঁজ-খবর নেয়নি। এরপর দিন গেল, মাস গেল, বছরও প্রায় গেল গেল। বিয়ের পর কয়েকদিনের মাথায় সুমি টের পেলো তার শরীরের কিছু পরিবর্তন, মাকে বলতেই মা জানালো সেও মা হতে চলেছে। আনন্দের পরিবর্তে কেমন যেন অজানা একটা ভয় এসে ভর করলো সুমি’র মনের ভিতর। স্বামীর খবর নেই, শ্বশুরবাড়ী যেন থেকেও নেই। এদিকে বাবা-মায়ের অবস্থাও শোচনীয়। সুমি’র নিজের যত্নই চলেনা, গর্ভের শিশুর যত্ন হবে কোথা থেকে! অবশেষে সময়সীমার প্রায় একমাস আগেই সুমি একটা মৃত শিশু প্রসব করলো। প্রথমে কিছুটা খারাপ লাগলেও পরক্ষণে সুমি খুশীই হলো সন্তানটা মৃত হওয়ায়। তারপর কেটে যায় আরো কয়েক মাস। কিন্তু অবস্থার আর কোন উন্নতি হয়না। সুমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে, এবার তাকেই কিছু একটা করতে হবে।
মামাকে ধরে সে তার স্বামীর ঢাকার একটা সম্ভাব্য ঠিকানা জোগাড় করে। এরই মধ্যে সুমিদের পাশের বাড়ীর রেহানা ঢাকা থেকে বাড়ী আসে ছুটি কাটাতে। রেহানা ঢাকায় কোন একটা পোশাক কারখানায় চাকুরী করে। বয়সে সুমি’র চাইতে কয়েক বছরের বড় হলেও সুমিকে খুব আদর করতো রেহানা আগে থেকেই। এবার বাড়ী এসে সুমি’র সবকিছু জানতে পেরে রেহানাও কষ্ট পায় ভীষণ মনে। সুমি রেহানাকে বলে তাকে ঢাকায় নিয়ে যেতে। ঢাকা গিয়ে সে রেহানার মত কোন পোশাক কারখানায় কাজ করবে, পাশাপাশি ঐ হারামজাদাটার খোঁজ করবে। সুমি বাবাও যেন সুমি’র এই সিদ্ধান্তে খুশী হয়। স্বামীকে খুঁজে পাবে কি পাবেনা তার চেয়ে সুমি’র বাবার মনে ভাবনা জাগে- সুমি চাকরী করলে সংসারে কিছু টাকা আসবে, ভালভাবে বাকী দুই ছেলে-মেয়ে নিয়ে থাকা যাবে। দিন ঘনিয়ে রেহানার ছুটি শেষে ঢাকা ফিরবার সময় হলো। সুমিও রেহানার সাথে ঢাকা রওনা হয়ে যায়। বাবা কোথা থেকে যেন হাজার দু’য়েক টাকাও সুমিকে জোগাড় করে এনে দেন। সেটাই সম্বল করে সুমি ঢাকার পথে যাত্রা করে। একবারের জন্যও সুমি ভাবতে পারেনি সেটাই তার শেষ যাত্রা। আর কখনো যাত্রাও হবেনা, বাড়ীও ফেরা হবেনা!
