×দু’সপ্তাহের মধ্যে বিষয়টি সুরাহা করতে হবে
×উচ্চ আদালতের আদেশ মানেনি বর্তমান সভাপতি
‘হক সাহেব তার এক সহসভাপতিকে বোর্ড থেকে বের করে দিয়েছেন। এমন কী সদস্য পদও খেয়ে ফেলেছেন’
– হাবিব উল্লাহ ডন, এফবিসিসিআই’র সহসভাপতি ও সাবেক সভাপতি, বারভিডা
‘ব্যয়ের হিসাব চাওয়ার অধিকার আছে। এ জন্যে বোর্ড থেকে ও সাধারণ সদস্য পদ বাতিল করা ঠিক হয়নি। বারভিডার সুনাম ক্ষুণ্ন হয়েছে’ – আব্দুল মান্নান চৌধুরী খসরু, সাবেক সভাপতি, বারভিডা
অর্থনৈতিক প্রতিবেদক
আদালতের রায়ে আটকে গেছে বাংলাদেশ রিকন্ডিশন্ড ভেহিক্যালস ইম্পোর্টার্স অ্যান্ড ডিলার্স অ্যাসোসিয়েশন (বারভিডা) নির্বাচন ২০২১-২০২৩। আগামী ৯ ডিসেম্বর, বৃহস্পতিবার এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবার কথা ছিল। গত ৫ ডিসেম্বর রোববার মহামান্য উচ্চ আদালত এ আদেশ দেন। জানা গেছে, আগামী দু সপ্তাহের মধ্যে দুই গাড়ি ব্যবসায়ীকে সদস্যপদ ফিরিয়ে দিয়ে নির্বাচন কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে বলেছেন আদালত। এর আগেও উচ্চ আদালতের নির্দেশনার পরও বহিষ্কৃত দুই গাড়ি ব্যবসায়ীকে সদস্যপদ ফিরিয়ে দেয়নি রিকন্ডিশন্ড গাড়ি ব্যবসায়ীদের সংগঠন বারভিডা। উচ্চ আদালত এই সংক্রান্ত আদেশ দিয়েছেন গত ২৫ অক্টোবর। আদালতের আদেশের কপি বারভিডা নির্বাচনের আপিল বোর্ড লিখিতভাবে গ্রহণ করেছেন ২৬ অক্টোবর। কিন্তু দুই সদস্যকে ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত না করেই ৩১ অক্টোবর চূড়ান্ত ভোটার তালিকা প্রকাশ করেছে বারভিডা। ৩০ অক্টোবর ঠিকই দুই সদস্যের কাছ থেকে বক্তব্য শুনেছেন বারভিডা আপিল বোর্ড। আদালতের আদেশ না মানায় বিস্মিত দুই সদস্য ১ নভেম্বর সোমবার বারভিডা আপিল বোর্ডকে বিষয়টি নিষ্পত্তির জন্য ২৪ ঘণ্টা সময় বেঁধে দিয়ে আইনি নোটিস দিয়েছেন। অন্যথায় আদালত অবমাননার বিষয়টি নজরে আনা হবে বলে সতর্ক করে চিঠি দিয়েছেন। এরপরও সময় ক্ষেপণ করে বারভিডা। বারভিডা নেতা এস এম আনোয়ার সাদাতের মামলার রায় দেন হাইকোর্টের বিচারপতি জে বি এম হাসান এবং বিচারপতি রাজিক আল জলিল।
বারভিডার সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, বর্তমান বারভিডা পষর্দের ঘোড়ামির কারণে এ ঘটনা ঘটেছেন। বিনা কারণে একজন সিনিয়র সহসভাপতির সদস্য পদ কেড়ে নেওয়া বর্তমান সভাপতি ঠিক হয়নি। এতে বারভিডার সুনাম ক্ষুণ্ন হয়েছে। এর প্রভাব পুরো অর্থনীতিতেও পড়বে।
এ বিষয় জানতে চালতে এফবিসিসিআই’র সহসভাপতি ও বারভিডার সাবেক সভাপতি হাবিব উল্লাহ ডন বলেন, ‘নির্বাচন কখন হয় জানা নেই। বারভিডার বর্তমান সভাপতি আবদুল হক সাহেব তার বোর্ড এক সহ সভাপতিকে বের করে দিয়েছেন। এমন কী সদস্য পদও খেয়ে ফেলেছেন, তা মহামান্য আদালত পর্যন্ত গিয়ে ঠেকেছে। নির্বাচন রিশিডিউল না হওয়া পর্যন্ত নির্বাচন হচ্ছে না। তিনি বলেন ৫ ডিসেম্বর নির্বাচন স্থগিত করেছেন মহামান্য আদালত। দু’সপ্তাহের মধ্যে বিষয়টি সুরাহা করতে বলেছেন আদালত।
