অসীম অভাব নিয়েই মানুষের অদ্ভুত জীবনযুদ্ধ এগিয়ে চলে। সম্পদের অভাব, সম্মানের অভাব কিংবা ক্ষমতার অভাব- সব মিলিয়ে মানুষের গল্পগুলো হরেক রকম। যার সবকিছু আছে তার অভাব আরও অনেক কিছুর। যার কিছুই নাই তার অভাব অল্পকিছুর। প্রিয় মানুষের অভাব, বিশ্বস্ত ছায়ার অভাব কিংবা জীবন ভাগাভাগি করা গল্পের অভাবে জীবন যেন অপূর্ণই থেকে যায়। বয়স যত বাড়বে অভাবের আধিক্য তত জটিলতায় টের পাবেন। জীবনে একবার অভাবের যুদ্ধে জড়ালে আর ফেরার উপায় থাকে না। সবচেয়ে বড় দুঃখ- জীবনের এই যুদ্ধ ফেয়ার হয় না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে জীবনের পক্ষে থাকে না।
মানুষ অন্যের সাথে তুলনা করে নিজের দুঃখকে প্রলম্বিত করে। সেধেসেধে দুঃখের সাগরে সাঁতার কাটে। যার দশতলা আছে সে প্রতিবেশীর বিশতলা দেখে লোভাতুর হয়। যার কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র আছে, সে শত কোটি টাকা সঞ্চয় করতে চায়। আর ও দরকার, আরও- মানুষকে নেশায় ধরে। ওদিকে যার ঘর নাই সে কোন রকমের ছনের দোচালায় আশ্রয়ের জন্য ব্যাকুল কাঁদে। দুপুরে খাওয়ার বাদে যাতে রাতের খাবার থাকে সে চেষ্টায় গোটা একটা দিন পরের জমিনে খাটে। ভালো থাকার জীবনযুদ্ধটা এমনই। কেউ লোভে কাতর, কেউ স্বপ্নে বিভোর। যেন একটা অসীম দৌড় প্রতিযোগিতা। যার কোন ফিনিশিং লাইন নাই। জীবনে একবার মাত্র ছুটি আসে। জীবন উপহার পায় স্থায়ী অবসর। তার আগে শুধু ছুটতে থাকা, ছুটতে থাকা। প্রতিদিন, প্রতিমুহূর্ত।
ছুটে চলার সময়ে কত শত অভিজ্ঞতায় জীবন যাবে। দেখা হবে বিচিত্র বৈচিত্র্যে ভরপুর মানুষের সাথে। কেউ অসাধারণ মেধা নিয়ে জন্মেছে আবার কেউ পাগলের মত চেষ্টা করছে কিন্তু সফলতা ধরা দিচ্ছে না। কেউ একটা ভাইভা দিয়েই পছন্দের চাকুরিভাগিয়েনিচ্ছে আবার কেউ ত্রিশতম বার সাক্ষাৎকার দিয়েও অপছন্দের কাজটিও পাচ্ছে না। কারো কারোঅনৈতিক সুযোগ-সুবিধার অন্ত নাই, কেউ কেউজীবনধারণের জন্য অনন্ত সংগ্রামে লিপ্ত। কারো কারো জন্ম অর্থ-প্রাচুর্যে ভরা পরিবারে আবার অনেকেই পরিচয়হীনভাবে রাস্তায় বেড়ে উঠছে। জীবন আসলে বিচিত্র-অদ্ভুত।
কারো কাছে অর্থ-সম্পদ ধরা দিয়েছে, কারো প্রতি বছর প্রমোশন হচ্ছে কিন্তু সুখ ধরা দিচ্ছে না। তীরের বেগে ছুটে চলা জীবনে কোনো বিশ্রাম নাই। যেন গোটা পৃথিবীর মালিক তাকে হতেই হবে। এই যে অসুখ তা মন খারাপ থেকে কোনোদিন মুক্তি দেবে না। অন্যের সাথে তুলনা করে জীবনের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি পরিমাপের খেসারত সারাজীবন দিয়ে যেতে হবে। একটা স্বস্তির জীবন গড়তে হলে অভিযোগহীন সময়ের মধ্য দিয়ে যেতে হবে। অল্পে সন্তুষ্টি না হলে সুখ ঘরে ফেরে না।
আপনি চাইলে সারাদিন অন্যের সাথে নিজের তুলনা করতে পারেন। তার ওটা আছে, আপনার সেটা নাই- এইসব হিসাবনিকাশ করে আফসোস করতে পারবেন কিন্তু ভালো থাকতে পারবেন না। জীবনযুদ্ধে যে এগিয়ে গেলো, তার কথা ভাবলে আফসোস ছাড়া কিছু হবে না। হিসাব মিলাতে পারবেন না। ভাগ্য, মেধা, স্কিল, পরিশ্রম, নিয়তি – এতো এতোভ্যারিয়েবল নিয়ে জীবনের সমীকরণ মেলানো যায় না। মানুষ কেবল চেষ্টা করতে পারে কিন্তু তার পরিণতি কী হবে তা মানুষ জানে না। কত সম্ভাবনাময় জীবন অকালে ঝরে গেছে, কত ক্ষমতাধর জেলে জীবন কাটাচ্ছে। কারো কারো অসীম সম্ভাবনার তরী তলিয়ে গেছে। জীবনের হিসাব আসলে মেলে না।
কারো সাথে তুলনা করে ভালো থাকা যায় না। কেননা ভালো থাকার কোনো শেষ নাই। সীমাবদ্ধতার মধ্যেও ভালো থাকার, নিজেকে ভালো রাখার সূত্র আবিষ্কার করতে জানতে হয়। দুঃখ উপভোগ্য করতে না পারলে সুখ অধরা থাকবে। লোভ সামলাতে হবে, দম্ভ দমাতে হবে। যখন যেমন পরিস্থিতি তখন সেখানে মানিয়ে নিতে হবে। জীবনযুদ্ধফেয়ার না বলেই পারলৌকিক হিসাবনিকাশের বাধ্যবাধকতা আছে। কতক্ষণ ছুটতে হবে, কখন থামতে হবে- লাগাম টানা জানতে হবে। অভাব সীমিত করতে না পারলে সুখ সুদূরে পালাবে। নিজের অবস্থান ও সামর্থ্য বুঝে স্বপ্ন বুনলে তা বাস্তবায়ন করা সহজ হয়। হরেক অভাবের মাঝেও জীবন রঙিন হয়ে উঠুক। সমগ্র জীবনে আমার জীবনটা মাত্র একবারই পাওয়া যাবে। কোন অযুহাতে যাতে জীবনের সিকি শতাংশও অপব্যয় না হয়- সাবধান।
রাজুআহমেদ, প্রাবন্ধিক
raju69alive@gmail.com