ঢাকায় এসে প্রথমে দুইদিন কোথাও বের হয়নি সুমি, রেহানার ঘরেই থাকে সে। এরমাঝে রেহানা তাদের কারখানাতেই সুমি’র জন্য একটা কাজ ঠিক করে দেয়। ঢাকায় আসার তৃতীয় দিনের মাথায় সুমি রেহানার সাথে কারখানায় গিয়ে কাজে যোগ দেয়। নতুন জায়গা, নতুন কাজ, কোন কিছুই ঠিকমত বুজে উঠতে পারেনা সুমি। রেহানা তাকে সাহায্য করে কাজের ক্ষেত্রে। কয়েকদিন যেতেই সুমি মোটামুটি তার কাজ বুজে ফেলে, আধাদক্ষ শ্রমিকের মত কাজ করতে শুরু করলো। তাদের কারখানায় প্রতি সপ্তাহে বেতন দেওয়ার রীতি চালু ছিল। যথারীতি সুমিও বেতন পেল সপ্তাহান্তে। বেতনের এক হাজার টাকা হাতে পেয়ে আনন্দে দুইচোখ দিয়ে জল বেরিয়ে এলো সুমি’র। জীবনের প্রথম আয়ের পুরো টাকাটাই সে রেহানার সহায়তায় বাড়ীতে বাবার কাছে পাঠিয়ে দেয়। বাবাও নিশ্চয়ই খুশী হয়েছিলেন সন্তানের উপার্জনের টাকাটা হাতে পেয়ে। হয়তো ভাবতে পারেননি তখন- এরপর থেকে শুধু সন্তানের উপার্জনের টাকাটাই চোখে দেখবেন, সন্তানকে আর দেখতে পাবেন না।
একমাস সুমি মন দিয়ে চাকরী করে যায়। স্বামীর চিন্তা মাথায় এলেও তাকে গুরুত্ব না দিয়ে কাজের প্রতিই বেশী মনোযোগী হয় সে। মাস পার হবার পর এবার স্বামীকে খুঁজে বের করবার চিন্তাটা তাকে খোঁচাতে থাকে ভিতর ভিতরে। রেহানাকে কথাটা বলেও সুমি, জানায় মামার দেওয়া ঠিকানাটার কথাও। রেহানাদের কারখানাটা ছিল আশুলিয়ার জামগড় এলাকায়, আর সুমি তার স্বামীর সম্ভাব্য যে ঠিকানাটা রেহানাকে দেখায় সেটা টঙ্গীর চেরাগআলী মার্কেটের। রেহানা তাকে জানায় জায়গাটা এখান থেকে অনেকটাই দুরে, সে নিজেও সময় করতে পারছেনা আর সুমিকেও একা যেতে দিতে পারছেনা। সুমি অপেক্ষা করে রেহানার সময় হয়ে উঠবার। ইতিমধ্যে সুমি’র বিষয়টা কারখানার আরো অনেকেই জানতে পারে। সুমিদের কারখানার এক অপারেটর জানায় সে টঙ্গীতেই থাকে, সে চেষ্টা করবে তার স্বামীর খোঁজ বের করতে। শুনে সুমি আশ্বস্ত হয় খানিকটা, আর অপারেটর ছেলেটা হাসে মনে মনে। তিন-চারদিন পর অপারেটর ছেলেটা জানায় সে সুমি’র দেয়া ঠিকানা খুঁজে পেয়েছে, এখন স্বামীকে সনাক্ত করার জন্যতো সুমিকে সেখানে যেতে হবে তার সাথে। রেহানার মন কোন এক অজানা আশঙ্কায় ঠিক সায় দিচ্ছিলোনা সুমিকে একা ঐ অপারেটর ছেলের সাথে যেতে দিতে, কিন্তু নিজেও তো যেতে পারছেনা। তাই বাধ্য হয়ে মন না চাইলেও সে সুমিকে বলে ছেলেটার সাথে যেতে। সেদিন ফ্লোর ইনচার্জকে বলে অপারেটর ছেলেটা আর সুমি দুইজনেই লাঞ্চ আওয়ারের পর কারখানা থেকে বেরিয়ে পড়ে। আশুলিয়া থেকে গাড়ীতে উঠে টঙ্গী যাবার জন্য। গাড়ী কিছুদূর চলার পর ছেলেটা কাকে যেন ফোন করে বলে, মাল নিয়ে আসতেছে সে তাড়াতাড়ি যেন গোডাউনটা রেডী করে রাখে। সুমি বুজতে পারেনা কথাটা, জিজ্ঞেস করে ভাই কি মাল নিতেছেন? ছেলেটা হেসে বলে আপনে বুজবেন না, অার বুজে আপনের কোন কাজও নাই। আপনিতো যাইতেছেন স্বামীরে খুঁজতে, স্বামীরে পাইবেন ই পাইবেন আজকা। তাও একটা না, সাথেও বোনাসও থাকবে কিছু। সুমি আবার বুজতে পারেনা কথাগুলো, স্বামী একটা না বোনাস- কথাগুলো কেমন যেন লাগছিল তার কাছে। কিন্তু সে অন্যকিছু আর যেন ভাবতে পারছিলনা, মাথায় শুধু বারবার ঘুরেফিরে একটা চিন্তাই আসছিল তার- স্বামীকে আজ সত্যি সত্যিই খুঁজে পাবে কি-না?
