একদিন সকালে বাজারে গিয়ে আমি যে খবরটা পেলাম, তাতে আমার পেটে দানা পড়ার চেয়ে বেশি চমক লাগলো। আলুর দাম এতটা বেড়েছে যে মনে হচ্ছিল বাজারে আমি কি কিনতে গিয়েছি, না সোনালি দিনগুলো আর ফিরে আসবে, সেটা ঠিক বুঝতে পারছিলাম না। এককালে ২০ টাকায় পঞ্চাশটা আলু কিনে বাড়ি ফিরতাম, আজ ২০ টাকায় একটাও কিনতে হচ্ছে! আমি তো অবাক হয়ে গিয়ে ভাবলাম, “এটা কি কিছু বিশেষ মিষ্টি আলু, না আমি কি শেয়ার বাজারের স্টক কিনতে এসেছি?”
একটু দাঁড়িয়ে ভাবলাম, “যাক, আলুর দাম তো বাড়ল, কিন্তু আলুর বিকল্প তো আছে!” আমার মাথায় এক মাস্টারস্ট্রোক এসে গেল—“আলু ছাড়াই ভর্তা!” ভাবলাম, যদি কিছু মজার কিছু বানানো যায়? তখনই খেয়াল করলাম, আলুর জায়গায় আমি কিছু মজার জিনিস ব্যবহার করতে পারি। তো, বাজারের দিকে রওনা দিলাম। এখন তো আর আলু কিনতে তো পারব না, কিন্তু ভাবলাম, কি আর হোক, বিকল্পে যদি কিছু বানানো যায়!
এবার শুরু হলো আমার ভর্তা তৈরির সৃজনশীল প্রক্রিয়া! খালি আলু নিয়ে আর কি হবে, এমন চিন্তা মাথায় আসতেই আমি তো একটা মাস্টার প্ল্যান বানিয়ে ফেললাম। এই ভর্তাতে একদম আলু ছাড়া আর কিছুই থাকবে না, অথচ সেটা হবে বেশ মজারও। আমার প্রথম চিন্তা হলো—ঢেঁড়স। হ্যাঁ, ঢেঁড়সের দাম কম, আর এর গলা আলুর মতো মচমচে হয়ে যায়। তো, ঢেঁড়স হাতে নিয়ে শুরু হয়ে গেল ঢেঁড়সের ভর্তা প্রস্তুতির প্রক্রিয়া। একটু তেল, মশলা, জিরে, আর শুকনা মরিচ দিয়ে, ঢেঁড়সকে মচমচে বানিয়ে ফেললাম। আমার তো মনে হচ্ছিল, যদি আমার এই ঢেঁড়সের ভর্তা আলুর মতো স্বাদ দেয়, তাহলে আলু কিনে আর কি হবে?
এবার ভাবলাম, যদি ঢেঁড়সের ভর্তা খেতে খেতে বাড়ির সবাই একটু অবাক হয়! তো, বাসায় গিয়ে শুরু করলাম গর্বের সাথে আমার “বিশ্ববিখ্যাত আলু ছাড়াই ভর্তা” তৈরির প্রক্রিয়া। প্রথমে মাকে বললাম, “মা, আজকের ভর্তা আলুর নয়, তবে শাকসবজি দিয়েই বেশ সুস্বাদু হবে।” মা তো অবাক হয়ে বললেন, “আলু ছাড়া ভর্তা!” তবে, মা যে কিনা সবসময়ই কিছু এক্সপেরিমেন্ট পছন্দ করেন, তিনি মুখে কিছু বলার আগে ঢেঁড়সের ভর্তা চেখে দেখলেন।
এতটুকু দেখেই আমার বাবা তো চোখ বড় করে বললেন, “এটা কী রকম ভর্তা?”