বারভিডা নেতা এস এম আনোয়ার সাদাতের সদস্য পদ বাতিল করার বিষয় জানতে চাইলে বারভিডার সাবেক সভাপতি আব্দুল মান্নান চৌধুরী খসরু বলেন, ‘বারভিডা সিনিয়র এ নেতাকে বাহিরে রেখে নির্বাচন করতে চেয়েছিল। এস এম আনোয়ার সাদাত সাহেব আদালতের স্বরণাপন্ন হলে আদালত নির্বাচনকে স্থগিতাদেশ দেন।
তিনি বলেন, বর্তমান বারভিডার সহসভাপতি হিসেবে বোর্ডের কাছে প্রধানমন্ত্রীর করোনা তহবিলে দেওয়ার নামে নগদে-বিকাশে টাকা ব্যয়ের হিসাব ও বার্ষিক সাধারণ সভার (এজিএম) হিসাব চাইতে পারে। চাওয়ার অধিকার তার আছে। এ জন্যে বোর্ড থেকে ও সাধারণ সদস্য পদ বাতিল করা ঠিক হয়নি। এটা বারভিডার সুনাম ক্ষুণ্ন হয়েছে।
এ বিষয়ে বারভিডার বর্তমান সভাপতি আবদুল হক বলেন, ‘নির্বাচন হচ্ছে না। কেনো হচ্ছে না জানতে চাইলে তিনি বলেন, মহামান্য আদালতের আমরা আবেদন করেছি। রায় বের হয়নি, তিনি হাতে পাননি।’ বারভিডার সহসভাপতি এস এম আনোয়ার সাদাত বিষয়ে জানতে চাইলে এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করবেন না বললেন তিনি।
বারভিডার সাবেক সহসভাপতি এস এম আনোয়ার সাদাত বলেন, আপিল বোর্ডের নিয়ম আদেশ মেনে তিনি ৩০ অক্টোবর সশরীরে হাজির হয়ে তার বক্তব্য ডুকমেন্টসহ উপস্থাপন করেন। আপিল বোর্ড তখন তার কথা শুনে চূড়ান্ত ভোটার তালিকা দেখার পরামর্শ দেন। ৩১ অক্টোবর চূড়ান্ত ভোটার তালিকায় দেখেন তাদের নাম নেই। তিনি দেখে হতবাক হন। তিনি বলেন, উচ্চ আদালত রায়ে স্পষ্টভাবে বলেছেন তাকে বহিষ্কার করা যৌক্তিক হয়নি; এই কারণে সদস্যপদ ফিরিয়ে দিতে নির্দেশনা দিয়েছেন। তারা আদালতের রায় পর্যন্ত মানল না। এখন তিনি সেই রায় প্রতিপালন করতে ২৪ ঘণ্টা সময় দিয়ে আইনি নোটিস দিয়েছেন। বিষয়টি মহামান্য আদালতের নজরে আনায় মহামান্য আদালত নির্বাচন স্থগিত করেন। এদিকে ৩১ অক্টোবর নির্বাচনী বোর্ড যে চূড়ান্ত ভোটার তালিকা প্রকাশ করেছে সেখানে ৫০৩ নম্বর সদস্য এস এম আনোয়ার সাদাত এবং ২৯১ নম্বর সদস্য দীনুল ইসলামের নাম নেই। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বারভিডা নির্বাচনী আপিল বোর্ড চেয়ারম্যান আবদুর রাজ্জাক বলেন, তারা অভিযুক্তের বক্তব্য শুনেছেন। কিন্তু আদালত যে রায় দিয়েছেন তা বাস্তবায়নের এখতিয়ার তাদের নয়। এটা করবে বারভিডা কমিটি। ফলে বারভিডা যদি সদস্যপদ পুনবর্হাল করে তাহলে তাদের ভোটার করতে কোনো বাধা নেই। এ বিষয়ে আবার এস এম আনোয়ার সাদাতের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, যেহেতু নির্বাচনের শিডিউল ঘোষিত হয়েছে, তখন সব ক্ষমতা হচ্ছে নির্বাচনী বোর্ডের। তাদের সংবিধান তাই বলে।