সুমিদের গাড়ীটা এরইমাঝে কামারপাড়া চলে আসে। অপারেটর ছেলেটা সুমিকে নিয়ে কামারপাড়া ব্রীজের সেখানেই নেমে পড়ে। সুমি জিজ্ঞেস করে আমরা কি চেরাগআলী আসছি? উত্তর পায় হ্যাঁ, এবার রিক্সায় করে ঐ জায়গায় যেতে হবে। তারপর ছেলেটা একটা রিক্সা ধরায় উত্তরা ১০ নং সেক্টর রানাভোলার কোন ঠিকানায় যেতে। সুমিও ছেলেটার সাথে রিক্সায় চড়ে স্বামীকে খুঁজে পাওয়ার আশায়। মনের ভিতর একটা উত্তেজনা কাজ করছিল তার। মিনিট দশেকের মাথায় রিক্সা এসে গন্তব্যে থামে। তারা দুইজন রিক্সা থেকে নেমে রিক্সাভাড়া মিটিয়ে হাঁটতে থাকে। সুমি ছেলেটার পিছনে পিছনে তাকে অনুসরণ করে পথ চলে। খানিকপর একটা পাঁচতলা বাড়ীর সামনে এসে দাঁড়ায় তারা। বাড়ীর গেটে দারোয়ান তাদের দেখে এগিয়ে আসে, আস্তে করে অপারেটর ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করে, বড়ভাই কইছিল মাল আসবে, নিয়া আসছেন? অপারেটর সুমি’র দিকে একবার তাকায়, তারপর কিছু না বলে গেট দিয়ে ভিতরে ঢুকে পড়ে, সুমিকেও আসতে বলে। সুমি কিছুটা ভয়ে ভয়ে গেটের ভিতর প্রবেশ করতেই দারোয়ান কেন জানি দ্রুত গেটটা বন্ধ করে দেয়। অপারেটর ছেলেটা সুমিকে বলে তার পেছনে আসতে। একটু পর তারা কেমন জানি একটা মেশিনের সামনে এসে দাড়ায়, ছেলেটা মেশিনের একটা বোতাম চাপ দিতেই মেশিনের দরজা খুলে যায়। তারপর ছেলেটা সুমিকে নিয়ে ঐ মেশিনের ভিতর ঢুকে যায়, আবার একটা বোতাম চাপ দিতেই মেশিনের দরজা বন্ধ হয়ে যায়, মেশিনটাও কেমন যেন নড়ে উঠে। সুমির মনে হলো সে যেন নীচের দিকে পড়ে যাচ্ছিলো, মেশিনের গায়ে হাত দিয়ে সে টাল সামলায়, সোজা হয়ে দাড়ায়। খানিকপরে মেশিনটার দরজা আবার নিজ থেকেই খুলে যায়, ছেলেটা সুমিকে নিয়ে মেশিনের ভিতর থেকে বেরিয়ে অাসে। সুমি টের পায় যে জায়গায় মেশিনের ভিতর ঢুকেছিল তারা এটা সে জায়গা না, একটু অন্যরকম যেন।
অপারেটর ছেলেটা এবার একটা দরজার পাশে একটা বোতাম চাপ দিতেই ভিতরে কোথাও যেন খুব সুন্দর একটা গানের মত শব্দ শুনতে পেল সুমি। দেখলো তারপর পরই দরজাটা খুলে গেল, দরজার ভিতরের দিকে একজন লোক দাঁড়ানো আছে। সুমিদের দেখে সে প্রথমে একটু কেমন করে যেন তাকালো, তারপর সুমিকে পা থেকে মাথা অবধি ভালভাবে দেখলো লোকটা। তারপর বললো ভিতরে যেতে। সুমি ভয় পেয়ে