আমি বললাম, “বাবা, এটা কোনও সাধারণ ভর্তা না, এটা হলো ফিউশন ভর্তা। আধুনিক যুগের ভর্তা, আলুর জায়গায় ঢেঁড়স!” বাবা যেন বুঝতে পারলেন, তাই আর কিছু না বললেন, তবে তাঁর মুখে এমন এক অদ্ভুত হাসি ছিল, যেন বুঝতে পারছিলেন যে আমি একটা অন্যরকম জিনিস তৈরি করেছি।
এবারের টার্গেট ছিল ভাইবোনদের! ওরা তো পুরো আশ্চর্য হয়ে গেল। ছোট বোন বলল, “ভাতের সঙ্গে আলু না থাকলে কি হয়! এখন কি আসলে কিছু ভিন্ন বানাবি?”
আমি বললাম, “দেখো, এতে কিছু বদলাতে হবে। তো, আজকে ঢেঁড়স দিয়ে বানাচ্ছি—তবে আমি তোমাকে বলছি, আলুর জায়গায় ঢেঁড়সও মচমচে হয়ে যাবে!”
এখন কিছুটা গম্ভীর হয়ে গিয়ে ভাই বলল, “তবে তো আলু ছাড়াই ভর্তা ভালো হবে?”
আমি একটু চুপ করে ভর্তা দিয়ে বললাম, “এটাই তো স্বাদ!” ভাই তো মুখের ওপর বললো, “আলু কি কখনো ভুল হতে পারে?” আমি আবার হাসি মুখে বললাম, “ভুল হতে পারে, কিন্তু ঢেঁড়সের ভর্তা মচমচে হয়! আলু যদি দাম না কমে, তাহলে কিন্তু ঢেঁড়সের দাম বাড়ানোর প্ল্যানও আছে!”
একটা বড়পত্রি মুখের হাসিতে ওরা সবাই ভর্তা শেষ করে ফেলল! এরপর, মায়ের মুচকি হাসি দেখে আমি আর ভাবলাম না, বললাম, “আলু ছাড়াই ভর্তা করে দেখাও, দাম বাড়লেও আমরা কখনো হারব না!”
এই মজার আলু ছাড়াই ভর্তা বানানোর একদিন ছিল, কিন্তু তাতে আবার শেখানো হলো, কখনো মনে করোনা, আলু ছাড়া ভর্তা হতে পারে না!
(০২)
আলু আর ডালের বন্ধুত্ব
-বিচিত্র কুমার
একদিন সকালে আলু আর ডাল বসে গল্প করছিল। আলু বলল, “বন্ধু, তোমার কী অবস্থা? দামে তো এখন রীতিমতো আগুন লেগে গেছে!”
ডাল হাসতে হাসতে বলল, “হ্যাঁ, তুমি তো জানো, আমি এখন পুরোপুরি ‘স্বর্ণ’ হয়ে গেছি। একদিন আমার দাম ছিল একটু-একটু, এখন তো মনে হচ্ছে, কোন সোনালী যুগে প্রবেশ করেছি!”
আলু একটু ভুরু কুঁচকে বলল, “আর তো বলো! আগে আমি ছিলাম বাজারের রাজা, এখন মনে হচ্ছে দামে কিছুটা সস্তা হলেও তুমি আমার থেকেও দামি হয়ে গেছ!”
ডাল বলল, “তবে কী জানো? তোমার ব্যাপারটা তো আরও অদ্ভুত! তোমার দাম যখন কম ছিল, তখন সবাই তোমার সঙ্গে ঘুরত। এখন দাম বাড়লে, সবাই যেন তোমাকে দূরে ঠেলে দিয়েছে!”
আলু কপালে হাত রেখে বলল, “তোমার কথাটা ঠিক। আমি যখন সস্তা ছিলাম, তখন আমার সাথে সবার সম্পর্ক ছিল পাকা, কিন্তু এখন দাম বাড়ায়, আমার মূল্য বেড়ে গেছে, আর সম্পর্কও যেন সরে যাচ্ছে! তবে তুমি তো সত্যিই ‘দামি’ হয়ে গেছ, সবাই তোমার সঙ্গে খুশি।”
ডাল মুচকি হেসে বলল, “না না, আমি তো জানি, এখন যদি বাড়ি বাড়ি গিয়ে বলি, ‘ডাল নিয়ে আসি’, তো তাদের মুখের হাসি সোজা গায়েব হয়ে যাবে!”