জানা গেছে, চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দরে ‘বারভিডা লেভি’র নামে চাঁদা আদায় স্থগিত করেছেন উচ্চ আদালত; আদায়কৃত সেই টাকা অবৈধ উল্লেখ করে তা সরকারি কোষাগারে ফেরতের নির্দেশ দিয়েছেন। একইসঙ্গে সংগঠনের আর্থিক অনিয়ম এবং প্রধানমন্ত্রীর করোনা তহবিলের টাকা তছরুপের অভিযাগকারী বারভিডা নেতা এস এম আনোয়ার সাদাতের সদস্যপদ ফিরিয়ে দেওয়ারও নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।
বারভিডার সদস্য দীনুল ইসলামের করা মামলায় রায় দেন বিচারপতি এম. এনায়েতুর রহিম এবং এম. মোস্তাফিজুর রহমান। আদালতের রায় হাতে পাওয়ার পর কে কে অটোমোবাইলসের মালিক এস এম আনোয়ার সাদাত বলেন, দুটি কারণে তার পর ক্ষুদ্ধ হয়ে কমিটির সহসভাপতি এবং সদস্যপদ থেকে বাতিল করে দিয়েছেন বারভিডা নেতৃত্ব। একটি হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রীর করোনা তহবিলে দেওয়ার নামে নগদে-বিকাশে ৮২ লাখ টাকা ব্যয়ের হিসাব তিনি চেয়েছেন। আরেকটি হচ্ছে, বার্ষিক সাধারণ সভার (এজিএম) এর নামে এক কোটি ৭৮ লাখ টাকা তছরুপের হিসাব। তার সদস্যপদ অন্যায়ভাবে যে কেড়ে নেওয়া হয়েছিল আদালতে সেটি প্রমাণ হয়েছে। অথচ তার অভিযোগের এখনও কিনারা করতে পারেনি বারভিডার বর্তমান কমিটি।
এদিকে রিকন্ডিশন্ড বা একবার ব্যবহৃত গাড়ি চট্টগ্রাম ও মোংলা সমুদ্রবন্দর থেকে ছাড় করার আগে এক হাজার টাকা লেভি বা চাঁদা আদায় ২০২০ সালের নভেম্বর থেকেই শুরু করছিল গাড়ি ব্যবসায়ীদের সংগঠন বারভিডা। বাংলাদেশ রিকন্ডিশন ভেহিক্যালস ইম্পোর্টার্স অ্যান্ড ডিলারস অ্যাসোসিয়েশন বা বারভিডার পক্ষে এই লেভি প্রথম আদায় শুরু করে মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষ। এরই মধ্যে ১০০ টাকা নিজেদের জন্য রেখে বাকি ৯০০ টাকা বারভিডা তহবিলে জমা করবে মোংলা বন্দর। কিন্তু বেসরকারি সংগঠনের চাঁদা সরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে আদায়ের আইনগত বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেন বারভিডার সদস্য দীনুল ইসলাম। এ নিয়ে তখন গাড়ি ব্যবসায়ীদের মধ্যে বিরুপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়ায় চট্টগ্রাম বন্দর পিছু হটে এবং চট্টগ্রাম থেকে লেভি আদায় শুরু হয়নি। এই ধরনের অভিযোগ করায় ক্ষুদ্ধ হয়ে বারভিডা নেতৃবৃন্দ তার সদস্যপদ বাতিল করে দেয়।
এরপর দীনুল ইসলামের পক্ষ থেকে আইনি নোটিশসহ বিভিন্ন উদ্যোগে লেভি আদায় বন্ধ করতে না পেরে তিনি সর্বশেষ ২৫ অক্টোবর উচ্চ আদালতে মামলা করেন। আদালত শুনানি শেষে লেভি আদায়কে অবৈধ উল্লেখ করে সেটি বন্ধ করার নির্দেশ দেন। একইসঙ্গে সেই লেভি সরকারি কোষাগারে ফেরতের নির্দেশ দেন।