দাঁড়িয়েই রইলো বাইরে। অপারেটর ছেলেটা প্রথমে ভিতরে ঢুকলো, তারপর সুমিকে বললো ভিতরে আসতে। সুমি তারপরও দাড়িয়ে রইলো। ছেলেটা তখন আবার বাইরে এসে সুমির একটা হাত ধরলো, মুখে বললো ভয়ের কিছু নাই এরা সবাই মিলে অাজ তোমার স্বামীকে খুঁজে দিবে। সুমি ছেলেটার হাত ছাড়াতে চাইলো, পারলোনা। ছেলেটা যেন আরো বেশী শক্ত করে তার হাতটা ধরে রাখছিল। একরকম টানের চোটেই সুমি দরজার ভিতর ঢুকে গেল, দরজা খুলে দেয়া লোকটা কালবিলম্ব না করেই দরজাটা আটকে দিলো। সুমিকে নিয়ে তারা ভিতরে একটা রুমে গিয়ে দাঁড়ালো। মোটামুটি বড় আকারের একটা রুম, একটা সোফা আর বড় সাইজের একটা বিছানা ছাড়া আর কিছু নেই রুমটাতে। জানালাগুলো সব ভারী পর্দা দেয়া, বাইরে কিছুই দেখা যায়না। সুমি মনে মনে খানিকটা ভীত হয়ে পড়লো। অপারেটর ছেলেটা সুমিকে সোফা দেখিয়ে সেখানে বসতে বললো। সুমি ভয়ে ভয়ে সোফায় গিয়ে বসলো। সে বসবার পর বাকী দুইজন ভিতরের অন্য কোথাও গেল। সুমি অবাক চোখে আশেপাশে দেখতে লাগলো। অনেক বড়লোকের বাসা মনে হলো তার কাছে। সে ভাবতে লাগলো তার স্বামী কি এখানেই আছে? পরক্ষণে আবার চিন্তা করলো ওরাতো বললো যে সবাই মিলে স্বামীকে খুঁজে দিবে, তার অর্থ এখানে নেই তার স্বামী। হয়তো আশে-পাশে কোথাও আছে, তার স্বামীর ঘরটাও হয়তো এদের ঘরের মতই হবে। হাজার রকম ভাবনা সুমির মাথায় ভিড় করতে শুরু করলো। এরই মধ্যে ছোট একটা মেয়ে এসে একগ্লাস শরবত দিয়ে গেল সুমিকে, যাবার সময় বললো আফা খাইয়া নেন। সুমি’র বেশ পানির তেষ্টা পেয়েছিল, তাই সে অার দেরী না করে শরবতটুকু খেয়ে নিলো। গ্লাসটা নামিয়ে রাখতেই কেমন যেন মাথা ঘুরানোর মত মনে হলো সুমি’র কাছে। সুমি ভাবলো হয়তো অনেক দুর গাড়ী চড়ে এসেছে বলে এমন লাগছে তার। এটা ভাবতে ভাবতেই যেন সুমি’র আবার ঘুম ঘুম একটা ভাব মনে হতে লাগলো। চোখের সামনে সবকিছু যেন খানিকটা ঘোলাটে ঘোলাটে লাগছিল, ভাল করে একটু নড়েচড়ে বসতে চাইলো সুমি। পারলো না, তার আগেই রাজ্যের ঘুম এসে যেন ঘর করলো সুমির চোখে, অার কিছু খেয়াল করতে পারলো না সুমি, চোখ দুইটি বুজে এলো সুমির।