আলু আরও একটু দুঃখিত হয়ে বলল, “এভাবে দাম বাড়ানোর পর, আমি যে প্রথমে ভালবাসা পেয়েছিলাম, সেটা হারাতে বসেছি!”
ডাল বলল, “অবশ্যই! কিন্তু তুমি যদি পাকা সস্তা আলু হয়ে যেতেই! তখন তোমার দাম এত না বাড়তো! আর সেই কারণে তোমার আর আমার মাঝে এই শাশ্বত বন্ধুত্ব এখন!”
আলু একটু ঘুরে বলল, “আমাদের তো একটাই কথা—বন্ধুত্বের দাম কখনও বাড়ানো উচিত নয়! তা না হলে, বাজারে ভুল সিগনাল চলে আসে!”
ডাল মুচকি হেসে বলল, “কিন্তু তুমি কি জানো, বাজারে আমরা দুজনের বন্ধু হয়ে থেকেও এত দামি হয়ে গেলাম! একসময়, লোকেরা বলত, ‘অলওয়েজ ডাল এবং আলু’। এখন কিন্তু কেউ বলে না!”
আলু ক্ষুব্ধভাবে বলল, “তা ঠিক! তবে আমরা এখন সবসময় সস্তার জন্য বাসায় যাব না, যদি আমার ‘গোপন’ দাম বাড়ানোর উপায় থাকে! আজকাল তো এরকম আছি!”
তবে, তারা দুজনেই একসময় নিজেদের খুশিতে জিজ্ঞেস করল, “বন্ধু, দাম বাড়ানোর দুঃখের কারণ কি, যদি আমাদের মধ্যে বন্ধুত্ব আরও মজবুত হয়ে থাকে?”
একটা হালকা হাসি দিয়ে, তারা বোঝাতে থাকে—“মুখে হাসি রেখে, একে অপরকে সবসময় অমূল্য বলে মনে করা উচিত!”
এভাবেই, আলু আর ডাল তাদের বন্ধুত্বের মূল্য বোঝাতে বসে থাকল, না জানিয়ে কে কখন কার দাম বাড়িয়ে দিয়েছে।
(০৩)
আলুর জন্য রান্নার বিদ্রোহ
-বিচিত্র কুমার
বাজারে আলুর দাম এমন বেড়েছে যে, বাড়ির রান্নাঘরে ‘আলু’ শব্দটা এখন অশুভ মনে হয়। এক সময় যে আলু ছিল আমাদের সবার প্রিয় এবং মজাদার উপকরণ, এখন তার নাম শুনলেই গা গুলিয়ে ওঠে। ভাবুন, একদিন আলু আর তার বন্ধু টমেটো দুইজন মিলে খেতে বসেছে, আর আলু বলছে, “দোস্ত, এই যে দাম বেড়ে গেছে, এখন আমাদের বেলাতেই মরতে হবে!”
“দাম কি বেড়েছে?” টমেটো উল্টো চোখ পাকিয়ে জিজ্ঞেস করল।
“হ্যাঁ, আমার তো মনে হয় এখন আমি স্বর্ণের চেয়েও দামি হয়ে গেছি। এইতো গতকাল বাজারে গেলাম, কাউকে ডেকে বললাম, ‘ভাই, এক কেজি আলু দাও।’ সে তো সরাসরি আমাকে বলল, ‘দাদা, এক কেজি আলু নয়, আপনার কাছে কি কোনও দামি অর্কিড ফুল বিক্রি করতে পারবেন?'”
টমেটো হেসে বলল, “আরে না না, তুই যদি এত দামি হয়ে যাও, তাহলে আমার তো সোনালী দিন আসবে। আমি তো মনে করেছিলাম, এক সময় তুমি কুমড়া হয়ে গেছিলে, এত সস্তা ছিলে!”
আলু ক্ষুব্ধ হয়ে বলল, “সস্তা বলতে কী বলছিস! সেই দিনগুলো গেছে, যখন কাঁঠালের সঙ্গে আমাদের আলাপ ছিল। এখন আমাদের মধ্যে গোপন কথা হয়! কাঁচা আমের মিষ্টি বদলে গেছে আলুর স্লটে। টমেটো ভাই, তুই ভালো করেছিস, তোর দাম বেড়ে গেছে না?”