আদালত রায়ে বলেন, লেভি আদায় করা আদালত অবমাননার শামিল। এরপর যদি আদায় কর হয় তাহলে দণ্ডবিধির ৩৮৫ ধারামতে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। মামলার আইনজীবী আমান উল্লাহ বলেন, আদালত সুষ্পষ্টভাবে লেভির নাম দিয়ে চাঁদা আদায়কে অবৈধ বলেছেন, তার ফেরতের নির্দেশ দিয়েছেন। একই সঙ্গে দীনুল ইসলামের সদস্যপদও ফেরতের নির্দেশ দিয়েছেন।
বারভিডার ২০১৯ সালের ২৬ ডিসেম্বর বার্ষিক সাধারণ সভায় চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর দিয়ে আমদানি করা গাড়িগুলো থেকে এক হাজার টাকা লেভি আদায়ের সিদ্ধান্ত হয়। কারণ হিসেবে বলা হয়, বারভিডার স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন ও প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা উন্নয়নে তহবিল বাড়াতে এ লেভি আদায় করা হচ্ছে। গত ৫ নভেম্বর থেকে মোংলা বন্দরে এই লেভি আদায় কার্যক্রম শুরু হয়।
জানতে চাইলে বারভিডা সভাপতি আবদুল হক বলছেন, ‘সংগঠনের বার্ষিক সাধারণ সভায় সর্বসম্মতিক্রমে ‘বারভিডা লেভি’ আদায়ের সিদ্ধান্ত হয়। এখন উচ্চ আদালতের লিখিত রায়ের কপি তিনি পাইনি। তবে শুনেছেন এক রায় হয়েছে। এখন রায়ের কপি না দেখে মন্তব্য করা যাবে না।’
জানা গেছে, ২০২১-২০২৩ বারভিডার নির্বাচনে মোট ভোটার সংখ্যা ৬৮৯ জন। নির্বাচনে স্বাধীনতা পরিষদ, গণতান্ত্রিক ও সম্মিলিত পরিষদ নামে তিন পরিষদ ২৫টি পদের বিপরীতে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। পরিষদ তিনটির মধ্যে একটি নেতৃত্ব দিচ্ছেন এফবিসিসিআই’র সহসভাপতি ও বারবিডার সাবেক সভাপতি হাবিব উল্লাহ ডন। তিনি সম্মিলিত পরিষদ নেতৃত্ব দিচ্ছেন। গণতান্ত্রিক পরিষদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন বারভিডার বর্তমান সভাপতি আবদুল হক। অন্যদিকে স্বাধীনতা পরিষদের ব্যানারের নেতৃত্ব দিচ্ছেন সিনিয়র সদস্য মোহাম্মাদ হাবিবুর রহমান।
সূত্র জানায়, নির্বাচিত ২৫ জন পরিচালকের মধ্যে থেকে একজন সভাপতি, তিনজন সহসভাপতি, একজন সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করবেন। এছাড়া ২৫ জন থেকে একজন করে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, কোষাধ্যক্ষ, যুগ্ম কোষাধ্যক্ষ, সাংগঠনিক সম্পাদক, প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক, পরিচালনা ও উন্নয়ন সম্পাদক এবং সাংস্কৃতিকবিষয়ক সম্পাদক করা হবে। বাকি ১৩ জন সংঠনের কার্যনির্বাহী পরিষদের সদস্য হিসেবে থাকবেন।
এদিকে গত ১৫ সেপ্টেম্বর বারভিডা কার্যালয়ে নির্বাচন বোর্ড ও নির্বাচন আপীল বোর্ডের এক যৌথ সভায় নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা হয়। এবারের নির্বাচন বোর্ডের চেয়ারম্যান এনায়েত হোসেন চৌধুরী। নির্বাচন বোর্ডের সদস্য এস এম জাহাঙ্গীর হোসেন এবং শামীম আহমেদ। নির্বাচন আপীল বোর্ডের চেয়ারম্যান মো. আব্দুর রাজ্জাক এবং সদস্য ইউছুফ আশরাফ ও মিসেস তাপসী সাহা।