অনেক পর সুমি’র ঘুম ভাঙ্গলো। চোখ মেলে সুমি তাকে আবিস্কার করলো, যে খাটটা দেখেছিল তার উপর শুয়ে আছে সে। তার শরীরটাই কেমন যেন অন্য রকমের লাগছে তার কাছে, পরনের কাপড়গুলোও এলোমেলো। ভাল করে উঠে বসতে গেলে সুমি টের পেলো তার নীচের অংশে কাপড় নেই, আর দুপায়ের মাঝেও কেমন যেন ব্যাথা! সুমি কিছু আন্দাজ করার আগেই হঠ্যাৎ তার চোখে পড়লো দেয়ালে একটা টিভির পর্দায় কি যেন দেখাচ্ছে। একজন লোক, আরে এতো সেই লোকটাই যে তাদের দরজা খুলে দিয়েছিল। আরে লোকটা কাপড় খুলছে কেন এমন নির্লজ্জের মত! এবার টিভির পর্দায় লোকটার বদলে একটা বিছানা দেখা গেল, একটা মেয়ে যেন শুয়ে আছে। আরে, শুয়ে আছে কি, এটাতো সে নিজেই! অনেকটা অজ্ঞানের মতই পড়ে আছে বিছানায়। লোকটাকে এবার আবার টিভির পর্দায় দেখা যাচ্ছে। পুরো উদোম শরীর লোকটার, ঐ বিছানার দিকেই গেল লোকটা। তারপর সুমি যেটা টিভির পর্দায় দেখতে পেলো তাতে সে যেন নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছিলোনা। লোকটা একে একে সুমি’র শরীরের সবগুলো কাপড় খুলে ফেললো। তারপর………. আর দেখতে পারলো না সুমি, চিৎকার করে কেঁদে উঠলো সে! তার চিৎকার শুনে অপারেটর ছেলেটা ছুটে এলো। তারপর তার দিকে তাকিয়ে টিভির দিকে তাকালো একবার। আবার সুমি’র দিকে তাকিয়ে হাসতে লাগলো ছেলেটা। মুখে বললো, কি বলেছিলাম না আজকে স্বামীকে পাবিই তুই, স্বামীর সাথে বোনাসও পাবি। একথা বলে সে বিছানায় সুমি’র কাছে এগিয়ে গেল। ধাক্কা দিয়ে আধশোয়া সুমিকে আবার বিছানায় শুইয়ে দিলো। বললো, এখনো শেষ হয়নি, এবার বোনাসটা নিয়ে নে। বলেই সুমি’র উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো সে।
তারপর যে কাহিনী সুমি’র জীবনে একের পর এক ঘটতে লাগলো তার জন্য কখনোই প্রস্তুত ছিলনা সুমি। ঐ বাসাতেই বন্দী জীবন কাটতে লাগলো সুমি’র। প্রতিদিন নতুন নতুন মানুষ আসে, ভোগ করে সুমিকে। বাঁধা দিতে চাইলে তারা মারধোর করে তাকে। একবার নয়, প্রতিদিন অন্তত আট-দশজন করে মানুষ আসতো। নরকের জীবন শুরু হলো সুমি’র, কতদিন এভাবে ঐ বাসায় কেটেছিল সঠিক মনে নেই সুমি’র। একদিন কিভাবে যেন সে বাসা থেকে বের হয়ে গেল। সেদিন আর মেশিনে চড়ে নয়, মেশিনের পাশের সিঁড়ি বেয়েই নীচে নেমে এলো। নীচে নেমে দেখলো গেটটা ফাঁকা, দারোয়ান নেই। একমুহুর্ত আর দেরী না করেই সুমি গেট দিয়ে বেরিয়ে রাস্তায় নেমে এলো, তারপর সোজা হাঁটতে শুরু করলো সোজা। কিছুদুর যেতেই একটা রিক্সা পেলো। সে রিক্সাটা