টমেটো এক ধাক্কায় পাল্টে গিয়ে বলল, “দাম তো বাড়েনি, কিন্তু এখন আমার সৌন্দর্যও বেড়েছে। বাজারে আজকাল আমাকে তুলি না, তাও আমার কাছে অনেক মানুষ ছবি তোলে।”
এদিকে, রান্নাঘরের কন্ট্রোল রুমে বাসির মা দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি চিন্তা করছেন, “আলু আর দামি হয়েছে! তাহলে তো আর আলুর দানা দিয়ে আলুর ভর্তা বানানো যাবে না। এই অবস্থা তো পেঁয়াজের থেকেও খারাপ হয়ে গেছে!” তিনি ভাবছেন, পেঁয়াজ তো কম দামেই পেলেও, আজকাল তার দামও বেড়ে চলেছে!
একদিন, মমতাজ নামক এক নারী বাজারে গিয়ে তীব্র কপালে কুড়ির সাথে ঘুরছিলেন। তিনি আলুর প্যাকেট দেখলেন, তবে থেমে দাঁড়িয়ে বললেন, “দ্যাখো, বাবা, এই আলুর দাম যে এত বেড়ে গেছে, আমার মনে হয় এর মধ্যে সোনার চুরির ছাপ থাকতে হবে!”
বাজারে দাঁড়িয়ে থাকা দোকানদার বললেন, “বৌদি, আলু সোনার নয়, তবে এখন পুরো গ্রামেরই জীবনের সোনালি দিন হয়ে গেছে! আলুর দাম বেড়ে গেছে, আর আমাদের আবার গয়নার দিন চলে এসেছে!”
মমতাজ তো খুশি! “তাহলে, চাঁদ সোনা বিক্রি না করে আলু কিনব!” বলেই হাসতে হাসতে চলে গেলেন।
একই সময়, রান্নাঘরে রেশমী মা রান্নার চিন্তা করে আরেকটা বিদ্রোহ করলেন। আলু ভর্তা তো আর আগের মতো হবে না, তাই তিনি আলুর বদলে কুমড়ার সাথে ভর্তা তৈরি করার সিদ্ধান্ত নিলেন। কিন্তু তার স্বামী, বিখ্যাত কুমড়া ভক্ত সাহেব, সেই ভর্তা দেখে চিৎকার করে উঠলেন, “এটা কি আলুর ভর্তা নাকি কুমড়ার কান্না?!”
এখন তো বাজারের খরচ আলুর জন্য এত বেড়েছে যে, বাড়ির বাচ্চারা বলছে, “মা, আলু কেমন, সেটা জিজ্ঞেস না করলেই ভালো। আমাদের গুঁড়া পাউডার দিয়েই চালিয়ে দাও!”
যাই হোক, আলুর দাম বাড়ানোর পরে কি হয়েছে জানেন? আলু, টমেটো আর কুমড়ার বিরোধে একটাই গতি রয়েছে, সেটা হলো—“দাম বাড়াও, গুছিয়ে নাও, একে অন্যের ওপর হালকা হাসি তো চাপিয়েই দাও!”
এভাবেই আলুর দাম বাড়ানোর বিদ্রোহ, রান্নাঘরের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি আর বাজারের ক্রীড়াদর্শন অব্যাহত রয়েছে। তবে, এই মজার বিদ্রোহের মধ্যে সবার হাসিতে একটাই বিষয় প্রমাণিত হলো—আলু যদি এত দামি হয়, তবে সবার রান্নাঘর থেকে একটাই দরকার: একটা হাসি আর অনেক আলু!
নামঃ বিচিত্র কুমার
ছদ্মনামঃ রুদ্র দাস ও আবদুর রহমান
গ্রামঃ খিহালী পশ্চিম পাড়া
পোস্টঃ আলতাফনগর
থানাঃ দুপচাঁচিয়া
জেলাঃ বগুড়া
দেশঃ বাংলাদেশ