দাঁড় করালো, রিক্সাওয়ালা জানতে চাইলো কোথায় যাবে, সে উত্তর দিলো আমার ভীষন বিপদ আগে এই জায়গা থেকে আমাকে তাড়াতাড়ি নিয়ে চলেন। রিক্সায় উঠে বসলে রিক্সাওয়ালা রিক্সা চালাতে শুরু করলো। অনেকক্ষণ পর খানিকটা দুরে এসে রিক্সা থামালো রিক্সাওয়ালা। সুমিকে বললো কি হয়েছে খুলে বলতে। সুমি খানিকটা ইতস্তত করে পরে বললো সবকিছু। এখন তাহলে কোথায় যাইবা? রিক্সাওয়ালা জানতে চাইলে সুমি জানালো সে জানেনা সে কোথায় যাবে, কাউকে সে চিনেনা এখানে। আশুলিয়ার কারখানা বা রেহানার ঠিকানা কোনটাই সঠিক জানা নেই তার। আর জানা থাকলেও হয়তো সেখানে আর ফিরে যেতোনা সে। সবশুনে রিক্সাওয়ালা বললো ঠিক আছে অাপাতত আমার লগে আমার বাসায় চলো, তারপর দেখা যাবে কি করা যায়। বলেই আবার রিক্সা চালানো শুরু করলো। তারপর রিক্সাওয়ালা তার বাসায় এনে সুমিকে সে নিজেও জোর করে ভোগ করলো, একবার নয় প্রায় পরপর দুই-তিনবার। সুমি’র আর কিছুই করবার ছিলনা, ঘরের এক কোনায় বসে বসে কান্না করা ছাড়া। তার কান্নায় মন গললো না রিক্সাওয়ালার। সে উল্টো সুমিকে বললো, দেখ ছেমরি তোরে তো অনেকে নষ্ট করছে, আমিও করছি। তুই এখন আর কোথাও যাইতেও পারবিনা। তারচেয়ে এককাজ কর, আমি রোজ মানুষ আনমু। তুই তাগোরে বিদায় করবি, টাকা পাবি মেলা। এছাড়া অার করারও কিছু ছিলনা তখন সুমি’র। কাঁদাকাটা শেষ করে নীরবভাবে যেন রিক্সাওয়ালার কথাতেই সায় দিয়েছিলো সুমি। সেই থেকে শুরু, আজ অবধি চলছে সুমি’র মানুষ বিদায় দেয়ার পালা।
এঘাট ওঘাট করে সুমি কয়েক বছর পর মোহাম্মদপুর এলাকায় এসে পড়ে। সেখানেও ঐ একই কাজ করতে করতে হঠ্যাৎ একদিন অসুস্থ হয়ে পড়লে আরো কয়েকজন রাস্তার মেয়ে মিলে তাকে একটা অফিস ঘরে নিয়ে আসে। সেখানে প্রথমে তাকে চিকিৎসা করা হয়, ঔষূধ পথ্য খাওয়ানো হয়। তারপর তাকে বলা হয় দুই একদিন এখানেই বিশ্রামে থাকতে। তাকে জানানো হয় এটা তার মতো মেয়েদের একটা সংগঠন যেখানে তাদের চিকিৎসাসহ নানা ধরণের সহযোগিতা দেয়া হয়ে থাকে। এই পেশাতে থাকতে গেলে যে ধরণের অসুখ-বিসুখ আর সমস্যাগুলো হয়ে থাকে তার সমাধান সে এখানেই পেতে পারে। আর এই সংগঠনটি যারা পরিচালনা করছেন তারাও সবাই একদিন তার মতোই যৌনকর্মী ছিলেন। এখন কেউ বয়সের কারণে আর কেউ স্বেচ্ছায় তা ত্যাগ করে এই সংগঠনের সাথে জড়িত হয়েছেন। চাইলে সে নিজেও তার পেশার পাশাপাশিই এখানে জড়িত থাকতে পারবে। সুমি’র মনে পড়ে গেল গত কয়েক বছরে অনেক নামীদামী জায়গায় কাজে গেলেও তার কোন আশ্রয় নেই কোথাও, তাই সে এই সংগঠনটিকেই তার আশ্রয় হিসেবে বেছে নিলো শেষ। সুমি এখন এই সংগঠনের একজন সক্রিয় কর্মী। সে নিজে যৌনকর্মী হয়েও আরো অসংখ্য যৌনকর্মীর অধিকার নিয়ে কাজ করছে। তাদের উদ্বুদ্ধ করছে পেশায় নিয়মিত থাকার পাশাপাশি নিজেদের স্বাস্থ্য সচেতনতা আর অন্যান্য অনেক বিষয় নিয়ে। সুমি এখন যৌনকর্মী হলেও আগের মত অবস্থায় নেই। যাকে তাকে দেহ বিলিয়ে দেয়না, সেও আজ কাল যাচাই বাছাই করে তবে খদ্দের ধরে। নিজেকে আর রাস্তার সাধারণ পতিতা ভাবেনা সে, অনেক পরিবর্তন নিজের ভিতর অন্যদের ভিতরও আনতে সক্ষম হয়েছে আজ সে। আর তাকে এই পরিবর্তনের রাস্তাটা চিনিয়েছেন যিনি তিনি শাহানাজ আপা, যার কথা শুরুতেই উল্লেখ করেছিলাম। সেইরাতে অনেক কথার ফাঁকে আরো একটা কথা জানিয়েছিল সুমি আমাকে। খুব সহসাই সে পুরোপুরি এই পেশা ছেড়ে দিচ্ছে। মানিক মিয়া এভিনিউ’র এই ফুটপাতেই দেহ কিনতে এসে তার দেহের শুধু নয়, তার প্রেমেই পড়ে গেছে কেউ একজন। প্রথমে বিষয়টাকে হেসেই উড়িয়ে দিলেও পরে বুজতে পারে ছেলেটি তাকে মিথ্যা বলেনি। সে প্রতিদিনই এই বাজারে আসে কিন্তু কোন পণ্য আর কিনেনা। তাকিয়ে দেখেওনা অন্য কোন মেয়েকে। দুর থেকে দাঁড়িয়ে একমনে শুধু সুমিকেই দেখে ছেলেটা, কিন্তু কখনো সুমিকে বাঁধা দেয়নি তার কাজে। সুমিই বরং মাঝেমাঝে লজ্জায় অন্যকোন খরিদ্দারের সাথে যেতে পারেনা ছেলেটাকে ওখানে দাঁড় করিয়ে রেখে।
আমার সাথে যে রাতে সুমি কথা বলেছিল তার প্রায় এক সপ্তাহ পর একদিন হঠ্যাৎ আমাকে ফোন দিয়ে সুমি জানায় আগামী বৃহষ্পতিবার আমাকে যে করেই হোক মগবাজার কাজী অফিসে উপস্থিত থাকতে হবে। শুনে খুব ভাল লাগে, আমি জানাই অবশ্যই থাকবো আমি। হ্যাঁ ছিলামও আমি সেদিন মগবাজার কাজী অফিসে, সুমি’র বড়ভাই হিসেবে তার অভিভাবক হয়েছিলাম আমি কাজী অফিসে। তার আগে বোনের জামাইটাকে বাজিয়ে দেখার জন্য সুমি’র কাছ থেকে ছেলেটার তথ্য সংগ্রহ করে গোয়েন্দাগিরি করি। বশির, ছেলেটা সত্যিই অনেক ভাল। বাবা-মা মারা গেছেন, সে একজনই ছেলে আর তার একটা ছোটবোন আছে গ্রামে চাচা-চাচীর কাছে থেকে পড়ালেখা করে। বশির পেশায় একজন ক্ষুদ্র মোটর পার্টস ব্যবসায়ী। আয় রোজগার ভাল। সুমি’র প্রতি তার ভালবাসা সত্যিই অবাক করেছিল আমার মত অনেককেই। এখন তাদের একটা ছেলে আছে, বয়স দেড় বছরের কাছাকাছি। আমার দেয়া নামটাই রেখেছে তারা তাদের ছেলের। আমার ছেলের নাম আমিই দিয়েছিলাম প্রতীক (আমার মরহুম বাবার প্রতীক সে আমার কাছে), অার সুমি’র ছেলের নাম দিয়েছিলাম প্রান্ত (বশির সুমি’র জীবনে প্রান্তরেখা টেনে দিয়েছিল তাই এই নামকরণ)।সবার কাছে দোয়া চাইবো প্রান্তের জন্য।
আমার শেষ কথা:
আক্ষেপ কী বলতে পারেন? নিজের দেহ বিলিয়ে ৮০ টাকা বা ১০০ টাকা পাচ্ছে যে মেয়েটি সে হচ্ছে সমাজ বিতাড়িত নষ্টা, কুলটা, বেশ্যা, বারবনিতা, পতিতা ইত্যাদি ইত্যাদি! কিন্তু তার দেহবিক্রির সিংহভাগ অর্থ যাদের পকেটে যাচ্ছে তারা কিন্তু সমাজপতি, সমাজ সংস্কারক কত কি উপমাধারী! কিন্তু ঐ মেয়েটির পতিতা হওয়ার পিছনের গল্পটা কি কারো জানা আছে? যদি কখনো সুযোগ আসে, যদি সভায় কখনো প্রশ্ন করা হয় একটি মেয়ে পতিতা হওয়ার পেছনের কারণগুলো কি কি? দায়ী কে? সেদিন আমি সবার সামনে জোর গলায় বলবো একটা মেয়ে পতিতা হওয়ার পিছনে সুস্হ জ্ঞানী শিক্ষিত কয়জন পুরুষ দায়ী! যারা অসহায় একটি মেয়ের দূর্বলতার সুযোগ নিয়ে ধর্ষন করে, যারা শিক্ষক হয়ে ছাত্রীকে ধর্ষন করে, যারা সমাজসেবী বলে পরিচিত হয়ে গরীব ঘরের একটি মেয়েকে কাজ দিবে বলে এনে ধর্ষন করে, তারপর তাকে আবার কোন আবাসিক হোটেল দিয়ে আসবার চুক্তি করে, যারা ভালবাসার নামে ভোগ করে একটি মেয়ের শরীর তারা, তারাই পতিতা সৃষ্টির আসল কারিগর! এবার আপনার বিচারের পালা, আপনিই বিচার করে বলুন কারণ কি আর দায়ীই বা কারা? কে বেশি অপরাধী? কারা সমাজে খারাপ কাজ বৃদ্ধি করছে? এই সমাজ থেকে কাকে আগে বিতাড়িত করা দরকার? এই মুখোশধারীরা যত দিন সমাজে থাকবে ততদিন সমাজে ন্যাক্কারজনক কাজের পরিধিটা বাড়তেই থাকবে! আগে তাদেরকে সমাজ থেকে বের করুন যারা একটি অসহায় মেয়েকে পতিতা হতে বাধ্য করে, যারা সরলতার সুযোগ নিয়ে মেয়ের সব কিছু কেড়ে নেয়। একটি মেয়েকে বেশ্যা বা পতিতা বলার আগে সমাজের সেই লোকগুলোকে চিহ্নিত করে দেখিয়ে দিন। মনে রাখবেন আমাদের এই পুরুষশাষিত সমাজে আজো মেয়েরা আসলেই অনেক অনেক বেশী পরিমাণ অসহায়!